কী হয়েছে বলবি তো? যামিনীর গলায় অধৈর্য ভাব।
সামনের দিকে তাকিয়ে গলা আরও নীচু করল বিশাখা। বলল, এখন নয়, ওই যে রাজলক্ষ্মী আর আরতিদি আসছে। টিফিনের সময় স্কুল থেকে দুজন বেরিয়ে যাব। বীণাপাণিতে বসে কথা বলব।
বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার স্কুল থেকে খানিকটা দূরে। নামে মিষ্টির দোকান হলেও, শিঙাড়া, কচুরিতে বিখ্যাত। টিচাররা টিফিনের সময় লোক দিয়ে কিনে আনায়। ছুটির পর বা হাতে সময় থাকলে নিজেরাই দোকানে চলে যায়। দোকানে গিয়ে জমিয়ে বসে খেয়ে আসে।
বিশাখার কথা জানবার আগ্রহ হলেও যামিনী স্কুলে সুযোগ পেল না। বিশাখার টানা ক্লাস। মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য আরতিদির পাল্লায় পড়তে হল। ফাঁকা স্টাফরুমের টেবিলের উলটো দিক থেকে ঝুঁকে পড়ে মহিলা বললেন, তোমাদের পশুপতিদার লেটেস্ট কীর্তিটা শুনবে নাকি যামিনী?
যামিনী আজকাল স্কুলে যতটা পারে কম কথা বলে। যেটুকু না বললে নয়। কথা বলতে শুধু যে ভালো লাগে না এমন নয়, কথা শুনতেও তার ভালো লাগে না। অন্যের সংসারের গল্পের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। কী করে মেলাবে? তার সংসার যে একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। তাই বিরক্ত লাগে। ক্লাস না থাকলে ব্যাগ থেকে পত্রিকা বের করে ওলটায়। খাতা দেখে। সবসময়েই যেন মেজাজটা রুক্ষ হয়ে থাকে। এই রুক্ষ ভাবটা আরও বাড়ছে। অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। ছাত্রীরা আজকাল ভয় পায়। আরতিদির কথা শুনে বিরক্ত হয় যামিনী।
এখন থাক, ব্যস্ত আছি আরতিদি।
আরে বাবা শোনই না। ওই লোক সেদিন দেখি আমাকে আড়াল করে কী যেন দেখে। আমিও ছাড়বার পাত্রী নই। পা টিপে টিপে পিছনে গিয়ে উঁকি দিলাম। দেখি কোলের ওপর ইংরেজি ম্যাগাজিন। আমাকে দেখে ফট করে পাতা বন্ধ করে দিল।
যামিনী মুখ দিয়ে বিরক্তির আওয়াজ করে বলল, খাতা দেখছি, আপনি এবার থামুন।
রাখ তোমার খাতা। খাতা কি শুধু তুমিই দেখ? আমরা দেখি না? আগে কথাটা তো শুনবে। ঘরে কে ফট করে এসে যাবে তখন আর বলতে পারব না। আমি তারপর থেকে ওই ম্যাগাজিন দেখার জন্যে তক্কেতক্কে ছিলাম। তোমাদের পশুপতিদা বাথরুমে যেতেই টেবিলের তলা থেকে বের করে পাতা ওলটালাম। কী দেখি জানো?
আরতি মুখ ঘুরিয়ে দরজাটা দেখে নিলেন। যামিনী খানিকটা ধমকের সুরে বলল, আপনি থামুন তো। বয়স হচ্ছে তবু একই কথা বলে যান।
আরতিদি ধমক গায়ে না মেখে ফিসফিস করে বললেন, পাতা জোড়া জোড়া মেয়েদের সব ছবি। গায়ে বুকে কিচ্ছু নেই! কোমরে কোনওরকমে একফালি করে নেকড়া জড়ানো, সে ও না থাকার মতো। মাগো!
