Mme-de Mon [aside], A clue-another clue-that I
will follow,
Until it lead to the throne?
Lord Lytton- The Duchess de la Vulliere. Act III, Scene III.
প্রথম পরিচ্ছেদ
আর এক উদ্যম
দেবেন্দ্রবিজয় বাটীতে পৌঁছিয়া বস্ত্রাদি পরিবর্ত্তন করিলেন। তখনই ডাক্তারের কাছে খবর গেল। ডাক্তার আসিয়া তাঁহার মস্তকের ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিয়া গেলেন।
অপরাহ্নে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশচন্দ্রকে নিকটে ডাকিলেন। তিনি লতিমন বাইজীর বাটীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন আল্মারীর ভিতর হইতে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া বলিলেন, “আমার হাতে এটা দেখিতে পাইতেছ?”
শ্রীশচন্দ্র মাথাটা একপার্শ্বে খুব অবনত করিয়া মনোভাব প্রকাশ করিল-মুখে কিছু বলিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, ” তোমাকে এবার একটা বড় শক্ত কাজ করিতে হইবে। কল্যকার সেই মজিদের কথা তোমার খুব মনে আছে বোধ করি।
সেই ভদ্রলোকের বাড়ীতে ঠিক এই রকম আর একখানি ছুরি আছে; যে কোন প্রকারে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া আনিতে হইবে। পারিবে?”
শ্রীশচন্দ্রের ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইল। মুখে একবার গভীর চিন্তার রেখা ফুটিয়া উঠিল। ক্ষণপরে পাকা বুদ্ধিমানের ন্যায় মস্তক সঞ্চালনপূর্ব্বক বলিল, “খুব পারিব?”
নবীন গোয়েন্দা শ্রীশচন্দ্র কিরূপ কৌশলে কার্যে্যাদ্ধার করিবে, ঠিক করিতে না পারিয়া, প্রবীন দেবেন্দ্রবিজয় সবিস্ময়ে শ্রীশের মুখের দিকে চাহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে?”
শ্রীশ বলিল,”যেরূপে পারি। যদি ছুরিখানি মজিদ খাঁর বাড়ীতে থাকে, আমি নিশ্চয়ই সন্ধান ক’রে বাহির করিব। ত’ যদি না পারি, তবে এতদিন আপনার কাছে প’ড়ে আছি কেন? আজ সন্ধ্যার পর মুসলমান ছেলেদের মত কাপড়-চোপড় প’রে, তার দরজায় হত্যা দিয়ে পড়ব-মড়ার মত প’ড়ে থাক্ব। যেন না খেতে পেয়ে মরতে বসেছি, ঠিক এমন ভাব দেখাব। অবশ্যই ছেলে-মানুষ দেখে ,মজিদ আমাকে কিছু খেতে দিবার জন্য বাড়ীর ভতরে নিয়ে যাবে। একবার বাড়ীর ভিতরে যেতে পারলে শর্ম্মারামকে আর পায় কে-কাজ না শেষ ক’রে, শর্ম্মারাম সে বাড়ী থেকে সহজে বেরুবে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যেরূপে পার, কার্য্যোদ্ধার করা চাই। খুব সবধান, ছুরিখানা যদি পাওয়া যায়, খুব সবধানে রাখিবে; বিষাক্ত ছুরি-একটুখানি কাটিয়া গেলে আর রক্ষা নাই-মনে থাকে যেন।”
শ্রীশচন্দ্র বলিল, “খুব মনে থাকিবে।”
৩.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যমের ফল
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ গিয়াছে। আকাশে মেঘ, তন্নিম্নে অন্ধকার, মেঘও অন্ধকার যন একসঙ্গে মিশিয়াছে। মেঘে সনাথনক্ষত্রমালা ঢাকা পড়িয়াছে। এবং অন্ধকারে গগনতলস্পর্শী বড় বড় গাছগুলা প্রকাণ্ড দৈত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।
এমন সময়ে শ্রীশচন্দ্র দীন মুসলমান বালকের বেশে বাটী হইতে বাহির হইল। একেবারে সরাসরি মজিদের বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। গোপনে খবর লইল, মজিদ খাঁ বাড়ীতে নাই-সান্ধ্য-ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। শ্রীশচন্দ্র মনে মনে বুঝিল, খাঁ সাহেব তাহা হইলে এখনই ফিরিবেন। দ্বার সম্মুখস্থ সোপানের উপরে তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়িল।
অনতিবিলম্বে মুষলধারে ভয়ানক বৃষ্টি আরম্ভ হইল। মেঘের গর্জ্জনে দিগবলয় পর্য্যন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এবং ঘন ঘন ক্ষণপ্রভার তীব্র দীপ্তিতে বিরাট বিশ্ব আলোকিত হইতে লাগিল। ইহাতে শ্রীশচন্দ্র সুবিধা বোধ করিল; সেইখানে শুইয়া পড়িয়া বৃষ্টিজলে ভিজিতে লাগিল এবং কাঁপিতে লাগিল।
পথে লোকের গতিবিধি নাই বলিলেই হয়; কদাচিৎ কোন পথিক ছাতা মাথায় দিয়া দ্রুতবেগে বাটী ফিরিতেছে; কদাচিৎ কোন ইতর শ্রমজীবী কর্ম্মস্থান হইতে বাটী ফিরিতেছে-ভিজিতে ভিজিতে, গায়িতে গায়িতে চলিয়াছে। শ্রীশচন্দ্রকে লক্ষ্য করিবার কাহারও অবসর নাই। পথে প্রায় এক হাঁটু জল জমিয়া গিয়াছে। কিয়ৎপরে শ্রীশচন্দ্র একটা শব্দ শুনিতে পাইল; বোধ হইল কে একটা লোক ছপ্ ছপ্ শব্দে জল ভাঙিয়া তাহারই দিকে আসিতেছে। যে হউক না কেন, মজিদ খাঁ আসিতেছেন, মনে করিয়া শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে লাগিল-কাঁপিতে লাগিল। পদশব্দে বুঝিতে পারিল, লোকটা তাহারই দিকে আসিতেছে। শ্রীশচন্দ্র একবার বক্রদৃষ্টিপাতে বিদ্যুতের আলোকে দেখিয়া লইল, তাহার অনুমান মিথ্যা নহে-মজিদ খাঁ বটে।
মজিদ অন্ধকারে আর একটু হইলেই শ্রীশচন্দ্রের ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিতেন। গেঙানি শব্দ শুনিয়া তিনি চমকিত চিত্তে একপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন। মজিদ খাঁ হউন আর যিনিই হউন, কাহারও পা তাহার ঘাড়ের উপরে পড়িয়া বেদনা প্রদান করে, এইরূপ ইচ্ছা শ্রীশচন্দ্রের আদৌ ছিল না, সুতরাং মজিদ নিকটস্থ হইলে, সে একটু জোরে জোরে গেঙাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। মজিদ সবিস্ময়ে বলিলেন, “কেরে তুই, এখানে?”
শ্রীশচন্দ্র পড়িয়া পড়িয়া গেঙাইতে লাগিল-উত্তর করিল না; বরং এবার একটু মাত্রা চড়াইয়া দিল।
মজিদ বলিলেন, “কে তুই? এমন করছিস্ কেন, কি হয়েছে?”
শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে গেঙাইতে কহিল, “আ-মি-এ-সমা-ইল, আজ-দু-দিন-খাও-য়া-হয়-নি।” পেটে হাত বুলাইতে এবং গেঙাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া মজিদের হৃদয় দয়া নামক কোন অদৃশ্য স্নৈহিক পদার্থ আর্দ্রীভূত হইল। তিনি অবনত হইয়া ছদ্মবেশী শ্রীশের গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া কহিলেন, “অসুখ করেছে না কি, কি অসুখ করছে?”
শ্রীশচন্দ্র নিজের ক্ষুদ্র উদরে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিল, “যত অসুখ-এই পেটের-ভ-ত-রে। আজ-দু-দিন-খেতে-পাই-নি। পেট-জ্ব’-লে-গে-ল।”
মজিদের মন করুণাপূর্ণ। তিনি সেই অজাতশ্মত্রু বালকের ধূর্ত্ততা বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার বোধ হইল, সত্যসত্যই বালকের অত্যন্ত কষ্টভোগ হইতেছে। তিনি শ্রীশচন্দ্রকে নিজের গৃহমধ্যে লইতে ব্যস্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি উঠিতে পারিবে? এখানে পড়িয়া থাকিলে মারা পড়িবে। আমি তোমাকে খাইতে দিব। ওঠ দেখি।” বলিয়া তিনি শ্রীশের হাত ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন।
বুদ্ধিমান শ্রীশ নানারূপে নিজের যন্ত্রণা ও দৌর্ব্বল্য প্রকাশ করিয়া-টলিয়া-হেলিয়া-বসিয়া-অনেক রকম ভঙ্গি করিয়া টলিতে টলিতে উঠিল। মজিদ অনেক কষ্টে তাহাকে সোপান অতিক্রম করিয়া দ্বিতলে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। শ্রীশচন্দ্র অবসন্নভাবে সেই গৃহতলে পুনরায় শুইয়া পড়িল-পড়িয়া ভয়ানক কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এবং বাইন্ মৎস্যের মত ঘন ঘন পাক্ খাইতে লাগিল। কেবল গেঙানিটা একটু কম পড়িল।
মজিদ দীপ জ্বালিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, আমি এখনই গরম দুধ লইয়া আসিতেছি।” বলিয়া ব্যস্তভাবে নীচে নামিয়া গেলেন।
মজিদ চলিয়া যাইবামাত্র শ্রীশ একবার ঘরের চারিদিক্টা দেখিয়া লইল। দেখিল, কেহ কোথায় নাই, ঘর আলোকিত-একেবারে লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।
গৃহ-প্রাচীরের পার্শ্বে একটা আল্মারী ছিল, শ্রীশ তাহা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল। দীপবর্ত্তিকা হস্তে তাড়াতাড়ি চারিদিক্ বেশ করিয়া দেখিয়া লইল। তন্মধ্যে ছুরি পাওয়া গেল না।
গবাক্ষের নিকটে একখানি টেবিল ছিল। শ্রীশ ছুটিয়া সেই টেবিলের নিকটে গেল; এবং টেবিলের উভয় পার্শ্বস্থ ড্রয়ার দুইটিই একেবারে দুই হাতে টানিয়া খুলিয়া ফেলিল; তাহার ভিতরে যে সব কাগজ-পত্র ছিল, তাহা উল্টাইয়া দেখিল-ছুরি নাই।
একপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র বিছানা ছিল। শ্রীশ সেই বিছানার গদি, বালিশ, লেপ সমুদয় তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, সেখানেও ছুরি পাওয়া গেল না। এত পরিশ্রম সার্থক হইল না-শ্রীশ বড় হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু হতাশ হইয়া বসিয়া থাকিবার এ সময় নহে-আর এক মুহূর্ত্ত ভাবিবার সময় নাই-এখনই মজিদ আসিয়া পড়িবেন। তিনি আসিয়া পড়িলে আর কিছুই হইবে না-সকল শ্রম পণ্ড হইবে। এত জলে ভেজা-এত গেঙানি-এত কাঁপুনি সকলই বৃথা হইবে। এমন কি প্রতিপালক দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে মুখ দেখানই ভার হইবে। শ্রীশচন্দ্র ব্যাকুলভাবে গৃহের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতে লাগিল। টেবিলের উপরে একটা কাঠের বাক্স ছিল। সেই বাক্সের উপরে শ্রীশের দৃষ্টি পড়িল। শ্রীশ বাক্স খুলিতে গেল, খুলিতে পারিল না-তাহা চাবিবন্ধ। বাক্সটা কৌশলে খুলিবার সময় ইহা নহে-ভাঙিতে গেলেও বিলম্ব হইবে-ততক্ষণে মজিদ আসিয়া পড়িবেন। শ্রীশ মনে ভাবিল, যখন ছুরি ঘরের আর কোথাও পাওয়া গেল না; তখন নিশ্চয়ই তাহা এই বাক্সের ভিতরে আছে; কিন্তু বাক্সটি চাবিবন্ধ, শ্রীশের বড় আশায় ছাই পড়িল! শ্রীশ একবার মনে করিল, বাক্সটি তুলিয়া লইয়া জানালা দিয়া পার্শ্বের গলিপথে ফেলিয়া দেবে-তাহার পর সময় মত খুলিয়া দেখিতে পারিবে। যেমন সঙ্কল্প-তেমনই কাজ-শ্রীশ দুই হাতে বাক্সটি লইয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের দিকে অগ্রসর হইল। এমন সময়ে গবাক্ষ পার্শ্ববর্ত্তী একখানি ছবির দিকে সহসা তাহার নজর পড়িল। শ্রীশ দেখিল, সেই ছবির পার্শ্বে ছুরির অগ্রভাগের মত কি একটা দেখা যাইতেছে; বাক্স রাখিয়া শ্রীশ তখনই সেটা আগে টানিয়া বাহির করিল-একখানা ছুরিই বটে-ঠিক সেই রকমের ছুরি-ঠিক এই রকমের একখানা ছুরি সে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দেখিয়া আসিয়াছে; কিন্তু ইহার বাঁট নাই-তা’ না থাক্। শ্রীশ তাড়াতাড়ি সেই বাক্সটি যথাস্থানে রাখিয়া দিল। দীপবর্ত্তিকা লইয়া পুনরায় সেই ছবির পশ্চাদ্ভাগ অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, সত্যসত্যই সেখানে ছুরির ভাঙা বাঁটখানা পড়িয়া রহিয়াছে। শ্রীশ তখনই ছুরিখানি ঠিক করিয়া সেই বাঁটের মধ্যে বসাইয়া দিল; তখন তাহার আর কোন সন্দেহ রহিল না, এই ছুরিই বটে।কার্যে্যাদ্ধার হইয়াছে, শ্রীশের মনে আর আনন্দ ধরে না-এমন কি আনন্দে সে লাফাইবে-কি নাচিবে-কিছুই ঠিক করিতে পারিল না; কিন্তু লাফাইবার অথবা নাচিবার সে সময় নহে- সে জ্ঞান শ্রীমান্ শ্রীশচন্দ্রের খুব ছিল। ছুরিখানা বিষাক্ত; পাছে, অসাবধানে কোথায় কাটিয়া-কুটিয়া যায়, এই ভয়ে সেই শ্রীশ একখানি ইংরাজী খবরের কাগজ ছিড়িয়া আট-দশ ভাঁজে সেই ছুরিখানা মুড়িয়া তখনই তাহা কটির বসনাভ্যন্তরে অতি সন্তর্পণে লুকাইয়া ফেলিল। শ্রীশ এত সত্বর-এত দ্রুতহস্তে এই সকল কাজ শেষ করিয়া ফেলিল যে, দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হয়।
এমন সময়ে বাহির সোপানে মজিদ খাঁর দ্রুত পদশব্দ শ্রুত হইল। ইতিপূর্ব্বে গৃহতলে যেখানে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতেছিল, পুনরায় সে ঠিক সেইস্থানে নিজের ক্ষুদ্র দেহখানা বিস্তার করিয়া দিল; এবং পূর্ব্বভাব অবলম্বন করিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিল-এ পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। শ্রীশ বাহাদুর ছেলে!
