এই অফিসে নীলাদ্রি আগে একবারই এসেছে। তার মায়ের সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে। দেবনাথের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা তখন সবে ঘটেছে। দশদিনও হয়নি। সেদিন দেবনাথের পরিচিতরা প্রায় সকলেই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছিল। কেউ যামিনীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলেছিল, কেউ চুপ করে দূরে দাঁড়িয়েছিল। যারা দেবনাথের অতটা ঘনিষ্ঠ নয়, এক ডিপার্টমেন্টে কাজও করত না, তারা মা আর ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল হাঁ করে। সেই তাকানোয়
যতটা না সহানুভূতি ছিল তার থেকে বেশি ছিল কৌতূহল। হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্ত্রী, সন্তান। কেমন হয় তাই দেখার কৌতূহল। সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি বলে এক ভদ্রলোক সেই সময় এই অফিসের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তার কাছেই এসেছিল যামিনী। খবর পেয়ে তিনি নিজে এসে দরজা খুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। দেবনাথ বলত, তাদের বস নাকি রাগী আর খিটখিটে। যামিনীরা সেরকম কিছু দেখল না। ভদ্রলোক খুবই আন্তরিকভাবে কথা বললেন। অথচ আদিখ্যেতা ধরনের সান্ত্বনাও দিলেন না। সোজা কথার মানুষ।
মিসেস চ্যাটার্জি, আপনাকে যদি বলি, চিন্তা করবেন না, সেটা মিথ্যে বলা হবে। অবশ্যই চিন্তা করবেন। আমরাও চিন্তা করব। যতদিন না ওঁর একটা খোঁজ পাওয়া যায় ততদিন এই চিন্তা থাকবে।
যামিনী বলল, আমি, আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি।
অবশ্যই, বলুন কী করতে পারি। আমরা ঠিক করেছি, পুলিশকে অফিস ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে চিঠি দেব। রিকোয়েস্ট করব যাতে বিষয়টা প্রপার গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুলিশ অনেক সময় কেস ফেলে রাখে। অথচ ওরা ইচ্ছে করলেই পারে। যাক, বলুন আমরা কী করতে পারি। মিস্টার চ্যাটার্জির খোঁজ পাওয়ার ব্যাপারে অফিস সবরকম কো-অপারেট করবে।
গত কটা দিন যামিনী উদভ্রান্তের মতো হয়েছিল। কী খাচ্ছে, কী পরছে খেয়াল ছিল না। দেবনাথের অফিসে আসছে বলে সেদিন খানিকটা পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়েছে। সেভাবে বাপের বাড়ি বলে যামিনীর কিছু নেই। মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। বাবা মারা যায় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার একবছর পর। একমাত্র ভাই বহুদিন ধরে বাইরে। পড়াশোনায় ভালো ছেলে। পড়তেই আমেরিকা যাওয়া। সেখানেই চাকরি, জোহান নামে এক ফুটফুটে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে। তারপর এদেশ-ওদেশ করে এখন কুইবেক শহরে বাড়ি বানিয়েছে। কলকাতায় আসে না। আমেরিকান বউ বাচ্চার সহ্য হয় না। বোনের বিয়ের সময় মাত্র দুদিনের জন্য এসেছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর তা-ও পারেনি। ওখান থেকে বোনকে বলেছিল–অতদিন ধরে বডি রাখার প্রশ্ন ওঠে না দিদি। তুই আর জামাইবাবু সব মিটিয়ে ফেল। আমি আর এখন যাচ্ছি না।
যামিনী অবাক হয়ে বলেছিল, আর কাজকর্ম?
কাজকর্ম মানে!
শ্রাদ্ধশান্তির কী হবে?
ভাই টেলিফোনে একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, তুই করবি। আমি খরচ-টরচ যা লাগে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
যামিনী রেগে গিয়ে বলে, খরচের কথা বলছিস কেন? ছেলে থাকতে আমি বাবার কাজ করব কী করে? আত্মীয়স্বজন কী বলবে?
দিদি, ইটস ইওর প্রবলেম। তোদের সমস্যা। আমি অনেকদিন ধরেই এসব নিয়মকানুনের বাইরে। প্লিজ আমাকে টানিস না। তা-ও মা বেঁচে থাকলে একটা মানে ছিল। অন্যরা কী বলল না বলল কিছু এসে যায় না। হু আর দে? ওরা কে? তুইও মাথা ঘামাস না দিদি। পুজোআচ্চা যে করতেই হবে এমনটাও নয়। না পারলে করবি না। তোদের বিষয়।
তোদের বিষয় বলছিস কেন? এ ব্যাপারে দেবনাথ কে? আমাদের বাড়ির কাজ। তোর একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে।
রেসপন্সিবিলিটি! কীসের? তোর বিয়ের পর আমি বাবাকে বলিনি তুমি আমার সঙ্গে চল? বলিনি? বাবাই রাজি হয়নি। উনি নাকি দেশ ছাড়বেন না। বোগাস! আমি কী করব? আমি তো রেসপন্সিবিলিটি নিতেই চেয়েছিলাম, উনি অ্যালাও করেননি। এখন যদি তোরা ভাবিস কাজকর্ম ফেলে কাছা পরা আর নেড়া হওয়ার রেসপন্সিবিলিটি পালন করতে আমি দেশে ছুটে যাব, তোরা ভুল করবি।
যামিনী দুঃখ পেয়ে বলেছিল, তুই এভাবে বলছিস কেন? সবার কথা ভেবেই তো বলেছি।
ভাই বিরক্ত গলায় বলল, তুই আমার হয়ে ওদের সরি জানিয়ে দিস। বল কত টাকা পাঠাব? হাউ মাচ?
যামিনী বুঝেছিল, দেশের সঙ্গে সম্পর্কের যেটুকু সুতো ঝুলছিল, বাবার মৃত্যুর পর ভাই সেটুকুও ছিঁড়ে দিল। বাপেরবাড়ি বলে তার আর কিছু রইল না। সে বলল, থাক। টাকা লাগবে না।
রাসবিহারীর কাছে এক মাঠে ব্যবস্থা করে কোনওরকমে বাবার কাজ সেরেছিল যামিনী। সবাইকে বলেছিল, ভাই আমেরিকায় করছে। সমস্যা কিছু নেই। পুজোআচ্চা, বিয়ের মতো শ্রাদ্ধশান্তির কাজও আমেরিকায় সুন্দরভাবে করা যায়।
দেবনাথের ঘটনার পরপর দূর সম্পর্কের মাসতুতো বোন সংযুক্তা কটা দিন এখানে এসেছিল। দেবনাথের অফিসে যাওয়ার সময় বলল, একটু সেজেগুজে যা।
যামিনী বলেছিল, কী হবে সেজেগুজে?
আমি বেড়াতে যাওয়ার সাজ বলছি না, কিন্তু তা বলে এরকম আলুথালু হয়ে ঘোরাটাও ঠিক নয়। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, সব শেষ হয়ে গেছে, আর কিছু করার নেই। বাকিরাও সেই সিগন্যাল পেলে দেবনাথদাকে তাদের খোঁজার ইচ্ছেটাই কমে যাবে। স্ত্রী যেখানে ভেঙে পড়েছে সেখানে অন্যরা উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে কেন?
কথাটা বুঝেছিল যামিনী। তাই দেবনাথের অফিসে গিয়েছিল যতটা সম্ভব ফিটফাট হয়েই। আঁচলটা কোলের ওপর নিয়ে যামিনী বলল, স্যার, সেদিন ও অফিসে কাউকে কি কিছু বলেছিল?