প্রথম পরিচ্ছেদ
কারাকক্ষে
মজিদ খাঁ এখনও হাজতে| কয়েক দিবস একস্থানে আবদ্ধ থাকায় তাঁহার মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গিয়াছে| বিশেষতঃ আজ-কাল তিনি আরও বিমর্ষ| উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে দেখিতে আসিতেন| মজিদ খাঁ তাঁহার নিকটে এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমুদয় সংবাদ শুনিতে পাইতেন| শুনিয়া বুঝিতে পারিতেন, রহস্যের ক্রমশঃ উদ্ভেদ হইয়া অসিতেছে-শীঘ্রই তিনি মুক্তি পাইবেন| সৃজান সংক্রান্ত যে কথা তিনি গোপন করিবার জন্য প্রাণপণ করিতেছিলেন, এখন আত্মরক্ষার্থ আর তাহা প্রকাশ না করিলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না|
এই কয়েকদিন মজিদ খাঁ একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছেন| প্রাণসমা জোহেরাকে তিনি কতদিন দেখেন নাই, কতদিন তাহার মধুর কণ্ঠে সুমধুর প্রেমসম্ভাষণ শুনিতে পান্ নাই| একমাত্র জোহেরার চিন্তা অনুক্ষণ তাঁহার হৃদয়ে জাগরূক| নির্জ্জনে চিন্তা যেরূপ গভীর হইয়া উঠে, মজিদ খাঁর ঠিক তাহাই হইয়াছিল| অনেক সময়ে তিনি মনকে অন্যদিকে ফিরাইবার চেষ্টা করিতেন-পারিতেন না| কখনও মনে হইত, এই আমি যেমন একমনে কেবল জোহেরার ভাবনা ভাবিতেছি, জোহেরার কি আমার জন্য এমন কাতর হইয়াছে? কখনও ভাবিতেছেন, অন্যের ন্যায় জোহেরাও হয়ত আমাকেই হত্যাপরাধী বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছে| আমার অপরাধের পরিমাণ আমি নিজে জানি; কিন্তু আমি তাহাকে কি করিয়া বুঝাইব, আমি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ? হায়, এই সূত্রে সে যদি আমাকে ঘৃণার চোখে দেখিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে ত সেখানেই আমার সকল আশা-ভরসা ঘুচিয়া যায়! কি করি, কিরূপে আমি সকল দিক্ বজায় রাখিয়া এত বিপদ-বিঘ্ন ঠেলিয়া মাথা তুলিতে পারিব? তাহার ত আর কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না| মজিদ খাঁ সেই নির্জ্জন কারা-কূপে পড়িয়া, আত্মহারা হইয়া ব্যাকুল হৃদয়ে অবিরত জোহেরার কথাই ভাবিতেছেন| ক্ষুব্ধ সিন্ধুবক্ষে যেমন তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠে, মজিদ খাঁর হৃদয়-সমুদ্র মথিত করিয়া তেমনই তরঙ্গ ছুটিতেছে-একটির পর একটি-তাহার পর আর একটি-ক্রমান্বয়ে-এক মুহুর্ত্তের জন্য বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-অবসর নাই| মোহ্যমান মজিদ খাঁ করতললগ্নশীর্ষ হইয়া নতমুখে নিজের ভবিষৎ চিন্তা করিতেছেন-বর্ত্তমানের ন্যায় ভবিষৎও তাঁহার অন্ধকারময় বোধ হইতেছে, কেবল অন্ধকার- নিরবছিন্ন দুর্ভেদ্য ঘোর অন্ধকার- সেই নিবিড় অন্ধকার ততোধিক অন্ধকারময়ী নিরাশার বিকটমূর্ত্তি ভিন্ন মজিদ খাঁ আর কিছুই দেখিতেছে না-সেখানে কোথায় আশার একটু ক্ষীণালোকরেখাও পড়ে নাই|
মজিদ খাঁ যখন আপন দুশ্চিন্তায় একেবারে বাহ্যজ্ঞান-রহিত তখন সহসা কাহার পদশব্দে তাঁহার চমক হইল| চকিতে চাহিয়া দেখেন, অন্ধকার সরিয়া গিয়াছে নয়নাগ্র হইতে সেই নিরাশার বিকটমূর্ত্তি অন্তর্হিত-চারিদিক্ দিবালোকপ্রদ্যোতিত-এবং আশার মোহিনীমূর্ত্তির ন্যায় কারাগৃহতলে অনতিদূরে দাঁড়াইয়া-তাঁহারই সেই হৃদয়ানন্দবিধায়িনী, অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী জোহেরা যেন ভাস্কর-রচিত সকরুণ পাষাণ-প্রতিমা স্থিরনেত্রে তাঁহারই দিকে নীরবে দৃষ্টিপাত করিতেছে|
প্রথমে মজিদ খাঁ নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না| মনে হইল, দিনরাত যাহাকে মনে ভাবা যায়, কখন কখন স্বপ্নঘোরে তাহার মূর্ত্তি প্রকটিত হয়-ইহাও কি স্বপ্ন? তাঁহার মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না; তিনি দুঃসহ বিস্ময়ে অবাক মুখে জোহেরার মুখের দিকে স্থিরনেত্রে চাহিয়া রহিলেন|
ত্খন বীণাবিনিন্দিত সুমধুর কণ্ঠে সুন্দরী জোহেরা হকিল, “একি! তুমি কি আমাকে চিনিতে পারিতেছ না? এমন করিয়া অপরিচিতের ন্যায় আমার দিকে চাহিয়া আছ কেন? আমি জোহেরা-আমি তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি|”
সেই অমৃতবর্ষী স্নেহকণ্ঠ একান্ত পরিচিত-একান্ত মধুর-একান্ত করুণাময়, একবার শুনিলে আর তাহা সহজে ভুলিতে পারা যায় না| তখন সহজে মজিদ খাঁ তাহাকে চিনিতে পারিলেন| তাড়াতাড়ি উঠিয়া, দুই হাতে জোহেরার হাত দুখানি ধরিয়া নতমুখে দাঁড়াইলেন| ক্ষণপরে কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, তুমি এখানে! তুমি কেন এ কলঙ্কিত স্থানে আসিলে? এখানে কত তস্কর, কত দস্যু, কত পরস্বাপহারী, নরনারীহন্তা পদচিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছে-তুমি কেন জোহেরা, না বুঝিয়া তাহার মধ্যে তোমার পদচিহ্ণ মিশাইতে আসিয়াছ? সহস্র নরপিশাচের পাপ-নিশ্বাসে এখানকার বায়ুও দুষিত, তাহা কি তুমি জান না? এখানে দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম নাই-এখানকার লোকেরা এক স্বতন্ত্র জীব-এমন অপবিত্র স্থানে তোমাকে দেখিয়া আমি আজ বড় বিস্মিত হইলাম!”
জোহেরা মৃদুকণ্ঠে কহিল, “ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই, মজিদ; তুমি যেখানে আছ, সে স্থান জাহান্নাম্ হইলেও আমার নিকটে পরম পবিত্র|”
মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, ” তুমি কিরূপে এখানে আসিবার অনুমতি পাইলে?”
জোহেরা কহিল, “উকীল বাবু আমার সঙ্গে আসিয়াছেন; তাঁহারই সাহায্যে আমি এখানে আসিতে পারিয়াছি| তিনি এখনই এখানে আসিবেন| উকীল বাবু আমাদিগের মঙ্গলের জন্য অনেক চেষ্টা করিতেছেন|”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “হাঁ, তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য| সত্যই তিনি আমাদিগকে আন্তরিক স্নেহ করেন; কিন্তু আমি এ জীবনে তাঁহার নিকটে অকৃতজ্ঞই রহিয়া গেলাম| আমি দেখিতেছি, আমার ভবিষৎ বড় ভয়ানক| এই ত অবস্থা-বিপাকে কি একটা ভয়ানক দুর্নাম কিনিলাম!”
জোহেরা কহিল, “ভবিষ্যতের তমোময় গর্ভে কি নিহিত আছে, কে জানে? যে সকল বিঘ্ন-বাধা এখন দুরতিক্রম্য বলিয়া বোধ হইতেছে, দুইদিন পরে তাহা সমুদয় দূর হইয়া যাইতে পারে| মানুষের হৃদয়ে বল থাকে কেন? বিপদ্ যেমন গুরুতর ভাবে চাপিয়া পড়ুক না কেন, ততই তাহার সহিত অন্তিমবলে যুঝিতে হইবে|”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে কহিলেন, “জোহেরা, আমি যে ভয়ানক অপরাধে এখানে বন্দী রহিয়াছি, তাহা তুমি অবশ্যই শুনিয়াছ; কিন্তু জোহেরা, তুমি কি তাহা বিশ্বাস কর?”
জোহেরা কহিল, “একটী বর্ণও না| আমি কেন-কেহই ইহা বিশ্বাস করেন নাই| ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, মুন্সী সাহেব, মোবারক সকলেরই মনে ধারণা-তুমি নিরপরাধ|”
অত্যন্ত বিস্মিতভাবে মজিদ খাঁ বলিলেন, “মিবারক! মোবারকেরও ধারণা আমি নিরপরাধ? খুনের রাত্রিতে মোবারকই ত আমাকে মেহেদী-বাগানে একটা গলির মোড়ে দেখিতে পাইয়াছিল; ইহাতে বরং খুনী বলিয়া আমার উপরেই তাহার সন্দেহই হইতে পারে|”
জোহেরা বলিল, “না তোমার উপরে তাঁহার সন্দেহ হয় নাই|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক আমার একজন প্রকৃত বন্ধু বটে| আমি তাহাকে অনেক দিন হইতে ভাল রকমে জানি|”
জোহেরা কহিল, “তুমি যতখানি প্রকৃত মনে করিতেছ, মোবারক ঠিক ততখানি নহেন-তিনি আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছেন|”
ম|(সাশ্চর্য্যে) কি আশ্চর্য্য-অসম্ভব!
জো| অসম্ভব নয়-পরশু সকালে এইজন্য তিনি আমার সঙ্গে দেখাও করিয়াছিলেন|
ম| তোমার সঙ্গে ! তুমি তাহাকে কি বলিলে?
জোহেরার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল| জোহেরা বলিল, “ইহা আবার তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছ? তোমার সহিত যে আমার বিবাহ-সম্বন্ধ এক-প্রকার ঠিক হইয়া গিয়াছে, সে কথা আমি তাঁহাকে বলিলাম| তাহাতে মোবারক বলিলেন যে, তিনি এইরূপ শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু কথাটা যে কতদূর সত্য, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই|”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “তাহার পর তোমাকে সে আর কি বলিল?”
জোহেরা| তাহার পর তিনি তোমার এই বিপদের কথা তুলিয়া বলিলেন, আমি যদি তাঁহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হই, তাহা হইলে তিনি তোমাকে নির্দ্দোষ সাব্যস্ত করিয়া এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে পারেন|
মজিদ| অসম্ভব-মোবারক কিরূপে আমাকে উদ্ধার করিবে?
জোহেরা| তাহা আমি জানি না| তাঁহার কথায় আমার বড় রাগ হইল, তাঁহার সাহায্য ব্যতিরেকেও আমরা যে তোমাকে নিরপরাধ সপ্রমাণ করিতে পারিব, তোমার সেই প্রকৃত বন্ধুটিকে তখন আমি তাহা বলিলাম| বলিয়াই আমি সেখান হইতে চলিয়া গেলাম| ইহার পর তাঁহার সহিত আমার আর দেখা হয় নই|
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক যে আমাকে এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, ইহা ত বন্ধুর কর্ত্তব্য কর্ম্ম; কিন্তু সেই সাহায্যের বিনিময়ে তোমার নিকট হইতে সে যে প্রস্তাব করিয়াছে, তাহ খুবই গর্হিত| বিশেষতঃ আমার সহিত তোমার বিবাহ-সম্বন্ধের কথা সে যে না শুনিয়াছে, এমনও নহে|”
জোহেরা বলিল, ” শুনিয়াছেন সত্য, কিন্তু কথটা কতদূর সত্য, তাহা তিনি জানিতেন না; তাহা হইলে তিনি বোধ হয়, এ কথা তুলিতে সাহস করিতেন না| সকলেরই ধারণা ছিল, মনিরুদ্দীনের সহিত আমার বিবাহ হইবে|”
৫.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-দুর্ভেদ্য
এমন সময়ে হরিপ্রসন্ন বাবু তথায় উপস্থিত হইলেন| মজিদ খাঁকে বলিলেন, “তোমার সহিত কয়েকটা বিশেষ কথা আছে, মজিদ!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “বলুন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বোধ হয়, তোমার স্মরণ আছে, একদিন তুমি বলিয়াছিলে যে, মনিরুদ্দীন এখানে ফিরিয়া আসিলে, সেদিন খুনের রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে রাত্রি বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল, তাহার সম্বন্ধে সমুদয় বিষয় প্রকাশ করিতে আপত্তি করিবে না| এখন মনিরুদ্দীন ফিরিয়া আসিয়াছে, তুমি অনায়াসে সে কথা বলিতে পার|”
মজিদ খাঁর মুখমণ্ডলে মলিনতার স্পষ্ট ছায়াপাত হইল| কম্পিতকণ্ঠে, বিবের্ণমুখে বলিলেন, “মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে; যাহাকে লইয়া এত কাণ্ড, সেই দিলজানও ফিরিয়াছে|”
মজিদ চকিতে একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস টানিয়া বলিলেন, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, দিলজান, এখন আমরা সকলেই জানিতে পারিয়াছি, সেদিল খুনের রাত্রিতে বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল-যাহার কথা তুমি প্রাণপণে গোপন করিতে চেষ্টা করিতেছ-সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী সৃজান| আর মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, তাহা দিলজানের নয়, সৃজানের| সৃজানই খুন হইয়াছে|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “হাঁ,-তাহাই বটে! তাহাই ঠিক|”
জোহেরা ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “তুমি কি ইহা আগে হইতে জানিতে যে, দিলজান খুন হয় নাই-সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে?”