৩.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কে ধরা পড়িল?
এমন সময়ে মজিদ খাঁ দুগ্ধপূর্ণ একটা বড় কাচের পেয়ালা হস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দুগ্ধ হইতে ধুঁয়া উড়িতেছে। মজিদ দুঃখিত ভাবে কহিলেন, “বড় কষ্ট হইতেছে-না?”
শ্রীশ রোদনের সুরে কহিল, ” বড় কষ্ট-পেট জ্ব’লে গেল-বুক পর্য্যন্ত শুকিয়ে গেছে-হুজুর-আমি আর বাঁচব না!”
“ভয় কি!” বলিয়া জানুতে ভর দিয়া মজিদ শ্রীশের মাথার কাছে বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, “এই দুধটুকু খেয়ে ফেল দেখি; গায়ে এখনই জোর পাবে।”
শ্রীশ অনেক কষ্টে (?) উঠিল। এবং দুধের পেয়ালা নিজের হাতে লইয়া পান করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
মজিদ নিকটস্থ একখানা চেয়ারে বসিয়া, একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিয়া টানিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন, এবং প্রসন্ননেত্রে বালক শ্রীশের দুগ্ধ পান দেখিতে লাগিলেন।
হায়, হতভাগ্য মজিদ! তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই-কালসর্পকে দুগ্ধ দিয়া পোষণ করিতেছ-এখনই একটা সুযোগ পাইলে সে তোমাকেই দংশন করিবে। দুগ্ধপান শেষ করিয়া শ্রীশ ভাবভঙ্গিতে জানাইল, সে অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে। সুস্থ হইবার কথা-এক সেরের অধিক দুগ্ধ তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল।
মজিদ জিজ্ঞাসা করিলেন, ” আর কিছু খাবে?”
শ্রীশ বলিল, ” আর কিছু না-হুজুরের দয়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম-আপনি না দয়া কর্লে এতক্ষণে জাহান্নমে যেতে হ’ত।”
মজিদ তাহাকে কিছু পয়সা দিলেন। বলিলেন, “এই পয়সা নিয়ে যাও, এখনও খাবারের দোকান খোলা আছে, কিছু খাবার কিনে খাও গিয়ে।”
শ্রীশ ছাড়িবার পাত্র নহে-অনেকগুলি পয়সা ট্যাঁকে গুঁজিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
মজিদ খাঁ নিজের ঘরের দ্বার বন্ধ করিলেন। তখন ঝড়-বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছিল। আকাশ পরিষ্কার-মজিদ খাঁ সমুদয় গবাক্ষগুলি খুলিয়া দিলেন। গবাক্ষপথে চাহিয়া দেখিলেন, সেই অনাহারক্লিষ্ট বালক, এক্ষণে পার্শ্বস্থ গলিপথে দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছে। আপনমনে বলিলেন, “পরোপকারে মনের তৃপ্তি হয়-ফলও আছে।”
বলিতে কি, মজিদ এই পরোপকারে যে ফলপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা পাঠক নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তি পাঠে বুঝিতে পারিবেন।
পরদিন অপরাহ্নে মজিদ নিজের ঘরে বসিয়া মনিরুদ্দীনের জমিদারী সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ ঠিক করিতেছিলেন।
এমন সময়ে দুই ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইলেন তন্মধ্যে একজন দেবেন্দ্রবিজয়, একজন স্থানীয় থানার জমাদার। মজিদ খাঁ দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চকিতে চাহিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আবার কি মনে ক’রে?”
দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে একখানি ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দেখাইলেন। মজিদ আরও চমকিত হইয়া, মহা ভয় পাইয়া কহিলেন, ” কি সর্ব্বনাশ! এ ওয়ারেন্ট যে আমারই নামে! আমি কি করিয়াছি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনি দিলজানকে হত্যা করিয়াছেন। সেই হত্যাপরাধে মহারাণীর নাম লইয়া আপনাকে এখন বন্দী করিলাম।”
তখনই মজিদ খাঁর হাতে সশব্দে হাতকড়ি পড়িল। মজিদ খাঁ বন্দী হইলেন।
৩.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য
দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করিলেন বটে, কিন্তু মজিদ দোষী কি নির্দ্দোষ, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার মনের ভিতরে সেই সন্দেহ পূর্ব্ববৎ রহিল। যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, সেই ছুরিকানি মজিদ খাঁর গৃহে পাওয়া গিয়াছে-ইহা একটা খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ বটে; এবং এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই তিনি মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন; কিন্তু মজিদ যে দিলজানকে খুন করিয়াছেন, তাহার কোন সুবিধাজনক কারণ দেখিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন, এ খুনটা অত্যন্ত জটিল রহস্যে পূর্ণ-ইহার স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও কঠিন। এরূপ স্থলে এখন যাহার উপরে একটুমাত্র সন্দেহ হইবে, তাহাকে ধরিয়া নাড়াচাড়া দিতে হইবে-নতুবা সহজে রহস্যোদ্ভেদ হইবে না; সেইজন্য দেবেন্দ্রবিজয় মজিদ খাঁকে ঠিক দোষী বলিয়া বুঝিতে না পারিলেও তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা যুক্তিসঙ্গত বোধ করিয়াছিলেন। যেমন সেই ছুরিতে একদিকে মজিদের উপরে দেবেন্দ্রবিজয়ের সন্দেহ প্রবল হইয়াছে; আর একদিকে শ্রীশ প্রমুখাৎ মজিদ ও জোহেরার কথোপকথন সম্বন্ধে যাহা তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহাতে মজিদের উপর হইতে সন্দেহটা কিছু হাল্কা হইয়াও গিয়াছে। মজিদের কথার ভবে বুঝা যায়, তিনি নিজেই মনিরুদ্দীনকে সন্দেহ করিতেছেন। দেবেন্দ্রবিজয় আবার ভাবিলেন, ” এমনও হইতে পারে, মজিদ জোহেরাকে মিথ্যা বলিয়াছে-আত্মদোষ ক্ষালনার্থে অনেকেই পরের উপর ঝোঁক্ দিয়া থাকে। মজিদ হয় দোষী, না হয় কোন-না-কোন রকমে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছেন। আরও বেশ বুঝা যাইতেছে, সৃজান বিবির গৃহত্যাগের সহিত এই খুনের মাম্লার কিছু সংশ্রব আছে। খুনের রাত্রে যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, সে কে? দিলজান? দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে বারাঙ্গনা-মুন্সী জোহিরুদ্দীনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। তবে এরূপও হইতে পারে, সৃজান বিবি তাহার মনিরুদ্দীনকে কাড়িয়া লইতেছে দেখিয়া, সে সৃজান বিবিকে দুই একটা কঠিন কথা শুনাইয়া দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। এইরূপ গাত্রদাহ উপস্থিত হইলে রমণীমাত্রেই দিগবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে; এবং তখন তাহাদের ভালমন্দ বিবচনা করিবার ক্ষমতা থাকে না। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে দিলজান। দেখিতেছি, এ রহস্য-সমুদ্রের তলদেশ পর্য্যন্ত আমাকে নামিতে হইবে।” মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দ্দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে সাধারণ ভদ্রলোকের মত সাদাশিধে পোষাকে বাহির হইয়া পড়িলেন; এবং লতিমন বাইজীর বাটী-অভিমুখে চলিলেন।
লতিমন বাইজী এবার দেবেন্দ্রবিজয়কে খুব খাতির করিয়া নিজের ঘরে লইয়া বসাইল। লতিমন দিলজানকে খুব ভালবাসিত। যাহাতে তাহার হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িয়া স্ব-কৃত পাপের ফলভোগ করে, তাহাতে লতিমন বাইজীরও খুব আগ্রহ দেখা গেল। এক্ষণে সে দেবেন্দ্রবিজয়কে প্রচুর সাহায্য করিতেও প্রস্তুত। প্রথম হইতেই সে অযাচিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি বহুবিধ উপদেশ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কাজের কথা কিছুও পাইলেন না। তিনি নিজের একেবারে নিজের কথাই পাড়িলেন! বলিলেন, “সেদিন রাত্রে দিলজান বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইবার সময়, কোথায় সে যাইতেছে, সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “তাহা ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, কেবল মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে? আর কোথায় নহে কি?
লতি। কই, আমাকে আর কোনখানে যাইবার কথা কিছু বলে নাই।
দেবেন্দ্র। নাই বলুক-তার ভাব-গতিক দেখিয়া ত কোন কথায় আপনি কি তখন এরূপ একটা অনুমান করিতে পারেন নাই যে, দিলজান সৃজান বিবির নিকটেও যাইবে?
লতি। (সবিস্ময়ে) সৃজান বিবি! সৃজান বিবির কাছে সে কি করিতে যাইবে?
দে। কি করিতে যাইবে, তা’ আমি কি করিয়া বলিব? আমার ধারণা যাহা হউক, একটা-কিছু করিতে সে গিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়, মজিদ ও জোহেরার সেই কথোপকথনের সারাংশ লতিমন বাইজীকে শুনাইয়া দিলেন। বাইজী এতক্ষণে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সব শুনিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তা’ হবে-আর্শ্চয্য কি! আমি ত ইহার কিছুই জানি না।”।
দে। তা’ না জানেন-ক্ষতি নাই। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের বাড়ীর দাসী-বাঁদীদের কাহাকেও আপনি চিনেন কি?
