আরও বিস্ময়-একি ব্যাপার-দিলজান জীবিতা-কি ভয়ানক ভ্রম! বিস্ময়বিহ্বলচিত্তে নিনির্মেষনেত্রে দিলজানের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সহসা কেহ কিছু বলিতে পারিলেন না।
রমণী তাঁহাদিগকে অবাঙ্মুখে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া বিস্মিত হইল। মৃদুকণ্ঠে বলিল, “আপনাদের কি প্রয়োজন, মহাশয়? বোধ করি, মল্লিক সাহেবের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন; তিনি ত এখন এখানে নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিলেন, “না, আমরা আপনার সঙ্গেই দেখা করিতে আসিয়াছি।”
রমণী সবিস্ময়ে বলিল, “আমার সঙ্গে! কেন? কই আপনাদিগের কাহাকেও আমি ত চিনি না!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না চিনিতে পারেন। ঠিক আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসি নাই-আপনার পরিবর্ত্তে আমরা এখানে সৃজান বিবিকেই দেখিতে পাইব, মনে করিয়াছিলাম।”
সৃজান বিবির নাম শুনিয়া দিলজান একবার ঘৃণার হাসি হাসিয়া বলিল বলিল, “এত্ক্ষনে আমি আপনাদের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। আপনারা মনে করিয়াছিলেন, মল্লিক সাহেব সৃজানকে গৃহের বাহির করিয়া আনিয়া এখানে রাখিয়াছেন। সেই ইচ্ছাটা তাঁহার ছিল বটে, কিন্তু আমি তাহা ঘটিত দিই নাই। আমি মাঝে পড়িয়া সেদিন রাত্রিতে সব গোল বাধাইয়া দিয়াছি।”
হরিপ্রসন বাবু বলিলেন, “সেদিন রাত্রিতে তুমি সৃজানের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলে, তাহা আমরা জানিতে পারিয়াছি। তোমার সহিত তাঁহার কি কথা হইয়াছিল?”
দিলজান বলিল, “অনেক কথা হইয়াছিল। আপনারা কে, কেনই বা আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা জানিতে না পারিলে আমি সে কথা আপনাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে পারি না।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আমাদের নাম বোধ হয়, তুমি শুনিয়া থাকিবে। আমার নাম হরিপ্রসন্ন-আমি উকীল, ইনি দেবেন্দ্রবিজয়-ডিটেক্টিভ-পুলিসের একজন নামজাদা কর্ম্মচারী-”
“আর আমার নাম মুন্সী জোহিরুদ্দীন,” বলিয়া মুন্সী সাহেব নিকটবর্ত্তী একটা আসন গ্রহণ করিলেন।
দিল। (সবিস্ময়ে) আপনি-আপনি মুন্সী সাহেব।
দেবেন্দ্র। হাঁ-ইনি তোমার ভগিনীপতি।
দিল। সৃজান যে আমার সহোদরা, কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?
দেবেন্দ্র। অনেক অনুসন্ধানের পর জানিয়াছি।
দিল। কে আপনাকে বলিল?
দেবেন্দ্র। তোমার পিতা-মুন্সী মোজাম হোসেন।
দিল। (বিবর্ণমুখে) আমার পিতা! সেখানেও আপনি গিয়াছিলেন।
দেবেন্দ্র। গিয়াছিলাম বৈ কি! কোন জায়গাই বাকী রাখি নাই; নতুবা জানিতে পারিব কিরূপে?
দিল। তাহ হইলে আমার আর আমার ভগিনী সম্বন্ধে সকলি ত আপনি জানিতে পারিয়াছেন; তবে আমাকে আবার কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
দেবেন্দ্র। তোমার ভগিনী সম্বন্ধে আমরা একটি কথা জানিতে পারি নাই।
দিল। কোন্ বিষয়ে, বলুন?
দেবেন্দ্র। তাহার হত্যা বিষয়ে।
দিলজান বজ্রাহতের ন্যায় চকিত হইয়া উঠিল; তীব্রকণ্ঠে বলিল, “কি ভয়ানক! হত্যা-হত্যা! কি সর্বনাশ! কাহার কথা আপনি বলিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যেদিন রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগ করিবার কথা, সেইদিন রাত্রিতে মেহেদী-বাগানে একটা স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া যায়। আমরা প্রথমে তাহা তোমারই মৃতদেহ মনে করিয়া-ছিলাম; এখন দেখিতেছি, আমাদের সে অনুমান মিথ্যা-সে মৃতদেহ সৃজান বিবির।”
“আমার স্ত্রী! কি মুস্কিল- হা ঈশ্বর, শেষে এই করিলে!” বলিয়া মুন্সী সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অত্যন্ত কাতরভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
দিলজান শুনিয়া, সেইখানে ব্যাকুলভাবে বসিয়া পড়িল। কাতরকণ্ঠে বলিল, “কি ভয়ানক! সৃজান নাই-খুন হইয়াছে-খুন! কে তাহাকে খুন করিল?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “জানা যায় নাই; তাহাই এখন আমাদিগকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে।”
দিলজান চিন্তিতভাবে বলিতে লাগিল, “তার কে এমন ভয়ানক শত্রু ছিল, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; আপনারা কি কিছু ঠাহর করিতে পারিয়াছেন? ভাল কথা, আপনারা সৃজানের মৃতদেহ দেখিয়া আমি খুন হইয়াছি, এরূপ মনে করিয়াছিলেন কেন?”
দে। সেদিন তুমি যে কাপড়-চোপড় পরিয়া বাহির হইয়াছিলে, সৃজানের মৃতদেহে আমরা তাহা দেখিয়াছিলাম।
দিল। হাঁ, তাহাই ত বটে-এতক্ষণে আমি সব বুঝিতে পারিয়াছি, ঠিক হইয়াছে।
দে। তুমি সেদিন রাত্রিতে তোমার ভগিনীকে কোথায় শেষ-জীবিত দেখিয়াছ?
দিল। তাহার বাড়ীতে।
দে। কখ্ন তুমি চলিয়া এস?
দিল। রাত দুইটার পর।
দে। এত রাত্রি পর্য্যন্ত তোমার ভগিনীর সহিত তুমি কি করিতেছিলে? কি এত কথা ছিল?
