সহসা এই একটা অপ্রত্যাশিতপূর্ব্বক ঘটনায় দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিব্রত হইয়া উঠিলেন| দেখিলেন, তিনি এক প্রবল রহস্য-স্রোতে সটান্ ভাসিয়া চলিয়াছেন| কূলে উঠিবার জন্য তিনি যখন যে তীর-লতা সুদৃঢ়বোধে ব্যগ্রভাবে দুই বাহু প্রসারিত করিয়া টানিয়া ধরিতেছেন, তাহাই ছিঁড়িয়া যাইতেছে| বরংবার এই অকৃতকার্য্যতা তাঁহার গর্ব্বিত হৃদয়ে দারুণ আঘাত করিল| তিনি একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন কি করিবেন, কিছু স্থির করিতে না পরিয়া ক্ষুন্নমনে মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে অবিলম্বে বাহির হইয়া পড়িলেন| নিজের বাটীতে না ফিরিয়া অরিন্দম বাবুর সহিত দেখা করিতে চলিলেন| এই একটা দারুণ গোলযোগে পড়িয়া অনেকদিন তাঁহার কোন সংবাদ লওয়া হয় নাই; সংবাদটা লওয়া হইবে| তাহা ছাড়া তাহার নিকটে সমুদয় খুলিয়া বলিলে, তিনি দুই-একটা সুপরামর্শও দেতে পারিবেন; মনে মনে এইরূপ স্তির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই স্বনামখ্যাত বৃদ্ধ ডিটেক্টিভ অরিন্দম বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করাই যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন|
অরিন্দম বাবু একজন নামজাদা পাকা ডিটেক্টিভ| বিশেষতঃ ফুল সাহেবের কেস্টায় তাঁহার নাম আরও বিখ্যাত করিয়া দিয়াছে| অরিন্দম বাবুকে দেখিলে তাঁহাকে বুদ্ধিমানের পরিবর্ত্তে নির্ব্বোধই বোধ হয়; তাঁহার সরল মুখাকৃতি দেখিয়া কিছুতেই বুঝিতে পারা যায় না, ইনি ডিটেক্টিভ পুলিসের একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালী, প্রধান কর্ম্মচারী| তিনি প্রথমে যখন কর্ম্মে প্রবিষ্ট হন, পুলিসের প্রবীণ কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কেহই তখন মনে করেন নাই, কালে ইনি এমন একজন হইয়া উঠিবেন| এমন কি শেষে, যাঁহারা পূর্ব্বে এই কথা মনে করিয়াছিলেন, তাঁহারাই অনেকে অনেক সময়ে সেই নির্ব্বোধের মত চেহারার অরিন্দম বাবুর পরামর্শ গ্রহণে কুণ্ঠিত হইতেন না| যখন তাঁহারা কোন একটা জটিল রহস্যপূর্ণ মামলা হাতে লইয়া রহস্যভেদের পন্থা-অন্বেষণে একেবারে হতাশ হইয়া পড়িতেন, তখন অরিন্দম বাবু সেখানে উপস্থিত হইয়া সহসা এক আঘাতেই রহস্য-যব্নিকা ভেদ করিয়া নিজের অমানুষিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন|
আজ প্রায় ছয়মাসকাল অরিন্দম বাবু বাতরোগে শয্যাশায়ী| শয্যাশায়ী হইবার অনেক পূর্ব্বে তিনি কর্ম্মত্যাগ করিয়াছিলেন| বয়স বেশি হইয়াছিল বলিয়া তিনি যে আর বড় পরিশ্রম করিতে পারিতেন না; তাহা নহে; সে জন্য তিনি কর্ম্মত্যাগ করেন নাই| বৃদ্ধ বয়সেও তাঁহার দেহে যৌবনের সামর্থ্য ছিল| সারাজীবনটা চোর ডাকাত খুনীর পিছনে পিছনে ঘুরিয়া সহসা একদিন তাঁহার নিজের জীবনের উপরে স্বতঃ কেমন একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল| এবং সেই ঘৃণা তাঁহার হৃদয়স্থিত অদম্য উদ্যম একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিল| তিনি আর ইহাতে সুখবোধ করিতে পারিলেন না| আর যেন তাহা ভাল লাগিল না| শেষে তিনি এমন নিরুদ্যম হইয়া পড়িলেন যে, দুই-একটা মামলা হাতে লইয়া তাঁহাকে অকৃতকার্য্যই হইতে হইল| এমন কি যথাযোগ্য মনোযোগের অভাবে তিনি একবার একবার একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন| সেইবার শেষবার-একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া তাঁহার মনে এমন একটা দুর্নিবার আত্মগ্লানি উপস্থিত হইল যে, তিনি সেইদিনই কর্ম্মে ইস্তফা দিলেন| ইহাতেও তাঁহার নিস্তার ছিল না| যেমন বড় বড় ব্যাবহারজীবীগণ নিত্য আদালত-গৃহে যাতায়াত করিয়া, প্রভৃত ধন এবং তৎসহ তেমনই প্রভূত খ্যাতি, প্রতিপত্তি লাভ করিয়া শেষ দশায় যখন ব্যবসায়ে একেবারে বীতরাগ হইয়া পড়েন, তখন তাঁহাদের আর কিছু ভাল না লাগিলেও গৃহে বসিয়া, অপরকে নিজের তীক্ষ্ণধার অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত যেমন খুব আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন, অরিন্দম বাবুরও শেষ দশায় ঠিক তাহাই ঘটিয়াছিল| কিন্তু অরিন্দম বাবুর উদ্দেশ্যটা একটু স্বতন্ত্র রকমের ছিল; যাহাতে কোন অর্ব্বাচীনের হাতে পড়িয়া কোন নির্দ্দোষী দণ্ডিত না হয়, সেজন্য তিনি পরামর্শগ্রাহীদের ভ্রমের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন| সর্ব্বাগ্রে তাহাদিগকে তাহাদের ভ্রমগুলি দেখাইয়া দিয়া পরে হত্যাকারীকে ধরিবার সূত্র নির্দ্দেশ করিয়া দিতেন| এবং ইহাতে তাঁহার খুব উৎসাহ দেখা যাইত| তাঁহার সেই উৎসাহ দেখিয়া সহজেই সকলে বুঝিতে পারিত, তাঁহার সেই নষ্ট উদ্যম আবার নবীবভাবে তাঁহার হৃদয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে|
