নীলাদ্রি আড়মোড়া ভেঙে বলল, ভয়ঙ্কর না সুন্দর আমার জানার দরকার নেই, যেখানেই যাবে সাবধানে থাকবে। সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরবে আর ফোন করলে ধরবে।
কিঙ্কিনি হাত জোড় করে বলল, প্লিজ দাদা, তুই অন্তত আর গার্জেনগিরি করিস না। গার্জেনগিরি অনেক হয়েছে। কপালে স্টিচ, পিঠে জুতোর দাগ নিয়ে আই অ্যাম টায়ার্ড। আমাদের পিকনিকের আজ নিয়ম কেউ মোবাইল অন করতে পারবে না। যে করবে তার ফাইন হবে। অতএব নো কল।
কিঙ্কিনি ঘর থেকে বেরোতে গেল। নীলাদ্রি ডাকল, অ্যাই কিঙ্কি শোন একবার। কিঙ্কিনি ঘুরে দাঁড়াল।
ইস পিছনে ডাকলি তো, কী হল?
নীলাদ্রি ফিসফিস করে বলল, মা, কাঁদছে না?
কিঙ্কিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, কাঁদছে! কই না তো, দেখলাম টেবিলে বসে আরাম করে চা খাচ্ছে। মনে হয় সেকেন্ড কাপ। তোর আবার বেশি বেশি।
কিঙ্কিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরও নীলাদ্রি বেশ খানিকটা সময় চুপ করে শুয়ে রইল। মা কাঁদছে না! তা হলে কোন কান্নার আওয়াজে আজ তার ঘুম ভাঙল? স্বপ্নে কিছু শুনছে? অথবা কে জানে হয়তো অভ্যেস হয়ে গেছে। কেউ না কাঁদলেও মনে হয়, এ বাড়ির সকাল হয় কান্না দিয়ে। মনটা খারাপ হয়ে গেল নীলাদ্রির।
০৩. স্কুলগেটের একপাশে বিশাখা
০৩.
যামিনী দূর থেকেই দেখতে পেল স্কুলগেটের একপাশে বিশাখা দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
এই সময়টা স্কুলে সবথেকে হই-হট্টগোলের সময়। গেটের কাছে ঠাসাঠাসি অবস্থা। মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে ঢুকছে। ছোট ছোট দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মায়েরা। চোখেমুখে গভীর উদবেগ। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অকারণ উদবেগ। কেউ কেউ টিচার দেখলে পড়িমড়ি করে ছুটে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে জানে না। কিছু বলার নেই। তবু যাচ্ছে, হাবিজাবি প্রশ্ন করছে। যেন টিচারের সঙ্গে কথা বলতে পারলেই মেয়ের জীবন এগিয়ে যাবে তরতর করে! রোজকার ঘটনা।
ভিড় দেখে প্রতিদিনকার মতো আজও যামিনীর গা জ্বলে গেল। উফ, আবার ওখান দিয়ে ঢুকতে হবে। তাকে যে সবাইকে ঠেলে ঢুকতে হবে এমন নয়। টিচারদের দেখলে সকলেই পথ ছেড়ে দেয়। তাকেও দেবে। যামিনীর রাগ হওয়ার কারণ অন্য। সে এলেই ছাত্রীর মায়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করে দেয়, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যতক্ষণ না বাগান পেরিয়ে, সিঁড়ি টপকে স্কুল বিল্ডিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ততক্ষণ এই দেখা চলতে থাকে। এতদিনে সকলেই ঘটনাটা জেনে গেছে। এমনকী যেসব মেয়েরা স্কুলে নতুন অ্যাডমিশন নেয় তাদের মায়েরাও কীভাবে যেন খবরটা সবার আগে পেয়ে যায়।
যামিনী মিসের বর নিখোঁজ।
বেশিরভাগেরই বিশ্বাস পালিয়ে গেছে। অন্তত সেরকম ভাবতে ভালোবাসে। পালিয়ে গেছের মধ্যে একটা রসালো ব্যাপার আছে। তাই যামিনীকে দেখার সময় দৃষ্টিতে একইসঙ্গে থাকে করুণা আর আঁশটে ভাব। প্রথম প্রথম লজ্জা, অপমানে মরে যেত যামিনী। ইচ্ছে করত মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। ধীরে ধীরে সেটা রাগে পরিণত হল। পরে অভ্যেস করে নিল। তবে সবদিন অভ্যেস কাজে দেয় না। কোনও কোনওদিন ভিড় থেকে ফিসফিস শুনতে পায়–ওই যে আসছে দেখ। মাথায় আগুন জ্বলে যায় তখন। স্কুলের পিছনে একটা ছোট গেট আছে। যামিনী হেডমিস্ট্রেসকে গেটটা খুলে দেওয়ার জন্য বলেছিল।
মায়াদি, ওই গেটটা, আপনি খুলে দিন। শুধু টিচাররা ইউজ করবে।
কেন মেইন গেটে সমস্যা কী হয়েছে?