দিল। কথা যাহা ছিল, তাহা অনেকক্ষণ শেষ হইয়া গিয়াছিল। রাত এগারটার পর সৃজান বাহির হইয়া যায়। আমি তাহার জন্য দুইটা পর্য্যন্ত তাহাদের বাড়ীতে অপেক্ষা করিয়াছিলাম।
দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিপথ হইতে যেন একখানা মেঘ সরিয়া গেল। তিনি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ওঃ! সকলই বুঝিতে পারিয়াছি-পাছে কেহ জানিতে পারে, এই ভয়ে সৃজান তোমার বেশ ধরিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল।”
দিলজান বলিল, “হাঁ-সে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল; তাহার পর তাহাকে আর আমি ফিরিতে দেখি নাই-রাত দুইটা পর্য্যন্ত আমি অপেক্ষা করিয়াছিলাম।”
হরিপ্রসন্ন বাবু খুব উৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আমার অনুমানই ঠিক, রাত বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদ খাঁর দেখা হইয়াছিল-সে নিশ্চয়ই সৃজান।”
দিলজান বলিল, “মজিদ খাঁ-মজিদ খাঁ-তাঁহাকে আমি চিনি, তিনি ইহার কি জানেন?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তিনি বিশেষ কিছু না জানিলেও-এখন তাঁহার মাথার উপরেই এই সকল বিপদ্ চাপিয়া পড়িয়াছে। দিলজানের হত্যাপরাধে অভিযুক্ত হইয়া তিনি অবস্থা-বিপাকে এখন হাজত-বন্দী।”
দিলজান বলিল, “আপনারা আমার ভগিনীর মৃতদেহ দেখিয়া মনে করিয়াছিলেন, আমি খুন হইয়াছি-কি ভয়ানক ভ্রম! কিন্তু মজিদ খাঁ-তিনি নিরীহ ভাল মানুষ; আমি তাঁহাকে জানি। তিনি কেন খুন করিতে-(সহসা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া) কি জানি আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না-আমি যতদূর-
মধ্যপথে বাধা দিয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “শোন, দিলজান, এখন কিছুই জানি না বলিলে চলিবে না। একজন নিরীহ ভদ্রলোক আজ বিপদ্গ্রস্ত-ভয়ানক বিপদ্-এমন কি তাহার প্রাণও যাইতে পারে; এ সময়ে তুমি কোন কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়ো না। তোমার ভগিনীর সহিত তোমার কি কি কথা হইয়াছিল; অকপটে সমুদয় প্রকাশ কর।”
৪.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দিলজানের কথা
দিলজান একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া এক গ্লাস জল আনিতে আদেশ করিল। ভগিনীর মৃত্যু-যে-সে মৃত্যু নহে-খুন, তাহার পর এই সকল জবাবদিহি। দিলজান যেন প্রাণের ভিতরে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল। ভৃত্য জল লইয়া আসিলে দিলজান পর্দ্দার অন্তরালে গিয়া এক নিঃশ্বাসে একগ্লাসে জল পান করিয়া ফেলিল-এবং অনেকটা যেন সুস্থ হইতে পারিল। পুনরায় আসিয়া সে দ্বারপ্রান্তে উপবেশন করিল। বসিয়া দিলজান বলিতে আরম্ভ করিল-প্রথমে স্বরটা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল-ক্রমে তাহা বেশ সংযত হইয়া আসিল। দিলজান বলিতে লাগিল;-“আমার বাল্য-জীবনী প্রকাশের কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না আপনারা তাহা এখন শুনিয়াছেন। মল্লিক সাহেব আমাকে লতিমন বাইজীর বাড়ীতে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে বিবাহ করিবেন বলিয়া আশাও দিয়াছিলেন; সেই প্রলোভনে আমি তাঁহার সহিত গৃহত্যাগ করি; কিন্তু আমাকে নিজের করতলগত করিয়া শেষে তিনি বিবাহের কথায় বড় একটা কান দিতেন না-কখন কখন আশা দিতেন মাত্র।
এইরূপে অনেকদিন কাটিয়া গেল। একদিন তাঁহারই মুখে শুনিলাম, কলিঙ্গা বাজারের মুন্সী সাহেবের সঙ্গে আমার ভগিনী সৃজানের বিবাহ হইয়াছে। শুনিয়া প্রথমতঃ সুখী হইলাম-তাহার পর ভিতরের কথা ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিয়া নিজের সর্ব্বনাশ বুঝিতে পারিলাম। শুনিলাম আমার ভগিনীও মল্লিক সাহেবের প্রলোভনে মুগ্ধ হইয়াছে। আর রক্ষা নাই-সত্বর ইহার প্রতিবিধান করা দরকার। আমি গোপনে সন্ধান লইতে লাগিলাম। একদিন শুনিলাম, আমার ভগিনী মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিবার জন্য স্থিরসঙ্কল্প। যাহাতে তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ না হয়, সেজন্য প্রাণপণ করিতে হইবে-নতুবা আমাকে একেবারে পথে বসিতে হয়। যেদিন রাত্রিতে আমার ভগিনী গৃহত্যাগের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিল, সেইদিন অপরাহ্ণে আমি মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, যেমন করিয়া হউক, তাঁহাকে নিরস্ত করিতে হইবে। পায়ে ধরিয়া পারি-না পারি, তাঁহাকে খুন করিব-এ সঙ্কল্পও আমার ছিল। তাঁহাকে খুন করিয়া সেই ছুরিতে নিজের প্রাণ নিজে বাহির করিয়া ফেলিতে কতক্ষণ সময়ের দরকার? সেজন্য আমি একখানি ছুরিও নিজের সঙ্গে লইয়াছিলাম। দারুণ নৈরাশ্যে, ঈর্ষা-দ্বেষে আমি তখন এক রকম পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম-মনের কিছুই ঠিক ছিল না। মল্লিক সাহেব তখন বাড়ীতে ছিলেন না; মজিদ খাঁর সঙ্গেই আমার দেখা হয়-মনের ঠিক ছিল না-আবেগে তাঁহাকে সকল কথা বলিয়া ফেলিলাম। তিনি আমাকে বুঝাইয়া বিদায় করিয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আমি কিছুতেই বুঝিলাম না-সে শক্তিও তখন আমার ছিল না। তিনি জোর করিয়া আমার নিকট হইতে ছুরিখানি কাড়িয়া লইতে আসিলেন। আমি কিছুতেই দিব না-তিনিও কিছুতেই ছাড়িবেন না-আমি তখন অনন্যোপায় হইয়া ছুরিখানা ঘরের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলাম। যেমন তিনি তাহা উঠাইয়া লইবার জন্য ছুটিয়া যাইবেন-দেখিতে না পাইয়া জুতাসুদ্ধ পা সেই ছুরিখানির উপরে তুলিয়া দিতে, সেখানা দুই টুক্রা হইয়া গেল। তিনি সেই ভাঙা ছুরিখানি নিজের জামার পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিলেন। আমি হতাশ হইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। বাড়ীতে ফিরিয়া মন আরও অস্থির হইয়া উঠিল-আশা ত্যাগ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। আমি আর একটা নূতন উপায় স্থির করিলাম। স্থির করিলাম, আমার ভগিনীর সহিত গোপনে দেখা করিয়া মর্ম্মকথা সমুদয় খুলিয়া বলিল। যাহাতে সে আমার গন্তব্য পথের অন্তরায় না হয়, সেজন্য তাহাকে বুঝাইয়া বলিব-নিশ্চয়ই সে আমার কথা ঠেলিতে পারিবে না-জানিয়া-শুনিয়া সে কখনই আমার সর্ব্বনাশ করিবে না। শুধু আমার নয়-সকল কথা খুলিয়া বলিলে সে নিজের সর্ব্বনাশও নিজে বুঝিতে পারিবে, মনে করিয়া আমি তাহার সহিত দেখা করিতে যাইলাম। যাইয়াই তাহার