মজিদ খাঁ মুখ নত করিলেন| বলিলেন, “হাঁ, খুনের রাত্রিতে বারটার পর সৃজান বিবির সঙ্গেই আমার দেখা হইয়াছিল| মনিরুদ্দীন ও সৃজান বিবির অবৈধ প্রণয়ের কথা আমি জানিতাম| মনিরুদ্দীন কোন কাজই আমাকে লুকাইয়া করিতে পারিত না-আমি তাহাকে দিন রাত চোখে চোখে রাখিতাম-এমন কি সেজন্য সে অনেক সময়ে আমার উপরে বিরক্ত হইত| আমি অনেকবার সৃজান বিবিকে গোপনে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে দেখিয়াছি| যাহাতে উভয়ে নিজ-নিজ চরিত্র সংশোধন করিতে পারে, সেজন্য আমি উভয়কেই অনেকসময়ে বুঝাইয়া নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু পতনের বেগ ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হয়|
আমি কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই| সেদিন রাত্রিতে সৃজান মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না| আমার সঙ্গেই তাহার সাক্ষাৎ হইয়া যায়| তাহার পর তাহার মুখে শুনিলাম, দিলজান না কি তাহার বাড়ীতে গিয়া উঠিয়াছে, এবং তাহাকে এখনও যে মনিরুদ্দীন ত্যাগ করে নাই, সমভাবে এখনও তাহাকে ভালবাসিয়া আসিতেছে, এমন কি বিবাহ করিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধও হইয়াছে, তাহা দিলজান, সৃজান বিবির কাছে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে| দিলজানের এই সকল কথা কতদূর সত্য, তাহা মনিরুদ্দীনের নিজের মুখে শুনিবার জন্য সৃজান বিবি তেমন সময়ে দিলজানের বেশে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| দিলজানের মুখে যাহা সে শুনিয়াছিল, তাহা যে মিথ্যা নহে, আমি সৃজান বিবিকে বুঝাইয়া বলিলাম| আমি মনে করিয়াছিলাম, এই সুযোগে যদি আমি পাপিষ্ঠা সৃজানকে নিরস্ত করিতে পারি, তাহা হইলে মনিরুদ্দীনকে একটা ভয়ানক দুর্নাম হইতে-বিশেষতঃ রাক্ষসী সৃজানের হাত হইতে রক্ষা করিবার অনেকটা সুবিধা হয়| আমার কথা শুনিয়া সৃজান বিবি অত্যন্ত রাগিয়া উঠিল| মনিরুদ্দীন যে এইরূপভাবে তাহার সহিত প্রবঞ্চনা করিয়াছে, সেজন্য মনিরুদ্দীনের প্রতি দোষারোপ করিতে করিতে সে আমাকেই দশ কথা শুনাইয়া দিল| আমি তাহাকে কিছুতেই শান্ত করিতে পারিলাম না| তখনই সে ক্রোধভরে বাড়ীর বাহির হইয়া গেল| সেই ভয়ানক রাগের মুখে সে কি ভয়ানক কাজ করিয়া ফেলিবে, এই ভয়ে আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম; পথে আসিয়া আর তহাকে দেখিতে পাইলাম না; সেদিন যেমন ভয়ানক কুয়াশা-তেমনি আবার ভয়ানক অন্ধকার! পথে দাঁড়াইয়া চরিদিকে চাহিতে চাহিতে এক ব্যক্তিকে যেন মেহেদী-বাগানের পথ ধরিয়া যাইতে দেখিলাম| কিছুদূর গিয়া আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না| ক্রমে মেহেদী-বাগানে আসিয়া পড়িলাম| সেখানেও তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম| এমন কি, দিলজানের বাড়ী পর্য্যন্ত গিয়াছিলাম; সেখানেও গোপনে খবর লইয়া জানিলাম, সৃজানের বাড়ী হইতে দিলজান তখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই| ফিরিবার মুখেও মেহেদী-বাগানে আমি সৃজানের অনেক অনুসন্ধান করিলাম| নিরাশ হইয়া যখন বাড়ী ফিরিতেছি, তখন একটা গলির মোড়ে মোবারকের সঙ্গে আমার দেখা হয়| তাহার পর বাড়ীতে ফিরিয়া শয়ন করিলাম| পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়াই এই খুনের কথা শুনিলাম| তাহার পর সেই লাসের পরিধেয় বস্ত্রাদির যেরূপ বর্ণনা শুনিলাম, তাহাতে আমি সহজেই বুঝিতে পারিলাম, সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে| এদিকে ক্রমে দিলজান খুন হইয়াছে বলিয়া চারিদিকে একটা রব উঠিয়া গেল| ভালই হইল মনে করিয়া আমিও অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিলাম|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহার একটা বিশেষ কারণ আছে|”
হ| এই খুন সম্বন্ধে না কি?
ম| খুন সম্বন্ধে বৈ কি|
হ| এখন কি তাহা প্রকাশ করিতে কোন আপত্তি আছে?
ম| একটু সময় দিন্, একবার ভাবিয়া দেখি, তাহার পর বলিতেছি|
হ| বেশ কথা|
জো| (মজিদের প্রতি) এ সকল কথা পূর্ব্বে কেন আমাদিগকে বল নাই?
ম| তাহারও কারণ আছে| আমি সৃজান বিবির নিকটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, তাহার সম্বন্ধে সেদিনকার কোন কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিব না| বিশেষতঃ তখন মনিরুদ্দীনের উপরে সৃজান বিবির যেরূপ রাগ দেখিয়াছিলাম, তাহাতে আমার বোধ হইয়াছিল যে, সে নিশ্চয়ই এইবার মনিরুদ্দীনকে ত্যাগ করিবে; এরূপ স্থলে এ কলঙ্ক-কাহিনী একেবারে চাপা পড়িয়া যাওয়াই ভাল| যদি আমি প্রকাশ করিতাম যে, সেদিন রাত্রে সৃজানের সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাহা হইলে আমাকে বাধ্য হইয়াই, সেই সঙ্গে তাহার সম্বন্ধে সকল কথাই প্রকাশ করিতে হইত|
হরিপ্রসন্ন বাবু, “কি আশ্চর্য্য! একজন স্ত্রীলোকের জন্য তুমি নিজের গলায় ফাঁসীর দড়ী জড়াইতে বসিয়াছ|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “না, এতদূর আমাকে অগ্রসর হইতে হইত না| বেগতিক দেখিলে আমাকে সকল কথাই বলিয়া ফেলিতে হইত| তবে যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ কেন না চেষ্টা করিব?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আগে তুমি কি মনে করিয়াছিলে যে, কে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “আগে আমি মনে করিয়াছিলাম, কেহই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে যায় নাই| তাহার পর যখন আপনি দিলজানের কথা আমার কাছে তুলিলেন, তখনই আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যদি কেহ গিয়া থাকে, ত দিলজানই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে| দিলজান সৃজানের যমজ ভগিনী| উভয়েই দেখিতে এক রকম, তাহার উপরে দুই জনে পরস্পর পোষাক পরিবর্ত্তন করিয়াছিল; বিশেষতঃ দিলজান খুব চতুর; এমন একটা সুযোগ কি সহজে তাহার হাত এড়াইতে পারে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কথা যাক্, সেই মৃত স্ত্রীলোকের নাম জানিয়াও এমন কোন্ বিশেষ কারণে তখন তুমি প্রকাশ করিতে সাহস কর নাই, তাহা এখন বলিবে কি?”
মজিদ খাঁর মুখ মলিন, এবং ললাটদেশ কুঞ্চিত হইল| এবং অতি কঠিনভাবে তিনি অধর দংশিত করিয়া একান্ত নিরাশভাবে একবার কক্ষের চারিদিকে চাহিলেন| তাহার পর কঠিন-কণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, সে বড় ভয়ানক কথা-তুমি তাহা সহ্য করিতে পারিবে না|”
জোহেরা বলিল, “যেমনই ভয়ানকই হউক না কেন-আমি তাহা সহ্য করিব| তুমি বল|”
মজিদের মুখের ভাব দেখিয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর বড় ভয় হইল| ভাবিলেন, মজিদ নিজেই খুনী না কি| জোহেরার সমক্ষে নিজের খুন-স্বীকার করিতে তাই এত ভীত হইতেছে? না-না-ইহা কখনই সম্ভব্পর নয়|
৫.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য
মজিদ খাঁ একবার নীরবে কি চিন্তা করিলেন| তাঁহার মুখমণ্ডল অন্ধকার হইয়া গেল| ক্ষণপরে তিনি মুখ তুলিয়া কি বলিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে খুব ব্যস্তভাবে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দেবেন্দ্রবিজয় সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই যে, আপনারা সকলেই এখানে আছেন-ভালই হইয়াছে-আপনাদিগের জন্য আজ আমি একটা নূতন খবর আনিয়াছি|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের নূতন খবর ?”
দে| খুনের| আমি ইতিমধ্যে মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করিয়াছিলাম| সেদিন খুনের রাত্রিতে তিনি কোথায় ছিলেন, কি করিয়াছিলেন, সে সকল বিষয় একপ্রকার জানা গিয়াছে|
হ| এমন কিছু শুনিলেন, যাহাতে তাহাকে এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত বিবেচনা করা যাইতে পারে?
দে| তাহাতে আর বিশেষ কি ফল হইত? এবার আমি প্রকৃত খুনীকে জানিতে পারিয়াছি|
“কে সে লোক?” অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা বলিয়া উঠিলেন| মজিদ খাঁ কিছু বলিলেন না-ব্যকুলনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোক নয়-একজন স্ত্রীলোক-একজন স্ত্রীলোক দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| সে এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে|”
জোহেরা আরও ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে এমন স্ত্রীলোক? নাম কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান|”
জোহেরা সবিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপার!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ভয়ানক!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপারই হউক-আর ভয়ানক ব্যাপারই হউক, দিলজান এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে| সেই খুনের রাত্রিতে দিলজান দারুণ ঈর্ষা-দ্বেষে মরিয়া হইয়া মেহেদী-বাগান পর্য্যন্ত সৃজানের অনুসরণ করিয়াছিল| সেইখানে সে সৃজানকে নিজ হস্তে খুন করিয়াছে|”
সন্দিগ্ধভাবে মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপ ভাবে, কোন অস্ত্রে খুন করিয়াছে, দিলজান কি কিছু বলিয়াছে?”
“এই ছুরিতেই সে সৃজানকে খুন করিয়াছে; দিলজান খুন স্বীকার করিয়া নিজের হাতে এই ছুরি আমাকে দিয়াছে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই দিলজান প্রদত্ত ছুরিখানি বাহির করিয়া দেখাইলেন|
মজিদ খাঁ, বিস্মিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “প্রথমতঃ আমি একটি কথাও বিশ্বাস করি নাই| এখন আমার মনে সন্দেহ হইতেছে, যদি দিলজান নিজেই খুন না করিবে, তবে কেন সে নিজের মুখে খুন স্বীকার করিতেছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ইহার কারণ আছে; আমার মুখেই আপনি তাহা শুনিতে পাইবেন| দিলজান মনিরুদ্দীনকে আন্তরিক ভালবাসে| আপনি এই খুনের অপরাধে সেই মনিরুদ্দীনকেই জড়াইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতেছেন, ইহা হয়ত সে শুনিয়া থাকিবে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” হাঁ, সেদিন আমি যখন মনিরুদ্দীনের স্কন্ধে এই হত্যাপরাধটা চাপাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম, তখন সে অন্তরালে থাকিয়া আমাদের অনেক কথাই শুনিয়াছিল|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহা হইলে ত ঠিকই হইয়াছে; পাছে মনিরুদ্দীনকে আপনি খুনের অপরাধে ফাঁসীর দড়ীতে তুলিয়া দেন, এই ভয়ে সে নিজে খুন স্বীকার করিয়াছে| বিশেষতঃ দিলজান স্বভাবতঃ বড় উগ্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক; আপনি বোধ হয়, তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন| তাহার উপর ভগিনীর খুনের কথা শুনিয়া, সেই খুনের অপরাধে মনিরুদ্দীনকে জড়াইয়া পড়িতে দেখিয়া দারুণ উত্তেজনায় তাহার মেজাজ আরও বিগ্ড়াইয়া যাইবার কথা| এখন কি বলিতেছে, কি করিতেছে সম্ভব, সে জ্ঞান আর তাহার নাই|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, ” কিন্তু এই ছুরিখানা?”
মজিদ খাঁ অবজ্ঞাভরে বলিলেন, “কিছু না-এই ছুরিতে সৃজান খুন হয় নাই-হইতে পারে না-ইহা কখনই বিষাক্ত নহে; আপনি বরং পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন| আমি খুব জোর করিয়া বলিতে পারি, দিলজানের দ্বারা কখনই এ খুন হয় নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার এ দৃঢ় বিশ্বাসের অবশ্যই একটা কারণ আছে; নতুবা আপনি এরূপ জোরের সহিত দিলজানের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিতেন না| আপনার বোধ হইতেছে-বোধ হইতেছে কেন-নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কে সৃজানকে খুন করিয়াছে|”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “না, আমি ঠিক জানি না| যাহা জানি, আপনাকে বলিতেছি| আমার মনে একটা ঘোরতর সন্দেহ রহিয়াছে; মেহেদী-বাগানের সেই স্ত্রীলোকের লাস যে সৃজানের, তাহা আমি প্রথমেই জানিতে পারিয়াছিলাম| জানিয়াও নাম প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই| সাহস না করিবার কারণই হইতেছে, আমি যাহা দেখিয়াছি-অতি ভয়ানক! দিলজান যে খুন করে নাই, আমার দৃঢ়বিশ্বাসের তাহাই একমাত্র কারণ| আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, সেদিন খুনের রাত্রিতে সৃজান রাগিয়া চলিয়া গেলে আমি তাহার অনুসরণ করিতে বাহির হইয়া পথে আর তাহাকে দেখিতে পাই নাই| এ কথাটা একেবারে মিথ্যা; বাধ্য হইয়া আমাকে সত্য গোপন করিতে হইয়াছিল| সৃজানের নিজের বাড়ীর দিকে গিয়াছে মনে করিয়া, আমি বাহির হইয়াই কলিঙ্গ-বাজারের পথে প্রথমে যাই| কিছুদূর গিয়া দেখি, পথিপার্শ্বস্থ লণ্ঠনের নীচে-নীচে অস্পষ্ট অন্ধকার-সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া একজন লোকের সহিত সৃজান বিবি কি বকাবকি করিতেছে| লোকটা কথায় কথায় খুব রাগিয়া উঠিল-স্বরও ক্রমে খুব ঊর্দ্ধে উঠিল| ক্রমে সেই লোকটা একহাতে সৃজানের গলা টিপিয়া ধরিয়া, অপর হাতে জোর করিয়া গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইল| সহসা সৃজান ব্যাকুলকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, এবং প্রাণপণে মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া গেল| লোকটাও সেইদিকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া গেল| আমি তাহাদের অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিলাম| চারিদিকে যেমন কুয়াশা, তেমনি ভয়ানক অন্ধকার, তাহাদের কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না| আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে, সৃজানের গলদেশে একটা আঁচড়ের দাগ ছিল-তাহা জোর করিয়া কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইবার দাগ| আমার বোধ হয়, সেই লোকটা সেই সময়েই সৃজানের গায়ে কোন বিষাক্ত অস্ত্র বিদ্ধ করিয়া দিয়া থাকিবে| সেই জন্যই ভয় পাইয়া, সৃজান বিবি একবার আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিয়াছে তাহর নিকট হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইয়া যায়| তাহার পর মেহেদী-বাগানে গিয়া, সেই বিষের প্রকোপে অবসন্ন হইয়া লুটাইয়া পড়ে; এবং সেইখানেই একান্ত অসহায়ভাবে হতভাগিনীর প্রাণবায়ু বাহির হইয়া যায়| আমার ত ইহই ধারণা|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সমস্ত শুনিতেছিলেন| মজিদ খাঁকে চুপ করিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সেই লোকটাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন কি?”