হেডমিস্ট্রেসের টেবিলের ওপর খানিকটা গলা মোম জমে আছে। খাম-টাম সিল করতে গলা মোম লাগে। যামিনী মাথা নামিয়ে নখ দিয়ে সেই মোম খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, না, সেরকম কিছু নয়। আসলে স্কুলে ঢোকার সময় খুব ভিড় হয়। স্টুডেন্ট, গার্জেন সবাই দাঁড়িয়ে থাকে।
মায়াদি অবাক হয়ে বললেন, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না যামিনী। এতদিন তো ওখান দিয়েই সবাই আসা যাওয়া করেছে। আমি করেছি, তুমি করেছে। হঠাৎ কী এমন ঘটল, যার জন্য আমাকে পিছনের গেটটা খুলে দিতে হবে!
যামিনী মুখ তুলল। বেশিরভাগ স্কুলের হেডমিস্ট্রেসরাই এরকম হয়। টিচারদের অসুবিধের কথা কিছু শুনতে চায় না। অথচ নিজেরা সাধারণ টিচার থাকার সময় অসুবিধে নিয়ে বিপ্লব দেখাত। দ্বিচারিতার চরম। নিজেরা চেয়ারে বসলে পুরোনো কথা সব ভুলে যায়। এই মহিলা মনে হয় সবার থেকে বেশি। মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। কোনও সমস্যা শুনলে এমন অবাক হয়ে পড়ে যেন আগে কখনও শোনেনি।
যামিনী বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হয়নি। গেটের ওপর থেকে ভিড়ের চাপটা একটু কমে আর কী।
হেডমিস্ট্রেসের বিস্ময় আরও বাড়ল। তিনি চোখ বড় করে বললেন, ভিড়ের চাপ! দশ পনেরো মিনিটের তো মামলা। তুমি এমনভাবে বলছ যামিনী যেন এটা স্কুল নয়, ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম বা শপিং মল। কাতারে কাতারে লোক ঢুকছে।
যামিনী বুঝল, এই মহিলাকে বোঝানো যাবে না। ইনি বুঝতে চান না। সে গলায় কঠিন ভাব এনে বলল, খুললে অসুবিধে তো কিছু নেই। গেটটা তো রয়েছেই, নতুন করে বানাতে হবে না। খরচ কিছু হচ্ছে না। আপনি এত চিন্তা করছেন কেন?
মায়াদি চেয়ারে হেলান দিলেন। একটু হাসলেন। বললেন, প্রশ্নটা সুবিধে অসুবিধের নয় যামিনী, প্রশ্নটা কারণ। একটা কাজ করতে গেলে তার পিছনে কারণ লাগে। এটা মেয়েদের স্কুল। তাদের ঢোকা বেরোনোর ওপর সবসময় নজর রাখতে হয়। দুম করে আরও একটা গেট খুলে দিলেই হল না। সেখানেও একজন দারোয়ান রাখতে হবে। তার মানে নতুন পোস্ট, নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট। গভর্নিংবডির ডিসিশন লাগবে।