দেখা পাইলাম না; সে কোথায় নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল। আমি তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। যখন আমার ভগিনী ফিরিয়া আসিল, তখন রাত প্রায় এগারটা। আমি তাহাকে নিজের অভিপ্রায় বেশ করিয়া বুঝাইয়া বলিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে বুঝিল না-আমার সহিত ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিল। কিছুতেই সে মল্লিক সাহেবকে ত্যাগ করিতে সম্মত হইল না। শেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল;-সে অগ্রে মল্লিক সাহেবের বাড়ীতে গিয়া, তাঁহার সহিত দেখা করিয়া জানিবে, আমার কথা কতদূর সত্য-তিনি আমাকে আন্তরিক ভালবাসেন কি না-তাহার পর যাহা হয় করিবে। যদি সে বুঝিতে পারে, মল্লিক সাহেব তাহার সর্ব্বনাশ সাধনের জন্য তাহার সহিত এইরূপ প্রণয়াভিনয় আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা হইলে সে তাঁহার আশা ত্যাগ করিবে, নতুবা নহে-এইরূপ স্থির হইল। আমিও তাহা যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ করিলাম! তখনই মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করা দরকার-কিন্তু কিরূপে তেমন সময়ে সে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবে, কোন উপায় স্থির করিতে পারিল না। বিশেষতঃ তেমন সময়ে বাটীর বাহির হইয়া একজন অপর পুরুষের সহিত দেখা করা তাহার পক্ষে খুবই দোষাবহ; কিন্তু দেখা করা চাই-ই । আমি একটা নূতন উপায় ঠিক করিয়া ফেলিলাম; তাহাকে আমার কাপড় জামা ওড়্না সমুদয় খুলিয়া দিলাম। সে তাহাই পরিয়া বাহির হইয়া গেল। আমি তাহার পোষাক পরিয়া তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। পাছে কোন রকমে ধরা পড়ি, এই ভয়ে আমি তাহার শয়নকক্ষে গিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া রহিলাম। মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিয়া, যা’ হয় একটা স্থির করিয়া তাহার শীঘ্র ফিরিবার কথা ছিল; কিন্তু অনেকক্ষণ আমি তাহার অপেক্ষা করিলাম। ক্রমে রাত দুটা বাজিয়া গেল। তখনও সৃজানকে ফিরিতে না দেখিয়া আমার মনে নানারকম সন্দেহ হইতে লাগিল। মনে ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই আমাকে বড় ফাঁকি দিয়া গিয়াছে; তথাপি নিরাশ হইলাম না-গোপনে আমিও সেখানে হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। আমি বরাবর মনিরুদ্দীনের বাড়ীর দিকে গেলাম। বাড়ীর পশ্চাতে একটা গলিপথে দেখি, একখানা গাড়ী তখনও সেখানে দাঁড়াইয়া আছে। দেখিয়া অনেক ভরসা হইল; বুঝিতে পারিলাম, সৃজান আমাকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। মল্লিক সাহেব সৃজানের জন্য গাড়ী লইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। তখন আমার মাথায় আর একটা মতলব উপস্থিত হইল; আমি সেই গাড়ীর দ্বার-সম্মুখে গিয়া দ্বারের হাতলে হাত দিয়া দাঁড়াইলাম। ভিতরে মনিরুদ্দীন সাহেব বসিয়াছিলেন। তিনি আমার হাত ধরিয়া গাড়ীর ভিতরে উঠাইয়া লইলেন। অন্ধকারে আমাকে তিনি চিনিতে পারিলেন না। গাড়ীর ভিতরে আরও অন্ধকার-আমার আরও সুবিধা হইল। আমি গাড়ীর ভিতরে উঠিয়া বসিলে, তিনি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত রাত হ’ল? আমি তাঁহার অপেক্ষা মৃদুস্বরে-পাছে ধরা পড়ি-খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর করিলাম, ‘হাঁ।’ তখনই গাড়ী ছাড়িয়া দেওয়া হইল। পথে তিনি অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, পাছে কণ্ঠস্বরে আমাকে চিনিতে পারেন, সেইজন্য আমি খুব মৃদুস্বরে তাঁহার প্রশ্নের ‘হাঁ’ ‘না’ ‘হুঁ’ বলিয়া উত্তর দিতে লগিলাম। ক্রমে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল। ষ্টেশনে অনেক লোকের ভিড়-দীপালোকে চারিদিক্ আলোকিত। অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িলাম; না ঢাকিলেও ক্ষতি ছিল না-সহজে তিনি আমাকে চিনিতে পারিতেন না; তথাপি সাবধান হওয়া দরকার। যাহা হউক, আমার একটা খুব সুবিধা ছিল। আমার পরিধানে সৃজানের পোষাক-সৃজানের জাফ্রাণ রঙের সিল্কের কাপড় জামা ওড়্না-তিনি আমাকে সন্দেহ করিতে পারিলেন না। এদিকে ট্রেণ ছাড়িবার বিলম্ব ছিল না; তিনি তাড়াতাড়ি প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া আমাকে লইয়া ট্রেণে উঠিলেন। তৎক্ষণাৎ সে ট্রেণ ছাড়িয়া দিল। তখন আমি অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করিয়া দিলাম। প্রথমে তিনি আমাকে চিনিতে পারিলেন না; তাহার পর যখন তিনি নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিলেন, তখন যেন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। তখন আমি তাঁহাকে সমুদয় কথা খুলিয়া বলিলাম। শুনিয়া তিনি আমার উপরে একেবারে খড়গহস্ত হইয়া উঠিলেন- অনেক তিরস্কার করিতে লাগিলেন। আমি তাহাতে কর্ণপাত করিলাম না। তিনি পরের ষ্টশনে নামিয়া পুনরায় কলিকাতায় ফিরিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। তাহা হইলে আমি ট্রেণ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব বলিয়া তাঁহাকে আমি ভয় দেখাইলাম। তিনি আর বাড়াবাড়ি করিলেন না। ষ্টেশনের পর ষ্টেশন পার হইয়া ট্রেণ চলিতে লাগিল। তিনি আর উচ্চবাচ্য করিলেন না; আমাকে এই বাগানে আনিয়া রাখিলেন।”
৪.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – ঘটনা-বৈষম্য
দেবেন্দ্রবিজয় দিলজানকে বলিলেন, “তোমার কথায় অনেক গুপ্তরহস্য ভেদ হইল বটে; কিন্তু তোমার ভগিনীর হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদে সুবিধা হইতে পারে, এমন কোন কথাই পাওয়া গেল না। তোমার কথায় বুঝিতে পারিলাম, মজিদ খাঁ সেই ছুরি সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, মিথ্যা নহে। আর তাঁহার সহিত মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, যাহার নাম তিনি এমন বিপদে পড়িয়াও অদ্যাপি প্রকাশ করেন নাই-আমরা মনে করিয়াছিলাম, তুমিই সেই স্ত্রীলোক। এখন বুঝিলাম, তোমার বেশ ধরিয়া তোমার ভগিনীই সেখানে গিয়াছিল। একমুহূর্ত্তে সকলই উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া গেল। যাহা হউক, এখন যাহাতে যোমার ভগিনীর হত্যাকারী ধরা পড়ে, তাহা করিতে হইবে; এ পর্য্যন্ত হত্যাকারীকে ধরিবার কোন সূত্রই পাওয়া যায় নাই। তুমি কি ইহার সম্বন্ধে কিছুই জান না?”