লতি। চিনি একজনকে আমি খুব চিনি, সে আমার এখানে দুই-তিন মাস কাজ করিয়া গিয়াছে। তার নাম সাখিয়া-সে এখন খোদ সৃজান বিবিরই বাঁদী।
দে। (সাগ্রহে) বটে! তবে সে নিশ্চয় অনেক খবরই রাখে। কোন রকমে এখন তাকে এখানে যদি একবার আনাইতে পারেন, তাহা হইলে আমার অনেকটা উপকার হয়। তাহার মুখ হইতে সকল কথাই আমি বাহির করিয়া লইতে পারি।
লতি। কেন পারিব না? আমার কথা সে কখনই ঠেলিবে না। এখন কর্ত্রী নাই, কাজকর্ম্মও তার হাতে বিশেষ কিছু নাই; খবর পাইলে এখনই সে আসিবে। আমি তার কাছে লোক পাঠাইতেছি।
দে। এখনই একজন লোক পাঠাইয়া দিন্, বিলম্ব করিবেন না। যতক্ষণ না সে আসে, ততক্ষণ আমাকে তাহার অপেক্ষায় এখানেই বসিয়া থাকিতে হইবে।
আচ্ছা, আমি এখনই ইহার বন্দোবস্ত করিতেছি,” বলিয়া লতিমন ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন সে দ্বারের নিকট গিয়াছে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, ” দাঁড়ান, আর একটা কথা আছে।”
লতিমন ফিরিয়া দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমি দিলজানের ঘরটা একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই; বিশেষতঃ বাক্স-দেরাজগুলি আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে হইবে।”
শিহরিত হইয়া সভয়ে লতিমন বলিল, “কেন, বাক্স-দেরাজ দেখিয়া কি হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেরাজ-বাক্সে লোকে অনেক রকম জিনিষ রাখে। গুপ্তচিঠি-পত্রও থাকিতে পারে, বিশেষতঃ কোন গুরুতর কারণ উপস্থিত না হইলে স্ত্রীলোক সহজে চিঠি-পত্র নষ্ট করে না। প্রেমপত্রাদি আরও যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করে। যদি দিলজানের সেই রকম দুই-একখানা চিঠিপত্র পাওয়া যায়, হয়ত তাহা হইতে দিলজানের পূর্ব্ব-জীবনের অনেক কথা প্রকাশ পাইতে পারে। আর কোন উদ্দেশ্যে কে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহাও জানা যাইতে পারে। আমাদের দেখা আছে, গুপ্তচিঠিপত্রে অনেক সময়ে অনেক কাজ হয়।”
চিন্তিতভাবে লতিমন ক্ষণপরে কহিল, “তাহা হইলে মজিদ খাঁকে খুনী বলিয়া আপনার বোধ হয় না?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন,” সে কথা এখন কিরূপে বলিল্ব? আমি এখন কোন কারণ খুঁজিয়া পাই না, যাহাতে মজিদ দিলজানকে খুন করিয়াছে বলিয়া একটা স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি। মজিদ দিলজানকে কেন খুন করিবে? অবশ্যই ইহার ভিতরে একটা অভিপ্রায় থাকা চাই-হাসি-তামাসার কথা নহে-খুন। চলুন, এখন আপনি আমাকে একবার দিলজানের ঘরে লইয়া চলুন দেখি।”
একটু ইতস্ততঃ করিয়া লতিমন কহিল, “সে কাজটা কি ঠিক হয়? আমার বিবেচনায় পরের বাক্স-দেরাজটা খোলা- ”
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চহাস্য করিয়া, বাধা দিয়া বলিলেন, “ক্ষতি কি আছে? আপনার দিলজান ত এ জগতে নাই। তাহার হত্যাকারীকে উপযুক্ত দণ্ড দিবার জন্যই আমরা তার বাক্স-দেরাজ খুলিতে চাই-কোন মন্দ উদ্দেশ্য ত নাই। এই উপলক্ষে হয় ত একজন নির্দ্দোষীর জীবনরক্ষাও হইতে পারে।”
লতিমন আর আপত্তি করিল না। দিলজান যে ঘরে বাস করিত, দেবেন্দ্রবিজয়কে সেখানে লইয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বে আর একবার মাত্র এই ঘরে আসিয়া ছিলেন। সেইদিন এই ঘরেই তিনি সেই বিষাক্ত ছুরি পাইয়াছিলেন। পাঠক তাহা অবগত আছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমেই দিলজানের বাক্সের ডালা ও দেরাজের ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন,-সকলগুলিই চাবি বন্ধ। লতিমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কাছে দিলজান চাবি রাখিয়া গিয়াছিল?”
লতিমন বলিল, “না, কেবল ঘরের চাবি আমার কাছে দিয়া গিয়াছে, আর সব চাবি তাহারই সঙ্গে ছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন। তাহার পর বলিলেন, “চাবি না থাকে, আপনি এক কাজ করুন আমাকে খানিকটা লোহার তার আনিয়া দিন, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক্ একটু যদি আনিতে পারেন, খুব সুবিধা হয়।”
“যাই-খুঁজিয়া দেখি, আর অমনি সাখিয়াকে আনিবার জন্য একজন বান্দাকেও পাঠাইয়া দিয়া আসি, “বলিয়া লতিমন ঘরের বাহির হইয়া গেল। এবং ক্ষণপরে একটী ছাতার শিক ও খানিকটা লোহার তার লইয়া ফিরিয়া আসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় লোহার তার ও শিক হাতে লইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “সাখিয়ার কাছে খবর গেল?”
লতিমন কহিল, “হাঁ, খবর পাঠাইয়াছি।”
৩.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – সাখিয়া
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় সেই লোহার তার ও শিকের সাহায্যে দিলজানের বাক্স ও ড্রয়ারগুলি খুলিয়া ফেলিতে লাগিলেন; এবং তন্মধ্যস্থিত জিনিষ-পত্র সমুদয় উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। প্রায় একঘন্টা কঠিন পরিশ্রমের পর নিজের কাজে লাগিতে পারে, এমন দুই-একটি মাত্র জিনিষ তাঁহার হস্তগত হইল’ তাহা একতাড়া পুরাতন চিঠী এবং দুইখানি ফটোগ্রাফ ভিন্ন আর কিছু নহে। চিঠীগুলি আমীর খাঁ নামক কোন ব্যক্তি মৃজান নাম্নী কোন রমণীকে লিখিতেছে। সকলগুলিই প্রেমপত্র, তাহা ভালবাসার কথা-বিরহের কথা-অন্তরঙ্গতার কথা ও অনন্তবিধ হা-হুতাশে পূর্ণ। ফটোগ্রাফ্ দুইখানির একখানিতে একটি শুক্লকেশ বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। তাহার পরপৃষ্ঠায় লেখা-“মুন্সী মোজাম হোসেন-সাং খিদিরপুর।” অপর ফটোখানি দিলজানের নিজের। ইহাতে দিলজান সালঙ্কারা নীলবসনা নহে, শুভ্রবসনা নিরলঙ্কারা-তথাপি তাহা বড় সুন্দর দেখাইতেছে। অবেণীসম্বন্ধ কেশগুচ্ছ-গুচ্ছে গুচ্ছে সুন্দর মুখখানির উভয় পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া অংসে পৃষ্ঠে এবং বক্ষের উপরে লুটাইয়া পড়িয়াছে। তুলিকাচিত্রিতবৎ আকর্ণবিশ্রান্ত বঙ্কিম ভ্রুযুগল, এবং ভাসা ভাসা প্রচুরায়ত ও কৃষ্ণচক্ষু দু’টী সে সুন্দর মুখমণ্ডলের অপূর্ব্ব শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। সেই ডাগর চক্ষু দুটীতে তেমনিই আবার কি মনোমোহিনী দৃষ্টি! তাহার পর, আরও মনোহর সেই উন্নত গ্রীবার বঙ্কিম ভঙ্গি। প্রসৃত পরিপুষ্ট বক্ষের উর্দ্ধার্দ্ধভাগ উন্মুক্ত। একটি কুসুমিতা লতা মালার সেই মত অংস ও কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া সেই কামদেবের লীলা-ক্ষেত্রতুল্য সমুন্নত বক্ষের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ফটোগ্রাফ্ দুইখানি বিশেষরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া একে একে পত্রগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলেন। দশ-দশখানি সুদীর্ঘ পত্র-দেবেন্দ্রবিজয় সকলগুলিরই আদ্যোপান্ত বিশেষ মনোযোগের সহিত মনে মনে পাঠ করিলেন। পাঠ শেষ করিয়া তিনি লতিমনের মুখের দিকে চাহিলেন। লতিমন এতক্ষণে নীরবে তাহার মুখের দিকে অবাক্ হইয়া চাহিয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন, “ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, এতক্ষণে সব বুঝিলাম। আপনি যাহাকে দিলজান বলিয়া জানেন, তাহার প্রকৃত নাম দিলজান নহে-মৃজান। খিদিরপুরে তাহার পিতৃগৃহ। তাহার পিতার নাম মোজাম হোসেন। ঘটনাক্রমে পিতৃগৃহে মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার প্রণয় হয়। মনিরুদ্দীন নিজের নাম গোপন করিয়া আমীর খাঁ নামে তাহার নিকটে পরিচিত হইয়া ছিলেন। মৃজান আমীর খাঁকে বিবাহ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করে; কিন্তু আমীর খাঁ সে সকল কথা উড়াইয়া দিয়া তাহাকে গৃহের বাহির করিবার চেষ্টা করে। পরিশেষে মনিরুদ্দীনেরই চেষ্টা সফল হইল। পরে যখন মৃজান বুঝিল, কাজটা সে নিতান্ত বুদ্ধিহীনার মত করিয়া ফেলিয়াছে, নিজে কলঙ্ক-সাগরে ডুবিয়াছে, এবং সেই কলঙ্কের কালিমা তাহার বৃদ্ধ পিতার মুখে লেপন করিয়াছে, তখন আত্ম-পরিচয় গোপন করিয়া দিলজান নাম লইয়া থাকিল।এই যে বৃদ্ধের তস্বীর দেখিতেছেন, ইনিই দিলজানের পিতা, নাম মোজাম হোসেন। আর এইখানি সেই আপনার মৃজান ওরফে দিলজানের তস্বীর।”
লতিমন মনোহর রূপকথার মত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে এই প্রেম কাহিনী একান্ত বিস্ময়ের সহিত শুনিল। সে বুঝিতে পারিল না, দেবেন্দ্রবিজয় কিরূপে ক্ষণকালের মধ্যে এত কথা জানিতে পারিলেন। নিজে সে এতদিন দিলজানের সহিত একসঙ্গে বাস করিতেছে, অথচ সে নিজে ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানে না। লতিমনের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত হইতে ফটোগ্রাফ্ দুইখানি লইয়া, নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া সমুখস্থ টেবিলের উপরে রাখিয়া দিল। এবং একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “হাঁ, একখানি দিলজানের তস্বীর। এখানে আমি তাহাকে কখনও এ রকম পোষাকে দেখি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বার ঠেলিয়া আর একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোক দীর্ঘাঙ্গী, কৃশা শ্যামবর্ণা। তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ হইতে পারে-পঁয়ত্রিশও হইতে পারে-ঠিক করা কঠিন। তাহাকে দেখিয়া সাগ্রহে লতিমন বলিয়া উঠিল, “কে, সাখিয়া না কি? বেশ-বেশ-খুব শীঘ্র এসে পড়েছিস্ ত!”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এই সাখিয়া সৃজান বিবির প্রধানা দাসী। তিনি তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন।
সাখিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়কে তেমন কঠিনভাবে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া ভীতা হইল। একটু যেন থতমত খাইয়া গেল। কি বলিবে, স্থির করিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিল।
তখন লতিমন সাখিয়াকে দেবেন্দ্রবিজয়ের পরিচয় দিল। শুনিয়া সে আরও ভীতা হইয়া উঠিল।
লতিমন বলিল, “সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা কর্তে চান্। যা’ জানিস্ সত্য বলবি।”
সাখিয়া শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, “কি মুস্কিল! আমি কি জানি, আমি কি বলব? থানা-পুলিসের হাঙ্গামে আমি নেই।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সকলই বিগ্ড়াইয়া যায়। তিনি সাখিয়াকে বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, “না-না-থানা পুলিসের হাঙ্গামা ইহাতে কিছুই নাই। যে রাত্রে সৃজান বিবি পলাইয়া যায়, সেই রাত্রের দুই-একটা খবর আমি তোমার কাছে জনিতে চাই। আমি পুলিসের লোক ঠিক নই-একজন গোয়েন্দা। মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তিনি আমার উপরেই সৃজান বিবিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার ভার দিয়াছেন। তা’ তোমাদের মত দুই-একজন লোক যদি এ সময়ে আমায় সাহায্য না করে, তা হইলে আমি একা কতদূর কি করিতে পারি? ইহাতে শুধু আমার উপকার করা হইবে না-তোমার মনিবেরও যথেষ্ট উপকার হইবে।”
শুনিয়া সাখিয়া মনে মনে সন্তুষ্ট হইল। বলিল, “এমন মনিব আর হয় না! বিবি সাহেবাকে তিনি কত ভালবাস্তেন-একদণ্ড চোখের তফাৎ করতেন না! এমন কি-”
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, “তোমার মনিব সাহেবের ভালবাসার কথা পরে শুনিব; এখন বিবি সাহেবার কথা কি জান, তাহাই আগে বল। একটা ভয়ানক খুনের মামলা ইহার ভিতরে রহিয়াছে।”
চোখ মুখ কপালে তুলিয়া সভয়ে বলিল, “খুন! কে খুন হয়েছে-আমাদের বিবি সাহেবা না কি?”
