যামিনী উঠে পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে বাদ দিন। বিষয়টা এত জটিল বুঝতে পারিনি। আমারই বলা ভুল হয়েছে।
হেডমিস্ট্রেস সামান্য হাসলেন। বললেন, যামিনী, তুমি কোনও কারণে উত্তেজিত হয়ে আছো। ঠিক আছে আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলব। সবাই যদি বলে তখন তো একটা কিছু করতেই হবে।
যামিনী হাতজোড় করে বলল, দোহাই আপনাকে, এটা নিয়ে আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলতে যাবেন না। সামান্য একটা গেট খোলা নিয়ে যে এত কথা শুনতে হবে আমি বুঝতে পারিনি। সরি মায়াদি।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে যামিনী, বেরোনোর সময় ঘরের দরজাটা অতিরিক্ত আওয়াজ করে বন্ধ করে। ইচ্ছে করেই করে। মানুষটাকে রাগ দেখানো প্রয়োজন। রাগ দেখানোর প্রতিশোধ নিলেন মায়াদি। পাঁচজনকে বললেন না, কিন্তু দুএকজনকে ডেকে ঘটনাটা বলে দিলেন। তিনি জানেন, টিচারদের মধ্যে কীভাবে দল বানাতে হয়। দল না থাকলে কন্ট্রোল থাকে না। সবাই ঘাড়ে ওঠে। গেটের খবর স্টাফরুমে আসতে সময় লাগল না। স্কুলের স্টাফরুম যে কত ভয়ঙ্কর জায়গা যার অভিজ্ঞতা নেই সে জানে না। যামিনী বলে, মেয়েদের স্কুল এককাঠি ওপরে। যে যার ইচ্ছেমতো ঘটনায় রং লাগাতে পারে। রং কতটা হবে তা নির্ভর করছে হিংসে আর কেচ্ছার ওপর। দুদিনের কানাঘুষোয় যামিনী শুনতে পেল, সে নাকি গোপনে স্কুলে যাতায়াত করতে চাইছে। সবার চোখের আড়ালে। এমনকী বসার জন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে আলাদা ঘর পর্যন্ত চেয়ে চিঠি লিখেছে। কথাটা কানে যেতে যামিনী একবার ভেবেছিল, হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গিয়ে চেঁচামেচি করে আসবে। তারপর বুঝল, এতে লাভ হবে একটাই, কেউ কেউ আলোচনার জন্য মুখরোচক বিষয় পাবে। তার থেকে পাত্তা না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দেবনাথ চলে যাওয়ার পর থেকে কতজনই তো নানান ভাবে অপমান করছে। কলিগরাই বা বাদ যাবে কেন?
তবে সবাই যে এরকম তা নয়। কেউ কেউ অন্যরকমও আছে। সবথেকে অন্যরকম বিশাখা। দেবনাথের ঘটনাটার পর সে ভীষণভাবে যামিনীদির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে-কোনও আত্মীয়ের থেকে অনেক বেশি। শুধু বিশাখা নয়, সঙ্গে আছে তার স্বামীও। যে হিন্দোল চাকরির জন্য বাড়িতে আসার সময় পেত না, সে অফিস কামাই করে যামিনীর সঙ্গে ছোটাছুটি করেছে। কতদিন। প্রথম কটা দিনের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন দু-বেলা হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হত, নাম না জানা, ঠিকানা না জানা কেউ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভরতি হয়েছে? হিন্দোল ওয়ার্ড পর্যন্ত ঢুকে যেত। তখন নীলাদ্রির পরীক্ষা। তাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়ার কেস দেখে সি আই ডি। তাদের দপ্তর কলকাতার ভবানীভবনে। দুদিন অন্তর সেখানেও ছুটতে হত। কোনওদিন সঙ্গে হিন্দোলও যেত। যে পুলিশ অফিসার তখন দেবনাথের ফাইলটা দেখতেন, তার কথাবার্তা কর্কশ, কিন্তু মানুষটা ভালো। শিক্ষিকা বলে যামিনীকে সম্মান দেখাতেন। কথা বলতেন দিদিমণি বলে। ভদ্রলোকের মা-ও নাকি স্কুলে পড়াতেন। সেই কারণেই বাড়তি খাতির। তবে গলায় সবসময় একটা ধমক ধমক ভাব। নিশ্চয় পুলিশে চাকরি করতে করতে গলাটা এরকম হয়ে গেছে।