সকলে| কে-কে-কে?
ম| মুন্সী সাহেব|
জোহেরা একান্ত স্তম্ভিতভাবে প্রাণহীন পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া রহিল| তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি ভয়ানক! তাহা হইলে মনিরুদ্দীন ত আমাকে মিথ্যাকথা বলেন নাই| তিনিও মুন্সী সাহেবকে ঊর্দ্ধশ্বাসে সৃজানের অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন| ঘটমাক্রমে এই নারীহত্যাটা স্ত্রী-হত্যায় পরিণত হইল দেখিতেছি| শেষে মুন্সী সাহেবই খুনী দ্মাড়াইলেন-এখনই আমাকে উঠিতে হইল| আর বিলম্ব নয়|” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় চলিলেন?”
“মুন্সী সাহেব সৃজানের গলা হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছিলেন এইবার একবার সেই কণ্ঠহার তদন্ত করিতে হইবে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে সেখান হইতে বাহির হইয়া গেলেন|
৫.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঝটিকা ভিন্নদিকে বহিল
মুন্সী সাহেবের সেই হত্যারাত্রির গতিবিধি সম্বন্ধে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনের নিকট কতক শুনিয়াছিলেন; তাহার পর এখন আবার মজিদ খাঁর মুখে সেই সম্বন্ধে যাহা শুনিলেন, তাহাতে মুন্সী সাহেবকেই হত্যাকারী স্থির করিয়া একরূপ কৃতনিশ্চয় হইতে পরিলেন| মুন্সী সাহেব ও সৃজান বিবির মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের পরিবর্ত্তে যে, সর্প-নকুল সম্বন্ধ স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা প্রতিবেশীরা সকলেই জানিত| দেবেন্দ্রবিজয়ও তাহাদের নিকটে কিছু কিছু শুনিয়াছিলেন| এখন তিনি বুঝিতে পারিলেন, বিশ্বাস-হন্ত্রী এই নূতন ব্যভিচারের কথা কোন রকমে জানিতে পারিয়া মুন্সী সাহেব গোপনে স্ত্রীর উপরে লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন| তাহার পর সুযোগমত সময়ে তাহাকে খুন করিয়াছেন|
দেবেন্দ্রবিজয় আরও ভাবিয়া দেখিলেন, কেবল সন্দেহ করিলে কোন কাজ হইবে না, মুন্সী সাহেব খুনের রাত্রিতে তাঁহার স্ত্রীর গলদেশ হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়া কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে| যে ছুরি মজিদ খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, সে ছুরিতে যে এই খুন হয় নাই-তাহা নিশ্চয়| এখন ঘটনা আর এক ভাব ধারণা করিয়াছে| পূর্ব্বে যে সকল সূত্র অবলম্বন করিয়া কাজ করিতেছিলাম, তাহা এখন একান্ত নিরর্থক বলিয়া বুঝিতে পারিতেছি| যে বিষাক্ত অস্ত্রে সৃজান খুন হইয়াছে, তাহাও এখন সন্ধান করিয়া মুন্সী সাহেবের অধিকার হইতে বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাঁহার নিজের দোষস্খালনের আর তখন কোন উপায়ই থাকিবে না| বিশেষতঃ মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁর নিকটে তাঁহার সেই খুনের রাত্রির গতিবিধি সম্বন্ধে যতটা প্রমাণ পাওয়া যাইবে, তাহাতে আমি তাঁহাকে অতি সহজে দোষী সাবুদ করিতে পারিব| মুন্সী সাহেব যে নিজেই স্ত্রীর হত্যাকারী, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না| এখন তাহার নিকট হইতে সেই কণ্ঠহার আর যে বিষাক্ত অস্ত্রে তিনি সৃজানকে খুন করিয়াছেন, তাহা এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা চাই; কিন্তু তিনিই যদি প্রকৃত হত্যাকারী হইবেন, তাহা হইলে সেদিন সৃজান বিবির সন্ধানে আমাদের সঙ্গে ফরিদপুরে গিয়াছিলেন কেন? এখানে দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে একটা খটকা লাগিল, বড় গোলমালে পড়িলেন| একবার ইচ্ছা হইল, অরিন্দম প্রদত্ত সেই বাক্সটি ভাঙিয়া দেখেন, তন্মধ্যে অরিন্দম বাবুর হস্তাক্ষরে কোন্ নিরীহ (?) ব্যক্তির নামটি লিখিত রহিয়াছে-কে সৃজান বিবির হত্যাকারী| কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না| ক্ষণেক চিন্তার পর আপন মনে বলিলেন, “কিছু নয়-মুন্সী সাহেবই প্রকৃত হত্যাকারী-নিশ্চয় এই বাক্সের মধ্যে তাঁহারই নাম লিখিত রহিয়াছে| মুন্সী সাহেব নিজের অপরাধ ঢাকিবার জন্যই সৃজান বিবির সন্ধানে আমাদের সহিত ফরিদপুরে গিয়াছিলেন| মনে করিয়াছিলেন, এরূপ করিলে কেহ তাঁহাকে সন্দেহ করিতে পারিবে না| সেখানে গিয়া যে সৃজানকে দেখিতে পাইবেন না, তাহা তিনি নিজের মনে বেশ জানিতেন| কেবল নিজের অপরাধ গোপন করিবার জন্য তিনি এইরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়া থাকিবেন|”
দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে বাহির হইলেন| সেই পথে মনিরুদ্দীনের বাড়ী| যাইবার সময়ে একবার মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিয়া যাইতে মনস্থ করিলেন| বহির্ব্বাটীতেই মনিরুদ্দীনের সহিত তাঁহার দেখা হইল| সেখানে আর কেহ ছিল না|
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, অত্যন্ত চিন্তা-গম্ভীর মুখে মনিরুদ্দীন একাকী বসিয়া আছেন| তাঁহার মুখমণ্ডল যেমন গম্ভীর, তেমনই বিবর্ণ| এবং বিশৃঙ্খলভাবে কতকগুলা চুল ললাটের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে|
দেবেন্দ্রবিজয়কে গৃহপ্রবিষ্ট দেখিয়া মনিরুদ্দীন রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি মনে করিয়া আবার? এবার দিলজানকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছেন না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলিলেন, “না|”
মনিরুদ্দীন কহিলেন, “না কেন?’
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি ত সেইদিনই আপনাকে বলিয়াছি, তাহার কথা আমার বিশ্বাস হয় নাই; কেবল আপনাকে এই বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবার জন্য দিলজান এরূপভাবে খুন স্বীকার করিয়াছে| তাহার ধারণা, আপনার দ্বারাই খুন হইয়াছে|”
মনিরুদ্দীন কহিলেন, “তাহার ধারণা যাহাই হউক-আপনার ধারণা কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ|”
মনিরুদ্দীন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে আপনি বুঝিতে পারিলেন, আমি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন আমি প্রকৃত হত্যাকারীর সন্ধান পাইয়াছি| আমি খুব সাহস করিয়া বলিতে পারি, নিশ্চয় তিনিই সৃজানকে খুন করিয়াছেন|”
ম| কে-মুন্সী সাহেব?
দে| হাঁ-মুন্সী সাহেব নিজে|
ম| আমিও তাহাই ভাবিয়াছিলাম| তিনি সৃজানকে ইদানীং ঘৃণা করিতেন|
দে| ইহার কারণ?
ম| কারণ অনেক| দেখুন-দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, আমি জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ নই-এমন কি সাধারণ লোকের অপেক্ষাও আমার অন্তঃকরণ নীচ; কিন্তু কি করিব? আমার হৃদয় যেরূপ দুর্ব্বল-তাহাতে কোন প্রবৃত্তিকে বশে রাখা আমার সাধ্যাতীত-চেষ্টা করিয়াও তাহা পারি নাই; কেবল আমি কেন-আমার বোধ হয়, অনেকেই এরূপ প্রলোভনের হাত এড়াইতে পারে না|
দে| অবশিষ্ট জীবনটাও কি এইরূপভাবে অতিবাহিত করিবেন?
ম| না-সে ইচ্ছা আর আমার নাই| এখন হইতে যাহাতে সৎপথে চলিতে পারি, সেজন্য সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব| আমি এবার বিবাহ করিব, স্থির করিয়াছি|
দে| পাত্রী কে?
ম| দিলজান| দিলজান যে আমাকে এত ভালবাসে, তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না| যদিও আমি তাহাকে দেখিয়াও দেখিতাম না; কিন্তু সে অদ্যপি অগাধ বিশ্বাসের সহিত আমার উপরে নির্ভর করিয়া আসিতেছে; কিন্তু আমি কেবল তাহাকে প্রবঞ্চিত করিতেই চেষ্টা করিয়াছি| এমন গভীর প্রেম যাহার, তাহাকে উপেক্ষা করিয়া আমি যে কি ভয়ানক অপরাধ করিয়াছি, সেজন্য আমার মনে এখন অত্যন্ত অনুতাপ হইতেছে| যতদিন না আমি তাহাকে বিবাহ করিয়া তাহার বিষন্ন মুখে হাসি আনিতে পারি, ততদিন কিছুতেই আমার চিত্ত স্থির হইবে না|
দে| তবে আর বিলম্ব করিতেছেন কেন|
ম| দিলজান বড় পীড়িত-ঈশ্বর যদি এখন রক্ষা না করেন, হয়ত সারাজীবন এই অনুতাপ আমাকে হৃদয়ের মধ্যে পোষণ করিতে হইবে|
দে| দিলজানের কি অসুখ করিয়াছে?
ম| দিলজান এখন উন্মাদিনী-তাহার মস্তিষ্ক একেবারে বিকৃত হইয়া গিয়াছে| সেই মূর্চ্ছাভঙ্গের পর হইতেই তাহার এইরূপ শোচনীয় অবস্থা|
দে| তাই ত-দিলজানের এরূপ অবস্থা, বড়ই দুঃখের বিষয়| এখন হইতে বিধিমতে চিকিৎসা আরম্ভ করুন|
ম| হাঁ-খুব চেষ্টা করিতেছি; চিকিৎসায় কোন ফল হইতেছে না| দিলজান দিনরাত কেবল প্রলাপ বকিতেছে|
এই বলিয়া মনিরুদ্দীন ললাটে হস্তার্পণ করিয়া নিতান্ত বিষন্নভাবে মুখ নত করিয়া রহিলেন| দেবেন্দ্রবিজয় আর কিছু না বলিয়া সেখান হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন|
৫.০৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে
মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেবের বাটী বেশি দূরে নহে| এক বাড়ীর ছাদ হইতে অপর বাড়ী বেশ দেখা যায়| দেবেন্দ্রবিজয় অনতিবিলম্বে মুন্সী সাহেবের বাটীতে গিয়া উপনীত হইলেন| দ্বার-রক্ষক ভৃত্যের মুখে শুনিলেন, মুন্সী সাহেব তখন বাটীতে নাই-প্রাতেই বাহির হইয়া গিয়াছেন|
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “জোহেরা বিবি অভী কাঁহা হৈঁ? উন্কি সাথ্ মোলাকাৎ হো সক্তা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “জী হুজুর! হো সক্তা! উন্নে অভী উকীল বাবুকে সাথ্ বৈঠকখানামে বাত্চিৎ কর্তে হৈঁ|”
দেবেন্দ্রবিজয় দ্রুতপদে দ্বিতলে উঠিয়া বৈঠকখানা ঘরের দ্বার-সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন| গৃহমধ্যে জোহেরা ও বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু| দুইজনে দুইখানি চেয়ারে বসিয়া আছেন| সম্মুখস্থ টেবিলের উপরে অনেকগুলি কাগজ পত্র ছড়ান রহিয়াছে|
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া জোহেরা বলিয়া উঠিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ভালই হাইয়াছে| সৃজান বিবির খুনের সম্বন্ধে আমাদের কথাবার্ত্তা হইতেছিল| ঘটনা যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আপনার সাহায্য বিশেষ আবশ্যক!”
দেবেন্দ্রবিজয় একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলেন, “আমার দ্বারা আপনাদিগের যতদূর সাহায্য হইতে পারে, তাহা আমি সাগ্রহে করিব| আমারই ভ্রমে মজিদ খাঁ আজ বিপদ্গ্রস্ত; যাহাতে এখন তাঁহাকে উদ্ধার করিতে পারি, সেজন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব| তাঁহার এই বিপদে আমি যথেষ্ট অনুতপ্ত|”
হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “আপনি আপনার কর্ত্তব্য কর্ম করিয়াছেন, ইহাতে আর অনুতাপ কি? মজিদের বিরুদ্ধে যে সকল অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে আপনি কেন-সকলেই তাহাকে দোষী স্থির করিয়াছিল| এখন আবার মুন্সী সাহেবের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “খুবই অকাট্য| মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ উভয়েই মুন্সী সাহেবকে তাঁহার পত্নীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছেন| বিশেষতঃ মজিদ খাঁ তাহাকে সৃজান বিবির গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইতে দেখিয়াছেন| ঘটনা খুব সত্য-তথাপি আমাদিগকে এ সম্বন্ধে দুই-একটা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে হইবে| এখন আমাদিগকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, মুন্সী সাহেব তাঁহার স্ত্রীর গলদেশ হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছেন, কোথায় তাহা রাখিয়াছেন; তাহার পর যে বিষাক্ত ছুরিতে সৃজান বিবিকে হত্যা করিয়াছেন, তাহাও সন্ধান করিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতে হইবে| সেই উদ্দেশ্যেই আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছি|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি কি মনে করেন, খুনের এমন ভয়ানক প্রমাণগুলি তিনি নিজের সর্ব্বনাশ করিবার জন্য-এখনও নিজের কাছে রাখিয়াছেন? আমার ত ইহা বিশ্বাস হয় না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশ্বাস না হইবার কোন কারণ নাই| এই হত্যাপরাধটা যে তাঁহার স্কন্ধে পড়িবে, এমন সম্ভাবনা তাঁহার মনে একবারও হয় নাই-দৈবাৎ মনিরুদ্দীন ও মজিদ খাঁ অলক্ষ্যে তাঁহাকে সেইদিন মেহেদী-বাগানে দেখিয়াছেন-এইমাত্র| নিজে তিনি তাহাও জানেন না| তা’ যাহাই হউক, যদি তিনি ছুরিখানি না রাখিতে পারেন, কিন্তু সেই কণ্ঠহার – কণ্ঠহার নিশ্চয়ই তিনি কোনখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন|”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার কারণ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কণ্ঠহার লইয়া যে ভবিষ্যতে একটা গোলযোগ উপস্থিত হইবে, ইহা মুন্সী সাহেবের স্বপ্নাতীত| কে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে গিয়ছে যে, সৃজান বিবি সেদিন রাত্রিতে কণ্ঠহার পরিয়া বাহির হইয়াছিল কি না?”