চোখে দুই ফোঁটা জল আনিয়া লতিমন বলিল, “না সাখিয়া, তোর বিবি সাহেবা নয়-আমাদেরই কপাল ভেঙ্গেছে-দিলজান খুন হয়েছে।”
সাখিয়া বলিল, “তাই ভাল-একটা বেশ্যা মাগী খুন হয়েছে, তার আবার কথা। আমি মনে করেছিলুম, আমাদের বিবি সাহেবা।”
লতিমন রাগিয়া বলিল, “রেখে দে তোর বিবি সাহেবা-সে আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে? তার আবার মান! আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা’ না হ’লেও, সে মনিরুদ্দীন ভিন্ন আর কিছু জানিত না। তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই কিন্লে বল্ দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা’হ’লে আমাদের দিলজানই বা খুন হবে কেন?”
সাখিয়া ক্রোধভরে উঠিয়া কহিল, “বেশ-তোমাদের দিলজান খুব সতী-আমাদের বিবি সাহেবার সঙ্গে তুলনা হয় না! তোমরা যে কেন আমাকে ডেকেছ, তা’ আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি; এখন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই খুন খারাপীটা বিবি সাহেবার ঘাড়ে ফেলিতে চাও; আমি সব বুঝিতে পারি। আমি নিতান্ত আর ছেলে মানুষটি ত নই-আমি তোমাদের এ সব কথায় নেই-আমি কিছুই জানি না, ” বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, আগেই খুনের কথা তুলিয়া নিজে আবার সব মাটি করিয়া ফেলিলেন। এখন আর বিনয় ছলে কিছু হইবে, এমন বোধ হয় না; বলপ্রয়োগ প্রয়োজন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থানোদ্যতা সাখিয়ার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া, সজোরে একটা টান্ দিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিলেন, “আরে ব’স মাগী, যবি কোথায়? যা জনিস্, তোকে এখনই বল্তে হবে-চলাকী করতে গেলে একেবারে পুলিসে চালান্ দিব জানিস্?”
সাখিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িয়া, হাঁউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। এবং এক্ষণে যে ধর্ম্মকর্ম্ম ও ভাল মানুষের দিন-কাল আর নাই, এবং ইংরাজের এত বড় রাজত্বটা সহসা মগের মুল্লুকে পরিণত হইয়াছে, অতিশয় বিস্ময়ের সহিত সে তাহাই বারংবার উল্লেখ করিতে লাগিল।
৩.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে
দেবেন্দ্রবিজয় অনেক বলিয়া-কহিয়া, বুঝাইয়া সাখিয়াকে একটু ঠাণ্ডা করিলেন। বুঝাইয়া দিলেন, যাহাতে তাহার বিবি সাহেবার উপরে এই খুনের অপরাধটা না পড়ে, সেই চেষ্টাই তিনি করিতেছেন, তখন সাখিয়া যাহা জানে বলিতে সম্মত হইল। এবং তাহার এজাহার লিখিয়া লইবার জন্য দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া ঠিক হইয়া বসিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” যেদিন রাত্রে তোমার বিবি সাহেবা পলাইয়া যায়, সেদিনকার সমুদয় কথা তোমার এখন বেশ মনে আছে?”
সাখিয়া বলিল, “তা, আর মনে নাই? এই ত সেদিনকার কথা! খুব মনে আছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি মনে আছে, বল? সেদিনকার কি জান তুমি?”
সাখিয়া। (চিন্তিতভাবে) সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল।
দেবেন্দ্র। কে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিল?
সাখি। দুজনেই।
দে। দুইজন আবার কে?
সাখি। বিবি সাহেবা আর জোহেরা বিবি-দুজনেই নিমন্ত্রণে গেছ্লেন। দে। সেখান হ’তে তাঁরা কখন ফিরলেন?
সাখি। রাত তখন দশটা-কি সাড়ে দশটা হবে! সেদিন বিবি সাহেবার তবিয়ৎ আচ্ছা ছিল না- বড় মাথা ধরিয়াছিল।
দে। আর কিছু ধরিয়াছিল?
লতি। (সহসা মাঝখান হইতে হাসিয়া বলিয়া উঠিল) আর ভূতে ধরিয়াছিল!
দে। আপনি চুপ করুন। (সাখিয়ার প্রতি) মাথা ধরায় তোমার বিবি সাহেবা বড়ই কাবু হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাহাতে বোধ হয়, বাড়ীতে আসিয়াই শয়ন করিতে গিয়াছিলেন?
সাখি। না-তা’ ঠিক নয়। আর একজন কে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য এসে ব’সে ছিল, তারই সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
দে। কে সে?
সাখি। তা’ আমি জানি না।
দে। কোন স্ত্রীলোক না কি?
সাখি। তা’ নয় ত আর কি-রাত এগারটার সময়ে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কি-
লতি। (বাধা দিয়া) তোমার বিবি সাহেবার পক্ষে সেটা বড় আশ্চর্য্য নয়।
দে। কে সে স্ত্রীলোক? তাহাকে তুমি দেখিয়াছ?
সাখি। দেখিয়াছি।
দে। কি রকম দেখ্তে? বয়স কত?
সাখি। তা’ আমি কি ক’রে জানব? আমি তার মুখ দেখ্তে পাইনি-ঘোম্টায় মুখখানা একেবারে ঢাকা ছিল! বয়সও কিছু ঠাহর কর্তে পারিনি।
দে। তাহার কাপড়-চোপড় কি রকম?
সাখিয়া কি উত্তর করে শুনিবার জন্য কৌতূহলপূর্ণহৃদয়ে লতিমন সোৎসুকে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
সাখি। সবই নীলরঙের-রেশমী কাপড়জামা সব। যে ওড়নাতে মুখখানা ডাহা ছিল, তাও নীলরঙের; তাতে আবার যে রেশমের চমৎকার ফুল-লতার কাজ, তেমন আমি-
লতিমন বাইজীকে আর শুনিতে হইল না। আকুলভবে বলিয়া উঠিল, “তবেই হয়েছে-সে আমাদেরই দিলজান।”
সাখিয়া প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়া উঠিল, “দিলজান! তা’ কেমন ক’রে হবে-আমাদের বাড়ীতে দিলজান-ফিলজানের পা বাড়াতে সাহস হবে না। সে নিশ্চয় কোন বড়লোকের মেয়ে-দিলজান কখনই নয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান বটে, সেই নীলবসনা সুন্দরী-দিলজান ছাড়া আর কেহই নহে।”
“কখনই নয়,” বলিয়া সাখিয়া লাফাইয়া উঠিল। বলিল, “কখনই সে দিলজান নয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তা’ না হউক, সে কথা যাক্-”
সাখিয়া বলিল, “সে কথা যাবে কেন-সে যদি দিলজানই হয়-তাতে দোষই বা হয়েছে কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়া বড় ঝগ্ড়াটে। তাহাকে রাগান ঠিক নহে। বলিলেন, “সে কথা যাক, সে দিলজানই হবে-তাতে আর হয়েছে কি? তাহার পর তুমি আর কি দেখিয়াছ, বল? সেই স্ত্রীলোকটি কখন গেল?
সাখি। স্ত্রীলোকটি আবার কেন? দিলজান।
দে। ভাল আপদ! সেই দিলজান কখন গেল? তোমার বিবি সাহেবার কাছে সে কি জন্যে গিয়াছিল?
সাখি। তা’ আমি কেমন ক’রে জানব্? আমার তাতে কি দরকার?
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সাখিয়াকে রোগে ধরিয়াছে-এখন কোন প্রশ্ন করিতে গেলেই সে ফোঁস করিয়া উঠিবে। বলিলেন, “তোমার তা’ জেনে দরকার নাই। তুমি যা’ জান তুমি যা’ দেখেছ, তাই বল? আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা কর্তে চাহি না।”
সাখিয়া বলিতে লাগিল, ” সে দিলজান কি-কে, জানি না বাবু, তার সঙ্গে বিবি সাহেবা দেখা কর্তে গেলেন। জোহেরা বিবি আপনার মহলে গিয়ে শুয়ে পড়্লেন। আমি শুতে যেতে পারলেম না-কি জানি-কি হুকুম হবে-জেগে ব’সে থাক্লেম। তা’ আর কোন হুকুম হয় নি। অনেকক্ষণ তাদের কথাবার্ত্তা হ’ল, তা আমি জানি না; প্রায় একঘন্টা পরে সে চ’লে গেল।”
দে। কে? দিলজান?
সাখি। দিলজান কি-কে জানি না, সেই নীলরঙের কাপড় পরা মেয়েটি। তারপর আমি বিবি সাহেবার শোবার ঘরের দিকে গেলাম। দেখি, তিনি কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়েছেন। আমি নীচে নেমে এসে যে দু-একটা কাজ বাকী ছিল, শেষ ক’রে ফেল্লেম। প্রায় রাত বারটা বেজে গেল। কাজ-কর্ম্ম সেরে যখন উপরে আসি, তখনও দেখি, আমাদের বিবি সাহেবার কবাট বন্ধ। আমিও নিজের ঘরে গিয়ে কবাট বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়্লেম। তার পর বিবি সাহেবা কখন উঠে গিয়েছেন, তা’ বিবি সাহেবাই জানেন।
দে। তাহা হইলে তোমার বিবি সাহেবা রাত বারটা পর্য্যন্ত নিশ্চয়ই বাড়ীতে ছিলেন?
সাখি। রাত বারটার মধ্যে কি ক’রে বাড়ী থেকে যাবেন? তখন সকলেই জেগে-চারিদিকে লোকজন, চাকর-বাকর-তা’ হলে ত তখনই ধরা পড়তেন। সকলে ঘুমুলে কখন চুপি চুপি উঠে গেছেন। আমার বোধ হয়, শেষরাত্রে উঠে গেছেন।
দে। রাত বারটার মধ্যে যে তিনি বাড়ী ছাড়েন নাই, তা’ তুমি বেশ জান?
সাখি। আমি কি মিথ্যাকথা বল্ছি? আমি তেমন মেয়ে নই। যা’ বল্ব-তা’ স্পষ্ট মুখের উপরেই বল্ব।
দেবেন্দ্রবিজয় আপন-মনে বলিলেন, “সাখিয়ার মুখে এখন যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে রাত বারটার পর সেদিন মজিদের সঙ্গে যে স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল, সে সৃজান বিবি নয়। আমারই অনুমান ঠিক, মজিদের আর অস্বীকার করিলে চলিবে না-সে নিশ্চয় দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে।”
সাখি। আর কি মশাই-যা’ আমি জানি সবই ব’লে দেয়েছি-আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে?
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আছে বৈ কি-তোমার বিবি সাহেবা কেমন দেখ্তে ছিলেন, বল দেখি?”
সাখিয়া বলিল, “তুমি কি রকম ভদ্রলোক, মশাই! ভদ্রঘরের মেয়ের রূপের খোঁজে তোমার কি দরকার? সে সব কথা আমি কিছুই জানি না। এ সব-”
সাখিয়া আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে দিলজানের ফোটোগ্রাফ্খানি তাহার চঞ্চল দৃষ্টিপথে পড়িল। সুর বদ্লাইয়া বলিল, ” এই যে, আপনি আমাদের বিবি সাহেবের একখানি তস্বীরও যোগাড় করেছেন!”
দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি দিলজানের ফোটোগ্রাফ্খানি সাখিয়ার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানি তোমার বিবি সাহেবার তস্বীর না কি?”
সাখিয়া তস্বীর দেখিতে দেখিতে বলিল, “হাঁ, এ আমাদের বিবি সাহেবারই তস্বীর। মুন্সী সাহেব বুঝি, বিবি সাহেবার সন্ধান কররার জন্য আপনাকে একখানা তস্বীর দিয়েছেন?”