দিল। না।
দেবেন্দ্র। তোমার ভগিনী খুন হইয়াছে, তাহা কি মল্লিক সাহেব জানিতেন? সে সম্বন্ধে তিনি তোমাকে কিছু বলিয়াছেন?
দিল। না, তিনি কিরূপে জানিতে পারিবেন?
দে। কিরূপে জানিতে পারিবেন, তা’ আমি তোমাকে কি বলিল? তিনি তোমার ভগিনীর না হউক-যে কোন একটা খুন সম্বন্ধে কিছু বলিয়াছেন কি?
দিল। না।
মুন্সী সাহেব দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “এখনকার কাজ ত সব মিটিয়া গেল; মেহেদী-বাগানের সেই নিহত স্ত্রীলোক যে আমারই স্ত্রী, সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই। এখন কি করিবেন, স্থির করিয়াছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন কলিকাতায় গিয়া একবার মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে হইবে। তিনি সেদিন রাত বারটার পর হইতে কোথায় ছিলেন, কি করিয়াছিলেন-তাঁহার গতিবিধি সম্বন্ধে সমুদয় কথা জানা এখন আমাদের বিশেষ দরকার হইতেছে।”
ব্যাঘ্রীর মত সবেগে মাথা তুলিয়া দিলজান দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “কি ভয়ানক! আপনি কি শেষে তাঁহাকেই সন্দেহ করিলেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কই-সন্দেহের কোন কথা ত আমি বলি নাই। তিনি সেদিন রাত বারটার পর কোন্ কাজে কোথায় ছিলেন, কোথায় গিয়াছিলেন, তাঁহারই গতিবিধির সন্তোষজনক উত্তর আমাদিগকে দিবেন মাত্র। ইহাতে ক্ষতি কি?”
“ক্ষতি কিছুই না,” বলিয়া দিলজান সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহাই করিবেন। আমি যাহা কিছু জানিতাম, সমুদয় বলিয়াছি।” তৎক্ষণাৎ দিলজান পর্দ্দা তুলিয়া, সেই দ্বারপথে কক্ষের বাহির হইয়া গেল।
হরিপ্রসন্ন বাবু দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সত্যই কি আপনি এখন অনুমান করিতেছেন, মনিরুদ্দীন সৃজানকে খুন করিয়াছে? সে সৃজানকে কেন খুন করিতে যাইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তা’ সৃজানকে সে কেন খুন করিতে যাইবে? সৃজানকে খুন করিবার কোন কারণই নাই; তা’ না থকিলেও সে খুন করিতে পারে আর তাহার কারণেরও কোন অভাব নাই।”
মুন্সী সাহেব চকিত হইয়া বলিলেন, “তবে কি মনিরুদ্দীন দিলজানকে খুন করিতে গিয়া ভ্রমক্রমে আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহাই ঠিক।”
৪.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রত্যাগমন
এদিকে মনিরুদ্দীন সুস্থ শরীরে বাড়ী ফিরিয়া আসিতে গনির মার আনন্দ ধরে না। সে মনিরুদ্দীনকে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে; মনিরুদ্দীনের উপরে তাহার খুব একটা স্নেহ পড়িয়া গিয়াছিল। কাল অনেক রাত্রিতে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, রেলপথে আসায় অনেকটা অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। গনির মা তাহার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিবার অবসর পায় নাই। বেলা দশটার পর নিদ্রাভঙ্গে উঠিয়া যখন মনিরুদ্দীন দ্বিতলের বৈঠকখানা গৃহে বসিয়া আল্বোলায় নল-সংযোগে ধূমপানে মনোনিবেশ করিয়াছেন, বৃদ্ধা গনির মা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইয়া, একখানি ধপ্ধপে কাপড় পরিয়া তাঁহার সম্মুখে গিয়া বসিল। গত রাত্রিতে মনিরুদ্দীন গনির মার সহিত ভাল করিয়া কথা কহে নাই বলিয়া, গনির মা মুখখানা একটু ভারি করিয়া বসিল।
মনিরুদ্দীন মৃদুহাস্যে তাহাকে পরিহাস করিয়া বলিলেন, “আর তোমার এ বিরহ-য্ন্ত্রণা দেখিতে পারি না-গনির মা, একটা নিকা করিবার চেষ্টা দেখ। চেষ্টা বা দেখিতে হইবে কেন-তুমি একবার মত্ কর, কত বাদশাহ ওম্রাও এখনি তোমার দ্বারস্থ হয়। আমি এখানে ছিলাম না- বোধ হয়, ইহার মধ্যে কোন বাদ্শাহ তোমার কাছে এক-আধখানা দরখাস্ত পেস করিয়া থাকিবে। তোমার মুখের ভাব দেখিয়া আমার ত তাহাই বিবেচনা হয়।”
গনির মা বলিল, “ওম্রাও বাদ্শাহে আর দরকার কি? আর দুইদিন বাদে একেবারে গোরের মাটির সঙ্গে নিকা হবে।”
মনিরুদ্দীন বলিল, “তাই বা মন্দ কি! কোন খবর এসেছে না কি?”