অরিন্দম বাবু চিকিৎসার জন্য কালীঘাটে গঙ্গার ধারে একখানি বাটী ভাড়া লইয়া এখন বাস করিতেছেন| শুশ্রূষার জন্য বাড়ীর মেয়েছেলেরাও সঙ্গে আসিয়াছেন| এদিকে চিকিৎসাও খুব চলিতেছে; কিন্তু কিছুতেই রোগের উপশম হইতেছে না| শরীরের অবস্থাও ভাল নহে-তিনি একেবারে শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছেন| এমন কি এখন উঠিয়া বসিবার সামর্থ্যও নাই|
দেবেন্দ্রবিজয় যখন অরিন্দম বাবুর বাটীতে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে| অরিন্দম বাবুর গৃহে তাঁহার অবারিত দ্বার-তিনি সরাসরি ভিতর বাটীতে প্রবেশ করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন| এবং দ্বিতলস্থ যে কক্ষে রুগ্নশয্যায় অরিন্দম বাবু পড়িয়াছিলেন, সেই কক্ষ মধ্যে তিনি প্রবেশ করিলেন| অরিন্দম বাবু বিছানায় যন্ত্রণাসূচক দীর্ঘানিঃশ্বাস ফেলিতেছেন, এক-একবার চীৎকার করিয়াও উঠিতেছিলেন| এমন সময়ে অনেক দিনের পর আজ সহসা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয় নিজের রোগের কথা তিনি একেবারে ভুলিয়া গেলেন| অত্যন্ত আগ্রহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আরে কেও-দাদা? এস-অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া বলিলেন, “আপনি এখন কেমন আছেন? একটা গোলযোগে পড়িয়া অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা করিতে পারি নাই|”
অরিন্দম বাবু কহিলেন, “কই কিছুতেই কিছু হইতেছে না-আর যন্ত্রণাও সহ্য হয় না| সে কথা যাক্, তোমার যে এতদিন দেখা নাই, কেন বল দেখি-কি এমন গোলযোগে পড়িয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন,-“একটা খুনের কেস হাতে লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি; এখন আপনার পরামর্শ বিশেষ দরকার; আর কোন উপায় দেখিতেছি না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বটে, এমন কি ব্যাপার?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বড় শক্তলোকের পাল্লায় পড়িয়াছি-আমাকে একদম্ বোকা বানাইয়া দিয়াছে|”
বুকের মর্ম্মকোষ হইতে টানিয়া খুব একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত-লোকটা এমনই ভয়ানক না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যতদূর হইতে হয়| এমন কি, ব্যাপার দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে, এবার আমি আপনার সেই পরমশত্রু ফুল সাহেবেরই প্রেতাত্মার হাতে পড়িয়াছি| সে আমাকে এমন বিপদে ফেলিয়াছিল যে, মনে করিলে অনায়াসে আমার প্রাণনাশও করিতে পারিত| অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহা করে নাই-এই আমার পরম সৌভাগ্য|”
৪.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – উপদেশ
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বল কি, এমন লোক সে! তাহা হইলে ত, এইবার তোমার স্বর্ণসুযোগ উপস্থিত-ইহার জন্য আবার দুঃখিত হইতে আছে? যশস্বী হইবার ত এই একমাত্র পন্থা| ইহা ত্যাগ করা কদাচ বুদ্ধিমানের কাজ নহে| গোয়েন্দাগিরি করিয়া বাহাদুরী লইবার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আজকাল দুর্ল্লভ| আগেকার মত কি আর সে রকম চতুর, সে রকম সুদক্ষ চোর ডাকাত, খুনী পাওয়া যায় হে? তা’ পাওয়া যায় না| এখনকার অপরাধীরা ও সব সাদা সিধে রকমের, নিতান্ত সরল প্রকৃতির; তাহাদের অপরাধগুলাও তেমনি সরল এবং নির্জ্জীব-তাহার মধ্যে দুরূহতা বা দুরাবগাহতার কিছুই পাইবে না| আজ-কালকার চোর ঘটী বাটী চুরি করিয়াই একটা মস্ত চোর; খুনী রক্তপাতের উত্তেজনা নিজের বুকের মধ্যে নিজেই সংবরণ করিতে না পারিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে| তাহাদিগকে ধরিবার জন্য বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকারের আবশ্যক দেখি না| কাহাকেও ধরিতে হইলে, সটান্ একখানা গাড়ী ভাড়া কর-সটান্ তাহার বাড়ীতে গিয়া হাতকড়ি লাগাইয়া দাও-ব্যস, আসামী গ্রেপ্তার হইয়া গেল| ইহাতে চিন্তাই বা কি এত, উদ্বেগেই বা কি এত? তুমি যে ইহার মধ্যে এমন একজন সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাইয়াছ, শুনিয়া সুখী হইলাম| তোমার অপরাধীর অপরাধটা কি রকম আমাকে বল দেখি; তাহা হইলে অনেকটা বুঝিতে পারিব, তিনি কিরূপ উচ্চদরের লোক|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তিনি খুব উচ্চদরের লোক, সন্দেহ নাই| পথিমধ্যে একজন স্ত্রীলোককে অতি অদ্ভুত উপায়ে হত্যা করিয়া একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছেন|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন-পর পর তিনবার তিন রকমস্বরে বলিলেন, ‘বটে! বটে! বটে!’ যেন তিনটি লোকের মুখ হইতে তিনটা ‘বটে’ বাহির হইল| ক্ষণেক চিন্তার পর বলিলেন, “খুনটা হয়েছে কোথায়?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলি মধ্যে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ওঃ! আমি এ কথা শচীন্দ্রের মুখে একবার শুনিয়াছিলাম বটে| তা’ ছাড়া একখানা খবরের কাগজেও এই খুনের বিষয় একটু লিখিয়াছিল| সে খুনটার তুমি কি এখনও কোন কিনারা করিতে পার নাই? কি আশ্চর্য্য! তোমার হাতে কেস্ পড়ায় হত্যাকারী যখন এখনও নিরুদ্দেশ-তখন অবশ্যই সে একজন যোগ্য লোক বটে! ব্যাপারটা সব খুলিয়া আমাকে বল দেখি; দেখি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যদি তোমার কিছু সাহায্য করিতে পারি| আচ্ছা, পরে তোমার শুনিব| (নিম্নস্বরে) তার আগে পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া, ধাঁ করিয়া এই দরজা টা খুলিয়া ফেল দেখি-একটা বড় মজা দেখিতে পাইবে| নিশ্চয়ই একজন কেহ দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আমাদের পরামর্শ শুনিবার চেষ্টায় আছে| আমি এখান থেকে তাহার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছি|”