লতিমন বলিল, “আরে পোড়ার-মুখী সাখি, তুই কি আজকাল চোখেও কম দেখিস্ নাকি? এ যে আমাদের দিলজানের তস্বীর।”
সাখিয়া বলিল, “আমি চোখে কম দেখ্তে যাব কেন? যে আমাকে ‘কম দেখে’ বলে, সে নিজে দু’চোখ কাণা। কে জানে কে তোমার দিলজান-তার মুখে আগুন, এ তস্বীর তার হ’তে যাবে কেন? এ ত আমাদের বিবি সাহেবার তস্বীর।”
লতিমন ছাড়িয়া কথা কহিবার পাত্রী নহে। বলিল, ” কে জানে, কে তোমার বিবি সাহেবা-মুখে আগুন তার! এ আমাদের দিলজানের তস্বীর।”
দেখিয়া-শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অবাক্! এবার তিনি ইহার মুখের দিকে চাহেন, একবার উহার মুখের দিকে চাহেন-কেহেই কম নহেন, উভয়েরই মুখের স্রোত সমান। গতিক বড় ভাল নয় দেখিয়া, ফটো দুইখানি ও সেই পত্রের তাড়াটি নিজের পকেটের ভিতরে পুরিয়া ফেলিলেন। অমনি সেই সঙ্গে দুইটি টাকা পকেট হইতে বাহির করিয়া সাখিয়ার হাতে দিতে-যেন জ্বলন্ত আগুনে জল পড়িল; ঝগ্ড়া ভুলিয়া সাখিয়া পরমানন্দে সেই টাকা দুটি বাজাইয়া আঁচলের খুঁটে বাঁধিতে লাগিল। তাহার সুর এবার একেবারে বদ্লাইয়া গেল-কতমতে সে দেবেন্দ্রবিজয়ের ভদ্রলোকত্ব সপ্রমাণ করিতে লাগিল।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কর্ণপাত করিলেন না। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে-সৃজান ও মৃজান উভয়েরই আকৃতি এরূপ সৌসাদৃশ্য থাকিবার কারণ কি? নিশ্চয়ই তাহারা উভয়ে একরকম দেখিতে; নতুবা একজনের ফটোগ্রাফ লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার এরূপ গোলযোগ বাধিবে কেন? দিলজান সৃজানের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, এবং উভয়ের নামেও অনেকটা মিল আছে। বোধ হয়, সৃজান দিলজানের কোন নিকট-আত্মীয়া হইবে। উভয়ের মধ্যে একটা কিছু সম্পর্ক থাকা খুবই সম্ভব; নতুবা বারনারী হইয়া দিলজান সৃজানের সহিত দেখা করিতে সেজন্য আপাততঃ খিদিরপুরে গিয়া মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত একবার সাক্ষাৎ করা বিশেষ প্রয়োজন হইতেছে। যে ব্যক্তি এই ফটোগ্রাফ তুলিয়াছে ইতোমধ্যে একবার তাহারও সহিত দেখা করিতে হইবে।
৩.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – তিতুরাম
দেবেন্দ্রবিজয় সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন। তখনই খিদিরপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিবার পূর্ব্বে তিনি সেই ফটোগ্রাফ ছবি প্রস্তুতকারীর সহিত দেখা করিলেন। তাঁহার নাম কবিরুদ্দীন! ফটোগ্রাফ ছবিতেই তাঁহার নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না। কবিরুদ্দীনের নিকটে গিয়া যাহা তিনি শুনিলেন, তাহাতে তাঁহাকে আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হইল। কবিরুদ্দীন বলিলেন, সেই ফটো দুইখানির একখানি মুন্সী মোজাম হোসেনের এবং অপরখানি তাহার কন্যা সৃজানের। তিনি দিলজান বা মৃজান সম্বন্ধে কিছু জানেন না। দেবেন্দ্রবিজয়ের বিস্ময় সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল; তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সৃজন বিবির ফটো দিলজানের দেরাজের মধ্যে কেন? অথচ লতিমন বাইজী সৃজান বিবির ফটোকে দিলজানের প্রতিকৃতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহে। অবশ্যই লতিমনের এরূপ করিবার একটা গুপ্ত-উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু সে উদ্দেশ্য কি? হয়তো লতিমনও এই খুনের মামলায় জড়ীভূত আছে; নতুবা তাহার ভ্রম হইয়াছে। এ যে বিষম ভ্রম! আগে একবার মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করি তাহার পর দেখিতে হইবে, দিলজানের খুনের সহিত লতিমন বাইজীর কতটুকু সংশ্রব আছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় একেবারে মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত সাক্ষাৎ করা যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন না। আগে বাহির হইতে তাহার বিষয়টা যতটা জানিতে পারা যায়, সেই চেষ্টা করিতে হইবে স্থির করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় সেখানকার একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পল্লীতে মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যাই বেশি। দক্ষিণাংশে কয়েকজন দরিদ্র হিন্দুর বসতি। দেবেন্দ্রবিজয় সেখান দিয়া যাইবার সময়ে দেখিলেন, একখানি খোলার ঘরে বাহিরের দাবায় বসিয়া একজন পক্ককেশ বৃদ্ধ ক্রোড়স্থিত একটি পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর সহাস্যে অনেক কটূক্তি বর্ষণ করিতেছেন। তাহাকে “ভাই-দাদা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন, তখনই আবার তাহাকে শ্যালক পদাভিষিক্ত করিয়া নিজে নিজে খুব একটা আনন্দানুভাব করিতেছেন; সেই আনন্দাতিশয্যে সেই বালকের ভাবী-পত্নীর উপরে (হয় ত এখনও সে জন্মগ্রহণ করে নাই) একটা অযথা দাবী দিয়া রাখিতেছেন! মুখর বৃদ্ধের মুখের বিশ্রাম নাই-অনবরত বকিতেছেন। শিশু কখনও ‘হাঁ’-কখনও ‘না’-কখনও বা ‘আচ্ছা’ বলিয়া ঘাড় নাড়িতেছে। বালকটি তাঁহার পৌত্র।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই মুখর বৃদ্ধের সম্মুখীন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, বলিতে পারেন, এখানে মুন্সী মোজাম হোসেন সাহেব কোথায় থাকেন?”
বৃদ্ধ কহিলেন “আরও আপনাকে অনেকটা যাইতে হইবে-গ্রামের বাহিরে গঙ্গার ধারে তিনি থাকেন। মহাশয়ের নাম?”
দে। দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। আপনার নাম?
বৃ। আমার নাম শ্রীতিতুরাম পরামাণিক।
দে। মহাশয়ের কি করা হয়?
বৃ। নিজের জাতীয় ব্যবসা-আমরা জতিতে নাপিত। তবে আমি নিজের হাতে আর পারি না, এ বুড়োবয়সে চোখে ঠাহর হয় না; আমার ছেলেই সব দেখে-শোনে।
দে। সে ত ঠিক কথা, উপযুক্ত ছেলের কাজই ত এই।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি যথাস্থানে ও যোগ্য ব্যক্তির নিকটেই উপনীত হইয়াছেন। এই বৃদ্ধের নিকটে সকল খবরই পাওয়া হাইবে। বৃদ্ধ জাতিতে নাপিত-নাপিত গ্রামের সংবাদপত্র-বিশেষ। যেখানে যাহা কিছু ঘটে, সে সংবাদ আগে ইহাদের নিকটে পৌঁছায়। বিশেষতঃ ইনি বৃদ্ধ-তাতে বেকার-নিজেকে বড়-একটা কিছু করিতে হয় না; সুতরাং ইনি গ্রামের ভালমন্দ সর্ব্ববিধ সংবাদে কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া আছেন। দেবেন্দ্রবিজয় “আঃ! আর পারা যায় না, অনেক ঘুরেছি,” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, “এখন কি মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা হইবে?”
বৃ। সকল সময়ে দেখা হবে। তিনি আজ পাঁচ বৎসর শয্যাশায়ী হ’য়ে রয়েছেন। খুব আমীর লোক ছিল গো-ইদানীং অবস্থাটা একেবারে খারাপ হ’য়ে গেছে। তাঁর কাছে আপনার কি দরকার?
দে। (যাহা মনে আসিল)। তাঁহার একখানি বাড়ী বিক্রয় হইবে, শুনিয়াছি। সেই বাড়ী কিনিবার ইচ্ছা আছে।
বৃ। সে বাড়ী অনেকদিন বিক্রী হ’য়ে গেছে। সে আজ সাত-আট বছরের কথা। এখন নিজে একখানি ছোট খোলার ঘর ভাড়া নিয়ে গঙ্গার ধারে থাকেন। তাঁর আর বাড়ী কোথায়। এখন অবস্থা বড় খারাপ।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, কথাটা ঠিক খাটিল না উল্টাইয়া দেওয়া দরকার। বলিলেন, “তাই ত, তবে কি ক’রে তাঁর চলে? তাঁর কি আর কেহ নাই-ছেলে-মেয়ে?”
তিতুরাম কহিলেন, “ছেলে নাই-দুইটি মেয়ে।”
দেবেন্দ্রবিজয় সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁর দুইটি কন্যা?”
তিতুরাম বলিল, “হাঁ, দুটি মেয়ে-যমজ। বড় চমৎকার দেখতে, বামুন-কায়স্থের ঘরেও এমন রূপ হয় না-যেন ফেটে পড়্ছে। একজনের নাম মৃজান আর একজনের নাম সৃজান।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বটে! মেয়ে দুটি কি এখন মুন্সী সাহেবের কাছেই আছে না কি?”
গম্ভীরভাবে তিতুরাম বলিলেন, “না মশাই! বড়-বড় মেয়ে। মুন্সী সাহেব আজ পাঁচ বৎসর ব্যারামে প’ড়ে। কে বা মেয়েদের দেখে, কে বা বিয়ে দেয়! একটা মেয়ে, মৃজান যার নাম, একটা কোন লোকের সঙ্গে তার ভাব হয়, তারই সঙ্গে সে কোথায় চ’লে গেছে। সেই অবধি সে একেবারে নিরুদ্দেশ।”
দে। কে সে লোক-নাম কি?
তিতু। কি আমীর খাঁ, না হামির খাঁ-মুসলমানের নাম ঠিক মনে থাকে না, বাপু।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, তিনি সেই সকল পত্র পড়িয়া পূর্ব্বে যাহা অনুমান করিয়াছিলেন, তাহা অভ্রান্ত। মনিরুদ্দীন আমীর খাঁ নামে এখানে আবির্ভূত হইয়া মৃজান সহ অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। এবং বামুন বস্তিতে লতিমনের বাড়ীতে মৃজানকে দিলজান নামে জাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর সেই সৃজান নামে যে মেয়েটি?”
তিতু। তার অদৃষ্টা ভাল। খুব একজন বড়লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সে এখন মুন্সী জোহিরুদ্দীনের পত্নী। যদিও জোহিরুদ্দীনের বয়স হয়েছে, তাতে আর আসে-যায় কি, খুব বড়লোক, বুড়ো হ’লে কি হয়!
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধ তিতুরাম এবার নিজের গায়ে হাত দিয়া কথা কহিতেছে। বলিলেন, “তা’ ত বটেই, এক সময়ে সকলেই বুড়ো হ’তে হবে।” মনে ভাবিলেন, যাহা হউক, এখানে আসিয়া অনেকটা কাজ হইল। দিলজান যে সৃজানের ভগিনী, ইহাতে সন্দেহ নাই। এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে পারিলেই সকল গোল চুকিয়া যায়।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী মোজাম হোসেনের বাসস্থানের ঠিকানা ঠিক করিয়া লইয়া সেখান হইতে উঠিলেন।
৩.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – পারিবারিক
দেবেন্দ্রবিজয় যখন গঙ্গার ধারে উপস্থিত হইলেন, তখন সূর্য্য অস্তোন্মুখ! অস্তোন্মুখ সূর্য্যের কনকপ্রবাহে চারিদিক্ ঝ্ল ম্ল করিতেছে। এবং সন্ধ্যার বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাত্যাবিতাড়িত তরঙ্গমালা প্রচণ্ডবেগে গঙ্গার কূলে আঘাত করিতেছে।
পশ্চিম-গগন হইতে বিকীর্ণ হইয়া কনকধারা গঙ্গার উভয় সৈকতশয্যায় স্বর্ণাস্তরণের ন্যায় বিস্তৃত রহিয়াছে। আকাশ এখনও স্বর্ণোজ্জ্বল রহিয়ছে; এবং সেখানে মেঘ বিচরণ করিতেছে। মেঘ কখনও বাঘ, কখনও হাতী, কখনও ঘোড়া, কখনও রথ, কখনও বা লাঠী কাঁধে এক বিকটাকার দৈত্যের আকৃতি ধারণ করিতেছে।
বলা বাহুল্য, সেদিকে দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টি ছিল না; তিনি আপনার কার্য্যোদ্ধারের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। কনকাস্তরণবিস্তৃত সৈকত-শয্যা, তথায় তরঙ্গের প্রচণ্ড আঘাত, অথবা আকাশে মেঘের নানারূপ মূর্ত্তিধারণ, এ সকল দেখিবার তাঁহার আদৌ অবসর ছিল না।
যথা সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী সাহেবের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুন্সী সাহেব একটী ঘরে একখানি খাটিয়ার উপরে শুইয়া আছেন। তিনি অত্যন্ত কৃশ-যেন সে শরীরে অস্থি ও ত্বক্ ছাড়া আর কিছুই নাই। চোখে মুখে কালিমা পড়িয়াছে। গণ্ডাস্থি বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এবং চোখের দৃষ্টি একান্ত নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও এখনও বুঝিতে পারা যায়, এক সময়ে এই মুখ খুব সুন্দর ছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া মোজাম সাহেব বলিলেন, “কে আপনি, মহাশয়? কোথা হইতে আসিয়াছেন? কি আবশ্যক?”