গনির মা বলিলেন, “খবর ত হ’য়েই আছে-পা বাড়ালেই হয়। এখন তামাসা থাক্, কাজের কথা শোন, তুমি এখান থেকে চ’লে গেলে একজন থানার লোক আমার কাছে তোমার সন্ধান নিতে এসেছিল।”
মনিরুদ্দীন চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “থানার লোক? সে কি, কি হইয়াছে? সে কে?”
গনির মা বলিল, “কি নাম বাপু তার-ঠিক মনে পড়্ছে না, কি দেবিন্দর না ফেবিন্দর-লোকটা বড় নাছোড়বান্দা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ওঃ! ঠিক হয়েছে, দেবেন্দ্রবিজয়-ডিটেক্টিভ-ইন্স্পেক্টর। তিনিই ত এখন আমাদের মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন।”
গনির মা জিজ্ঞাস করিল, “এ সকল কথা তুমি কোথায় শুন্লে বাপ্?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল বাড়ীতে ঢুকিবার আগেই সব শুনিয়াছি। মেহেদী-বাগানে কে একটা মাগী খুন হইয়াছে-পুলিসের লোক তাহাকে দিলজান মনে করিয়াছে-কি পাগল!”
গনির মা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে কি দিলজান সত্যি সত্যি খুন হয় নি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “না, সৃজান বিবি খুন হইয়াছে।”
গনির মা সংশয়িতচিত্তে বলিয়া উঠিল, “সে কি! তবে শুনেছিলুম, তুমি না কি সৃজানকে কোথায় নিয়ে গিয়ে রেখেছ; পাড়ার লোকের কাছে একেবারে কান-পাতা যায় না-ছেলে বুড়ো আদি ক’রে কেবল তোমার নিন্দা। দেখ দেখি কোথায় কিছু নাই-একজনের নামে অমনি এত বঢ় একটা অপবাদ কেমন করে রটিয়া দিলে গো!”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “তুমি কি আমাকে এমনই মনে কর? যাহা হউক, পুলিস এখন সৃজানের হত্যাকাণ্ডে আমাকে বোধ হয়, জড়াইতে চেষ্টা করিবে। আজ সকালেও একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের এখানে আসিবার কথা ছিল। এখনও যে তাঁর কোন দেখা নাই, তাহাই ভাবিতেছি।”
গনির মা বলিল, “কেন, এখানে আবার তোমার কাছে আস্বে কেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, ‘খুন সম্বন্ধে আমি কিছু জানি কি না, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতে আসিবেন!”
গনির মা জিজ্ঞাসা করিল, “মজিদ খাঁ কি সত্য-সত্যই খুন করিয়াছে?”
মনিরুদ্দীন বলিল, “কি আশ্চর্য্য! মজিদ খাঁকেই খুনী বলিয়া তোমার বিশ্বাস হইল? তুমি আমাদের সংসারে থাকিয়া চুল পাকাইয়া ফেলিলে-আমাদের দুইজনকে জন্মাবধি দেখিয়া আসিতেছ-নিজের হাতে মানুষ করিয়াছ, তবু তুমি আমাদের এখনও চিনিতে পারিলে না?”
এমন সময়ে কক্ষদ্বারে কে মৃদু শব্দ করিল। মনিরুদ্দীন বলিলেন, “কে ওখানে?”
ধীরে ধীরে দ্বার ঠেলিয়া একটী বালক ভৃত্য কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং মনিরুদ্দীনের হাতে একখানি কার্ড দিল।
মনিরুদ্দীন কার্ডের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গনির মাকে বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় উপস্থিত। আমি ত তোমাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, তিনি খুনের তদন্তে আজ আমার কাছেও আসিবেন। (ভৃত্যের প্রতি) যাও, তাঁহাকে এইখানেই লইয়া এস।”
ভৃত্য চলিয়া গেল। গনির মা-ও উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিল। মনিরুদ্দীন তাহাকে বসিতে বলিলেন। ক্ষণপরে তথায় দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন।
৪.০৭ – সপ্তম পরিচ্ছেদ – দোষক্ষালনের জন্য কি?
মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিয়া বলিলেন, “আপনার নাম দেবেন্দ্রবিজয় বাবু-একজন খুব খ্যাতনামা ডিটেক্টিভ, তাহা আমি শুনিয়াছি। মহাশয়ের সহিত পরিচয় হওয়ায় আমি খুব সুখী হইলাম। বোধ করি, মেহেদী-বাগানের খুনের তদন্তেই আপনি আমার কাছে আসিয়া থাকিবেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনকে একবারে কাজের কথা পাড়িতে দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “হাঁ, আপনার অনুমান ঠিক-আমি দুই-একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই; সন্তোষজনক উত্তর পাইলে সুখী হইব।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “বটে, ফরিদপুরে আমার বাগানে গিয়া যাহার সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহার নিকটে আপনি ত সকলই শুনিয়াছেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় আরও বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি তাহা কিরূপে জানিতে পারিলেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল রাত্রেই সেখানকার একখানা বড় রকম টেলিগ্রাম পাইয়াছি। আমার বাগানে যাহার সঙ্গে আপনাদের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান নয়-দিলজান, তাহা আপনি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন?”
দে। হাঁ, আমার ভুল হইয়াছিল।
মনি। আপনার ন্যায় খ্যাতনামা লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডিটেক্টিভের এমন ভুল হওয়া ঠিক নহে।
দে। উপন্যাসের ডিটেক্টিভের ভুল না হইতে পারে; আমরা সে রকমের ডিটেক্টিভ নহি-সামান্য মনুষ্যমাত্র; আমাদের পদে পদে ভ্রম হওয়াই সম্ভব।
মনি। যাক্, সে কথায় আর দরকার নাই। দিলজানই যে সেদিন রাত্রিতে সৃজানের সহিত দেখা করিতে তাহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল, আপনি ফরিদপুরে গিয়া তাহার নিজের মুখে সে কথা শুনিয়াছেন, বোধ হয়।
দে। শুনিয়াছি।
মনি। সৃজান যে এখানে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিল, তাহাও বোধ হয়, দিলজান আপনাকে বলিয়াছে।
দে। বলিয়াছে।
মনি। তবে আপনি সকলই ত শুনিয়াছেন, এ ছাড়া আমার নিকটে আর নূতন কথা কি পাইবেন?