কবাট ভিতর হইতে ভেজান ছিল| দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া দ্রুতহস্তে কবাট খুলিয়া ফেলিলেন| চকিতে দেখিলেন, সম্মুখে দাঁড়াইয়া-রেবতী| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় খুব বিস্মিত হইলেন| অরিন্দম বাবু খুব একটা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন, এবং রেবতী খুব লজ্জিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া পলাইবার পথ পাইলেন না|
অরিন্দম বাবু এখনও হাস্য সম্বরণ করিতে পারেন নাই| হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই ত’ দিদি যে আবার আমাদের উপরে ডিটেক্টিভগিরি করিতে আসিবে, তা’ আমি ভাবি নাই; যাহা হউক, খুব ধরা পড়িয়া গিয়াছে|” তাহার পর হাস্য সম্বরণ করিয়া, সুর বদ্লাইয়া বলিলেন, “দেখ্লে দাদা, পুরুষের হৃদয় হইতে স্ত্রীলোকের হৃদয় কত তফাৎ! আমি রোগে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি; তুমি পুরুষ মানুষ-মনে করিলেই এখানে আসিতে পার, তাই আসো না; কিন্তু দিদি আমাকে ভুলিতে পারে নাই-সংসারের শত কাজ-কর্ম্ম ফেলিয়াও তাড়াতাড়ি আমাকে দেখিতে আসিয়াছে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি আপনার দিদির কত উপকার করিয়াছেন!”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “দাদারই বা কি অনুপকার করিয়াছি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার যে উপকার করিয়াছেন, তাহাতেও প্রকারান্তে আপনার দিদিরই উপকার করা হইয়াছে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “আর দিদির যে উপকার করিয়াছি, তাহাতে বুঝি প্রকারান্তে দাদার কোন উপকার করা হয় নাই? যাক্ ভাই, আর তর্কের প্রয়োজন নাই; এখন কাজের কথাই হউক|”
দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুনের মোকদ্দমা হাতে লওয়া অবধি যখন যাহা ঘটিয়াছে, যাহা তিনি করিয়াছেন, আদ্যোপান্ত অরিন্দম বাবুকে বেশ গুছাইয়া বলিতে লাগিলেন|
শুনিতে শুনিতে অরিন্দম বাবুর মুখভাব বদ্লাইয়া গেল; রোগের যন্ত্রণা তিনি একেবারে বিস্মৃত হইয়া গেলেন, অখণ্ড মনোযোগের সহিত শুনিয়া যাইতে লাগিলেন| কখন বা শুনিতে শুনিতে কি-এক তীব্র উত্তেজনায় দুই হস্তে শয্যাস্তরণ মুষ্টিবদ্ধ করিয়া উঠিবার উপক্রম করেন, আবার একান্তে তন্ময়ভাবে নীরবে শুনিতে থাকেন| পরমভক্ত বৈষ্ণব যেমন সুমধুর হরিনামের মধ্যে মগ্ন হইয়া যান, আমাদের অরিন্দম বাবুও দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনীর মধ্যে তেমনি মগ্ন হইয়া গেলেন| কেবল এক-একবার তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইতে লাগিল, ‘পূর্ব্বে যদি ইহা শুনিতাম’, ‘পূর্ব্বে যদি আমি খবর পাইতাম’, ‘তখন যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকিতাম! ‘ ইত্যাদি|
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনী শেষ হইলে তিনি অধিক উত্তেজনায় উভয় হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিয়া উঠিলেন, “বড় মজাই হইয়াছে-বিরাট ব্যাপার! একরূপ লুকোচুরি খেলাই আরম্ভ হইয়াছে-খেলা জমিয়াছে-এখন বুড়ি ছুঁইবার পালা| আরে দাদা, তুমি ত এ কেস্টা বুদ্ধিমানের মত পরিচালিত করিতেছ|”
হতাশ দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি উপহাস করিতেছেন-ইহাতে আমার নির্ব্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পাইয়াছে|”
জিহ্বা ও তালুর সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “নিশ্চয়ই না-তোমার কথা শুনিয়া এ বুড়ার বুকে আনন্দ ধরিতেছে না! এখন আমি বুঝিয়াছি, আমি মরিলেও আমার আসন অধিকার করিবার একজন যোগ্য লোক রাখিয়া যাইতে পারিব| আমার ইচ্ছা হইতেছে, একবার উঠিয়া, তোমার বুকে করিয়া নৃত্য করি|”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে এখনও সন্দেহ যে, অরিন্দম বাবু তাঁহাকে উপহাস করিতেছেন| তিনি বলিলেন, “আপনি আমাকে উপহাসই করিতেছেন; আমি কিসে এতটা প্রশংসার যোগ্য-বুঝিতে পারিলাম না| হত্যাকারী এখনও ধরা পড়ে নাই; আমার এ কাজে যতটুকু যশঃ ছিল, বরং তাহা এখন যাবার দাখিলে পড়িয়াছে|”