জোহেরা বলিল, “তিনি দিনরাত্রি সেই কণ্ঠহার পরিতেন| আমি তাঁহাকে সর্ব্বদাই সেই কণ্ঠহার গলায় রাখিতে দেখিয়াছি|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কণ্ঠহার ছড়াটা কিরূপ দেখিতে?”
জোহেরা বলিল, “সাবেক ধরণের; আজ-কাল সে রকম ধরণের কণ্ঠহার বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না| বড় বড় হীরা-মুক্তা দিয়া পরিপাটী সাজান – দামও অনেক হইবে; মাঝখানে একখানা হীরার খুব বড় ধুক্ধুকী|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “অনুমান করিয়া আপনি বলিতে পারেন, মুন্সী সাহেব এখন সেই কণ্ঠহার কোথায় রাখিয়াছেন?”
জোহেরা কহিল, “কোথায় তিনি রাখিয়াছেন, তিনিই জানেন; আমি কিরূপে বলিব? হয় ত নিজের শোবার ঘরে রাখিয়া থাকিবেন-কি এখানেও তিনি রাখিতে পারেন|”
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু চমকিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “এখানে!”
জোহেরা বলিল, “হাঁ, এখানেও তিনি সেই কণ্ঠহার রাখিতে পারেন-এই ঘরেই তিনি সদাসর্ব্বদা বসেন| তাঁহার দলিল-দস্তাবেজ, জমিদারীর কাগজ-পত্র সকলেই এই দেরাজে রাখিয়া থাকেন; তাঁহার সেই সকল দরকারী কাগজ-পত্র কেহ হাত দিতে যাইবে না, মনে করিয়া তিনি ইহারই একটা টানার মধ্যে সেই কণ্ঠহার ছড়াটাও হয়ত রাখিয়াছেন|”
জোহেরা যে দেরাজটি তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিল, তেমন সুন্দর গঠনের প্রকাণ্ড দেরাজ এখন বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না-দৈর্ঘ্যে প্রায় ছাদতলস্পর্শী| উপর হইতে নীচ পর্য্যন্ত ছোট বড় অনেকগুলি ড্রয়ারে পরিশোভিত| এবং প্রত্যেক ড্রয়ারে দুইটি করিয়া উজ্জ্বল স্ফটিক-গোলক সংলগ্ন রহিয়াছে|
৫.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কণ্ঠহার
দেবেন্দ্রবিজয় চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া সোৎসাহে ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন; সকলগুলিই চাবি-বন্ধ-একটাও খুলিতে পারিলেন না| তখন দেবেন্দ্রবিজয় একান্ত হতাশভাবে নিজের চেয়ারে বসিয়া বলিলেন, “না-সুবিধা হইল না দেখিতেছি, সকলগুলিই চাবি দেওয়া| তালা ভাঙ্গিয়া খানা-তল্লাসী করিবার অধিকার এখন আমার নাই|”
জোহেরা বলিল, “সে অধিকার থাকিলেও আপনি এ দেরাজ হইতে সেই কণ্ঠহার বাহির করিতে পারিবেন না| ইহাতে এমন একটি গুপ্তস্থান, তাহা কেহই জানে না, অথচ সেই গুপ্তস্থান বিনা চাবির সাহায্যে খুলিতে পারা যায়| যদি মুন্সী সাহেব কণ্ঠহার গোপন করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন, খুব সম্ভব-সেই গুপ্তস্থানে রাখিয়া দিয়াছেন|”
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেরাজের আপনাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে করিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই দেরাজে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে না কি?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, আমি একদিন সৃজান বিবির কাছে এই দেরাজের সুখ্যাতি শুনিয়াছিলাম| কথায় কথায় সৃজান বিবি সেই গুপ্তস্থানের কথা বলিয়া ফেলিলেন| সে গুপ্তস্থানের কথা বাড়ীর আর কেহই জানে না; এমন কি নিজে মুন্সী সাহেবও জানেন না| এ দেরাজটি সৃজান বিবির পিতার ছিল| কন্যার বিবাহের সময়ে তিনি কন্যাকে এই দেরাজটি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু কহিলেন, “সে গুপ্তস্থান কোথায়?”
জোহেরা কহিল, “তাহা আমি জানি না| সে গুপ্তস্থান কোথায়, কিরূপভাবে খুলিতে হয়, সে সম্বন্ধে সৃজান বিবি আমাকে কিছুতেই বলেন নাই| এই দেরাজের মধ্যে এমন একটা গুপ্তস্থান আছে, কেবল এই কথাই বলিয়াছেন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তুমি নিজে অন্য কোন সময়ে সৃজান বিবির অসাক্ষাতে সেই গুপ্তস্থান খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিয়াছিলে?”
জোহেরা কহিল, “হাঁ, দুই-তিন দিন করিয়াছিলাম; স্ত্রীলোকের মনে কৌতূহলের প্রভাব বড় বেশি; কিন্তু চেষ্টা সফল হয় নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ভাল আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখি; সেই গুপ্তস্থানের কথাটা যদি মিথ্যা না হয়, আমি ঠিক সন্ধান করিয়া বাহির করিব|” বলিয়া আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বৃথা পরিশ্রমের ফল কি, দেবেন্দ্র বাবু? যদি আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহাতে বিশেষ কি ফল হইবে? জোহেরা মুখেই ত শুনিলেন, এই সৃজান বিবি ছাড়া মুন্সী সাহেবও সে গুপ্তস্থানের কথা জানেন না-তাহা হইলে তিনি কিরূপে সেখানে সেই কণ্ঠহার রাখিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পূর্ব্বে-বোধ হয়, মুন্সী সাহেব সে গুপ্তস্থানের কথা জানিতেন না; সম্ভব, পরে তিনি কোন রকমে জানিতে পারেন| একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে দোষ কি আছে? হয় ত সেই গুপ্তস্থানে এই সকল ড্রয়ার খুলিবার চাবি পাওয়া যাইতে পারে|”
দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দেরাজটির চারিদিক্ বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন| সেই গুপ্তস্থান আবিষ্কারের কোন সুযোগ দেখিতে পাইলেন না| দেরাজের উপরে কাঠের উদ্ভিন্ন ফুললতামোড়ের অনেক কারুকার্য্য ছিল| পরিশেষে দেবেন্দ্রবিজয় সেইগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলেন| একস্থানে দেখিলেন, সেই সকল কাঠের ফুললতার মধ্যে একটা ফুল কিছু মলিন, বারংবার হাত লাগিলে পালিসের ঔজ্জ্বল্যের যেরূপ হ্রাস হয়, এবং একটা দাগ পড়িয়া যায়, সেই ফুলটিতে ঠিক সেই রকমের একটা দাগ পড়িয়া গিয়াছিল| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে আশার সঞ্চার হইল| তিনি সেই কাঠের ফুলটি ঘুরাইয়া, ফিরাইয়া, টিপিয়া টানিয়া অনেক রকমে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন| কিছুতেই সেটা একটু সরিল না-নড়িল না| তথাপি তিনি হতাশ হইলেন না, সেই ফুলটি লইয়া তিনি ক্রমাগত নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন| বারংবার এইরূপ করিতে হঠাৎ একটা ‘ক্রিং’ শব্দ হইল; এবং সেই সঙ্গে সেই ফুলের পার্শ্বসংলগ্ন একটা কাঠের পাতা উল্টাইয়া ঝুলিয়া পড়িল; সেখানে একটি রূপার ছোট হাতল রহিয়াছে| দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার চেষ্টা সফল হইয়াছে-সেই হাতল ধরিয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন-নিঃশব্দে একটি ক্ষুদ্র ড্রয়ার বাহির হইল| দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়ব্যাকুলনেত্রে দেখিলেন, সে ড্রয়ারের মধ্যে একছড়া হীরামুক্তাখচিত কণ্ঠহার-আরও একটা তীক্ষ্ণমুখ তীরের ফলা পড়িয়া রহিয়াছে| তা’ ছাড়া আর কিছুই নাই|
৫.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – মেঘ-ঘনীভূত
গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতর হইতে সেই কণ্ঠহার বাহির হইতে দেখিয়া জোহেরার মুখে কথা নাই-হরিপ্রসন্ন বাবুর মুখেও কথা নাই-দেবেন্দ্রবিজয়ও বিস্ময়-স্তম্ভিত| সর্ব্বপ্রথমে দেবেন্দ্রবিজয় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন| জোহেরাকে বলিলেন, “দেখুন দেখি, সেই সেই কণ্ঠহার কি না; আপনি যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, তাহাতে ইহা যে সেই সৃজান বিবির কণ্ঠহার, দেখিয়া বেশ বুঝা যাইতেছে; এই যে মাঝখানে হীরার একখানা বড় ধুক্ধুকিও রহিয়াছে|”
জোহেরা কম্পিতকণ্ঠে কহিল, “হাঁ, এই সেই কণ্ঠহার; কিন্তু-কিন্তু-এ তীরের ফলা-ইহা ত কখনও আমি দেখি নাই|” বলিয়া জোহেরা তাহা ড্রয়ারের মধ্য হইতে তুলিয়া লইল|
জোহেরার হাত হইতে সেই তীরের ফলা লইয়া উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু উল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন, “তাই ত এ তীরের ফলা কোথা হইতে আসিল? খুব ধারাল দেখিতেছি|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “খুব সাবধান, হরিপ্রসন্ন বাবু! ধার পরীক্ষা করিতে চেষ্টা করিবেন না| এখনই বিপদ্ ঘটিয়া যাইবে – বড় সাংঘতিক – দেখিতেছেন না, ইহা বিষাক্ত?”
“বিষাক্ত!’ বলিয়া সভয়ে হরিপ্রসন্ন বাবু সেই তীরের ফলাটা ড্রয়ারের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন| বলিলেন, “কিরূপে আপনি বুঝিতে পারিলেন, ইহা বিষাক্ত?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “নিশ্চয়ই বিষাক্ত! পূর্ব্বে আমাদের ভুল হইয়াছিল; সেই ছুরিতে সৃজান বিবি খুন হয় নাই| আমি এখন ঠিক বুঝিতে পারিতেছি, এই তীরের ফলা দিয়া সৃজান বিবিকে খুন করা হইয়াছে|”
জোহেরা হতাশভাবে বলিল, “মহাশয়, তবে কি আপনি এখন মুন্সী সাহেবকেই দোষী স্থির করিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, নিজের পত্নীর অসচ্চরিত্রতার কথা তাঁহার অনবগত ছিল না| সৃজান বিবি মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গৃহত্যাগ করিবার যে বন্দোবস্ত করিয়াছিল, তাহাও তিনি সেদিন কোন রকমে জানিতে পারিয়া থাকিবেন| সেই খুনের রাত্রিতে তিনি যে গোপনে স্ত্রীর অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে গিয়াছিলেন. তাহা মনিরুদ্দীন দেখিয়াছিলেন| আর একজন – মজিদ খাঁ, তিনিও মুন্সী সাহেবকে পথের ধারে একটা আলোক-স্তম্ভের নীচে দাঁড়াইয়া সৃজান বিবির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করিতে করিতে তাহার গলদেশ হইতে একছড়া কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইতে দেখিয়াছেন| তখনই সৃজান বিবি মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া পালাইয়া যায়-মুন্সী সাহেবও তাহার অনুসরণ করেন| তাহার পর যখন সেই মেহেদী-বাগানে সৃজান বিবির লাস পাওয়া যাইতেছে, তখন মুন্সী সাহেবই দোষী| বিশেষতঃ মুন্সী সাহেব ভিন্ন আর কেহই এ গুপ্ত ড্রয়ারের বিষয় জানে না, আর সৃজান বিবি যদিও জানিত, সে এখন জীবিত নাই; অথচ যখন এই ড্রয়ারের মধ্যে সৃজান বিবির খুনের প্রধান নিদর্শন স্বরূপ এই কণ্ঠহার আর তীরের ফলা পাওয়া যাইতেছে, তখন মুন্সী সাহেবই ইহা এইখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন| নিশ্চয়ই তিনি স্ত্রীহন্তা!”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আপনি কি করিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন এই কণ্ঠহার আর তীরের ফলা গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতরেই রাখিয়া দিয়া মুন্সী সাহেবের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিব| তিনি আসিলে প্রথমতঃ তাঁহাকে খুন সম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিবার, তাহা করিব| অবশ্যই তিনি অস্বীকার করিবেন; তখন এইগুলি সহসা তাঁহার চোখের সাম্নে ধরিয়া দিলে তিনি মহা গোলমালে পড়িয়া আত্মদোষক্ষালনের কোন উপায়ই পাইবেন না|”
জোহেরা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মুখ নত করিল| জোহেরা বুঝিল, তাহার আর এক নূতন বিপদ্ উপস্থিত! এক্ষণে ঘটনা যেরূপ দাঁড়াইতেছে, তাহাতে মজিদ খাঁ মুক্তি পাইবেন বটে; কিন্তু তাহার অভিভাবক মুন্সী সাহেবের বিপদ্ বড়ই গুরুতর হইয়া উঠিতেছে| জোহেরা মনে অত্যন্ত ব্যথা লাগিল| বলিল, “যদি সৃজান বিবির স্বভাব ভাল হইত, তাহা হইলে আমাদের আজ এমন সর্ব্বনাশ হইত না!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সকলের স্বভাব যদি ভাল হইত, তাহা হইলে আমাদের কাজ চলে কৈ? হাত-পা গুটাইয়া বেকার বসিয়া থাকিতে হয়|”
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় এই গুপ্ত-ড্রয়ারটা কিরূপে খোলা ও বন্ধ করা যায়, পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া তন্মধ্যে হীরার কণ্ঠহার ও বিষাক্ত তীরের ফলাটা রাখিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন|
এমন সময়ে বাহিরের সোপানে কাহার পদশব্দ হইল| পরে কণ্ঠস্বরও শুনা গেল| স্বর শুনিয়া জোহেরা বুঝিতে পারিল, মোবারক| বলিল, “মোবারক বিবাহের প্রস্তাব লইয়া মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে আসিতেছেন; বোধ হয়, এই ঘরেই আসিবেন| আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে চহি না – আপনারা বসুন – আমি বাড়ীর ভিতরে যাই|” বলিয়া জোহেরা গমনোদ্যতভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইল|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাই ত, এমন সময়ে আবার মোবারক আসিয়া উপস্থিত| আমি মুন্সী সাহেবের সঙ্গে একাকী দেখা করিব মনে করিয়াছিলাম| আমারও এখন একবার অন্য একটা ঘরে গিয়া বসিলে সুবিধা হয়|”
জোহেরা বলিল, “এই পাশের ঘরে আপনারা উভয়ে বসিতে পারেন| মোবারক চলিয়া গেলে আপনারা মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিবেন|” এই বলিয়া জোহেরা পার্শ্ববর্ত্তী কক্ষের-দ্বার সম্মুখস্থ পর্দ্দাখানা সরাইয়া দিল| সকলে পার্শ্ববর্ত্তী প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলে জোহেরা ভিতরে গিয়া পর্দ্দা টানিয়া দিল|
৫.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – মহা বিপদ্
ক্ষণপরে হাস্যপ্রফুল্ল মুখে মোবারক-উদ্দীন সেই বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না| তাঁহার মুখমণ্ডল সহসা অপ্রসন্নভাব ধারণ করিল| য়ে ভৃত্য তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া উপরে আনিয়াছিল, সে ঘরের বাহিরে দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল| মোবারক-উদ্দীন তাহাকে রুক্ষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুম্নে অভী বোলা কি জোহেরা বিবি উপর্কা বৈঠকনামে বৈঠৈ হৈঁ; পর বে কাঁহা হৈঁ?”