দে। আপনার কাছে আপনার সম্বন্ধে, দুই-একটী কথা জানিবার জন্য আসিয়াছি।
মনি। কি, বলুন?
দে। সেদিন রাত্রে আপনি রাত এগারটার পর কোথায় গিয়াছিলেন-কি করিয়াছিলেন-কোথায় কাহার সহিত আপনার দেখা হইয়াছিল, আশা করি, আপনার কাছে তাহার সন্তোষজনক উত্তর পাইব।
মনি। ওঃ! এতক্ষণে আপনার মনের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম; তাহা হইলে আপনি এখন আমাকেই সৃজানের হত্যাকারী স্থির করিয়াছেন দেখিতেছি; মন্দ নয়!
দেবেন্দ্রবিজয় কোন কথা কহিলেন না। একটু অপ্রতিভভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন।
মনিরুদ্দীন বলিতে লাগিলেন, “মহাশয়, এ আপনার কিরূপ পরিহাস, বুঝিতে পারিলাম না। পরিহাস-প্রসঙ্গেও এ কথা বলা আপনার যুক্তি-সঙ্গত হয় নাই। আমার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে বোধ হয়, আপনি সবিশেষ অবগত নহেন; তাহা হইলে কখনই আপনি আমার উপরে এমন একটা ভয়ানক সন্দেহ করিতে পারিতেন না। মদ্যপ, বেশ্যাসক্ত হইলেও আমি এমন পিশাচ নহি-একজন স্ত্রীলোককে খুন করিতে যাইব। আপনি যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, মজিদ খাঁ ধৃত না হইলে আপনি কিছুতেই আমার কাছে তাহার একটিরও উত্তর পাইতেন না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, মজিদ খাঁর জন্য বাধ্য হইয়া আমাকে আপনার এই সকল প্রশ্নের উত্তর করিতে হইবে। বেশ ভাল হইয়া বসুন, বলিতেছি।” গনির মাকে বলিলেন, “তুনি এখন যাইতে পর-তোমার এখানে থাকিবার অরার কোন প্রয়োজন নাই।”
গনির মা যেমন উঠিয়া যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “আমার একটু প্রয়োজন আছে। তুমি না আমায় বলিয়ছিলে, সেদিন রাত এগারটর পর মজিদ খাঁর সহিত যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান?”
গনির মা বলিলেন, “হাঁ, দিলজানই ত – সে নিশ্চয়ই দিলজান আর কেহ নহে?”
গনির মা বলিল,”কি মুস্কিল্! আমি যে নিজের চোখে তাকে দেখেছি। আমি কি তাকে চিনি না? সেই মুখ – সেই চোখ, তা ছাড়া সন্ধ্যার আগে, সে যেমন সেজে-গুজে এসেছিল-রাতেও ঠিক সেই কাপড়-চোপড় পরেই এসেছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মিথ্যাকথা-ঠিক চিন্তে পার নাই।”
বৃদ্ধা গনির মার ক্রোধ মস্তকে উঠিল। সে হাত মুখ নাড়িয়া বলিল, “আমি বুড়োমাগী, আমার মিথ্যাকথা-তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে-আমি মিছে কথা বল্তে গেছি! কি আমার পীর-পয়গম্বর এসেছে রে” বলিতে বলিতে ক্রোধভরে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান ও সৃজান যমজ ভগিনী-উভয়েই একই রকম দেখিতে-তাহাতে উপরে আবার একই রকমের পোষাক-তাহাতে বৃদ্ধা গনির মার যে এরূপ ভুল হইবে, তাহার আশ্চর্য্য কি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ভুল হওয়াই খুব সম্ভব। যাহা হউক, আপনি এখন আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনারই কথা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “দেখুন, আমি সামান্য মনুষ্য মাত্র- প্রলোভনের দাস-প্রবৃত্তির দাস-কি জানি, কি মোহবশে সৃজানকে দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। তাহাকে লাভ করিবার জন্য আমার হৃদয় একটা অদম্য তৃষ্ণায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আপনি আমাকে অসচ্চরিত্র পরস্ত্রীলোলুপ বলিয়া ঘৃণা করিতে পারেন; কিন্তু আপনি স্থির জানিবেন, আমার কথা ছাড়িয়া দিই-অনেক সাধুপুরুষও এ প্রলোভনের হাত এড়াইতে পারে না। সেইদিন রাত্রিতে সত্যসত্যই আমি সৃজানকে লইয়া কলিকাতা ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলাম। রাত্রি এগারটার পর হইতে আমি বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে একখানা গাড়ী লইয়া সৃজানের অপেক্ষা করিতেছিলাম। নিজের গাড়ী নহে-একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। আপনি সে প্রমাণ সেই গাড়ীর কোচম্যানের নিকটে অনায়াসে পাইবেন। তাহার নাম করিম; এই জানবাজারেই সে থাকে। রাত যখন প্রায় বারটা, তখন আমি গাড়ী ছাড়িয়া একবার চলিয়া আসি; তাড়াতাড়িতে ঘড়ীটা সঙ্গে লইতে ভুল করিয়াছিলাম। পুনরায় বাড়ীর ভিতরে গিয়া ঘড়ীটা লইয়া আসিতে হইবে, মনে করিয়া আমি গাড়ী হইতে উঠিয়া আসিলাম। বাড়ীর সম্মুখভাগে আসিতেই দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক দ্রুতবেগে উন্মাদিনীর মত আমার বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল। সেদিন ভয়ানক অন্ধকারময় রাত্রি-তাহার উপর কুয়াশায় চারিদিক্ ঢাকিয়া ফেলিয়াছিল। বাহিরে অন্ধকারের মধ্যে সে কোথায় মিশিয়া গেল, আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। বহির্দ্বারের ভিতরে একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছিল; তাহারই আলোকে আমি কেবল একবার নিমেষমাত্র তাহার মুখ দেখিতে পাইয়াছিলাম; তাহাতেই তাহাকে আমি তখন দিলজান মনে করিয়াছিলাম। সাজসজ্জাও ঠিক দিলজানের অনুরূপ। আমি দেখিয়াই আর অগ্রসর হই নাই; সেখানেই স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। এমন সময়ে আর একজন কে আমার পাশ দিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। সেই স্ত্রীলোকটি যেদিকে গিয়াছিল, সেই লোকটিকেও সেইদিকে যাইতে দেখিলাম। মনে বড় সন্দেহ হইল-কে এ লোক? কেনই বা দিলজানের অনুসরণ করিতেছে? অবশ্যই ইহার ভিতরে কিছু রহস্য আছে সেটুকু দেখা দরকার। তাহারা দুইজনে যেদিকে গিয়াছিল, আমিও দ্রুতপদে সেইদিকে তখন ছুটিয়া গেলাম। নিকটবর্ত্তী সকল স্থানেই তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম। যে অন্ধকার, নিজেকেই নিজে দেখিতে পাওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করিলাম, দুইজনের কাহাকেও আর দেখিতে পাইলাম না। পরিশ্রান্ত হইয়া প্রায় একঘণ্টা পরে আবার সেই গাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। সৃজানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। রাত্রি দুইটার পর দিলজান আমার গাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি সৃজান মনে করিয়া তাহাকে ভিতরে তুলিয়া লইলাম। এদিকে গাড়ী শিয়ালদহ ষ্টেশনের দিকে চলিল। সেখানে ট্রেণে উঠিয়া আমার ভ্রম আমি বুঝিতে পারিলাম।”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত আগ্রহের সহিত মনিরুদ্দীনের কথা শুনিয়া যাইতেছিলেন। মনিরুদ্দীন নীরব হইলে, তিনি সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে লোকটিকে আপনি সেই রমণীর অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন, কে সে লোক?”