আপনি রোজ রোজ আসছেন কেন দিদিমণি? পথ তো কম নয়।
যামিনী চুপ করে থাকে। কী বলবে? তার আসা ছাড়া উপায় কী? হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ আর কোথায় করবে? যদি পথে পথে ঘুরে করা যেত, তা হলে তাই করত। পুলিশ একমাত্র ভরসা। তখন সবে ছমাস পেরিয়েছে। সবসময় আশা মানুষটা ফিরে আসবে। একটু দৌড়াদৌড়ি করলেই হবে। চারপাশে সবাই কত কথা বলছে। কেউ বাড়ি এসে বলছে, কেউ টেলিফোন করছে। দূর সম্পর্কের এক ননদ বলল, অনেক সময় মানুষের স্মৃতি কিছুদিনের জন্য লোপ পায়। নিজের নাম-ঠিকানা সব ভুলে যায়। সেই স্মৃতি আবার ফিরে আসে নিজে থেকেই, তুমি চিন্তা কোরো না যামিনী। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এক কাকার হয়েছিল। সাতদিন বাইরে ছিল।
যামিনী চোখের জল মুছে বলল, এর তো ছমাস হয়ে গেল।
ননদ ঢোঁক গিলে বলেছিল, আহা, সবার তো একরকম হবে না। কেউ অল্পদিন, কেউ বেশি। ফিরে এলেই তো হল।
সেই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। এমনকী ছোট ছেলেমেয়েদুটোও নয়। তবু তখন কলিংবেল বাজলে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। তারা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। বিশেষ করে সন্ধের পর। দেবনাথ যখন অফিস থেকে ফিরত। বুকটা হাহাকার করে উঠত। কিঙ্কিনি কতদিন পড়তে পড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছে। যামিনী নীচু গলায় বলেছে, কাদিস না। কাঁদবি কেন? তোর বাবা তো মারা যায়নি!
কে বলল তোমায় মারা যায়নি? মারা না গেলে কেন ফিরছে না?
যামিনীর চোখ ছাপিয়ে জল পড়ত। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় বলত, কেন সে তো মানুষটা ফিরে এসে বলবে। দেখবি ঠিক বলবে। রাতে খেতে বসে কত গল্প করবে।
কিঙ্কিনি ডুকরে উঠে বলে, আমি কিছু শুনব না, কিচ্ছু না। আমার বাবাকে চাই।
ভবানীভবনে অফিসারের ঘরের বাইরে বসে স্লিপ পাঠাত যামিনী। সময় হওয়ার আগেই ডাক পড়ত। অফিসার বলতেন, দিদিমণি, আপনাকে কতদিন টানতে হবে আপনি কি তা জানেন? জানেন না। এখনই দম ফুরিয়ে ফেললে চলবে কেন?
যামিনী বলত, আপনি একটু চেষ্টা করুন।
অফিসার বলত, এই তো ফাউল করে ফেললেন দিদিমণি। একটু চেষ্টা করুন কথাটার মানে কী? আমরা কি চেষ্টা করছি না? যথেষ্ট চেষ্টা করছি। আমাদের রাজ্যে গড়ে রোজ কতজন করে মিসিং হয় আপনি জানেন? হারিয়ে যাওয়ার মানুষ খোঁজার কতকগুলো পদ্ধতি আছে। আমরা তার বাইরে যেতে পারি না। সব থানায় মেসেজ গেছে। আপনার হাজব্যান্ডের ফটো গেছে। আমরা হাসপাতাল নার্সিংহোমগুলোতে খবর পাঠিয়েছি। ছোট বড় যতগুলোতে পারা যায়। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এর বেশি কী করব?