বিশ্রী মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কিছু না-কিছু না-ব্যস্ত হইয়ো না-ইহাতে তোমার যশঃ শতগুণে বাড়িয়া যাইবে| আমার ত খুবই মনে হয়, তুমি এই কেস্টা বেশ ভাল রকমেই পরিচালিত করিয়া আসিতেছ; কিন্তু আরও ভাল রকম হওয়া দরকার ছিল| মনোযোগ থাকিলে খুবই ভাল পরিচালিত করা যাইতে পারিত| তোমার মুখে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে তোমার বুদ্ধি ও সাহসের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়| কেবল একটু অভিজ্ঞতার অভাব, একটুতেই তুমি লাফাইয়া ওঠ, আবার একটুতেই একেবারে হতাশ হইয়া পড়| স্থিরসঙ্কল্প হওয়া চাই-একটা বিষয়ে স্থির লক্ষ্য চাই-এখনও তুমি অনেক ছেলেমানুষ-পাকাচুলের অবশ্যই একটা মূল্য আছে| যাহা হউক, তুমি ইহাতে কয়েকটা বিষয়ে বড় ভুল করিয়াছ; আমি তাহা তোমাকে এখন সরলভাবে বুঝাইয়া দিতেছি|”
৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গুরু ও শিষ্য
বিদ্যালয়ের ছাত্র যেমন নীরবে অবনতমস্তকে শিক্ষকের নিকটে পাঠ গ্রহণ করে, দেবেন্দ্রবিজয়ও ঠিক সেইরূপ নতশিরে রহিলেন| আর উভয়ের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কও বটে|
অরিন্দম বাবু বলিতে লাগিলেন, “সত্যসত্যই তুমি কয়েকটা বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছ| রহস্য-ভেদের তিন-তিনটি সুযোগ তিনবার তোমার হাত এড়াইয়া গিয়াছে; আমি তাহা তোমাকে দেখাইয়া দিতেছি|”
“কিন্তু আপনি যদি-” দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, তখনই বাধা দিয়া, মুখভঙ্গি সহকারে, জিহ্বা ও তালু সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বলিলেন, “দুই-একটা কথা আমাকে বলিতে দাও-ব্যস্ত হইও না| কি সূত্র ধরিয়া গোয়েন্দাগিরি করিতে হয়, তাহা তোমার মনে আছে কি? গোয়েন্দাগিরির মূলমন্ত্র হইতেছে যে, কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করিবে না-যাহা কিছু সম্ভব বা সত্য বোধ হইবে, তাহাই আগে অবিশ্বাস করিবে| এই মূলমন্ত্র কি তোমার মনে ছিল? ইহাই অবলম্বনে কাজ করিতে কি তুমি চেষ্টা করিয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমিও এই মূলমন্ত্র লক্ষ্য করিয়া কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছি| অনেক স্থলে চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে| যাহা একান্ত সত্য বলিয়া মনে হয়, তাহার উপরে জোর করিয়া অবিশ্বাস করা বড় শক্ত কাজ|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাহাই ত চাই, এই সূত্র ধরিয়া তুমি যে কোন অন্ধকারময় পথ অবলম্বন কর না কেন, ইহা পরিশেষে দীপালোকের কাজ করিবে, বিপথে চালিত হইবার কোন শঙ্কা থাকিবে না; অথচ যথাসময়ে ইহা তোমাকে ঠিক সত্যে উপনীত করিয়া দিবে| এমন মূলমন্ত্র কি একবারও ভুলিতে আছে! নতুবা এমন একটা অবস্থাধীন ঘটনা ঘটিল, যাহা খুবই সম্ভব বলিয়া মনে লাগিল; তুমি এই মূলমন্ত্র ভুলিয়া তাহা বিশ্বাস করিলে; তাহার পর এমন একটা ঘটনা ঘটিল, যাহাতে তাহা তুমি বুঝিলে ইহা আরও সম্ভবপর- ইহা কখনই মিথ্যা হইতে পারে না| তুমি অমনি ইহাই প্রকৃত বলিয়া লাফাইয়া উঠিলে; এরূপ করিলে ডিটেক্টিভগিরি হয়? তা’ হয় না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত বোধ হয়, আপনি যতটা মনে করিয়াছেন, আমি একেবারে ততটা সরল-বিশ্বাসী নই|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিকই ততটা| এখন যেরূপ ঘটনা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই দোষী বলিয়াই বোধ হয়| তুমিও তাহাই খুব সম্ভব বলিয়া মনে করিতেছ, বিশ্বাসও করিয়াছ| কেমন ঠিক কি না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, যেরূপ দেখিতেছি তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই আমার দোষী বলিয়া বিশ্বাস হয়; কারণ-”
মধ্যপথে বাধা দিয়া অরিন্দম বাবু বলিয়া উঠিলেন, “কারণ তোমাকে বলিতে হইবে না- আমি নিজেই তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি; খুবই সম্ভব বলিয়া বিশ্বাস করিতেছ-সেই বিশ্বাসে কাজ করিয়া পরে কৃতকার্য্য হইবে, এরূপ মনেও করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলেন| জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরূপ স্থলে আপনি যদি দাঁড়াইতেন, তা’ হ’লে আপনি কি করিতেন?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিক বিপরীত| হয় ত তাহাতে আমি ভুলও করিয়া ফেলিতাম; কিন্তু সে ভুলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হইত না; এই অবিশ্বাসে পরে আমি একটা ন্যায়সঙ্গত মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিতাম|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আরও দুই-একটি কারণে মনিরুদ্দীনকে দোষী বলিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছে| তিনি নিজের দোষ ঢাকিবার জন্য মুন্সী সাহেবের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার চেষ্টা করিতেছেন|”
অরি| এই জন্যই কি তোমার বিশ্বাস এতটা বদ্ধমূল হইয়াছে?