থতমত খাইয়া বৃত্য বলিল, “খোদাবন্দ! বিবি সাহব্ নে ইস ঘর্মে থী, ঔর উন্কে সাথ্ ঔর দো রইসোঁ ভি থা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “কুল দো রইসোঁ| আব্ তো বহুৎ রইসোঁকা আমদানী হোগা| জানে দেও ইস্ বাত্ কো, অব্ জোহেরা বিবি কাঁহা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “হুজুর মেরে সমঝ্মে উননে অন্দরমে গয়া হোগা| কহিয়ে তো উন্কো খবর দেঁ|”
মোবারক একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া, একটা জৃম্ভণ ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “ন্যহি, অভী কুছ্ জরুরৎ ন্যহি হৈ; বাদ্ উন্সে মোলাকাৎ করুঙ্গা| অব্ মুন্সী সাহব্কে সাথ্ একদফে মোলাকাৎ কর্না চাহিয়ে| যবতক্ মুন্সী সাহেব না আবে, তবতক্ হমে ইস্ জায়গা হাজির রহ্না হোগা!”
ভৃত্য একটা সেলাম করিয়া চলিয়া গেল| অনতিবিলম্বে ধীরে ধীরে সাহেব সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন| তাঁহার মুখভাব মলিন, চক্ষু কালিমালেপিত, মাথার চুলগুলাও বড় বিশৃঙ্খল|
তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া মোবারক দ্বারপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন| এবং উন্মুক্ত দ্বার ভিতর হইতে চাপিয়া দিয়া বলিলেন, “এই যে আপনি খুব শীঘ্র আসিয়াছেন| আমি মনে করিতেছিলাম, আপনার জন্য কতক্ষণই না আমাকে এখানে বসিয়া অপেক্ষা হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে আপনার কি প্রয়োজন?”
মোবারক পুনরায় নিজের আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, “বিশেষ প্রয়োজন আছে|”
মুন্সী সাহেব ভ্রুযুগ ললাটে তুলিয়া বলিলেন, “ব্যাপরটা কি?”
মো| ব্যাপারটা-বিবাহ|
মু| কাহার বিবাহ?
মো| আমার|
মু| তা’ আমার কাছে কেন?
মো| আপনার মত না হইলে হইবে না| আমি জোহেরা বিবিকে বিবাহ করিতে চাই|
মু| (চমকিত ভাবে) অসম্ভব! কিছুতেই তাহা হইবে না|
মো| না হইবার কারণ? আমি নীচবংশীয় নই – অর্থোপার্জ্জনে সক্ষম – বাহিরে আমার মান-সম্ভ্রম যথেষ্ট|
মু| (ঘৃণাভরে) কিন্তু চরিত্র সম্বন্ধে?
মো| (সহাস্যে) মন্দ কি? তবে এরূপ বয়সে সকলেরই যেরূপ একটু-আধটু চরিত্র-দোষ ঘটে, আমারও তাহাই জানিবেন-তাহার বেশি কিছু পাইবেন না| আপনি কি বিবাহে আপত্তি করিবেন?
মু| নিশ্চয়ই|
মো| কেন?
মু| প্রথমতঃ-জোহেরা মজিদ খাঁকে বিবাহ করিতে স্থিরসঙ্কল্প|
মো| (ঘৃণাভরে) মজ্জিদ খাঁকে-কি আশ্চর্য্য! হত্যাপরাধে যে লোক জেলে পচিতেছে-অনতিবিলম্বে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবে – তাহাকে বিবাহ!
মু| হত্যাপরাধ হইতে সে শীঘ্র নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন হইবে|
মো| কিরূপে?
মু| (বিরক্তভাবে) সে কথায় এখন দরকার কি?
মোবারক কঠিন হাস্যের সহিত বলিলেন, “এই আপনার প্রথম আপত্তি| দ্বিতীয়টা কি শুনি?”
মুন্সী সাহেব কিছু না বলিয়া পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া সেই প্রকাণ্ড দেরাজের একটা ড্রয়ার টানিয়া খুলিয়া ফেলিলেন| এবং তন্মধ্য হইতে গোলাপী রঙের ফিতে-বাঁধা একতাড়া পত্র বাহির করিয়া সশব্দে টেবিলের উপরে ফেলিয়া দিয়া, সেই তাড়ার প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এগুলি কি, বলিয়া দিতে হইবে কি?”
পত্রগুলি দেখিয়া মোবারকের মুখ একেবারে অন্ধকার হইয়া গেল| অর্দ্ধোত্থিত হইয়া টেবিলের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা আপনি কোথায় পাইলেন?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “এই দেরাজের একটা গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে এই চিঠিগুলি পাওয়া গিয়াছে| এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় কেহ কিছু জানে না, মনে করিয়া আমার স্ত্রী এই চিঠিগুলা এইখানেই লুকাইয়া রাখিয়াছিল; কিন্তু তাহার পিতা যখন এই দেরাজটী দেন্, তখনই তিনি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের কথা আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন| তাহা আমার স্ত্রী জানিত না| একদিন কি খেয়াল হইল, ঐ গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া এই চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম|”
শুষ্কহাসি হাসিয়া মোবারক বলিল, “কিসের চিঠি এ সব?”
কঠিনকণ্ঠে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কিসের চিঠি তাহা আবার তোমাকে বুঝাইয়া বলিয়া দিতে হইবে? তুমি এই সকল চিঠি আমার স্ত্রীকে লিখিয়াছিলে-এখন একেবারে আকাশ হইতে পড়িয়া কোন ফল নাই|”
মোবারক বলিল, “এই সকল চিঠি আমার লেখা, আমি তাহা স্বীকার করিতেছি; কিন্তু আপনার স্ত্রীকে আমি লিখি নাই-সৃজানকে লিখিয়াছিলাম, তখন আপনার সহিত তাহার বিবাহই হয় নাই| ইহার জন্য আপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন| ইহাতে আমার এমন বিশেষ কি অপরাধ দেখিলেন?”
উঠিয়া ক্রোধে কম্পিতস্বরে মুন্সী সাহেব কহিলেন, “বেত্মিজ, তোমার পরম সৌভাগ্য যে এখনও আমি তোমার রক্ত-দর্শন করি নাই| আমার স্ত্রীর স্বভাব ভাল ছিল না বলিয়াই, আমি ততটা করি নাই; নতুবা তুমি এখন যেখানে বসিয়া আছ, এতক্ষণ ঐখানে তোমার মৃতদেহ লুটাইয়া পড়িত| বেয়াদব্ বেইমান্, কোন সাহসে তুমি জোহেরাকে বিবাহ করিতে চাও? তোমার মত বদ্মাইসের সহিত আমি জোহেরার বিবাহ দিব-এ কথা মনেও স্থান দিয়ো না|”
মোবারক টেবিলের উপরে সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া বলিল, “নিশ্চয়ই আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দেবেন| বিশেষ একটা কারণে আপনাকে বাধ্য হইয়া জোহেরা-রত্ন আমার হাতে সমর্পণ করিতেই হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিশেষ কারণটা কি শুনি?”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিল, “আমার মুখে কি শুনিবেন? আপনি নিজে কি তাহা জানেন না?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কই, আমি কিছুই জানি না-তোমার কথা আমি বুঝিতে পারিতেছি না|”
মোবারক বলিল, “এবার পুলিসের লোক তদন্তে আসিলে আমি তাহাদিগকে বলিতে পারিব, সৃজান বিবির হত্যাকারী – সৃজান বিবিরই স্বামী – স্বয়ং মুন্সী সাহেব|”
মুন্সী সাহেব মহা রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কি ভয়ানক! তুমি মনে করিয়াছ, আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছি?”
মনে করিয়াছি কি, “টেবিলের উপরে মোবারক পুনরপি সশব্দে আর একটা চপেটাঘাত করিল| বলিল, “আমি নিশ্চয়ই জানি, আপনি আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী – ইহা আমি শপথ করিয়াই বলিতে পারি| যদি আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে সম্মত না হন্, তাহা হইলে আমি সকলের নিকটে এ কথা প্রকাশ করিয়া দিতেও কুণ্ঠিত হইব না|”
রাগিয়া, বিবর্ণ হইয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কি ভয়ানক মিথ্যাকথা! আমি যে আমার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছি, তাহার প্রমাণ কোথায়?”
মোবারক বলিল, “প্রমাণ আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যেই আছে-আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কেন কষ্ট পাইতেছেন?”
উন্মেত্তের ন্যায় সবেগে মুন্সী সাহেব দেরাজের কাছে ছুটিয়া গেলেন| দ্রুতহস্তে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলেন| খুলিয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে তাঁহার স্ত্রীর সেই কণ্ঠহার এবং একটা তীরের ফলা দেখিতে পাইলেন| তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল| এবং মোবারক তাঁহার বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া চোখে-মুখে পরিহাসের মৃদু হাসি হাসিতে লাগিল|
পার্শ্ববর্ত্তী গৃহের দ্বারপার্শ্বে রুদ্ধশ্বাসে উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু, ডিটেক্টিভ ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় ও জোহেরা এতক্ষণে তাহাদিগের নেপথ্যবর্ত্তী এই ভয়ানক অভিনয়ের বক্তৃতাবলী শ্রবণ করিতেছিলেন| রহস্য ক্রমশঃ ভেদ হইতে দেখিয়া সমস্ত কথাগুলি শুনিবার জন্য তাঁহারা সেখানে উদ্বিগ্নহৃদয়ে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
মোবারক মুন্সী সাহেবের নিকটস্থ হইয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া অত্যন্ত পরুষকণ্ঠে কহিল, “এখন প্রমাণ দেখিতে পাইলেন ত? এই কণ্ঠহার আপনি খুনের রাত্রিতে সৃজান বিবির গলদেশ হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়াছিলেন, মনে পড়ে, এই বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া সৃজানকে আপনি স্বহস্তে খুন করিয়াছিলেন? এই দেখুন, সেটাও এই পড়িয়া রহিয়াছে|”
মুন্সী সাহেব একান্ত শূন্যদৃষ্টিতে সেই কণ্ঠহার ও তীরের ফলাটার দিকে চাহিয়া রহিলেন| তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিতেছিল-আরও কাঁপিতে লাগিল| সহসা তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না|
৫.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল
ক্ষণপরে কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া, মুন্সী সাহেব বিস্ময়বিক্ষুব্ধকণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ ভয়ানক ষড়যন্ত্র! এই কণ্ঠহার-হাঁ এই কণ্ঠহার আমি রাখিয়াছি বটে-কিন্তু এ তীরের ফলা কোথা হইতে আসিল? আমি ত ইহার কিছুই জানি না|”
সপরিহাসে মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন, কিন্তু ‘জানি না’ বলিলে কি লোকে এখন আপনার কথা বিশ্বাস করিবে? বিশেষতঃ আপনার ড্রয়ার হইতেই যখন এই সকল জিনিষ পাওয়া যাইতেছে, তখন আর ‘জানি না’ বলা যে একান্ত বিড়ম্বনা!”
মহা গরম হইয়া মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এ গুপ্ত ড্রয়ারের কথা কিরূপে জানিলে?”
মোবারক কহিল, “কই গুপ্ত-ড্রয়ার সম্বন্ধে আমি ত আপনাকে কোন কথাই বলি নাই|”
মুন্সী সাহেব আরও গরম হইয়া কহিলেন, “মিথ্যাবাদী-তুমি নিশ্চয়ই এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় অবগত আছ, তুমি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতরে কি আছে কি না, কিরূপে জানিলে? আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এই তীরের ফলা তুমিই এখানে রাখিয়াছ|”
মোবারক হটিবার পাত্র নহে| কঠিন পরিহাসের সহিত কহিল, “তাই না কি! এ তীরের ফলা আমি কোথায় পাইব? মুন্সী সাহেব, এ বৃদ্ধ বয়সে একজন নির্দ্দোষীর স্কন্ধে নিজের হত্যাপরাধটা চাপাইতে চেষ্টা করিবেন না | চেষ্টা করিয়াও বিশেষ কিছু ফল হইবে না-আপনার পাপের ফল, একা আপনাকেই ভোগ করিতে হইবে|”
মুন্সী সাহেব অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “আমি খুন করি নাই-কে খুন করিয়াছে, তাহাও জানি না| আমার স্ত্রী গৃহত্যাগের সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমি জানিতাম, স্বীকার করি| সেই খুনের রাত্রিতে আমি গোপনে আমার স্ত্রীর অনুসরণও করিয়াছিলাম| মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে আমার স্ত্রী বাহির হইয়া আসিলে আমিই তাহার নিকট হইতে এই কণ্ঠহার জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছি| সে তখনই ভয় পাইয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া যায়| আমিও তাহার অনুসরণ করি; কিন্তু কিছুদূর গিয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিতে পাই নাই| ইহা ছাড়া সেদিনকার রাত্রির খবর আমি আর কিছুই জানি না| পরদিন প্রাতে শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে একটা স্ত্রীলোক খুন হইয়া পড়িয়া আছে|”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি তখন বুঝিতে পড়িয়াছিলেন যে, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা আপনার স্ত্রী?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না-তখন আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই| মনিরুদ্দীন সেই রাত্রিতে এখান হইতে চলিয়া যাওয়ায় মনে করিয়াছিলাম, আমার স্ত্রীও তাহার সঙ্গ গ্রহণ করিয়াছে; অন্য কোন স্ত্রীলোক খুন হইয়া থাকিবে| তাহার পর যখন ফরিদপুরে গিয়া দেখিলাম, তখন বুঝিতে পারিলাম, মেহেদী-বাগানে আমার স্ত্রীই খুন হইয়াছে, কিন্তু কে খুন করিয়াছে-তাহার সম্বন্ধে আমি বিন্দু-বিসর্গ জানি না|”
চোখে মুখে পরিহাসের হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন| এরূপভাবে এখন কথাটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে আপনার এ কথা কে এখন বিশ্বাস করিবে?”
