যামিনী বলল, বিজ্ঞাপনটা একটু বড় করে দেওয়া যায় না। একেবারে সকলের মধ্যে এইটুকু ফটো গেছে।
অফিসার ভুরু কুঁচকে যামিনীর দিকে তাকালেন। বললেন, সরকারের একটা বাজেট আছে। সবাইকে সেই বাজেট মেনে চলতে হয়। যে হারিয়ে যায়নি তাকেও মেনে চলতে হয়, যে হারিয়েছে তাকেও মেনে চলতে হয়। আপনি যদি চান কাগজে কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দিন, রাস্তায় হোর্ডিং লাগান। তবে মনে রাখবেন দিদিমণি, সরকারিভাবে নিরুদ্দেশ বলতে কিন্তু আমাদের দেওয়া ওইটুকু বিজ্ঞাপনই বোঝাবে।
হিন্দোল তাড়াতাড়ি ম্যানেজের চেষ্টা করে। কাচুমাচু গলায় বলল আপনারা সব পারেন। স্যার।
না, সব পারি না। আবার অনেক কিছু পারি। দেবনাথবাবু যদি বাহান্ন বছরের পুরুষ মানুষ না হয়ে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে হত, আমাদের সুবিধে হত। মুম্বই পুলিশকে অ্যালার্ট করতাম। স্টেশনে স্টেশনে জিআরপি নজর রাখত। ঠিক কান ধরে নিয়ে আসতাম। নদশ বছরের মেয়ে হলেও হত। চাইল্ড ট্রাফিকিং-এর সুতোগুলো আমাদের জানা আছে। রেড লাইট এরিয়াগুলোতে সোর্স আছে। একটা না একটা খবর জুটে যেত। দেখবেন বাইরে একজন মহিলা বসে অছে। বসিরহাটের দিক থেকে এসেছে। কলকাতায় মেইড সারভেন্টের কাজ করে। ওর দুটো মেয়ে। কাছাকাছি বয়স। দশ-এগারো। একসঙ্গে দুটোই মিসিং। আমরা নিশ্চিত মিসিং নয়, টাকার লোভ দেখিয়ে কোনও টাউট নিয়ে গেছে; হয়তো চালানও করে দিয়েছে এতক্ষণে।
যামিনী আঁতকে উঠে বলল, সে কী! চালান করে দিয়েছে? কী হবে?
অফিসার হালকা গলায় বললেন, কী আর হবে? মুম্বই দিল্লি বা কলকাতার রেড লাইট এরিয়া রেড করে হয়তো একদিন পেয়ে যাব। কবে পাব জানি না, তবে পাব বলেই বিশ্বাস। টিপ-অফের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটা ধেড়ে লোক হারিয়ে গেলে আমাদের ধরে নিতে হবে নিজেই লুকিয়ে পড়েছে। তাকে খুঁজে বের করা কঠিন। অবশ্যই যদি না কোনও…।
অফিসার চুপ করলেন। যামিনী বলল, কী?
অফিসার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হেসে বলল, বাদ দিন দিদিমণি। যখন যেমন হবে আপনাকে খবর দেব। আপনার নম্বর তো আমার কাছে রইল।
দেবনাথ নিখোঁজ হওয়ার দেড়বছরের মাথায় একদিন দুপুরে যামিনীর মোবাইল বেজে উঠল। যামিনী তখন স্কুলে। স্টাফরুমে বসে হাফইয়ারলি পরীক্ষার খাতা দেখছে। রিং টোনের মিহি আওয়াজে দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করল। নম্বর দেখে চমকে উঠল। ভবানী ভবন থেকে অফিসারের ফোন। এতদিন পর! মানুষটার গলা থমথমে। মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগেছে। নাকি গলা এরকমই? অনেকদিন পর শুনছে বলে ভুলে গেছে!
একবার যে আসতে হবে দিদিমণি।
যামিনী ব্যস্ত হয়ে বলল, কবে?
কবে নয়, আজ। আজই আসতে হবে।
বুকটা ধক করে উঠল। কবজি উলটে ঘড়ি দেখল যামিনী। স্কুল থেকে বেরিয়ে স্টেশন, তারপর ট্রেন ধরে কলকাতা পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তা হোক। সে উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, আসছি, সময় লাগবে। আপনি অফিসে থাকবেন তো?
অফিসার ধমকের সুরে বললেন, কী অদ্ভুত কথা বলছেন! আপনাকে আসতে বলে আমি চলে যাব!
যামিনী তাড়াতাড়ি বলল, না, না আমি সেরকম কিছু বলিনি। কোনও খবর আছে?