দেবে| আরও একটা কারণ আছে; বোধ হয়, দিলজান ভিতরের সকল কথাই জানে| মনিরুদ্দীনকে বাঁচাইবার জন্য সে নিজে খুন স্বীকার করিতেছে|
অরি| এইখানে তুমি পদে পদে ভ্রম করিয়াছ|
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন| বলিলেন, “তবে কি আপনি মনে করেন, মনিরুদ্দীন নিরপরাধ?”
সহসা অরিন্দম বাবুর মুখমণ্ডল ঘনঘটাচ্ছন্ন হইল| দেখিয়া ভয় হয়, এমন একটা মুখভঙ্গি করিয়া তিনি বলিলেন, “বোধ করা করি কি, আমি নিশ্চয়ই বলিতেছি, সে নিরপরাধ|”
শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ‘থ’ হইয়া গেলেন|
৪.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কাজের কথা
দেবেন্দ্রবিজয় জানিতেন, যাঁহার পরামর্শ লইতে আসিয়াছেন তিনি একজন দৈবশক্তিসম্পন্ন মহানিপুণ ব্যক্তি| তিনি যাহা বলেন, কদাচ তাহার ব্যতিক্রম হইতে দেখা যায় না| তথাপি দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার এই কথায় আস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন না| ভাবিলেন, এক-এক বার সকলেরই ভুল হয়, ইনি হয়ত এবার ঠিক মীমাংসায় উপনীত হইতে পারেন নাই| দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ অপ্রসন্নভাব ধারণ করিল|
তাহা অরিন্দম বাবুর লক্ষ্য এড়াইল না| তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে সেই মনের কথাগুলি স্বহস্তস্থিত লিপির ন্যায় পাঠ করিলেন| বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার কথাটা দেবেন্দ্রবিজয় বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না; কিছু বলিলেন না|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার এ অনুমান কি ঠিক? মনিরুদ্দীন কি এ খুন সম্বন্ধে কিছুই জানে না?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “খুব ঠিক, মনিরুদ্দীন তোমার মত একান্ত নির্দ্দোষ-এমন কি খুন সম্বন্ধে তুমি আমি যতটা জানি, সে নিজে এতটা খবর রাখে না|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসে আপনি এরূপ কৃতনিশ্চয় হইতেছেন, বুঝিতে পারিলাম না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে যাহা কিছু তোমার মুখে আমি শুনিয়াছি, তাহা যদি অপ্রকৃত না হয়, আমার অনুমানও অপ্রকৃত হইবে না| আমার খুবই মনে হয়, মোবারক ইহার ভিতরকার অনেক কথা জানে, এমন কি সে হত্যাকারীরও খবর রাখে|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার ত তাহা বোধ হয় না| কেন সে তাহা গোপন করিতে যাইবে?”
একান্ত হতাশভাবে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এতদিন গোয়েন্দাগিরি করিয়া যে, তুমি নির্ব্বোধের মত এমন একটা প্রশ্ন করিবে, তাহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই| তোমাকে দেখিয়া আমি মনে করিয়াছিলাম, আমি মরিলেও একজন যোগ্য ব্যক্তি আমার আসন অধিকার করিতে পারিবে-কি মহাভ্রম আমার| তুমিই নিজেই মনে মনে একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখ দেখি, তোমার এই প্রশ্নটা কতটা নির্ব্বোধের মত হইয়াছে| ভাল, আমিই না হয়, তোমাকে দুই-একটা কথা বুঝাইয়া দিতেছি| মনে কর, তুমি একটা খুন করিয়াছ, তোমার কোন বন্ধু তোমাকে খুন করিতে দেখিয়াছে, এরূপ স্থলে সে কি তোমার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিতে পারে?” কথাগুলি অরিন্দম বাবু অত্যন্ত বেগের সহিত বলিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, মোবারকের তেমন কোন উদ্দেশ্য নাই| তাহা হইলে সে কখনও তাহার বন্ধু মজিদ খাঁর নাম প্রকাশ করিত না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “আমিও যে তাহা না বুঝি, তাহা নহে; আর সেই খুনটা যদি মজিদ খাঁ নামক কোন বন্ধুর দ্বারা না হইয়া, তাহার অন্য কোন শত্রুর দ্বারা হইয়া থাকে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “শত্রু হইলে ত কোন কথাই নাই; তাহা হইলে ত মোবারক তাহাকে তখনই পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিত|”
অরিন্দম বাবু জিজ্ঞাসিলেন, “আর যদি মোবারক তোমার মত নির্ব্বোধ না হয়?”