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথম প্রশ্ন দুটীর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন দেখিলেন না। বলিলেন “আবশ্যক কিছু আছে। আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার নিকটে আসিয়াছি। আপনার সহিত অনেক কথা আছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “অনেক কথা কহিবার সুবিধা আমার নাই। ডাক্তারের নিষেধ-খুব নির্জ্জনে থাকা দরকার। এমন কি কাহারও সঙ্গে দেখা করাও ঠিক নহে; আপনি বিদায় লইলে সুখী হইব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যথা সময়ে বিদায় লইব, সেজন্য আপনি অকারণ উদ্বিগ্ন হইবেননা। আপনার কন্যাদের সম্বন্ধে দুই-একটী কথা জিজ্ঞাস্য আছে।”
অতিরিক্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বৃদ্ধ মোজাম হোসেন বলিলেন, “কন্যাদের! আমার একটি ভিন্ন কন্যা নাই। আপনি কি ভুল বকিতেছেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, আমার কিছু মাত্র ভুল হয় নাই। আপনার দুইটি কন্যা। একজনের নাম সৃজান, কলিঙ্গা-বাজারের মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইয়াছে। অপর মেয়েটির নাম মৃজান।”
রুগ্ন বৃদ্ধ কঠোর-নেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে চাহিলেন। তেমনি কঠোর-কণ্ঠে বলিলেন, “কে তুমি বেয়াদব্, ঐ সকল পারিবারিক কথায় তোমার কি প্রয়োজন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি ডিটেকটিভ-পুলিসের লোক।”
মুন্সী মোজাম হোসেন শুইয়াছিলেন-ব্যগ্রভাবে উঠিয়া বসিলেন। রোষক্ষুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “বুঝিয়াছি, মুন্সী জোহিরুদ্দীন কোন গুপ্ত অভিসন্ধিতে আপনাকে এখানে পাঠাইয়াছেন। পাঠাইয়া ভাল করেন নাই; আমি সেখানকার সকল খবর শুনিয়াছি। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের দোষেই আমার কন্যার এই অধঃপতন হইয়াছে। তিনি যদি আমার কন্যার প্রতি সদ্ব্যবহার করিতেন, তাহা হইলে কখনই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটিতে পারিত না। এমন কি তিনি, আমি শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি জানিয়াও, আমাকে দেখিবার জন্য আমার কন্যাকে একবারও এখানে পাঠাইতেন না। দোষ আমার কন্যার নহে-দোষ তাঁহার নিজেরই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে পাঠান নাই। আমি নিজেই কোন প্রয়োজনে আসিয়াছি। আমার হাতে একটা বড় জটিল মাম্লা পড়িয়াছে।”
মোজাম হোসেন বলিলেন, “কিসের মাম্লা?”
দেবেন্দ্রবিজয় সহসা উত্তর করিলেন, “আপনার অপর কন্যার খুনের মাম্লা।”
মৃত্যুশরাহত মৃগের ন্যায় মুন্সী সাহেব চমকিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও শুকাইয়া গেল। কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “হা আল্লা! মৃজান খুন হইয়াছে!”
দেবেন্দ্রবিজয় ছাড়িবার পাত্র নহেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃজান আবার কে?”
“আমার কন্যা-আমার কন্যা!” বলিয়া বৃদ্ধ উভয় হস্তে মুখ আবৃত করিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই মাত্র আপনি বলিলেন, আপনার একটি ভিন্ন আর কন্যা নাই; আমিও ঠিক তাহাই মনে করিয়াছিলাম।”
বৃদ্ধ রোদনোচ্ছ্বসিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “আমার দুইটি কন্যা-আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম। আপনি যে মৃজানের কথা বলিতেছেন, সে আমীর খাঁ নামে একটা বদ্মায়েসের প্রলোভনে পড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহার আর সন্ধান পাই নাই। আমার নিজের অবস্থা দেখিতেছেন, তাহাতে সন্ধান করিবার সামর্থ্যও আর নাই। সে অবধি আমি সেই শয়তানীর নাম মুখে আনি না-সে আমার মুখে কলঙ্কের কালি দিয়া গিয়াছে; কিন্তু তথাপি সে দোষ তাহার নয়-বেইমান্ আমীর খাঁই তাঁহার সর্ব্বনাশ করিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধের মনের মধ্যে এ সময়ে একটা অদম্য বেগ আসিয়াছে। এই সময়ে বৃদ্ধের হৃদয়ের দ্বার কোন রকমে একটুখানি উদ্ঘাটন করিয়া দিতে পারিলে, তাঁহার মুখ হইতে অনেককথাই বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু কোন্ কথা দ্বারা ঠিক স্থানে আঘাত করা যাইতে পারে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহা খুঁজিতে লাগিলেন। তখনই একটা ঠিক করিয়াও ফেলিলেন। বলিলেন, “দেখুন মুন্সী সাহেব, আপনি একজন মান্য-গণ্য, মহাশয় ব্যক্তি, আপনার পারিবারিক বিষয়ে কোন কথার উত্থাপন করা আমার পক্ষে একান্ত অনুচিত, সেটুকু বুঝিবার শক্তি যে আমার নাই, এমন নহে। তবে আমার উপরে একটা দায়িত্ব রহিয়াছে, সে দায়িত্ব যে-সে দায়িত্ব নহে, একজন লোকের জীবন নিয়ে টানাটানি। যদি তাহা আমার কাছে শোনেন, আপনিও আমাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইবেন। তখন আমার নিকটে আপনি অসঙ্কোচে সকল কথাই প্রকাশ করিবেন।”
জ্বলন্ত রক্তচক্ষুঃ মেলিয়া মুন্সী সাহেব একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন; তাহার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বলুন, আমি শুনিতে প্রস্তুত আছি-আপনার বক্তব্য শেষ করুন। যদি উচিত বোধ করি, দ্বিধা করিবার কিছুই না থাকে, আমি আপনার কাছে কোন কথা গোপন করিব না।”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুন ও সৃজানের গৃহত্যাগ সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতেন, বলিলেন। এবং এই খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে কতটা সংসক্তি আছে, তাহাও বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর মজিদ খাঁকে যে সকল ভিত্তিহীন সন্দেহ দ্বারা কঠিনভাবে জড়াইয়া ফেলিয়া, তিনি তাহাকে একেবারে হাজতে পুরিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাও অনুক্ত রাখিলেন না।
বিশেষ মনোযোগের সহিত সকল কথা শুনিয়া মোজাম হোসেন ক্ষণকাল নতমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে অত্যন্ত করুণ-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “এক সময়ে আমার এমন দিন ছিল, যখন অনেকেই আমার মুখ চাহিয়া থাকিত। যাহাদের আসন নিম্নে ছিল, এখন আমাকে অবস্থা বিপাকে তাহাদের নিম্নে আসন পাতিতে হইয়াছে। এখন একটা কিছু সামান্য নিন্দাতে সকলেই আমার উপরে চাপিয়া পড়িবে, সেইজন্য আমাকে খুব সাবধানে চলিতে হয়; কলঙ্কের কথা যত গোপন থাকে, সেজন্য এখন আমার বিশেষ চেষ্টা করাই কর্ত্তব্য; কিন্তু আপনার মুখে যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে একজন নির্দ্দোষীর জীবন-সংশয়। এখন তাহাকে উদ্ধার করিবার জন্য ভদ্রব্যক্তিমাত্রেরই চেষ্টা ও সাহায্য করা উচিত। বলুন, আপনি কি জানিতে চহেন? অবক্তব্য হইলেও আমি তাহা আপনাকে বলিব।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিলজান কি আপনার কন্যা?”
প্রত্যুত্তরে মুন্সী সাহেব একখানি কেতাবের ভিতর হইতে দুইখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ফেলিয়া দিলেন।
৩.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্বকথা
ফটোগ্রাফ দুইখানি কুড়াইয়া লইয়া দেখিতে দেখিতে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এ যে দুইখানিই আপনার কন্যা দিলজানের তস্বীর দেখিতেছি।”
মুন্সী সাহেব শুষ্কমুখে শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিলেন, “কেবল আপনার নহে, এরূপ ভ্রম অনেকেরই হইয়াছে। উহা একজনের নহে, আমার দুই কন্যারই তস্বীর। এইখানি মৃজানের-আপনি যাহাকে দিলজান বলিতেছেন। আর এইখানি সৃজানের।” বলিয়া নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় ছবি দুইখানি বিশেষ মনোনিবেশপূর্ব্বক পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। দুইখানিতে অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রীমূর্ত্তি। উভয়ের মুখাকৃতির অতি সাদৃশ্য। তাহার উপর বেশভূষা একপ্রকার হওয়ায় আরও মিলিয়া গিয়াছে-চিনিবার যো নাই। এমন কি দুইজনের পৃথক্ ছবি উঠাইবার কোন আবশ্যকতা ছিল না; এবং কোন মিতব্যয়ী ইহাতে কখনই অনুমোদন করিতে পারিতেন না। যাহা হউক, সেই একমাত্র ছবি লইয়া লতিমন ও সাখিয়ার ভয়ানক গোলযোগ ঘটইবার কারণ দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে এতক্ষণে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। তিনি এখন আর তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই দেখিলেন না।
মুন্সী মোজাম হোসেন বলিতে লাগিলেন, ” আমি এখানে প্রায় আজ দশ বৎসর, এই গঙ্গার ধারে বাস করিতেছি। মেয়ে দুটি আমার কাছে থাকিত। অনেক দিন পূর্ব্বেই তাহাদিগের মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমিই তাহাদিগকে মাতৃপিতৃস্নেহে বুকে করিয়া লালন-পালন করিয়াছি।
হায়, তাহার পরিমাণ যে এমন হইবে, কে তাহা পূর্ব্বে ভাবিয়াছিল। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমীর নামে একটী যুবক আমার কাছে ফার্সী শিখিতে আসিয়াছিল। আমি উত্থান শক্তি রহিত-কোথাও যাইবার ক্ষমতা ছিল না। আমীর খাঁ আমার এইখানেই অধ্যয়ন করিতে আসিত। এইখানেই সে কোথায় একটা বাসা ভাড়া করিয়াছিল। প্রথম হইতেই আমার কন্যা মৃজানকে তাহার একান্ত অনুরাগিণী দেখিয়াছিলাম। বুঝিলাম, মনের ভিতরে একটা ঘোরতর দুরভিসন্ধি লইয়া আমীর খাঁ আমার সংসারের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। কিছুদিন পরে আমি সেই চরিত্রহীন, বেইমান্ আমীর খাঁকে এখান হইতে দূর করিয়া দিলাম। আমার কন্যা তখন সেই প্রতারকের প্রলোভনে একান্ত মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। একদিন আমার মৃজানকে লইয়া একেবারে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল-আর তাহাদের কোন সংবাদ পাইলাম না। সেই অবধি আমি সেই কলঙ্কিনী কন্যার নাম মুখে আনি না-মৃজান নামে একটা শয়তানী যে আমার এখানে এতকাল আশ্রয় করিয়াছিল, সে কথা আমি একেবারে ভুলিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছিলাম। মৃজান নামে যে কোন কালে আমার একটা মেয়ে ছিল, তাহা আমি আর মনে মনে স্থান দিতে ইচ্ছা করিতাম না। এমন কি সৃজানই যে আমার একমাত্র মেয়ে, এই ধারণাই এখন আমার মনের মধ্যে এক রকম ঠিক হইয়া গিয়াছিল। ক্রমে সেই সৃজানও তাহার ভগিনীর পথানুসরণ করিল। আমার মান-সম্ভ্রম আর কিছুই রহিল না। কিন্তু এ কাজটা ঠিক জোহিরুদ্দীনের দোষেই হইয়াছে; তিনি সৃজানকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখিতেন-একে তাঁহার বয়স হইয়াছে, তাহার উপরে আবার তিনি অমূলক সন্দেহের বশে সৃজানের সহিত এমন সব ব্যবহার করিতেন যে, তাহাতে তাহার হৃদয় অধিকার করা দূরে থাক্, বরং তাহার হৃদয়ে যতটুকু স্থান পাইয়াছিল, নিজদোষে তাহাও নষ্ট করিয়া ফেলিলেন। এ দুনিয়ার নিয়মই এই। সে যাহা হউক, আমরাও তাই বোধ হয় যে, সৃজান ও মোনিরুদ্দীনের গুপ্ত-অভিসন্ধি মৃজান কোন রকমে টের পাইয়াছিল; পাছে, মনিরুদ্দীন তাহার যেমন সর্ব্বনাশ করিয়াছে, তাহার ভগিনীরও সেইরূপ দুর্গতি করে, এই আশঙ্কায় হয় ত সে নিজেই ভগিনীকে সাবধান করিতে রাত্রিতে জোহিরুদ্দীনের বাটীতে গিয়াছিল। সম্ভব, সৃজান মৃজানের কথায় কর্ণপাত করে নাই। তাই মৃজান আর কোন উপায় না দেখিয়া মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়, মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না- তাহার পর সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময়ে পথে হতভাগিনী খুন হইয়াছে। তেমন একজন সম্ভ্রান্ত, সদাশয় ব্যক্তির পুত্র হইয়া মনিরুদ্দীন যে এরূপে পিতৃনাম রক্ষা করিতেছে, ইহাই আশ্চর্য্য!”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আপনার কন্যা দিলজানের খুনের কি কিনারা হইল?”