ভীত হইয়া মুন্সী সাহেব কহিলেন, “তাহা হইলে তুমি এখন আমাকেই হত্যাকারী বলিয়া ধরাইয়া দিতে চাও নাকি?”
মোবারক কহিল, “যদি আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হ’ন কাজেই আমাকে তাহা করিতে হইবে|”
মু| কি প্রস্তাব?
মো| পূর্ব্বেই বলিয়াছি-জোহেরাকে আমার সহিত বিবাহ দিতে হইবে|
মু| জোহেরা যদি তোমাকে বিবাহ করিতে না চায়, আমি তো তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিয়া কোন কাজ করিতে পারি না|
মো| অবশ্য আপনি তাহা পারেন-আপনি তাহার একমাত্র অভিভাবক|
মু| আমি কিছুতেই পারিব না|
মো| না পাড়েন – বিপদে পড়িবেন|
মু| কি বিপদ্?
“সহজ বিপদ্ নহে-ফাঁসী-কাঠে ঝুলিতে হইবে,” বলিয়া মোবারক অত্যন্ত কঠিনভাবে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন| মুন্সী সাহেবও ভীতি-বিস্ফারিতনেত্রে মোবারকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন| কাহারও মুখে কথা নাই| পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে যাঁহারা রহস্যোদ্ভেদের অপেক্ষায় ছিলেন, মোবারকের শেষ কথায় তাঁহাদেরও হৃদয় স্তম্ভিত হইয়া গেল|
কিয়ৎক্ষণ গভীর চিন্তার পর মুন্সী সাহেবই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন| দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “তুমি যাহা মনে করিয়াছ, কিছুতেই তাহা হইবে না-আমি তোমার প্রস্তাব ঘৃণার সহিত অগ্রাহ্য করিলাম|”
মোবারক মুন্সী সাহেবের মুখের সম্মুখে ঘন ঘন তর্জ্জনী অঙ্গুলিটা কম্পিত করিয়া কহিল, “স্মরণে থাকে যেন, ইহার শেষ-ফল বড় ভয়ানক হইবে|”
মুন্সী সাহেব দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “যেমনই ভয়ানক হউক না কেন, আমি সেজন্য প্রস্তুত আছি|”
মোবারক ক্ষণেক কি ভাবিল| ভাবিয়া বলিল, “আপনার মাথার উপরে এমন একটা ভয়ানক বিপদ্; তথাপি যে আপনি এমন সময়ে কেন এমন করিতেছেন, বুঝিতে পরিলাম না| আপনার মনে কি ভয় হইতেছে না? ইহার কারণ কি?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কারণ-প্রথমতঃ আমি খুন করি নাই| দ্বিতীয়তঃ এই বিষাক্ত তীরের ফলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না| তুমিই আমাকে বিপদে ফেলিবার জন্য ইহা এইখানে রাখিয়াছ| নিশ্চয়ই এ সকল ষড়্যন্ত্র- তোমার|”
মোবারক কহিল, “যে কারণে হউক না কেন, আপনি নির্দ্দোষ হইলেও আপনার আর রক্ষার উপায় নাই| ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কাজ করিবেন| এখন আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে ক্ষতি কি-আপনি ত আমার হাতে| আপনাকে এই হত্যাকাণ্ডে জড়াইয়া বিপদে ফেলিবার জন্য আমিই এই তীরের ফলাটা আপনার গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে রাখিয়াছিলাম|”
সেই তীরের ফলাটা উদ্যত করিয়া মুন্সী সাহেব ক্রোধভরে মোবারকের দিকে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “বদ্বখ্ত| তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ|”
হাত হইতে তীরের ফলাটা কাড়িয়া লইয়া মোবারক কহিল, “আপনার স্ত্রীকে আমি খুন করিয়াছি, এমন কথা ত আমি আপনাকে বলি নাই| প্রকৃত ব্যাপার যাহা ঘটিয়াছে, আমার কাছে এখন শুনুন, তাহার পর আপনি যাহা বলিতে হয়, বলিবেন| আপনি যখন আপনার স্ত্রীকে অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানে গিয়াছিলেন, তখন আমিও আপনাদের অনুসরণ করিয়াছিলাম| আপনার স্ত্রী যে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে রাত্রিতে গৃহত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমিও শুনিয়াছিলাম| ব্যাপারে কি ঘটে দেখিবার জন্য আপনার ন্যায় আমিও মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে গোপনে অপেক্ষা করিতেছিলাম| আপনি মেহেদী-বাগানে আপনার স্ত্রীকে খুঁজিয়া না পাইয়া, ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু আমার সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল| আমি তখন তাহার নিকট হইতে এই সকল গুপ্ত-চিঠি ফেরৎ চাই; তাহাতে সে আপনার ঐ গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতর ঐ চিঠিগুলা পাওয়া যাইবে বলে, আর গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশলও আমাকে বলিয়া দেয়| তাহার পর সেদিন আপনার সহিত দেখা করিতে আসিলাম, তখন এখানে আর কেহই ছিল না| আমি এই চিঠিগুলির জন্য আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া ফেলিলাম, কিন্তু ইহার ভিতরে চিঠি-পত্র দেখিতে পাইলাম না|”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না পাইবার কথা-এই চিঠিগুলা আমি গুপ্তড্রয়ার হইতে বাহির করিয়া অন্যস্থানে রাখিয়াছিলাম|” মোবারক কহিল, “হাঁ, এখন আমি তাহা জানিতে পারিয়াছি| যাহা হউক, চিঠির পরিবর্ত্তে আমি আপনার গুপ্ত-ড্রয়রের মধ্যে এই কণ্ঠহার ছড়াটা দেখিতে পাইলাম| আমি সেদিন খুনের রাত্রিতে আপনাকে আপনার স্ত্রীর নিকট হইতে ইহা কাড়িয়া লইতে দেখিয়াছিলাম| আমার আরও সুবিধা হইল; জোহেরাকে বিবাহ করিতে হইলে আগে আপনাকে হাতে রাখা দরকার মনে করিয়া, আমিই এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা এই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া দিয়াছিলাম| এখন আমার সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হইয়াছে-আপনাকে বাধ্য হইয়া এখন আমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইবে-সকল বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতে হইবে|”
মহা খাপ্পা হইয়া সাহেব গর্জ্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সয়তান! তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ নিশ্চয়ই-আর কেহ নহে-এখন আর অস্বীকার করিলে চলিবে না| আমি তোমার মুখ-চোখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| আমি এখনই তোমাকে পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিব-ফাঁসী-কাঠে ঝুলাইয়া তবে ছাড়িব|”
মোবারক কহিল, “বাঃ! আপনি যে পাগলের মত কথা বলিতেছেন! এখন যদি আপনি আমার বিরুদ্ধে কোন কথা কাহাকেও বলেন, কেহই আপনার কথা বিশ্বাস করিবে না| লাভের মধ্যে নিজেকে আরও জড়াইয়া ফেলিবেন| যদিও আমি দোষী, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এমন একটাও প্রমাণ নাই, যাহাতে আপনি আমাকে খুনী সাব্যস্ত করিতে পারেন|”
আরও রাগিয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “আর কোন প্রমাণের আবশ্যকতা নাই-তুমি নিজমুখে এইমাত্র খুন স্বীকার করিলে|”
মোবারক কহিল, “ইহাকে খুন স্বীকার করা বলে না-আপনার নিকটে যাহা বলিলাম, সাধারণের নিকটে তাহা আমি একেবারে উড়াইয়া দিব-দুঃখের বিষয়, আপনার একজনও সাক্ষী নাই|”
সাক্ষী নাই কি-মিথ্যাকথা! এই পাশের ঘরে তিনজন সাক্ষী বিদ্যমান, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বাহির হইয়া আসিলেন| তাঁহার পশ্চাতে-উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা|
৫.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিজের বিষে
মোবারক ভয় পাইয়া একটা অব্যক্ত চীৎকার করিয়া উঠিল| মুন্সী সাহেব স্তম্ভিত হইয়া গেলেন| রাগে, দুঃখে, বিস্ময়ে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল| মোবারক সমূহ বিপদ্ দেখিয়া পলাইবার উপক্রম করিল – ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য দ্বারের দিকে সবেগে ছুটিয়া গেল| মুন্সী সাহেব ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মত তাহার উপরে লাফাইয়া পড়িলেন; এবং দুই হাতে তাহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া ধরিলেন| মোবারক তাঁহাকে এক ধাক্কা দিয়া, সবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার ললাটপার্শ্বে এক প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিল, মুন্সী সাহেব সে দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না|-তখনই মৃতবৎ ধরাশায়ী হইলেন| ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে জোহেরাও সংজ্ঞা হারাইল, টলিতে টলিতে মাটিতে পাড়িয়া যাইবার উপক্রম করিল; পার্শ্বে বৃদ্ধা হরিপ্রসন্ন বাবু ছিলেন, তিনি জোহেরাকে ধরিয়া ফেলিলেন| দেবেন্দ্রবিজয়ও এতক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না; মুন্সী সাহেবকে মুষ্ট্যাঘাত করিতে দেখিয়া তিনি পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া মোবারকের দিকে ছুটিয়া গেলেন| মোবারক দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে সেই তীরের ফলাটা দক্ষিণ হস্তে উদ্যত করিয়া নিকটস্থ একখনা চেয়ারে বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় মোবারকের মস্তক লক্ষ্যে পিস্তলটা উদ্যত করিয়া কহিলেন, “এক পা নড়িলে এই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথার খুলি উড়াইয়া দিব| নারকি, সাবধান! উঠিবার চেষ্টা করিলেই মরিবে-কিছুতেই আমাদের হাত হইতে আর পলাইতে পারিবে না|”
“আর কি-আর উপায় নাই!” বলিয়া মোবারক একান্ত হতাশভাবে সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা ভূতলে নিক্ষেপ করিল| কহিল, “দেবেন্দ্রবিজয়! আমি নিশ্চয়ই পলাইব! তুমি কি মনে করিয়াছ, মোবারককে আর ধরিয়া রাখিতে পারিবে? কখনও তাহা পারিবে না| কিছুতেই না|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত কঠিন কণ্ঠে কহিলেন, “তোমাকে শীঘ্রই ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলিতে হইবে-সহজে পরিত্রাণ পাইবে না|”
ভ্রুভঙ্গি করিয়া, পৈঁশাচিক হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “ভুল-ভুল-একান্ত ভুল| আর তোমরা কেহই মোবারককে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাইতে পারিবে না| মোবারক তোমাদের হাত ছাড়াইয়া এখন অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছে-সে আর এখন কাহাকেও কিছুমাত্র ভয় করিবার পাত্র নহে| এই দেখিতেছ না-এ কি হইয়াছে?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিসম্মুখে বাম হস্ত প্রসারিত করিয়া দিল| দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মোবারকের হাত কাটিয়া গিয়া রক্ত ঝরিতেছে|
মোবারক বলিল, “যখন মুন্সী সাহেব আমাকে অক্রমণ করেন, সেই সময়ে অসাবধানে আমি ঐ বিষাক্ত তীরের ফলাতে নিজের হাত কাটিয়া ফেলিয়াছি আর পনের মিনিট – পনের মিনিট পরে আমাকে পাইবে না-সকলই ফুরাইবে| আমি মরিব| আর কেহই আমাকে রাখিতে পারিবে না-এ বিষ একেবারে অব্যর্থ|”
দেবেন্দ্রবিজয় ক্ষুব্ধভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি আপদ্! সব মাটি হইল|”
“একেবারে মাটি! সেজন্য আর অনর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া ফল কি?” বলিতে বলিতে মোবারক চেয়ার ছাড়িয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল| ক্ষণপরে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, “আমাকে ধরিয়া ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলাইতে পারিলেই কি দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি কৃতার্থ হইতে? আর তাহাতেই বা তোমার কি এমন বাহাদুরি প্রকাশ পাইত? তোমার বাহাদুরি আমি বেশ জানিয়াছি-এতদিন কেবল অন্ধের ন্যায় হাতড়াইয়া ঘুরিয়াছ বৈ ত নয়-বুদ্ধির কাজটা করিয়াছ কি? কিছুই ত দেখিতে পাই না| প্রথমে তুমি মজিদ খাঁকে সন্দেহ কর, তাহার পর মনিরুদ্দীনকে-দিলজানকে-শেষে মুন্সী সাহেবকে একে একে সকলকেই তুমি খুনী মনে করিয়াছ – তখন কাজেই শ – | তোমার গোয়েন্দা-গিরিটা অনেকটা সেই রকমের দেখিতে পাই| তোমার চোখে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আমি কিরূপভাবে নিজের কার্য্যোদ্ধার করিয়া আসিতেছিলাম-একবার মনে ভাবিয়া দেখ দেখি| খুনী বলিয়া কি একবারও আমর উপরে সন্দেহ করিতে পারিয়াছিলে-দৈব এমন প্রতিকূল না হইলে সাধ্য কি তোমার-দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি আমাকে ধরিতে পার? তোমাকে আমি পদে পদে বোকা বানাইয়া নিজের কাজ হাসিল করিয়াছি; আমি সকল সময়েই তোমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি-চোখ থাকিতে তুমি অন্ধ-আমাকে দেখিতে পাও নাই| আমিই তোমাকে কয়েকখানা পত্র লিখিয়া সতর্ক করিয়াছিলাম| একদিন রাত্রিতে গলিপথে আমার হাতে তোমার কি দুর্দ্দশা হইয়াছিল, মনে পড়ে কি? কেবল দয়া করিয়াই সেদিন তোমার জীবনটা একেবারে শেষ করিয়া দিই নাই| এখন বুঝিতেছি তোমাকে সেরূপ দয়া করাটা ভাল হয় নাই| সেইদিনই এই পৃথিবী হইতে তোমাকে একেবারে বিদায় করিয়া দিলেই ভাল হইত| তোমার মত একজন নামজাদা ডিটেক্টিভকে এরূপভাবে এ পর্য্যন্ত বোকা বানাইয়া রাখা, যে-সে লোকের কাজ নহে-বড় সহজ কাজও নহে; কিন্তু আমি কত সহজে তাহা করিয়াছি, ভাবিয়া দেখ দেখি; ভাবিয়া দেখ দেখি, কাহার বাহাদুরি বেশি! যদিও আমি এখন দৈব-দুর্ব্বিপাকে তোমার হাতে ধরা পড়িয়াছি-কিন্তু তুমি সহস্র চেষ্টাতেও আর আমাকে ধরিয়া রাখিতে পারিবে না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তুমি মহাপাপী-তোমার পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়াছে| সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এখনও নিজের মুখে নিজের পাপ স্বীকার কর| তোমার অপরাধে মজিদ খাঁ এখনও বন্দী হইয়া রহিয়াছে| দেখি, এ সময়ে একজন ডাক্তারকে আনিলে যদি কিছু সুবিধা হয়|” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