যামিনী ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। সে কষ্ট করে নিজেকে সামলাল। বাধা দিয়ে লাভ নেই। আরতিদি গজগজ করতে লাগলেন, সব পুরুষমানুষ এক, সুযোগ পেলেই নোলা লকলক করে। কাউকে বিশ্বাস করি না। একটু বউয়ের চোখের আড়াল হয়েছে কি হয়নি অমনি ঘাড়ে আঁপিয়ে পড়ে। মেয়েমানুষ একটা পেলেই হল। কোনও বাছবিচার নেই। এই তো আমাদের মোড়ের পন্টুর স্টেশনারি দোকান, অনেক সময় দোকানে পন্টু থাকে না, ওর বউটা এসে বসে। তোমায় কী বলব যামিনী, ওই মেয়েকে যে কী হতকুচ্ছিত দেখতে, একবারের বেশি দুবার মুখের দিকে তাকানো যায় না। কিন্তু হলে কী হবে তোমার পশুপতিদা একটু ফাঁক পেলেই বলে, যা-ই পন্টুর দোকান থেকে পাঁউরুটিটা নিয়ে আসি, একটু টুথপেস্ট কিনে আনি, যা বাবাঃ সিগারেট তো নেওয়া হল না। খালি ছুতোনাতা। পরশু সন্ধেবেলা মাথায় গেল আগুন ধরে, বললাম, অত বাহানার কী দরকার? যাও না, গিয়ে সরাসরি বল, অ্যাই মেয়ে তোমার বুকের কাপড়টা সরাও তো, আমি সাধ মিটিয়ে তোমার বুকদুটো দেখি। দেখে বাড়ি যাই। তা হলে আর বারবার ছুটে আসতে হবে না। ভালো বলেছি না?
আরতিদি ফাঁকা স্টাফরুমে আরও বকবকানি চালাতেন। দেবলীনা ঢুকতে চুপ করে গেলেন। ভয়ে নয়, এটাই তাঁর রীতি। তিনি তার স্বামীর গল্পগুলো সবসময় একজনকে ধরে বলেন। যখন যাকে একা পান। সন্দেহবাতিক অসুখের এটা একটা লক্ষণ। অসুস্থ মানুষ যখন কোনও অবিশ্বাসের কথা কাউকে বলে তখন এমন ভঙ্গি করে শুধু তাকেই কথাগুলো বলা হচ্ছে। তাদের সব সন্দেহের গল্পগুলোই বানানো বলেই এই ভানটা করতে হয়।
ঘণ্টা বাজতে ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠলেন আরতিদি। টেবিলটা ঘুরে যামিনীর পাশে। এসে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত দিয়ে নীচু গলায় বললেন, সব পুরুষমানুষ বলায় রাগ করেছ নাকি? আমি কিন্তু দেবনাথের কথা বলতে চাইনি। তোমার স্বামী এই দলে পড়ে না। ও একদম আলাদা, আমি জানি।
যামিনী চমকে উঠল। এ আর একরকম আরতিদি! নিমেষে সব রাগ কমে গেল যামিনীর। হেসে বলল, আমি জানি আরতিদি।
বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এককোণায় দুটো বেঞ্চ আর টেবিল। দোকানের ছেলেটা জানে স্কুলের দিদিমণিরা এসে চট করে সেখানে বসবে না। তারা পিটপিটে স্বভাবের। আগে টেবিল বেঞ্চ ভালো করে মুছতে হবে। মোছা থাকলেও সামনে মুছতে হবে। কাপ প্লেট নিয়েও এক কারবার। এটা মোছো, ওটা ধোও করেই যায়। আজ কিন্তু দুই দিদিমণি এসে সে-সব কিছুই করল না। পিছনের বেঞ্চে মুখোমুখি বসে সামান্য কিছু খাবারের অর্ডার দিল।
যামিনী বলল, নে এবার বল। কী প্রবলেম হয়েছে? শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা করেছিস?
বিশাখা সরাসরি যামিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমার কোনও প্রবলমে নয়। দেবনাথদার ব্যাপার।