বিরক্তভবে, মুন্সী মোজাম হোসেন বলিলেন, “দিলজানের নাম আমার কছে করিবেন না। আপনার কথাই ঠিক, কে মৃজানকে খুন করিয়াছে, কেমন করিয়া বলিব? আপনি যেমন বলিতেছেন, আমরাও তাহাই বোধ হয়; মজিদ খাঁর কোন দোষ নাই- সে কেন মৃজানকে খুন করিবে? কোন কারণ দেখি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমি তাহার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পাইয়াছি; কিন্তু এমন কোন একটা কারণ দেখিতেছি না, যাহাতে তাহাকে খুনী বলিয়া বুঝিতে পারি। এখন আপনার কন্যা মৃজানের পূর্ব্বজীবন সম্বন্ধে দুই-একটী বিষয় আমার জানা দরকার। আমীর খাঁর পূর্ব্বে মৃজান আর কাহারও অনুরাগিনী হইয়াছিল?”
অবনতমস্তকে মোজাম হোসেন বলিলেন, “না”।
“মৃজানের কেহ অনুরাগী হইয়াছিল?”
“না।”
“একজনও না?”
“না।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মুন্সী মোজাম হোসেনের নিকট থাকিয়া আর বিশেষ কোনকাজ হইবে না; বিদায় লইয়া সুতরাং উঠিয়া পড়িলেন। কাজের মধ্যে-প্রকৃতরূপে এক্ষণে জানিতে পারা গেল, দিলজান সৃজানের সহোদরা ভগিনী। এবং উভয় ভগিনীই একজনের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। সুতরাং দিলজানের খুনের সহিত সৃজানের গৃহত্যাগের যে একটা খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, সে সম্বন্ধে দেবেন্দ্রবিজয়ের আর কোন সন্দেহ রহিল না। কিন্তু কিছুতেই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না-সে সম্পর্কটি কি-এবং কেনই বা দিলজান খুন হইল-কে বা তাহাকে খুন করিল? একবার মনে হইল, সৃজানই কি ঈর্ষাবশে নিজের ভগিনীকে খুন করিয়া নিজের অধঃপতনের পথ পরিষ্কার করিয়া লইয়াছে? কে জানে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না-আরও গোলযোগে পড়িলাম। মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিয়া এ রহস্য পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক্, আরও গোলযোগ বাঁধিয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইবার চেষ্টা করিয়া যখন যে সূত্র অবলম্বন করিতেছেন, সামান্য দূর যাইতে-না-যাইতে তাহাই ছিঁড়িয়া গিয়া তাঁহাকে এমন অন্ধকারময় বিপথে চালিত করিতেছে যে, তিনি তথা হইতে বাহির হইবার কোন সুগম পথ খুঁজিয়া পাইতেছেন না। বুঝিলেন, এ রহস্যজালে যেরূপ বিষম জট্ ধরিয়াছে, যাহা আরও নিবিড়ভাবে পাক-খাইয়া যাইতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তখন আপন মনে বলিলেন, “এখন একবার মুন্সী জোহিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে হইবে। যদি তাঁহার স্ত্রী সৃজান বিবি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে? অনুচিত হইলেও আমাকে এই সকল কথা তাঁহার নিকটে তুলিতে হইবে। তাঁহার কলঙ্কিনী স্ত্রী সম্বন্ধে কোন কথা এখন তাঁহাকে বলিতে গেলে তিনি রাগ করিতে পারেন। তাহাতে ক্ষতি কি? একজন নির্দ্দোষী ব্যক্তিকে রক্ষা করিবার জন্য আমি সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিব। আমার খুব বিশ্বাস-মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী।”
৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – উকীল-হরিপ্রসন্ন
কোন কোন তৃণ করতলে দলিত করিলে তাহা হইতে সুগন্ধ বাহির হয়; তেমনই মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হইলেই অনেকেরই মুখে তাঁহার গুণগ্রামের কথা বাহির হইতে লাগিল। এমন একজন ধর্ম্মনিষ্ঠ, দয়ালু, বুদ্ধিমান্, সদ্বিদ্বান্ সচ্চরিত্র যুবক মজিদ খাঁ যে, এইরূপ একটা কলঙ্কজনক বারবনিতার হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছেন, একথা সহসা কাহারও বিশ্বাস হইল না। দুঃসহ বিস্ময়ের সহিত প্রথমে সকলেই এই অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব সংবাদ শুনিল, কিন্তু কেহ বুঝিতে পারিল না, কোন্ কারণে মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিতে পারেন। সকলেই মজিদ খাঁকে এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সচেষ্ট হইল। সাধারণতঃ এরূপ দেখা যায়, কেহ বিপদে পড়িলে তাহার বন্ধুবর্গ ধীরে ধীরে গা-ঢাকা দেন; কিন্তু মজিদ খাঁর বন্ধুবর্গ তেমন নহেন, তাঁহার সকলে আজ মজিদ খাঁকে বিপন্মুক্ত করিবার জন্য বদ্ধপরিকর।
লদ্ধপ্রতিষ্ঠ বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু নম্র-স্বভাব মজিদ খাঁকে বড় স্নেহ করিতেন। তিনি মজিদ খাঁর এই বিপদের কথা শুনিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন; এবং যাহাতে তাঁহাকে ফাঁসীকাঠের মুখ হইতে বাঁচাইতে পারেন, তাহার আয়োজন করিতে লাগিলেন।
উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মনিরুদ্দীনের পিতার সহাধ্যায়ী বাল্যবন্ধু। বন্ধুর জমিদারী-সেরেস্তার সমস্ত মাম্লা-মোকদ্দমা তাঁহাকেই দেখিতে হইত; তাঁহার অবর্ত্তমানে এখনও দেখিয়া থাকেন। তিনি মজিদ খাঁ ও মনিরুদ্দীনের বাল্যকাল হইতে তদুভয়কে দেখিয়া আসিতেছেন। তদুভয়ের স্বভাব পরষ্পর ভিন্ন রকমের। মনিরুদ্দীন যেমন দাম্ভিক, নির্ব্বোধ, অশিষ্ট, চঞ্চল এবং নির্দ্দয়; মজিদ তেমনি ঠিক তাহার বিপরীত-মজিদ মার্জ্জিতবুদ্ধি, বিনয়ী, শিষ্ট শান্ত ধীর এবং পরোপকারী। সেইজন্য হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদেরই বিশেষ পক্ষপাতী। মনিরুদ্দীনের পিতার মৃত্যুর পর হইতে তাঁহার জমিদার-সংক্রান্ত কোন মাম্লা-মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিতই তৎসম্বন্ধে পরামর্শ করিতেন। মনিরুদ্দীনকে সেজন্য তাঁহার বড়-একটা প্রয়োজন হইত না।
জোহেরার পিতার সহিতও সুবিজ্ঞ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুর বন্ধুত্ব ছিল। মনিরুদ্দীনের পিতার ন্যায় তাঁহারও জমিদারী-সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা, হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে আসিয়া পড়িত। জোহেরার পিতার সহিত মনিরুদ্দীনের পিতার বিশেষ সদ্ভাব থাকায় তদুভয়ের জমিদারী সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা একা নিজের হাতে লইতে হরিপ্রসন্ন বাবুর কোন গোলযোগের সম্ভাবনা ছিল না। এবং দুইজন বড় জমিদারকে হাতে পাইয়া তাঁহার আয়ের পথ বেশ সুগম হইয়াছিল। এক্ষণে মুন্সী জোহিরুদ্দীন জোহেরার বিষয়-সম্পত্তির অছি হওয়ায় হরিপ্রসন্ন বাবুর একটু ক্ষতি হইয়াছে। মুন্সী সাহেব কিছু স্বজাতিপ্রিয়। তিনি অধিকাংশ মোকদ্দমা একজন স্বজাতীয় ব্যবহারজীবীর হস্তে নির্ভর করিয়া থাকেন। তবে কোন সঙ্গীন মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবুকেই তাঁহাকেই তাঁহার প্রয়োজন হইত। হরিপ্রসন্ন বাবুও তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত ছিলেন না; যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়াছেন, এখন এই বৃদ্ধ বয়সে অতিরিক্ত পরিশ্রমে আর তাঁহার বড় একটি রুচি ছিল না। তবে তিনি জোহেরাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন বলিয়া অনেক সময়ে তাঁহাকে স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া অনেক কাজ সম্পন্ন করিতে হইত। যখন জোহেরা এতটুকুটি, তখন তিনি তাহাকে অনেকবার কোলে পিঠে করিয়াছেন। তাঁহার নিজের সন্তানাদি না থাকায় তিনি বিজাতীয় বন্ধুর কন্যা জোহেরাকে অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছেন। এবং জোহেরা অদ্যাপি তাঁহাকে পিতৃতুল্য ভক্তি করে। জোহেরা যে মজিদ খাঁর অনুরাগিণী এবং কেবল অভিভাবক মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মত্ না থাকায় বয়স অধিক হইলেও জোহেরার বিবাহ বন্ধ আছে, তাহা হরিপ্রসন্ন বাবুর অগোচর ছিল না। মজিদ খাঁ অতি সুপাত্র। তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহে তিনি পক্ষপাতী ছিলেন; কিন্তু ইদানীং তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত একটা জনরব শুনিয়াছিলেন যে, জোহেরা মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে; কিন্তু অদ্য সহসা জোহেরা সাক্ষাৎ অভিলাষিণী হইয়া তাঁহার নিকটে একজন লোক পাঠাইতে বুঝিতে পারিলেন, তাহা জনরবমাত্র। উকীল মানুষ তিনি, জোহেরার মনোগত ভাব বুঝিতে তাঁহার কতখানি সময়ের আবশ্যক? তিনি আপন মনে কহিলেন, নিশ্চয়ই জোহেরা মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হওয়ায় অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে, এখন আমার সহিত দেখা করিয়া একটা পরামর্শ করিতে চায়। মনে করিয়াছে, মজিদ খাঁর বিপদে আমি নিশ্চিন্ত আছি-কি ভ্রম! যাক্ এখন জোহেরার সহিত দেখা না করিয়া আগে মজিদ খাঁর সঙ্গে আর একবার দেখা করিতে হইবে। মজিদ, যেরূপ জটিলভাবে এই বিপদে পড়িয়াছে- যদিও সে নির্দ্দোষী, তথাপি তাহাকে উদ্ধার করা বড় শক্ত হইবে। তাহার বিরুদ্ধে তিনটি ভয়ানক প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে। প্রমাণগুলি লিখিয়া রাখা দরকার, ” বলিয়া পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া লিখিতে লাগিলেন।
১। মজিদ খুনের রাতিতে দিলজানকে শেষজীবিত দেখিয়াছে।
২। সেই রাত্রিতেই মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের অনতিদূরে মোবারক মজিদকে দেখিয়াছে; তখন মজিদের বড় ব্যস্ত-সমস্ত ভাব।
৩। মজিদের বাসা হইতে একখানা বিষাক্ত ছুরি পাওয়া গিয়াছে। খুব সম্ভব, সেই ছুরিতেই দিলজান খুন হইয়াছে।
অত্যন্ত কঠিন প্রমাণ। ভাবিয়া দেখিলেন, ইহাতে মজিদ যে প্রতিবাদ করিয়াছে, তাহা কোন কাজেরই নহে; তথাপি হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাও নোটবুকের অপর পৃষ্ঠায় লিখিলেন:-
১। মজিদ এখন বলিতেছে, খুনের রাত্রিতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান নহে। সে অন্য কোন স্ত্রীলোক। তাহার নাম সে কিছুতেই প্রকাশ করিতে পারিবে না।
২। মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের কিছুদূরে তাহার সহিত মোবারকউদ্দীনের যে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, মজিদ বলিতেছে, তাহা দৈবক্রমেই হইয়া থাকিবে।
৩। যেদিন রাত্রিকালে দিলজান খুন হয়, সেই দিন অপরাহ্ণে দিলজানের সহিত মজিদের দেখা হইয়াছিল। মজিদ বলিতেছে, সে তাহার নিকট হইতে ঐ ছুরি জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছিল।
হরিপ্রসন্ন বাবু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দেখিলেন, মজিদ যে প্রতিবাদ করিতেছে, কিছুতেই টিকিবে না। নির্দ্দোষ হইলেও তাহাকে তাহারই দোষে এই হত্যাপরাধে দণ্ডার্হ হইতে হইবে। মজিদ কেন এরূপ কপট ব্যবহার করিতেছে? এখন আর একবার তাহার সহিত দেখা করিয়া যাহাতে তাহার মতি ফিরাইতে পারি, যাহাতে সে অকপটভাবে আমার কছে সকল কথা প্রকাশ করে, সে চেষ্টা এখন আমাকে দেখিতে হইবে। এইরূপ স্থির করিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়া পড়িলেন।
৩.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – মুখ বন্ধ
মজিদ খাঁ হাজতে ।
হরিপ্রসন্ন তাঁহার সহিত দেখা করিয়া অনেক রকমে বুঝাইতে লাগিলেন । তাঁহার মাথার উপরে অতি সূক্ষসূত্রে যে একখানা ভয়ানক বিপদের খড়গ ঝুলিতেছে, তাহাও নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিলেন ।
মজিদ খাঁ বলিলেন, “যাহা বলিবার, তাহা আমি পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি । তবে ছুরিখানির সম্বন্ধে আমি আপনার নিকটে কোন কথা গোপন করিতে চাহি না । আমি বিগত বুধবারে অপরাহ্ণে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলাম । সেইখানে দিলজানের সহিত আমার দেখা হয় । দিলজান মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল । তাহার অবস্থা তখন ভাল নহে; সে ক্ষোভে, রোষে যেন উন্মত্তা হইয়া উঠিয়াছিল । আমি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইতে লাগিলাম. কিছুতেই তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিলাম না । একবার সে রোষভরে সেই ছুরিখানা বাহির করিয়া বলিল, “আগে সে মনিরুদ্দীনকে খুন করিবে, তাহার পর সৃজানকে; নতুবা সে কিছুতেই ক্ষান্ত হইবে না । আমি তাহার নিকট হইতে জোর করিয়া ছুরিখানা কাড়িয়া লইতে গেলাম; সে তখন ছুরিখানি দ্বারের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল । আমি যেমন ছুটিয়া গিয়া ছুরিখানি কুড়াইয়া লইতে যাইব-দেখিতে না পাইয়া ছুরিখানি মাড়াইয়া ফেলিলাম, তাহাতেই ছুরির বাঁট ভাঙ্গিয়া যায় । আমি ছুরিখানি তুলিয়া পকেটে রাখিয়া দিলাম । ছুরিখানি যে বিষাক্ত, তাহা আমরা কেহই তখন জানিতাম না । দিলজানের যদি জানা থাকিত, তাহা হইলে আমি যখন ছুরিখানা লইয়া কাড়াকাড়ি করি, অবশ্যই সে আমাকে সাবধান করিয়া দিত, আর সে নিজেও সাবধান হইত । যাহা হউক, তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়া আমি নিজের বাসায় চলিয়া আসি; ইহার পর দিলজানের সহিত আর আমার দেখা হয় নাই । বাসায় আসিয়া ছুরিখানা পকেট হইতে বাহির করিয়া আমি টেবিলের উপরেই ফেলিয়া রাখিয়া দিই । আমি চাবির পাশে ছুরি রাখি নাই-আর কেহ সেখানে রাখিয়া থাকিবে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে সেইদিন মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে রাত এগারটার পর যে স্ত্রীলোকটির সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল, সে কে?”