মোবারক হাত নাড়িয়া নিষেধ করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, “ডাক্তার ডাকিয়া কোন ফল নাই| আমি যাহা করিয়াছি-সমুদয় বলিতেছি, একখানা কাগজে তোমরা লিখিয়া লও-লিখিয়া শেষ করা পর্য্যন্ত যদি বাঁচি-লিখিবার শক্তি থাকে, আমি তাহাতে নিজের নাম সহি করিয়াও দিব|”
ইতিপূর্ব্বে জোহেরা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছিল| হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া টেবিলের উপর হইতে কাগজ কলম টানিয়া লইয়া বলিলেন, “আমিই লিখিয়া লইতেছি|”
৫.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – নিজে মরিল
মোবারক গৃহতলে পড়িয়া, অর্দ্ধমুদিতনেত্রে ক্ষীণকণ্ঠে নিজের পাপকাহিনী বলিতে লাগিল,- “ইদানীং আমি অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপালে থাকিতাম| কিছুদিনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছিলাম| নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্ব্বতমালায় কাওয়াল জাতি বাস করে| কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত সুন্দরী; কিন্তু তাহাদিগের স্বভাব অত্যন্ত কলুষিত-সকলেই স্বেচ্ছাচারিণী-সতীত্ব বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা তাহারা জানে না| আমি একটু অবসর পাইলেই তাহাদের সঙ্গে গিয়া মিশিতাম| তাহাদের মধ্যে মানিয়া নাম্নী কোন রমণীর সহিত আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়| কিছুদিন পরেই মনিয়ার মৃত্যু হয়- সেই মানিয়ার কাছেই আমি এই তীরের ফলাটা পাইয়াছিলাম| তাহার মুখে শুনিয়াছি, কাওয়াল জতিরা এই তীরের ফলা তৈয়ারী করিয়া পক্ষাধিক কাল কোন একটা বিষাক্ত গাছে বিদ্ধ করিয়া রাখিয়া দেয়| তাহাতে সেই তীরের ফলা এমনই বিষাক্ত হয় যে, তাহার একটু আঁচড়ে দেহস্থ সমুদয় রক্ত বিষাক্ত হইয়া উঠে; অতি অল্পক্ষণে প্রাণ বহির হইয়া যায়| কাওয়াল জাতিরা হিংস্র প্রাণী শিকারে এই তীরের ফলা ব্যবহার করিয়া থাকে| নেপাল হইতে আসিবার সময়ে এই তীরের ফলা আমিই সঙ্গে আনিয়াছিলাম| নেপালে আমি অনেকদিন ছিলাম| তাহার পূর্ব্বে আমি খিদিরপুরে থাকিতাম| খিদিরপুরে সৃজান বিবির পিত্রালয়| আমি সৃজানকে প্রাণের অধিক ভালবাসিতাম| সৃজানও আমাকে ভালবাসিত-তখন মুন্সী সাহেবের সহিত তাহার বিবাহ হয় নাই| আমার মনে ধারণা ছিল, পরে আমার সহিত নিশ্চয়ই সৃজানের বিবাহ হইবে| কিছুদিন পরে সহসা সৃজানের মনের পরিবর্ত্তন ঘটিল-সৃজানের ভালবাসা ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল| বিষয়-ঐশ্বর্য্যে, ধন-দৌলতের উপরেই তাহার অনুরাগটা বেশি প্রকাশ পাইতে লাগিল| সে আমাকে বিবাহ করিতে চাহিল না-উপেক্ষাও করিল না-প্রকারান্তরে আমাকে হাতে রাখিল| ইচ্ছা, যদি একান্তই কোন ধনবান্ জমিদার, আমীর-ওম্রাও না জুটে, তখন সে আমাকে বিবাহ করিবে| এই সময়ে আমাকে অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় নেপাল যাইতে হয়| কিছুকাল পরে সেখান হইতে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, মুন্সী সাহেবের সহিত সৃজানের বিবাহ হইয়া গিয়াছে| আমি একদিন সৃজানের সহিত গোপনে দেখা করিলাম| এই প্রবঞ্চনার জন্য আমি তাহাকে অনেক কটূক্তি করিলাম-সে সকলই হাসিয়া উড়াইয়া দিতে লাগিল| ক্রমেজানিতে পারিলাম, সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগের চেষ্টায় আছে| আমাকে ছাড়িয়া সৃজান মনিরুদ্দীনের অঙ্কশোভিনী হইবে, ইহা আমার একান্ত অসহ্য হইল; মনে মনে স্থির করিলাম, প্রাণ থাকিতে কখনই তাহা ঘটিতে দিব না| আমাকে এতদিন আশা দিয়া আজ যে, সে হঠাৎ এরূপভাবে নিরাশ করিবে, এতদিন ভালবাসা জানাইয়া আজ যে সে হঠাৎ এরূপভাবে আমাকে উপেক্ষা করিবে, ইহা আমার পক্ষে একান্তই অসহ্য! আমাকে ঘৃণা করিয়া, মনিরুদ্দীনকে লইয়া সে সুখী হইবে, আর আমি দীননেত্রে তাহার সুখ-সৌভাগ্যের দিকে চাহিয়া থাকিব-তাহা কখনই হইতে দিব না| মনে মনে স্থির করিলাম, গোপনে সৃজানের সহিত একবার দেখা করিয়া যাহাতে সে এ সঙ্কল্প ত্যাগ করে, সেজন্য বুঝাইয়া বলিব| যদি সে তাহাতে অন্যমত করে, তাহা হইলে তাহাকে এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সাহায্যে খুন করিতেও কুণ্ঠিত হইব না| তাহার পর হঠাৎ একদিন জানিতে পারিলাম যে, সেদিন রাত্রিতেই সে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবে| আমিও রাত্রি দশটার পর বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম| প্রথমে মুন্সী সাহেবের বাড়ীতে গিয়া গোপনে সন্ধান লইলাম যে, সৃজান রাজাব-আলির বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছে| সেখান হইতে ফিরিয়া আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে আসিলাম| সেখান গোপনে সন্ধান লইয়া জানিতে পারিলাম, মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই| মনে বড় সন্দেহ হইল, সৃজান নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবার অজুহাতে বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছে-মনিরুদ্দীনও বাড়ীতে নাই; অবশ্যই ভিতরে ভিতরে উভয়ে পলাইবার একটা কিছু বন্দোবস্ত করিয়াছে| রাগে দ্বেষে আমার সর্ব্বঙ্গ জ্বলিয়া যাইতে লাগিল|স্থির করিলাম, যদি সহজ উপায়ে কার্য্যসিদ্ধ না হয়, দুইজনকেই খুন করিব| পুনরায় বাসায় ফিরিয়া আসিলাম| বিষাক্ত তীরের ফলাটা পকেট লইয়া আবার মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম| মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে আসিয়া দূর হইতে মুন্সী সাহেবকে সেখানে দেখিতে পাইলাম| কি আশ্চর্য্য! এমন সময়ে মুন্সী সাহেব এরূপভাবে এখানে দাঁড়াইয়া কেন? কিছুই বুঝিতে পারিলাম না| তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তিনি যেন কাহার অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়াইয়া আছেন| তিনি আমাকে দেখিতে পান্ নাই; আমিও তাঁহার সহিত তখন দেখা করা যুক্তিযুক্ত বোধ করিলাম না| মনে অত্যন্ত কৌতূহল উপস্থিত হইল; কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে লুকাইয়া রহিলাম| এমন সময় মনিরুদ্দীনের বাড়ীর ভিতর হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে একটি স্ত্রীলোক ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল| দ্বারের উপরে লণ্ঠন জ্বলিতেছিল, তাহারই আলোক চকিতে একবারমাত্র আমি তাহার মুখখানি দেখিতে পাইলাম-দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম-সে সুন্দরী সৃজান| সৃজানকে বাহির হইতে দেখিয়াই মুন্সী সাহেব ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল| এবং তাহাকে টানিয়া একটু তফাতে পথিপার্শ্বস্থ একটা অলোকস্তম্ভের নিম্নে গিয়া দাঁড়াইল| মুন্সী সাহেব তাহাকে হাত মুখ নাড়িয়া কি বলিতে লাগিলেন| দুই-একটা কথা আমি শুনিতে পাইলাম, ভাল বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু ভাবভঙ্গিতে খুব রাগের লক্ষণ দেখা গেল| সৃজান একবার মাত্র চীৎকার করিয়া উঠিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া গেল| মুন্সী সাহেবও তাহার পশ্চাতে ছুটিয়া গেলেন| পরে আরও কি ঘটে দেখিবার জন্য আমি দ্রুতপদে মেহেদী-বাগানের দিকে চলিলাম| মেহেদী-বাগানে আসিয়া প্রথমে তাহাদের দুইজনের কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না| পরে একটা গলির ভিতর হইতে সৃজানকে বাহির হইতে দেখিলাম| আমি তখনই ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলাম| সে অন্ধকারে প্রথমে আমাকে চিনিতে না পারিয়া, চমকিত হইয়া হাত ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করিল| তাহার পর চিনিতে পারিয়াও সে আমাকে অনেক কটূক্তি করিতে লাগিল| আমি ধীরভাবে তাহা শুনিয়া গেলাম-তাহার কথায় রাগ করিলাম না| মনিরুদ্দীনকে ছাড়িয়া সে যাহাতে আবার আমার হয়, সেজন্য তাহাকে অনেক বুঝাইতে লাগিলাম| আমি তাহাকে তখনই বালিগঞ্জে আমার বাসায় লইয়া যাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলাম| বলিলাম, ‘দেখ সৃজান, তুমি কিছুতেই আমার হাত হইতে অব্যাহতি পাইবে না| আমার সঙ্গে তোমাকে আমার বাসায় যাইতে হইবে| তাহার পর রাত্রিশেষে তোমায় আমায় একদিকে চলিয়া যাইব| এখন তোমার আর গৃহে ফিরিবার কোন উপায়ই নাই; মুন্সী সাহেব স্বচক্ষে তোমাকে মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইতে দেখিয়াছেন-তিনি নিশ্চয়ই এখন তোমাকে হত্যা করিবেন| আমি এতদিন তোমার আশাপথ চাহিয়া আছি-আর আজ যে তুমি এমন কঠিনভাবে আমাকে একেবারে নিরাশ করিবে, কিছুতেই তাহা হইবে না|’ অনেক সাধ্য-সাধনার পর সৃজান আমার সহিত যাইতে সম্মত হইল| তখন সম্মত হইতে দেখিয়া আমি সেই প্রেম-পত্রগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম| এই পত্রগুলি আমি অনেকদিন পূর্ব্বে-যখন সৃজানের বিবাহ হয় নাই-তখন লিখিয়াছিলাম| সৃজানকে বলিলাম, এই সকল পত্র যদি পরে কখনও কাহারও হাতে পড়ে, তাহা হইলে সকলই প্রকাশ হইয়া পড়িবে! সকলেই জানিতে পারিবে, তুমি আমার সহিত গিয়াছ; কিন্তু দুই-চারিদিনের মধ্যে কোন রকমে যদি এই পত্রগুলি বাহির করিয়া আনিতে পারা যায়-তাহা হইলে আমাদের আর সে ভয় থাকে না| তাহাতে সৃজান এই পত্রগুলি যেখানে যেরূপভাবে রাখিয়াছিল, বলিল| গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশল আমাকে বলিয়া দিল| আমি তাহাকে মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথ দিয়া নিজের বাসার দিকে লইয়া চলিলাম| কিছুদূর গিয়াই সৃজানের মত আবার ফিরিয়া গেল-সে আমার সহিত আর যাইতে চাহিল ন| আমার মুখের উপরেই আমাকে সে ঘৃণার সহিত বলিল, আমি তাহার যোগ্য নই-সে সর্ব্বান্তঃকরণে মনিরুদ্দীনকেই ভালবাসে| শুনিয়া দারুণ ঈর্ষায় আমার আপাদমস্তক জ্বলিয়া গেল-মুখে রাগের ভাব কিছু প্রকাশ করিলাম না-তাহাকে খুন করিতে প্রস্তুত হইযা বলিলাম, ‘সৃজান, তুমি আমাকে ত্যাগ করিলেও আমি কিন্তু তোমাকে এ জীবনে ভুলিব না| যদি একান্তই আমি এখন তোমর অযোগ্য হইয়া থাকি, যদি একান্তই তুমি আমাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করিবে, এরূপ কঠিনভাবে উপেক্ষার সহিত আমাকে ত্যাগ করিয়ো না, আমার মর্ম্মভেদ করিয়ো না; তাহা আমার অসহ্য হইবে| আজ একবার হাসিমুখে শেষবার তোমার ঐ মুখখানি চুম্বন করিতে দাও- বহুদিনের তৃষিত আমি, চিরবিদায়ের আজ শেষ প্রেমালিঙ্গন, সৃজান, আর আমি তোমাকে কখনও বিরক্ত করিতে আসিব না|’ বলিয়া তাহাকে বুকে লইয়া মুখচুম্বন করিলাম; সেই ব্যাকুলতার সময়ে আমি অলক্ষ্যে তাহার গলদেশে বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া একটা আঁচড় লাগাইয়া দিলাম| সে তাহার কিছুই জনিতে পারিল না| ক্রমে যখন তাহার সর্ব্বাঙ্গ একেবারে অবসন্ন হইয়া আসিল, তখন আমি তাহাকে প্রকৃত যাহা ঘটিয়াছে প্রকাশ করিলাম| বলিলাম, ‘সৃজান, এখনই তুমি মরিবে-আর তোমার রক্ষার উপায় নাই, বড় ভয়ানক বিষ| কি ভ্রম! মোবারক বাঁচিয়া থাকিতে তুমি অন্যের উপভোগ্য হইবে, মনে করিয়াছিলে!’ সৃজান কোন উত্তর করিল না- তখন তাহার কণ্ঠস্বরও অতি ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে-কি বলিতে চেষ্টা করিল, স্পষ্ট বলিতে পারিল না-অনতিবিলম্বে তাহার মৃত্যু হইল| আমিও তখন আত্মরক্ষার একটা উপায় উদ্ভাবন করিয়া ফেলিলাম| তাহার মৃতদেহ পথের উপর হইতে তুলিয়া লইয়া যাহাতে সহজে কহারও নজর না পড়ে, এরূপভাবে একটা গাছের আড়ালে রাখিয়া দিলাম| তখনই আমি রাজাব-আলির বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম; সেখানে সেদিন আমারও নিমন্ত্রণ ছিল| পরে কোন রকমে আমার উপরে সন্দেহের কোন কারণ উপস্থিত হইলেও নিজেকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে পারিব মনে করিয়া আমি সেখানে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত রহিলাম| রাত দুইটার পর রাজাব-আলির বাড়ী হইতে বাহির হইলাম| মাথায় আর একটা মতলব আসিয়া উপস্থিত হইল| আমি আবার মেহেদী-বাগানের দিকে গেলাম-সেখানে পথ দেখাইবার অজুহাতে একজন পাহারাওয়ালাকে সঙ্গে লইলাম; তাহাকে কিছুদূর গিয়া ছাড়িয়া দিলাম| যে গাছতলায় সৃজানের দেহ মৃতদেহ রাখিয়াছিলাম, সেখানে গিয়া দেখিলাম, যেমনভাবে সৃজানকে ফেলিয়া গিয়াছিলাম, তখনও ঠিক সেইভাবে পড়িয়া রহিয়াছে-হাত পা অত্যন্ত কঠিন হইয়া গিয়াছে| তখনও সেই মৃতদেহ কহারও নজরে পড়ে নাই| আমি তখনই মৃতদেহ সেখান হইতে তুলিয়া আনিয়া গলিপথের মাঝখানে ফেলিয়া সেই পাহারাওয়ালাকে ডাকিতে লাগিলাম| সে আবার ছুটিয়া আসিল-পরে আরও দুই-তিনজন পাহারাওয়ালা আসিয়া জুটিল-আমি তাহাদের হাতে সৃজানের মৃতদেহ তুলিয়া নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরিয়া আসিলাম| তাহার পর যাহা, ঘটিয়াছে, সকলই আপনার জানেন| পরে এই সকল চিঠি হইতে এই খুনের সম্বন্ধে আমার উপরে কোন কারণ উপস্থিত না হয়, সেজন্য একদিন আমি এই চিঠিগুলার সন্ধানে মুন্সী সাহেবের সঙ্গে সেখা করিতে আসি| মুন্সী সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; আমি এই ঘরে একাকী বসিয়া তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম; সেই সুযোগে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলাম; কিন্তু তাহার ভিতরে চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম না; কেবলমাত্র একছড়া কণ্ঠহার ছিল| খুনের রাতে মুন্সী সাহেব যাহা করিয়াছিলেন, আমি সমস্তই জানিতাম; ইহাতে সহজেই তাঁহার ঘাড়ে দোষ চাপাইতে পারা যাইবে মনে করিয়া, আমি সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা সেই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া গুপ্ত-ড্রয়ারটা পূর্ব্ববৎ বন্ধ করিলাম|” এই পর্য্যন্ত বলিয়া মোবারক চুপ্ করিল| তাহার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ ভগ্ন হইয়া আসিয়াছিল-বলিতে বলিতে কথা অনেকবার জড়াইয়া যাইতেছিল| মোবারক যাহা বলিল, হরিপ্রসন্ন বাবু একখানি কাগজে তাহা লিখিয়া লইয়াছিলেন| মোবারকের মৃত্যু সন্নিকটবর্ত্তী দেখিয়া তিনি তাড়াতড়ি উঠিয়া এক কলম কালি লইয়া, মোবারকের হাতে দিয়া সেই কাগজখানায় একটা নাম সহি করিতে বলিলেন| অতি কষ্টে মোবারক নিজের নাম সহি করিল| তাহার ইসাদীর স্থলে দেবেন্দ্রবিজয়, হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা নিজ নিজ নাম সহি করিলেন| এবং দেবেন্দ্রবিজয় একটা লম্বা খামের মধ্যে সেই কাগজখানা ভাঁজ করিয়া পুরিয়া ফেলিলেন| এদিকে মোবারকের দেহ ক্রমশঃ অবসন্ন ও অবশ হইয়া আসিতে লাগিল| ঘন ঘন শ্বাস বহিতে আরম্ভ হইল| স্বপ্নাবিষ্টের জড়িত ভগ্নকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “পাপের পরিণাম কি ভয়ানক! কি মনে-করে এখানে-আসিলাম, কি হইল? কোথায়-জোহেরাকে-বিবাহ-করিব, না-নিজের-বিষে-নিজে-মরি-লা-ম| বিষ-বিষ-বড়-জ্বালা-অসহ্য-স-র্ব্বাঙ্গ-জ্ব’-লে-গে-ল-পুড়ে-গেল| এই-বিষে-এক-দিন-সৃজান-জ্বলিয়া-পুড়িয়া-মরি-য়াছে| কোথায়-যাই-তেছি-কত-দূরে, জা-হা-ন্নমে-না-না-ঐ-যে-জোহেরা,-না-জোহে-রা-নয়-সৃজান-পিশাচী-সৃ-জা-ন-আর-না-আ-মি-আ-র-উঃ- ”
মোবারকের মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না| ধীরে ধীরে তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল; যেন হতভাগ্য নিদ্রিত হইল| দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এ জগতে ইহা শেষ নিদ্রা-এ নিদ্রা যখন ভাঙিবে, তখন সে আর এক নূতন জগতে গিয়া উপস্থিত হইবে|
৫.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শেষ
মোবারকের মৃত্যুর পরদিন প্রাতেই দেবেন্দ্রবিজয় সহর্ষমুখে বৃদ্ধ অরিন্দম বাবুর বাসায় উপস্থিত হইলেন| বগলে অরিন্দম-প্রদত্ত সেই বাক্স|
অরিন্দম বাবু তঁহাকে আনন্দোৎফুল্ল দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে, কার্য্যোদ্ধার হইল?”
দে| হইয়াছে|
অ| খুনী ধরা পড়িয়াছে?
দে| ধরা পড়িয়াও সে পলাইয়া গিয়াছে-সে আর ধরা পড়িবে না|
অ| কেন-মরিয়াছে না কি?
দে| হাঁ|
অ| খুনী কে?
দে| মোবারক!
অ| (সবিস্ময়ে) মোবারক! কিরূপে জানিতে পারিলে মোবারক খুনী?
দেবেন্দ্রবিজয় তখন আনুপূর্ব্বিক সমুদয় ঘটনা অরিন্দম বাবুকে বলিলেন| শুনিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত! কপ্লিত গল্পের অপেক্ষা এক-একটা সত্য ঘটনা অধিকতর বিস্ময়কর হইয়া দাঁড়ায়|
যাহ হউক, মোবারক শেষে হত্যাকরীতে পরিণত হইল, দেখিতেছি|”
দে| হাঁ, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যপার! মোবারককে আমি একবারও সন্দেহ করি নাই|
অ| আশ্চর্য্য ব্যাপার আর কি, মোবারককে সন্দেহ না করাই তোমার অন্যায় হইয়াছে|
দে| কিন্তু তাহাকে সন্দেহ করিবার কোন সূত্র এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই|
অরিন্দম একটু উষ্ণভাবে বলিলেন, “অন্ধ তুমি! অনেক সূত্র ছিল| তুমি দেখিয়াও দেখ নাই-সেজন্য চেষ্টাও কর নই| ঘটনাস্রোতে, তোমাকে যখন যেদিকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে, তুমি তখনই সেইদিকে ভাসিয়া গিয়াছ| ইহা তোমার একটা মহৎ দোষ| এখন হইতে সর্ব্বাগ্রে ইহার সংশোধনের চেষ্টা করিবে| এই দেখ, আমি তোমাকে এমন একটা সূত্র বলিয়া দিই, যাহাতে তুমি অবশ্য প্রথম হইতেই মোবারকের উপর সন্দেহ করিতে পারিতে| তোমার মুখেই শুনিয়াছি, ডাক্তার লাস পরীক্ষা করিয়া রাত বারটার সময়ে মৃত্যুকাল নির্দ্ধারণ করেন| তাহা হইলে রাত বারটা হইতে মৃতদেহটা সেই গলির ভিতরেই পড়িয়াছিল| রাত দুইটার পর মোবারক গিয়া প্রথমে সেই মৃতদেহ দেখিতে পায়| রাত বারটা হইতে দুইটার মধ্যে আর কেহ সে পথে যায় নাই, ইহা কি সম্ভব? অবশ্যই এই সময়ের আরও দুই-চারিজন সেই গলিপথে যাতায়াত করিয়া থাকিবে| সেই মৃতদেহ আর কাহারও চোখে না পড়িয়া তেমন কুয়াশার অন্ধকারে একেবারে মোবারকের চোখে যে পড়িল-ইহার অর্থ কি? এইখানেই কেমন একটু গোলযোগ ঠেকিতেছে না? তাহার পর আরও দেখ, মোবারক মজিদ খাঁকে ঐ গলির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল| তখন মোবারক মজিদ খাঁর যে ভাব দেখিয়াছিল, সে ভাবে মজিদ খাঁকে খুনী বুঝায় কি? কিছুতেই নয়| যদি মজিদ খাঁ নিজে খুনী হইত, সে মোবারকের সহিত অন্যরূপ ব্যবহার করিত| হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে মোবারক তখন কিছু না জানিতে পারে, সেইজন্য মজিদ খাঁ কি মোবারককে সেই গলিপথে না যাইতে দিয়া প্রকারান্তরে তাহাকে অন্যদিকে কি নিজের বাসাতে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিত না? এরূপ স্থলে অতি নির্ব্বোধেরও মাথায় এ বুদ্ধি যোগায়; কিন্তু মজিদ খাঁ প্রকৃত খুনী নহে, সেজন্য সে এরূপ কোন চেষ্টাও করে নাই| আর মজিদ খাঁ সেই গলির মধ্যে যদি এরূপভাবে অরক্ষিত অবস্থায় স্ত্রীলোকের একটা লাস পড়িয়া থাকিতে দেখিত, তাহা হইলে সে অবশ্যই সে কথা মোবারকের নিকটে প্রকাশ করিত|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কিন্তু মজিদ খাঁ যদি ভয়ে সে কথা প্রকাশ না করিয়া থাকে?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ইহাতে ভয়ের বিশেষ কারণ কি? যদি ভয়ের কোন কারণ থাকিত, তাহা হইলেও মজিদ খাঁ মোবারক যাহাতে তখন সে গলির ভিতরে না যায়, সেজন্য কোন উপায় অবলম্বন করিত; কিন্তু মজিদ সেজন্য চেষ্টামাত্রও করে নাই| ইহাতে বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে, মজিদ খাঁ গলির ভিতরে সেই মৃতদেহ দেখে নাই, অথচ ঠিক পথের উপরে মৃতদেহ এরূপভাবে পড়িয়াছিল যে, সেখান দিয়া কাহাকেও যাইতে হইলে, হয় মৃতদেহ বেড়িয়া, না হয় পদদলিত করিয়া যাইতে হইত| এরূপ স্থলে মৃতদেহ মজিদের লক্ষ্য না হওয়াই আশ্চর্য্য; কিন্তু পরক্ষণেই মোবারক সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিয়া মৃতদেহ আবিষ্কার করিয়া ফেলিল, পাহারাওয়ালাকে ডাকিল-লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল-ব্যস্| আমার বোধ হয়, মোবারক পূর্ব্বে খুন করিয়া ঐ লাস কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিল| তাহার পর একটা বুদ্ধি খাটাইয়া সেই লাস্টা পাহারাওয়ালাদের স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়াছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, তাহাই ঠিক, মৃত্যুকালে মোবারক সে কথা নিজেই স্বীকার করিয়াছে; কিন্তু মোবারক যে খুনী, ইহা একবারও আমার মনে হয় নাই, কি আশ্চর্য্য! যাহা হউক, এখন কার্য্যোদ্ধার হইয়াছে, আপনার সেই বাক্স আমি লইয়া আসিয়াছি, একবার চাবিটা চাই, দেখিতে হইবে-”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ হইতে কথাটা লুফিয়া লইয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “-কে হত্যাকারী| এই না? এখন আর তাহা দেখিয়া লাভ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কোন উত্তর করিল না| অরিন্দম বাবু বালিশের নীচে হইতে বাক্সের চাবিটা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বাক্স খুলিয়া ফেলিলেন| দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি কাগজে লিখিত রহিয়াছে- “মোবারক|”
দেবেন্দ্রবিজয় থ হইয়া গেলেন|
৫.১৩ উপসংহার
মেহেদী-বাগানের এই অত্যাশ্চর্য্য নারীহত্যা-রহস্যের উদ্ভেদ হইলে আবার একটা খুব হৈ-চৈ পড়িয়া গেল| পরে কয়েকখানি সাপ্তাহিক সংবাদ-পত্রে সমগ্র ঘটনাটা সুশৃঙ্খলভাবে বাহির হইলে সকলে অত্যন্ত আগ্রহ ও বিস্ময়ের সহিত তাহা পাঠ করিতে লাগিল| এক-একটা সত্য ঘটনা গল্পাপেক্ষা অদ্ভুতও হয়, ইহা এখন অনেকেই বুঝিতে পারিলেন|
মজিদ খাঁ মুক্তি পাইলেন| মুন্সী সাহেব এবার মজিদ খাঁর সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে আপত্তি করিলেন না| খুব জাঁক-জমকের সহিত মহাসমারোহে শুভবিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল|
মনিরুদ্দীন দিলজানকেই বিবাহ করিলেন| জীবনের এই ঘটনাপূর্ণ অধ্যায়টা বিস্মৃত হইবার আশায় তিনি সহর ত্যাগ করিয়া ফরিদপুরের সেই বাগান-বাটীতে গিয়া আপাততঃ বাস করিতে লাগিলেন| দিলজানও সেই বাগান-বাটীতে স্থানপ্রাপ্ত হইল| ইহার পর মনিরুদ্দীনের চরিত্রে আর কোন দোষ দেখা দেয় নাই-দিলজানের অদৃষ্ট ভাল|
মুন্সী সাহেব আর বিবাহ করিলেন না| সে অভিরুচিও আর ছিল না| এই ঘটনায় নারীজাতির উপর হইতে তাঁহার বিশ্বাস একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছিল| তিনি সহরত্যাগ করিয়া স্বদেশে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন; ইচ্ছা অবশিষ্ট জীবনটা সেইখানেই অতিবাহিত করিবেন|
দেবেন্দ্রবিজয় কয়েকদিন অত্যধিক পরিশ্রম ও চিন্তায় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন; এক্ষণে বিশ্রামের একটু অবসর পাইলেন| অনেক সময়েই তাঁহার মন হইত, এমন জটিল রহস্যপূর্ণ মোকদ্দমা আর কখনও তাঁহার হাতে পড়ে নাই| ঘটনাচক্রে যেরূপ ভাবে ঘুরিতেছিল, তাহাতে বৃদ্ধ মুন্সী সাহেবেরই চাপা পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল| যাহা হউক, ঈশ্বর তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন| নতুবা একজন নিরপরাধ বৃদ্ধকে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাইয়া তাঁহাকে আজীবন অনুতাপ করিতে হইত|
পরে কখনও কোন সূত্রে দশজন বন্ধুবান্ধবের সহিত মিলিত হইলে অনুরুদ্ধ দেবেন্দ্রবিজয় সর্ব্বাগ্রে মেহেদী-বাগানের এই অত্যাশ্চর্য্য নারীহত্যার বিপুল রহস্যপূর্ণ কাহিনীতে সকলের হৃদয়ে অত্যন্ত বিস্ময়োদ্রেক করিতেন |