অরিন্দম বাবুর এইরূপ প্রশ্নে দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, মুখে কিছু বলিলেন না| কিছু না বলিলেও অরিন্দম বাবু তাহা বেশ বুঝিতে পারিলেন| বলিলেন, “দেখ দাদা, এ বৃদ্ধের কথায় রাগ করিয়ো না-রাগ করিলে ‘গৃহের অন্ন অধিক পরিমাণে ভক্ষণ করা’ ভিন্ন আর কোন বিশেষ ফললাভ করিতে পারিবে না| মোবারক যদি তাহার কোন শত্রুকে খুন করিতে দেখিয়া থাকে, আর সে যদি নিজে তোমার মত নির্ব্বোধ না হইয়া বেশ বুদ্ধিমান্ হয়, তাহা হইলে সে সেই হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করিতে না পারে; বরং সে সময়ে সেই শত্রুকে পুলিসের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য সে তাহার সাহায্যও করিতে পারে| কোন প্রবল শত্রুকে নিজের মুঠার ভিতরে রাখিবার ইহাই ত প্রকৃষ্ট উপায়| সময়ে সেই শত্রুর নিকট হইতে অনেক কাজ আদায় হইতে পারে| শত্রু হ’ক্, আর মিত্র হ’ক্, মোবারক হত্যাকারীকে নিশ্চয় জানে, কোন একটা কারণে সে তাহা এখন চাপিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে| তাহাকে কূট-প্রশ্নের অগ্নি-পরীক্ষায় না ফেলিতে পারিলে ভিতরের কোন কথাই তুমি কখনও তাহার মুখ হইতে বাহির করিতে পারিবে না|” এই বলিয়া অরিন্দম বাবু বিষম উদ্বেগের সহিত ঘন ঘন উভয় করতল নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ভাল, এইবার আমি আপনার পরামর্শ মত কাজ করিব|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এখন তুমি কিরূপে কাজ হাসিল্ করিবে, বল দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখনও কিছু ঠিক করিতে পারি নাই| ঠিক করিবার পূর্ব্বে আপনার কথাগুলি আমাকে আরও একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিতে হইবে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “হাঁ, আগে ভাবিয়া-চিন্তিয়া পরে কাজে হাত দেওয়াই ঠিক; নতুবা অনেক সময়ে পরিশ্রম সার হয়| এবার বিশেষ বিবেচনার পর এমন একটা সূত্র অবলম্বন করিবে, যাহা অবলম্বনে প্রকৃত স্থানে উপনীত হইতে পার| অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িলে কি হইবে? যাহা হউক, তুমি ইহার মধ্যে যে দুই-তিনটা মস্ত ভুল করিয়া ফেলিয়াছ, তাহা আমি দেখাইয়া দেতেছি| একটু বুঝিয়া চলিলে এতদিন সর্ব্বতোভাবে এ রহস্য ভেদ হইয়া যাইত|”
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলেন শুনিবার জন্য অরিন্দম বাবু ক্ষনকাল নীরবে রহিলেন| দেবেন্দ্রবিজয় মৌন হইয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না| মনে করিলেন, অবশ্যই আমি কোন বিষয়ে বড় ভুল করিয়া থাকিব; নতুবা ইনি এ কথা এত জোরের সহিত বলিবেন কেন?
অরিন্দম বাবুর নিকটে ‘ভাবা’ ও ‘বলা’ একই কথা| তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মনোভাব বুঝিতে পারিয়া তাঁহার উপরে বড় সন্তুষ্ট হইলেন| বলিলেন, “প্রথমেই তুমি সেই ছুরিখানা লইয়া খুব একটা অবিবেচকের মত কাজ করিয়া ফেলিয়াছ| মজিদ খাঁ যদি খু করিয়াই থাকিবে, তাহা হইলে কেন সে সেই হত্যাকাণ্ডের সাঙ্ঘাতিক প্রমাণ স্বরূপ সেই ছুরিখানা নিজের ঘরে লুকাইয়া রাখিতে যাইবে? সে অনায়াসে সেইখানে ফেলিয়া আসিতে পারে| সে ছুরি মজিদ খাঁর নিজের নহে যে, সেখানে ফেলিয়া আসিলে তাহার কোন বিপদের সম্ভাবনা ছিল| লাসের পাশে ঐ ছুরিখানি পড়িয়া থাকিলে কেহই এমন সন্দেহ করিতে পারিত না যে, মজিদ খাঁর দ্বারা এই খুনটা হইয়াছে| মজিদ খাঁর নিজের ছুরি হইলে অবশ্যই সে তাহা গোপন করিবার চেষ্টা করিত| এখন তোমার এই প্রথম ভ্রমটা বুঝিতে পারিলে কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তখন আমি ইহা ভাবিয়া দেখি নাই; অবস্থাগত প্রমাণের উপরে নির্ভর করিয়াই আমি অগ্রসর হইতেছিলাম|”
বর্ষণোম্মুখ মেঘের ন্যায় মুখখানা গম্ভীর করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ইহার নাম অগ্রসর নহে, বরং ক্রমশঃ হটিয়া আসা| আমি হইলে কখনই সেই ছুরিখানার উপরে এতটা পরিশ্রম করিতে রাজী হইতাম না| তাহার পর দ্বিতীয়তঃ হত্যাকারীর সেই বেনামী-পত্র| হাতে-পায়ে সূতা বাঁধিয়া, যেমন করিয়া লোকে পুতুল নাচায়, হত্যাকারীও এই বেনামী-পত্রে তোমাকে সেই রকম করিয়া নাচাইয়া লইয়া বেড়াইয়াছে| যে অভিপ্রায়ে সে তোমাকে পত্র লিখিয়াছিল, তুমি এমনই আস্ত হনূমান্, যে ঠিক তাহার মতলব মত কাজই করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় মহা অপরাধীর ন্যায় কহিলেন, “এখন আমি তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু এরূপ স্থলে ইহা ভিন্ন আর কি উপায় করা যাইতে পারে?”
