যামিনী চমকে উঠে বলল, দেবনাথ! দেবনাথের কী ব্যাপার!
যামিনীদি, হিন্দোল মনে হয়, দেবনাথদার একটা খবর পেয়েছে।
যামিনী হাত বাড়িয়ে বিশাখার একটা হাত চেপে ধরল।
কী খবর! খারাপ কিছু? মরে গেছে?
ছি ছি মারা যাওয়ার কথা কেন বলছ? সেরকম কিছু নয়। যেটুকু জেনেছি সুস্থ শরীরের কথাই জেনেছি। তবে খবরটা সেবারের মতো ভুলও হতে পারে। সেই যে সিআইডি অফিসার। ভুল করেছিল। একটা ভবঘুরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। এটাও হয়তো সেরকম…।
যামিনী বড় করে শ্বাস নিয়ে বিশাখার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। বলল, হোক ভুল, তুই বল। হিন্দোল কী খবর পেয়েছে?
বিশাখা মাথা নামাল।
খবরটা আমরা তোমাকে বলতে চাইনি, হিন্দোল তো একেবারেই নয়। তারপরেও অনেক আলোচনা করে দেখলাম, তোমাকে না জানানোটা অন্যায় হবে। আমরা চাই খবরটা ভুল হোক। ভালো নয় যামিনীদি। খবরটা খুব খারাপ।
যামিনীর শরীরটা কেঁপে উঠল।
০৪. কেমন আছ নীলাদ্রি
০৪.
কেমন আছ নীলাদ্রি?
ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
আছি একরকম। বয়স বাড়ছে, শরীরে নানান গোলমাল শুরু হয়েছে। তোমার মা কেমন আছেন? বোন? তোমার বোনের নামটা যেন কী? খুব সুন্দর একটা নাম…আহা, মনে পড়ছে না…কী যেন…।
কিঙ্কিনি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে, কিঙ্কিনি। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি–তোমার বাবা সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছে।
বাবা নয়, আমার মায়ের দেওয়া নাম।
তাই নাকি! বাঃ। কিঙ্কিনি কেমন আছে? সে কত বড় হল?
এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে।
সে কী! এত বড় হয়ে গেছে। আমি যখন দেখেছিলাম, এইট না নাইনে পড়ছে। কী খাবে নীলাদ্রি?
না না, আমি কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি।
খেয়ে এসেছে তো কী হয়েছে? ট্রেন জার্নিতে সব হজম হয়ে গেছে।
সত্যি খাব না।
আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আগে কাজের কথা বলে নিই, তারপর দুজনে মিলে না হয়। বেরিয়ে গিয়ে কোথাও খাব। নাকি তোমারও তোমার বাবার মতো স্বভাব? সবসময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে? হা হা। তোমার বাবার ব্যাপারটা জানো তো? অফিস টাইমের পর একমিনিটও উনি অপেক্ষা করতেন না। ট্রেন ধরতে ছুটতেন।
অর্ধেন্দু দত্ত আওয়াজ করে হাসলেন। নীলাদ্রির অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি হওয়ার কথা। সে বসে আছে তার বাবার অফিসে। অর্ধেন্দু দত্ত অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তিনি নীলাদ্রিকে একতলায় ইউনিয়নরুমেই বসিয়েছেন। যতই ইউনিয়নরুম তোক বাড়িটা তো এক। অস্বস্তি তো হবেই। দেবনাথ কখনও ছেলেমেয়েদের অফিসে নিয়ে আসেনি। ফ্যামিলি পিকনিক, অ্যানুয়াল ফাংশনে অনেকেই স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে আসত। সেখানেও নীলাদ্রিরা আসেনি। দেবনাথ নিজেই এ ধরনের গেটটুগেদার যতটা পারত এড়িয়ে যেত। তার ভালো লাগত না, আবার দূরত্বটাও একটা কারণ ছিল।
অর্ধেন্দু দত্ত কাল ফোন করেছিলেন। রাতে যামিনীকে কথাটা বলতে যামিনী ছেলের দিকে চমকে তাকাল। দু-বছর পর লোকটার নাম শুনছে। ভুরু কুঁচকে বলল, কখন করেছিল?
