অফিসার থামলেন। পিওন চা এনেছে। সবাই চা নিল। বিশাখা চা খুব কম খায়। দিনে খুব বেশি হলে দুকাপ। সে-ও নিল। হিন্দোল গোড়ায় একটু উসখুস করছিল। অফিসারের কথা শুনতে শুনতে সেই উসকানি বন্ধ হয়ে গেছে। টেবিলের আড়ালে বিশাখা যামিনীর হাতটা চেপে ধরে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অফিসার আবার বলতে শুরু করেন।
আমি দেখলাম পসিবিলিটি দুটো। যেটার যুক্তি স্ট্রং সেটা হল উনি কোথাও যাননি। অ্যাক্সিডেন্ট ধরনের কিছু ঘটেছে। হয় বড় ধরনের ইনজুরি, নয় ফেটাল। আর দুর্বল পসিবিলিটি হল, সুখ শান্তি, নিশ্চয়তার পরও মানুষটার ঘরবাড়ি, সংসার ভালো লাগেনি। তাই সবাইকে ছেড়ে, সব ছেড়ে চলে গেছেন। তা হলে সেটা হবে একটা দার্শনিক ব্যাপার। এই সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিয়েছি। না দিয়ে উপায় ছিল না, এটা ধরে নিলে পুলিশের আর কোনও কাজ থাকত না। ফাইল বন্ধ করে দিতে হয়; দর্শনের রহস্য ভেদ করা পুলিশের কর্ম নয়। তাই ওটা সরিয়ে ভাবাই ভালো। এরপর থেকে আমি নিজে রেগুলার বিভিন্ন থানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করলাম। হাওড়া শিয়ালদা জিআরপির সঙ্গে কথা বলেছি। এতদিন কাজের কাজ কিছু হয়নি। মনে হচ্ছে, এবার ফল পেয়েছি। মনে হচ্ছে বলছি এই কারণে যে আমি সিওর নই। আপনি সিওর করবেন। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন যাব। জিআরপি লকআপ।
হিন্দোল চমকে উঠে বলল, লকআপ! লকআপে কী হয়েছে?
অফিসার হিন্দোলের দিকে তাকিয়ে বললেন, লকআপে কিছু হয়নি। যেখানে একজনকে রাখা হয়েছে। কাল রাতে আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেনে লোকটাকে জিআরপি ধরে। ভিখিরি, ভবঘুরে টাইপ। গেটের পাশে মেঝেতে বসে আসছিল, রাতে এক প্যাসেঞ্জারের খাবার কেড়ে নিতে যায়। বাধা দিতে গেলে গলা টিপে ধরে। প্যাসেঞ্জাররা সবাই মিলে ধরে তাকে রেল পুলিশের হাতে তুলে দেয়। দেখা যায়, লোকটা পুরোপুরি উন্মাদ। কখনও হাসছে, কখনও তেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কেসে জিআরপি সাধারণত আসামিকে গভীর রাতে কোনও স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ভবঘুরে পাগলকে কে সামলাবে? এই লোক নাকি কিছুতেই নামতে চায়নি। বাধ্য হয়ে তাকে আজ সকালে হাওড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে।
অফিসার চুপ করেন। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র গোছগাছ করতে থাকেন। জলভরা চোখে যামিনী ফিসফিস করে বলল, তারপর কী হল?
অফিসার উঠে পড়লেন। বললেন, চলুন, এবার বেরোই। দুপুরে আমাকে হাওড়া থেকে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়েছে। জানানোর কারণ, আমরা দেবনাথবাবুর যে ফটো পাঠিয়েছিলাম তার সঙ্গে লোকটার মিল আছে। কপালের কাটা দাগটাও রয়েছে। যে ছেলেটা ডিউটিতে ছিল তার কেমন সন্দেহ হয়। সে মিসিং ফাইল বের করে। এটাও একটা আশ্চর্য বিষয়। সন্দেহ করে কেউ পুরোনো ফাইল বের করছে সচরাচর দেখা যায় না। কে আবার আগ বাড়িয়ে খাটতে চায়? হয়তো আমি নিয়মিত লেগে ছিলাম বলেই করেছে। যাক, লোকটা নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারছে না। বলেছে, শুধু বউয়ের নামটা মনে আছে, যামিনী। বছর দেড়েক হয়ে গেল বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিল, এখন আর চিনে ফিরে যেতে পারছে না। বাড়ির কেউ এলে চিনতে পারবে।
যামিনী মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, এক্ষুনি আমাকে নিয়ে চলুন..প্লিজ…।
বিশাখা যামিনীর কাঁধটা চেপে ধরে বলল, শান্ত হও যামিনীদি।
ডুকরে উঠে যামিনী বলল, ভিখিরি হয়ে গেছে!
অফিসার নরম গলায় বললেন, ভিখিরি হোক আর পাগল হোক, মানুষটাকে পাওয়াই আসল। অসুখের চিকিৎসা আছে। তবে ভুলও হতে পারে। ওরকম একটা লোক নিজের নাম বলতে পারছে না, শুধু স্ত্রীর নাম মনে আছে এটা এখনই বিশ্বাস করার কিছু নেই। ঠিক বললেও যামিনী যে একজনেরই নাম হবে এমনটাও ভাবার কারণ নেই। আমি জিআরপিকে বলেছি, আজই কোর্টে তুলবেন না, একটা দিন অপেক্ষা করুন। নিন, চলুন।
ভুলই হয়েছিল। মানুষটা যে তার স্বামী নয় সেটা বুঝতে এক ঝলকের বেশি সময় লাগেনি যামিনীর। রোগা চেহারায় একমুখ দাড়ি গোঁফ। গায়ে লুঙ্গি আর ছেঁড়া ফতুয়া। তীব্র দুর্গন্ধ। যামিনীকে দেখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কীরে খেতে দিবি না? খিদেতে তো মলুম রে হারামজাদি।
ভবানীভবনের অফিসারের দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর ছেলেটি নীচু গলায় বলল, স্যার বিকেল থেকে স্ত্রীর নামও বদলে ফেলেছে। কখনও বলছে জয়া, কখনও বলছে উমা। লেখাপড়া জানা লোক। আমার কীরকম সন্দেহ হচ্ছে।
কীরকম?
মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে কনফিউজ করছে।
অফিসারের ভুরু কুঁচকে গেল। বললেন, আপনি ভালো করে দেখুন।
দেখছি স্যার।
সেদিন ট্রেনে গোটা পথটা কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিল যামিনী। বিশাখা পাশে বসে হাত ধরে রেখেছিল। মুখে কিছু বলেনি। স্পর্শ বলেছিল, আমি তোমার চোখের জলের কারণ বুঝতে পারছি যামিনীদি। তুমি কাঁদো।
.
যামিনীকে দেখতে পেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল ছাত্রীকে ঠেলে এগিয়ে এল বিশাখা। যামিনী দেখল মেয়েটার মুখটা যেন কেমন চিন্তিত হয়ে আছে।
কী হয়েছে?
বিশাখা গলা নামিয়ে বলল, একটা কথা আছে। স্কুলে বলা যাবে না।
যামিনী অবাক হয়ে বলল, কী কথা? স্কুলে বলা যাবে না কেন?
বিশাখা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ভেবেছিলাম ফোনে বলব…হিন্দোল বলল, এসব কথা ফোনে বলা ঠিক নয়।