বৃদ্ধ অরিন্দম বাবু সহসা স্পিরিটের মত যেন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন| কহিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! এখনও তুমি বলিতেছ, আর কি উপায় করা যাইতে পারে| এই বুদ্ধি লইয়া তুমি ডিটেক্টিভগিরি করিতে চাও? গোয়েন্দাদিগকে কত প্রতিকূল ঘটনার মধ্য দিয়া কার্য্যোদ্ধারের দিকে অগ্রসর হইতে হয়, সে সম্বন্ধে তোমার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা হয় নাই, দেখিতেছি| যদি হত্যাকারীকে জানিবার ইচ্ছা এতটা প্রবল হইয়াছিল, তখন নিজে একটা ছদ্মবেশ ধরিয়া সেই গোলদিঘীতে গেলে কোন গোল ছিল না, সহজে কার্য্যোদ্ধারও হইত|”
৪.১৪ চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – ভ্রম-সংশোধন
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, এবার অরিন্দম বাবুর প্রতি নহে-নিজের প্রতি| নিজের এতবড় একটা নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য তাঁহার মনে অত্যন্ত ক্ষোভ উপস্থিত হইল| তিনি নিজের জনুদেশে সশব্দে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন “কি আপদ্! আমার মত হস্তিমূর্খ কি আর আছে! এমন একটা সহজ উপায় থাকিতে আমি নিজের ক্ষেপ্ হারাইয়া বসিলাম! যতদিন বাঁচিব, সেদিনকার সেই নির্ব্বুদ্ধিতার কথা আমার মনে চির-জাগরুক থাকিবে| কখনই ভুলিতে পারিব না|ও
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এতটা কুণ্ঠিত হইবার কোন আবশ্যকতা নাই| তুমি যাহাকে নির্ব্বুদ্ধিতা বলিতেছ, তাহা ঠিক নির্ব্বুদ্ধিতা নয়; বরং অমনোযোগিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা বলিতে পার| সে যাহা হউক, তাহার পর তৃতীয়তঃ তুমি সেই হত্যাকারীকে ধরিবার জন্য গোলদিঘীর নিকটে কয়েকজন অনুচরকেও ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলে|”
একান্ত নিরাশভাবে দেবেন্দ্রবিজয় অস্পষ্টকণ্ঠে বলিলেন, “ইহাতেও কি আমার দোষ হইয়াছে?”
হঠাৎ একটা টক্ কুলে কামড় দিয়ে ফেলিলে মুখখানা সহসা যেরূপ বিকৃতভাব ধারণ করে, সেইরূপ বিকৃত মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কি বিপদ্! এখনও তুমি নিজে সেটা বুঝিতে পার নাই? খুবই দোষ হইয়াছে-ইহার নাম ডিটেক্টিভগিরি নয়-পেয়াদাগিরি!”
কথাটায় দেবেন্দ্রবিজয় তীব্র কশাঘাতের জ্বালা অনুভব করিলেন| গুরুমহাশয়ের নিকটে কানমলা খাইয়া নিরুপায় সুবোধ বালক যেমন অপ্রতিভভাবে মুখ নত করে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাই করিলেন| ক্ষণপরে নতমুখে মহাপরাধীর ন্যায় মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “আপনি কি বলেন, হাতে পাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়াই ঠিক?”
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় একান্ত ক্ষুব্ধভাবে অরিন্দম বাবু সবেগে উঠিয়া বলিতে গেলেন-পারিলেন না| পায়ের যেখানটা বাতে ফুলিয়া উঠিয়াছিল, সহসা নাড়া পাইয়া সেখানটা ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল| যন্ত্রণাসূচক একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া তিনি তখনই আবার শুইয়া পড়িলেন| মহা গরম হইয়া বলিলেন, “কি মুস্কিল! আগে তুমি তাহাকে হাতে পাও, তাহার পর তাহাকে ধরিবার বন্দোবস্ত কর| এখন কোথায় তোমার হাত – আর কোথায় তোমার হত্যাকারী! গোলদিঘীতে নিজে ছদ্মবেশে গিয়া আগে সেই ধড়ীবাজ লোকটাকে চিনিয়া লইতে হয়| তাহার পর ধীরে ধীরে যেমন রহস্য উদ্ভেদ হইতে থাকিত-তেমনই ধীরে ধীরে ক্রমশঃ তাহার নিকটস্থ হইয়া যথাসময়ে-ঠিক যথা-মুহুর্ত্তে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হয়| হাত পাতিয়া বসিয়া থাকিলে কি হাতে পাখী আসিয়া বসে, না পাখীর পশ্চাৎদিকে থাকিয়া দূর হইতে ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদসঞ্চারে অলক্ষ্যে গিয়া তাহাকে সহসা ধরিয়া ফেলিতে হয়?”