দুপুরে। বললেন, কাল সেকেন্ড হাফে যেন একবার বাবার অফিসে যাই।
যামিনী উৎসাহ গোপন করে বলল, কেন? কিছু বলেছে? তোর বাবার টাকা-পয়সার কিছু ব্যবস্থা করেছে?
না, বাবার কিছু নয়, আমার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে চান। এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন জানতে চাইলেন। কী করি বল তো?
যামিনী আবার বিছানা করার কাজে মন দেয়। নিস্পৃহ ভাবে বলল, তুই যা ভালো বুঝবি কর। একটা পাকা কাজ পেলে তো ভালোই।
নীলাদ্রি বলল, তুমি আমার সঙ্গে যাবে মা?
যামিনী মুখ ঘুরিয়ে বলল, না। আমি কেন যাব? তোমাকে ডেকেছে তুমি যাও। যদিও ওই লোক কতটা কী পারবে আমার জানা নেই। তোর বাবারটা তো কিছুই পারল না। আবার কে জানে পারতেও পারে, ইউনিয়নের অনেক ক্ষমতা। একটা পারেনি বলে আর কিছু পারবে না এমন না-ও হতে পারে, তবে পারুক না পারুক তুমি আমাকে জড়াবে না।
নীলাদ্রি আর কথা বাড়ায়নি। তার কৌতূহল বেশি নয়। একটা সময় এই অর্ধেন্দু দত্ত লোকটার সঙ্গে মায়ের খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। মা ওঁর কাছে যেত। উনিও এ-বাড়িতে এসেছেন। ফোন করতেন। তাদের খবর নিতেন। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। মনে আছে কিঙ্কি তাকে জিগ্যেস করেছিল, দাদা, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে মায়ের কী হয়েছে জানিস?
নীলাদ্রি অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে! কী হয়েছে?
কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোণে বেঁকা হেসে বলল, মনে হয় ঝগড়া হয়েছে।
কী বলিস যা-তা, ওরা কি তোর মতো ছেলেমানুষ?
কিঙ্কিনি স্কুল ইউনিফর্ম পরে ছিল। চুলের বেণি পিঠ থেকে সামনে এনে, ফিক করে হেসে বলল, বড়মানুষদেরও ঝগড়া হয়। কাল রাতে অর্ধেন্দুকাকু ফোন করেছিল। মা বলল, আর কখনও এ বাড়িতে ফোন করবেন না। হি হি। আমি আড়াল থেকে শুনেছি। হি হি।
নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, হাসছিস কেন?
ওমা বড়দের ঝগড়া দেখলে হাসি পাবে না! সবাই কি তোর মতো হাঁদা?
কথাটা সরল হলেও কিঙ্কিনি বলেছিল বেঁকা ভাবে। তারপর কাঁধে স্কুলের ব্যাগ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল একছুটে। নীলাদ্রি অবাক বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর ভুলেও গেল। কাল আবার অর্ধেন্দু দত্তর ফোন পেয়ে মনে পড়েছে। সত্যি অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে মায়ের কোনও সমস্যা হয়েছিল নাকি?
হ্যাঁ, সমস্যা হয়েছিল। সমস্যাটা বুঝতে পেরেও যামিনী ঠেকাতে পারছিল না। শুধু বুঝতে পারছিল, ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে। নিজেকে আটকাতে হবে। পারছিল না। চোরাস্রোতের মতো গোপন টানে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎই একদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে। ভয় পায়। মনে হয় কিঙ্কিনি সব বুঝতে পারছে! সব দেখতে পাচ্ছে। কিঙ্কিনি নয়, কিঙ্কিনির চোখ দিয়ে দেখছে দেবনাথ! সেদিন থেকেই নিজেকে বেঁধে ফেলল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি তখনই।