অফিসার বোধহয় অল্প চুপ করে থেকে মেজাজ ঠিক করতে চাইলেন। পারলেন না।
খবর না থাকলে আপনাকে এতদূর কি গল্প করার জন্য ডেকে আনছি দিদিমণি? আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।
যামিনী টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। বলল, খারাপ কোনও খবর?
খারাপ ভালো আপনি বুঝবেন। আই অ্যাম ডুয়িং মাই ডিউটি। আর শুনুন, একা আসবেন না। কাউকে সঙ্গে আনবেন। পারলে ওই ছেলেটাকে নিয়ে আসুন। ওই যে আপনার কলিগের হাজব্যান্ড, হি জি আ স্মার্ট বয়। আমি রাখছি। আর হ্যাঁ, চিন্তা করবেন না। লাক ফেভার করলে ঘটনাটা আলটিমেটলি ভালোও হতে পারে।
বিশাখাকে বলতে সঙ্গে-সঙ্গে সে হিন্দোলকে ফোন করল। হিন্দোল লাফিয়ে উঠল। নিশ্চয় সুখবর। সুখবর ছাড়া পুলিশ এত তাড়াহুড়ো করত না।
কোনও চিন্তা নেই, ঠিক সময় ভবানীভবনের সামনে চলে আসছি।
বিশাখা বলল, তোমার অফিস?
উত্তেজিত হিন্দোল বলল, অফিসের গুলি মারো। দেড়বছর পর একজন হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, আর আমি অফিস করব? আমি যে কী এক্সাইটেড ফিল করছি বিশাখা, তোমাকে বোঝাতে পারব না।
বিশাখা যামিনীর হাত চেপে বলল, আমিও যাব যামিনীদি। তুমি না বলবে না। আমি শাশুড়িকে ফোন করে দিচ্ছি।
অফিসার তিনজনকে দেখে একটু ভুরু কোঁচকালেও খুশি হলেন। চা দিতে বললেন। যামিনী বলল, আমরা চা খাব না, আপনি চলুন কোথায় যেতে হবে।
অফিসার হেসে বললেন, খান, সামনের মাসে আমি বদলি হয়ে যাচ্ছি। নর্থ বেঙ্গল চলে যাব। তখন আর চা খাওয়াতে পারব না। অবশ্য পুলিশের চা যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। কথা শেষ করে অফিসার এবার জোরে হাসলেন।
হিন্দোল বলল, এরকম কেন বলছেন? ইউ হ্যাভ ডান আ লট। অনেক করেছেন।
অফিসার যামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস চ্যাটার্জি, আমি আপনাদের কয়েকটা কথা বলতে চাই। গত দেড়বছর ধরে আপনার হাজব্যান্ডকে ট্রেস করবার জন্য কিছু চেষ্টা আমি করেছি। আমাদের যা যা রুটিন পদ্ধতি আছে তার বাইরে গিয়েই করেছি। কেন করেছি জানেন? করেছি কারণ হাজার হাজার মিসিং-এর মধ্যে এই কেসটা সম্পর্কে আমার গোড়াতেই খটকা লেগেছিল। শুধু খটকা বলব না, খানিকটা ইন্টারেস্টিংও। একটা মানুষ নিজের বাড়ি পছন্দ করে, পরিবারের লোকদের পছন্দ করে, তাদের কোম্পানি সবসময় এনজয় করে, তা হলে কেন দুম করে হারিয়ে যাবে? পুলিশের কাজই অবিশ্বাস করা। আমিও আপনাকে অবিশ্বাস করলাম। বুঝলাম আপনি যা বলছেন সব ঠিক নয়। নয়তো কিছু কিছু জিনিস লুকিয়েছেন। আমি লোক লাগিয়ে আপনাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম, আপনার আর দেবনাথবাবুর। সম্পর্কের মধ্যে বড় কোনও গোলমাল পাব। পেলাম না। অন্তত বাইরে থেকে তো নয়ই। এরপর আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে লোক পাঠাই। ধারদেনা আছে কিনা জানতে চাই। অনেক সময় ফাইনানশিয়াল কোরাপশনে জড়িয়ে পড়লে এরকম হতে পারে। কিছুদিন ডুব দিয়ে দেয়। এরকম ঘটনা আমি দেখেছি। কিন্তু তা-ও কিছু পেলাম না। আমার লোকেরা খবর এনেছে, দেবনাথবাবু চাকরি বেশ ভালোই করতেন। টাকা পয়সা, প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্টের ডিমান্ডও বেশি ছিল না, আবার আনসার্টেনিটিও কিছু ছিল না। যাকে বলে নিশ্চিন্ত জীবন। সব মিলিয়ে হি ওয়াজ আ হ্যাপি পারসেন। গুড ফ্যামিলি ম্যান। তা হলে উনি কোথায় গেলেন? কেন গেলেন? আদৌ কি গেছেন?