দেবেন্দ্রবিজয় বিবর্ণ হইয়া বলিলেনম “হাঁ, আপনার কথায় এখন আমি সব বুঝিতে পারিতেছি|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তুমি তাহা না করিয়া বাগানের চারিদিকে ঘাটী বসাইয়া, কথাটা পাঁচ-কান করিয়া ফেলিয়াছ; নিজে সাধ করিয়া এমন একটা মহাসুযোগ ছাড়িয়া দিয়াছ! যাহাতে মাছে শীঘ্র টোপ ধরে, সেজন্য টোপের চরিদিকে চার ফেলিতে হয়| তুমি তাহা না করিয়া, একটা লাঠী লইয়া জল ঠেঙাইয়া চারিদিক্ হইতে মাছ তাড়াইয়া টোপের নিকটে আনিতে চেষ্টা করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাড়াতাড়ি করিয়া আমি অনেকগুলি ভুল করিয়াছি সত্য, কিন্তু এখন আর উপায় নাই-বিশেষ বিবেচনার সহিত কোন কাজ না করিলে এইরূপ ঠকিতে হয়| তা’ যাহাই হউক, আমার ত খুবই মনে হয়, এতগুলো ভুলভ্রান্তি করিয়াও আমি অনেকটা অগ্রসর হইতে পারিয়াছি| রহস্যোদ্ভদের আর বড় বিলম্ব নাই|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কথাটা বুদ্ধিমানের মত হইল না, অন্ধকারে পথ হাত্ড়াইয়া অগ্রসর হওয়া অপেক্ষা একটা আলোক সংগ্রহ করাই ঠিক-আর তাহাই বুদ্ধিমানের কাজ; নতুবা অগ্রসর হইতে হইতে এমন একটা বিপথে গিয়া পড়িতে পার যে, গন্তব্য স্থান হইতে তাহা আরও অকেন দূরে| এমন কি সেখান হইতে ফিরিয়া পুনরায় পূর্ব্বস্থানে আসিতেই তোমার দম ছুটিয়া যাইবে, তা’ গন্তব্য স্থানে তখন উপস্থিত হওয়া ত বহু দূরের কথা|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আমার ঠিক তাহা ঘটে নাই, আমি বিপথে চালিত হইয়া দূরে গিয়া পড়ি নাই; সোজা পথ ধরিতে না পারিয়া বাঁকা পথে অগ্রসর হইতেছি, ইহাই আমার বিশ্বাস| আশা করি, এইবার আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে ধরিতে পারিব| আমি এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিব, মনে করিতেছি|”
অরিন্দম বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার কাছে কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছি, মোবারক এখন জোহেরার পাণিপ্রার্থী| এখন সে মুন্সী সাহেবের সহায়তা করিতে গিয়া সত্য গোপন করিতে পারে|”
অরি| তাহা হইলে তুমি আবার মুন্সী সাহেবকে সন্দেহ করিতেছ, দেখিতেছি|
দে| কতকটা তাহাই বটে; আপনি কি বলেন? আপনার অনুমান-শক্তি যেরূপ তীক্ষ্ণ, বোধ করি, আপনি প্রকৃত হত্যাকারীকে জানিতে পারিয়াছেন|
অ| জানিতে পারিয়াছি| ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কিরূপ সময় স্থির করিয়াছিলেন?
দে| রাত বারটার সময়|
অ| তাহাই ঠিক-ঠিক হইয়াছে|
দে| কে হত্যাকারী?
অ| আমি এখন কিছু বলিব না| যাহা কিছু বলিবার, তাহা বলিয়াছি| তুমি নিজে তদন্ত করিয়া নিজের বুদ্ধিতে যদি কাজ হাঁসিল করিতে পার, তাহাতে তোমার মনে আনন্দ হইবে, আমিও শুনিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারিব| এখন আমি হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করিয়া তোমাকে নিরুদ্যম করিতে চাহি না|
এই বলিয়া অরিন্দমববু ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন| পার্শ্বস্থ টেবিলের উপরে একটা ষ্টিলের ছোট ক্যাস-বাক্স ছিল, তাহা উঠাইয়া শয্যার উপরে লইলেন, এবং চাবী লাগাইয়া খুলিয়া ফেলিলেন| তন্মধ্যে উপস্থিত খরচের জন্য দশটাকার পাঁচ-সাত কেতা নোট, কয়েকটা খুচ্রা টাকা,-পয়সা, কতকগুলা সিকি, দুয়ানি ছিল, সেগুলি বাহির করিয়া বালিসের নীচে রাখিয়া দিলেন| তাহার পর টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ ও কলম কালি লইয়া অন্যদিকে ফিরিয়া কি লিখিলেন| লিখিলেন-কালি শুকাইবার বিলম্ব রহিল না-কাগজখানি ভাঁজ করিয়া বাক্সের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন, এবং চাবি লাগাইয়া, বাক্স বন্ধ করিয়া, চাবিটা যেখানে নোট, টাকা, পয়সা রাখিয়াছিলেন, সেইখানে রাখিয়া দিলেন| তাহার পর বাক্সটি দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দিয়া বলিলেন, “ইহার ভিতরে হত্যাকারীর নাম লেখা রহিল| এখন তুমি এই বাক্সটি লইয়া যাও| যখন কৃতকার্য্য হইবে, আমার কাছে লইয়া আসিয়ো; আমি তোমার মুখে গল্পমাত্র শুনিয়া কিরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তখন এই বাক্স খুলিয়া তোমাকে দেখাইয়া দিব; এখন নয়-এখন আর কোন কথা আমার কাছে পাইবে না| আমি ইঙ্গিতে তোমাকে পূর্ব্বে অনেক কথাই বলিয়া দিয়াছি-তোমার পক্ষে তাহাই যথেষ্ট|” দুই-একটি কঠিন কথা বলিয়াছি; দেখো দাদা, সেজন্য যেন বুড়োটার উপরে রাগ করিয়ো না, তাহা হইলে বড় অন্যায় হইবে| আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করিতে পারিব না; তোমার উপরে এই অপদার্থ বুড়োটার অনেকখানি জোর খাটে-মনে থাকে যেন|”
৫.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে
পঞ্চম খণ্ড
নিয়তি-রাক্ষসী
“This is the man should do the bloody deed;
The image of a wicked heinous fault
Lives in his eye; that close aspect of his
Does show the mood of a much-troubled breast.”
Dodd’s “Beauties of Shakespeare.”