ম। কিরূপে জানিব?
দে। সে কি আপনার পরিচিতের মধ্যে কেহ নহে?
ম। পরিচিত হইলেও–তেমন অন্ধকারে তাহাকে কিরূপে চিনিতে পারিব?
দে। যদিও ঠিক না চিনিতে পারেন-তাহার আকার-প্রকারে ভাবে অমুক লোক বলিয়া আপনার মনে কোন রকম একটা ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
ম। (চিন্তিতভাবে) সে ধারণা হয় নাই কি? হওয়াই খুব সম্ভব।
দে। (ব্যগ্রভাবে) কি নাম?
ম। মুন্সী সাহেব।
দে। (চকিতে) কে, জোহিরুদ্দীন?
ম। হাঁ।
৪.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?
দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন| এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমগ্র ঘ্টনা মনে মনে তোলপাড় করিতে লাগিলেন| শেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, মনিরুদ্দীন ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’ চাপাইতে চাহেন| নিজের দোষক্ষালনের জন্য তিনি এই হত্যাপরাধটা মুন্সী সাহেবের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে পারিলেই এখন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন| লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে বিপথে চালিত করিবার চেষ্টা করিতেছে| যাহা হউক, দেবেন্দ্রবিজয় সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না|
মনিরুদ্দীন দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “কি ভাবিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি এখন মুন্সী সাহেবের উপরে এই হত্যাপরাধটা চাপাইতে চাহেন, দেখিতেছি, আপনার এইরূপ দোষারোপের কারণ যে আমি না বুঝিতে পারি, এমন মনে করিবেন না|”
মনিরুদ্দীন ক্রোধভরে বলিলেন, “না, আমি কাহারও উপরে দোষারোপ করিতেছি না; সে ইচ্ছাও আমার নাই| আমি মুন্সী সাহেবের মত একজনকে দেখিয়াছিলাম, এইমাত্র| ইহাতে আপনি দোষারোপের কথা কি পাইলেন? যাক্, আপনার সহিত আমার আর কোন কথা নাই| আপনি এখন নিজের পথ দেখিতে পারেন|” বলিয়া মল্লিক সাহেব রাগে অস্থির হইয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
দেবেন্দ্রবিজয়ও তখনই চকিতে দাঁড়াইয়া উঠিলেন; এবং অন্তর্ভেদী বক্রদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন| মনিরুদ্দীনও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন| এমন সময়ে তাঁহাদিগের পশ্চাতে কক্ষদ্বারে নিঃশব্দে ঈষন্মুক্ত হইল তখন কেহই তাহা লক্ষ্য করিলেন না|
প্রশান্তস্বরে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আর দুই-একটি প্রশ্নের সদুত্তর পাইলেই আমি নিজের পথ দেখিব| যে একঘন্টাকাল আপনি অন্ধকারে তাহাদের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন, তাহার মধ্যে আর কোন কাণ্ড ঘটে নাই? আপনি কি আর কিছুই দেখেন নাই?”
মনি| না-কিছু না|
দে| তাদের অনুসন্ধান ছাড়া আপনি আর কিছুই করেন নাই?
মনি| না|
দে| অনুসন্ধানে কোন ফল হয় নাই?
মনি| কিছুই না| আমি সে দু’জনের কাহাকেও আর দেখিতে পাই নাই|
দে| কাহাকেও না-দিলজানকেও নয়?
মনি| না|
দে| বাঃ! কেহ ইহা বিশ্বাস করিবে?
মনিরুদ্দীন আরও রুষ্ট হইলেন; ক্রোধে তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল; এবং হস্তদ্বয় দৃঢ়রূপে মুষ্টিবদ্ধ হইল| অত্যন্ত কঠিনকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এই হত্যাপরাধে আমাকেই দোষী সাবুদ্ করিতে চাহেন?”
দে| না-সে ইচ্ছা আমার আদৌ নাই| আমি আপনাকেই একবার আপনার নিজের কথা ভাবিয়া দেখিতে বলি; তাহা হইলে আপনি আমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারিবেন| ভাল, আমিই আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি| মনে করুন, কোন ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোককে লইয়া একেবারে নিরুদ্দেশ হইবার চেষ্টায় আছেন| তাঁহার আর একটি প্রণয়িনী তখন বর্ত্তমান| তাহাকেও সেই ভদ্রলোকটি পূর্ব্বে গৃহের বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন| কোন রকমে সে তাহার প্রণয়ীর এই নূতন প্রেমাভিনয়ের কথা জানিতে পারিয়া সেই রাত্রিতেই সে তাহাতে বাধা দিবার জন্য তহাদিগের বাড়ীতে আসে| সেই ভদ্রলোকটি তখন বাড়ীতে ছিলেন না; কিন্তু স্ত্রীলোকটি যখন হতাশ হইয়া বাহির হইয়া যায়, গোপনে থাকিয়া তিনি তাহাকে দেখিতে পাইয়া তখন তাঁহার অনুসরণ করেন| তাহার পর পথিমধ্যে কোন নির্জ্জন স্থানে অবশ্য তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়া থাকিবে| পরস্পর সাক্ষাতে স্ত্রীলোকটি সুমিষ্ট প্রেমসম্ভাষণের পরিবর্ত্তে নিজের অন্তর্দাহের বেগে তাঁহাকে যখন অনেকগুলি কটূবাক্য শুনাইয়া দিতে আরম্ভ করিল, তখন সেই ভদ্রলোকটি-”
মনিরুদ্দীন বাধা দিয়া বলিলেন,-“তাহাকে খুন করিল, এই ত আপনি বলিতে চাহেন? আপনার ধারণা, আমিই তাহাকে খুন করিয়াছি| ইহা আমি অনেকক্ষণ বুঝিয়াছি; কিন্তু আপনার এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক-আমার সঙ্গে সেই স্ত্রীলোকের আর দেখা হয় নাই| যদিই বা পরে দেখা হইয়া থাকে, তহা হইলে আমি আমার বাঞ্ছিত সৃজানকে দেখিতে পাইতাম-প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে|”
দেবেন্দ্রবিজয় মহা-অপ্রতিভ হইলেন| এ জীবনে তিনি আর কখনও অপ্রতিভ হন্ নই| মনে ভাবিলেন, এই খুনের কেসটা ভয়ানক বিশ্রী| কয়েকদিন হইতে অনবরত ভাবিয়া ভাবিয়া, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, তাঁহার মাথা যেন একেবারে বিগ্ড়াইয়া গিয়াছে; নতুবা তিনি নিজে আজ সহসা এমন একটা ভুল করিয়া ফেলিতেন না| তিনি ইহাও সহজে বুঝিতে পারিলেন, মনিরুদ্দীন বড় ধূর্ত্ত, তাঁহারই সমকক্ষ বুদ্ধিমান্-সহজে হটিবার পাত্র নহেন| নিমেষের মধ্যে অনেক কথাই তাঁহার মনে পড়িল-সেই বেনামী পত্রাবলী-ঘুষ দেওয়ার প্রলোভন, নির্জ্জন গলিপথে অলক্ষিতে লগুড়াঘাত-সেই সকল ক্রিয়ার কর্ত্তা-এই কি সেই লোক? সন্দেহে দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তিষ্ক বড় চঞ্চল হইয়া উঠিল| তিনি সহসা অতি কঠিনকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, কথাটা বলা আমার ভুল হইয়াছে-স্বীকার করি; কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানিবেন কি ভয়ানক বিপদের বজ্র আপনার মাথার উপরে উদ্যত রহিয়াছে| সহজে আপনি নিষ্কৃতি পাইবেন না| দিলজান মনে করিয়া আপনি ভ্রমক্রমে সৃজানকেও খুন করিতে পারেন-তাহাই ঠিক| আপনি খুন না করিলে এরূপ ভাবে, এরূপ সময়ে কে তাহাকে খুন করিল?”
“দিলজান|”
৪.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সম্ভব?
পশ্চাৎ হইতে কে উত্তর করিল, কি আশ্চর্য্য! স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর না? দেবেন্দ্রবিজয় ও মনিরুদ্দীন উভয়েই মহা বিস্মিত হইয়া মাথা তুলিয়া ফিরিয়া দেখিলেন, মুক্ত কক্ষদ্বারে দাঁড়াইয়া মুক্তকেশা দিলজান| তাহার কৃষ্ণচক্ষুঃ জ্বলিতেছে, -সুকৃষ্ণকেশপাশ আলুলায়িত-কতকগুলা চোখে মুখে আসিয়া পড়িয়াছে-কি এক তীব্র উত্তেজনায় তাহার আপাদমস্তক কম্পিত হইতেছে! তাহার দক্ষিণ হস্তে একখানি সুদীর্ঘ শাণিতা ছুরিকা-তাহাও ভয়ানক বেগে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে-দৃষ্টি উন্মাদের; কিন্তু স্বর অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়-দৃঢ়স্বরেই দিলজান বলিল, “আর কেহ নহে, এই দিলজান নিজে| আমার জন্য একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করিয়ো না| আমি অন্তরালে থাকিয়া সমুদয় শুনিয়াছি-কাহারও কোন দোষ নাই-আমি শয়তানীই সকল অনর্থের মূল| তোমরা যে আমার অপরাধ একজন নির্দ্দোষীর উপরে ফেলিবে, তা’ আমি তোমাদের কথার ভাবে ফরিদপুরের সেই বাগানেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম| যত শীঘ্র পারিয়াছি, এখানে চলিয়া আসিয়াছি| আরও শীঘ্র পৌঁছতে পারিলে ভাল হইত-মল্লিক সাহেবকে সকল কথা বলিয়া সাবধান করিয়া দিতে পারিতাম| ঠিক সময়ে আসিতে পারি নাই-যাহা মনে করিয়াছিলাম, তাহা হইল না| তাহা না হইলেও এখানে অসিয়া তোমাদের হাত হইতে এখন একজন নির্দ্দোষীকে যে রক্ষা করিতে পারিলাম, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট| কে আমার ভগিনীকে খুন করিয়াছে, শুনিতে চাও? আমি নিজে-নিজের হাতে নিজের ভগিনীকে খুন করিয়াছি-রোষে, দ্বেষে, প্রাণের জ্বালায়, দারুণ ঈর্ষায় উন্মাদিনী হইয়া ভগিনী ভগিনীর বুকে ছুরি বসাইতেও কুণ্ঠিত হয় নাই| সৃজান যেমন আমাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইল, আমিও তখনই গোপনে তাহার অনুসরণ করিলাম| সৃজান এখানে আসিলে আমি পথে গোপনে তাহার অপেক্ষা করিোতে লাগিলাম| এখান হইতে সে বাহির হইলে আবার আমি তাহার অনুসরণ করিয়া মেহেদীবাগানে তাহাকে ধরিলাম| সে কিছুতেই মল্লিক সাহেবকে ত্যাগ করিতে চাহিল না| আমি তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম| সে না বুঝিয়া মর্ম্মভেদী কটুক্তি বর্ষণ করিয়া আমার রাগ বাড়াইয়া দিল| আমি আর সহিতে না পরিয়া এই ছুরিতে তাহাকে খুন করিলাম|” হস্তস্থিত রৌপ্যমণ্ডিত সুদীর্ঘ ছুরিকা দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ের কাছে সজোরে নিক্ষেপ করিল| শারীরিক ও মানষিক উভয়বিধ দারুণ উত্তেজনায় তখনই দিলজানের সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়া গেল| সে সেইখানে মৃতবৎ লুটায়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানি তাড়াতাড়ি কুড়াইয়া লইলেন| এবং মনিরুদ্দীন স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইলেন| পরক্ষণে মনিরুদ্দীন ছুটিয়া গিয়া দিলজানের মাথার কাছে ভূলগ্নজানু হইয়া বসিয়া ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “একি ভয়ানক ব্যাপার!”
দে| সত্য হইলে খুব ভয়ানক বৈ কি!
ম| আপনি কি বিশ্বাস করেন না?
দে| একটি বর্ণও না|
৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায় অরিন্দম