মজিদ খাঁ অবনতমস্তকে কহিলেন, “সে কথা আমি কিছুতেই বলিতে পারিব না-বাধা আছে । আমি যতক্ষণ না সেই স্ত্রীলোকের সহিত আর একবার দেখা করিতে পারিতেছি ততক্ষণ আমি তাহার নাম প্রকাশ করিতে পারিব না, আমি তাহার নিকটে এইরূপ প্রতিশ্রুত আছি । তাহার সম্মতি ব্যতীত এখন আর উপায় নাই ।”
হরি । তাহার সম্মতি কতদিনে পাইবে?
মজিদ । তা’ আমি এখন কিরূপে বলিব? তবে এ সময়ে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে একবার দেখা হইলে আমি যাহা হয়, একটা স্থির করিয়া হয় ত সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিতে পারিতাম ।
হরি । তোমার কথার ভাবে বুঝিতে পারা যাইতেছে, সেই স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই সৃজান ।
মজিদ । কই, আমি ত আপনাকে কিছু বলি নাই ।
হরি । স্পষ্টতঃ না বলিলেও, তোমার কথার ভাবে বুঝাইতেছে, সেই স্ত্রীলোক আর কেহ নহে-সৃজানই সম্ভব ।সম্ভব কেন-নিশ্চয়ই । আর আমাকে গোপন করিতে চেষ্টা করিয়ো না । ঠিক করিয়া বল দেখি, সে সৃজান কি না?
মজিদ । আমার অপরাধ ক্ষমা করুন, আপনি কোন ক্রমেই এখন আমার কছে আপনার এ প্রশ্নের উত্তর পাইবেন না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু আরও অনেক চেষ্টা করিলেন, কিছুতেই মজিদ খাঁর মত্ পরিবর্ত্তন করিতে পারিলেন না । বলিলেন, “তুমি যদি বাপু, তোমার নিজের বিপদের কতটা গুরুত্ব না বুঝিতে পার, তোমার মত নির্ব্বোধ আর কেহই নাই । যদি তুমি এখনও আমার কাছে সত্য গোপন করিতে চাও-আমি তোমাকে উদ্ধার করিবার কোন সুবিধাই করিতে পারিব না ।”
তথাপি মজিদ খাঁ নিরুত্তর রহিল ।
৩.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুখবন্ধের কারণ কি?
হরিপ্রসন্ন বাবু হাজত হইতে বাহির হইয়া নিজের বাড়ীর দিকে চলিলেন । বাটীসম্মুখে আসিয়া দেখিলেন বহির্দ্বারের নিকটে একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে । দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন, সে গাড়ী জোহেরার । বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার যাইতে বিলম্ব হওয়ায় জোহেরা নিজে আসিয়াছে । গাড়ীর ভিতরে জোহেরা বসিয়া ছিল । হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে সস্নেহ-সম্ভাষণ করিয়া আপনার বাটীর ভিতরে লইয়া গেলেন । দ্বিতলে একটি প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া তাহাকে বসিতে বলিলেন; এবং একটা স্বতন্ত্র আসনে তাহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বসিলেন । বসিয়া বলিলেন, “আমি এখনই তোমার ওখানে যাইব বলিয়া মনে করিতেছিলাম । একটা বিশেষ কাজ থাকায়-খবর পাইয়াই যাইতে পারি নাই । তা’ তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে । যে জন্য তুমি আমাকে তোমার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছিলে, তাহা আমি অনুভবে তখনই এক প্রকার বুঝিতে পারিয়াছিলাম । আমি এই মাত্র মজিদের নিকট হইতে ফিরিতেছি । মজিদ নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী-তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই ।”
জোহেরা বলিল, “নির্দ্দোষী -তিনি যে নির্দ্দোষী, তাহা আমিও জানি । তাঁহার দ্বারা কখনই এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্ভবপর নয়; কিন্তু কিরূপে তাঁহার নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ হইবে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না ।”
চিন্তিতমুখে হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাই ত, যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এখন মজিদের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা বড় শক্ত ব্যাপার! এমন কি সে আমার কাছেও কিছুতেই কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহে না । কেবল সকলই গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে ।”
জোহেরা ব্যাকুলভাবে কহিল, “কি মুস্কিল! তিনি আবার এ সময়ে – এই ভয়ানক বিপদের মাঝখানে দাঁড়াইয়া এমন করিতেছেন কেন? কি কথা তিনি আপনার কাছে প্রকাশ করেন নাই?”
উকীলবাবু বলিলেন, “সেই খুনের রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম । কিছুতেই মজিদ তাহার নাম বলিল না । আমার বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোক আর কেহই নহে-সৃজান বিবি ।”
“সৃজান বিবি!” যেন প্রতিধ্বনি করিয়া জোহেরা বলিল, “কি সর্ব্বনাশ! তিনি সেখানে-তেমন সময়ে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন যাইবেন? আপনার অনুমানই ঠিক নহে ।”
উকীল বাবু বলিলেন, “আমার অনুমানই ঠিক-সৃজান বিবি মনিরুদ্দীনের সহিত গোপনে দেখা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার দেখা না হইয়া ঘটনাক্রমে মজিদের সহিতই তাহার দেখা হইয়া যায় । সৃজান বিবি-যাহাতে মজিদ তাহার নাম প্রকাশ না করে, সেজন্য তাহাকে প্রতিশ্রুত করাইয়া থাকিবে । এইরূপ একটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় মজিদ সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করিতে পারিতেছে না । মজিদ এখন বলিতেছে, সেই স্ত্রীলোকের নাম প্রকাশ করুতে হইলে, অন্ততঃ মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করা দরকার; কিন্তু এ সময়ে কি মনিরুদ্দীনের সহজে দেখা পাওয়া যাইবে? সে এখন একেবারে নিরুদ্দেশ ।
জোহেরা কহিল, “নিজে এমন বিপদাপন্ন; এ সময়ে সৃজান বিবির নাম প্রকাশ করিতে হইলে কি ক্ষতি আছে? কি আশ্চর্য্য! সামান্য প্রতিজ্ঞার জন্য বিবির যে সম্ভ্রমহানি হইবে, এখন আর এমন সম্ভবনা নাই-সে ত নিজের মান-সম্ভ্রম নিজেই জলাজ্ঞলি দিয়া গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে; তবে তাহার জন্য কেন আত্মোৎসর্গ?”
উকীল বাবু বলিলেন, “আরও একটা কারণ আছে । সৃজান বিবি যে মনিরুদ্দীনের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে, ইহা লোকে শুনিলেও সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে এখন সকলেরই সন্দেহ আছে । কিন্তু এখন যদি মজিদ প্রকাশ করে যে, সৃজান বিবিকেই সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দেখিয়াছে, তাহা হইলে মনিরুদ্দীন যে, সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িয়াছে, সে সম্বন্ধে ত আর কাহারও সন্দেহের কোন কারণই থাকিবে না । যাহা তাহারা শুনিয়াছে, তাহাতেই সকলে কৃতনিশ্চয় হইতে পারিবে । ইহাতে মনিরুদ্দীন দোষী হইলেও মজিদ তাহাকে আপনার ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করে-কিছুতেই সে তাহার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিবে না । সেইজন্যই মজিদ কোন কথা প্রকাশ করিবার পূর্ব্বে একবার মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে চাহে বোধ হয় ।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া জোহেরা বলিল, “কিন্তু এখন মনিরুদ্দীনকে কোথায় পাওয়া যাইবে- তাঁহার ত কোন সন্ধান নাই । তবে কি হবে?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাই ত, কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না । মজিদের বিরুদ্ধে কয়েকটা প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে ।”
সোৎসুক জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহার অনুকূলে কি কোন প্রমাণই নাই? তিনি কি নিজের উদ্ধারের জন্য আপনার নিকটে কোন কথাই প্রকাশ করেন নাই? আত্মরক্ষায় তিনি কি এমনই উদাসীন?”
উকীল বাবু বলিলেন, “তাঁহার অনুকূলে একটা প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে-এখন তাহা সপ্রমাণ করা চাই । মজিদের মুখে শুনিলাম, যে ছুরিখানি তাহার বাসায় পাওয়া গিয়াছে, তাহা সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছিল । তাহার পর নিজের বাসায় আনিয়া টেবিলের উপরে সেই ছুরিখানা ফেলিয়া রাখে; কিন্তু ছবির পাশে কে তাহা তুলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা মজিদ নিজে জানে না । তাহার অনুমান, বাড়ীওয়ালীই ঘর পরিষ্কার করিতে আসিবার সময় ছুরিখানি ছবির পাশে তুলিয়া রাখিয়া থাকিবে ।”
জোহেরা বলিল, “তাহা হইলে এখন একবার তাহা আপনাকে সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে । আপনি হামিদার সহিত একবার দেখা করুন ।”
উকীল বাবু বলিলেন, দেখা ত করিবই; কিন্তু কাজে কতদূর হইবে, বুঝিতে পারিতেছি না ।
জোহেরা ব্যগ্রভাবে কহিল “হতাশ হইবেন না-নিশ্চয়ই আপনি কৃতকার্য্য হইবেন ।”
৩.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কারণ – দুর্জ্ঞেয়
হরিপ্রসন্ন বাবু আর কালবিলম্ব না করিয়া মজিদ খাঁর বাসাতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । হামিদা তখন বাড়ীতেই ছিল । হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমাকে একবার মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া চল । বিশেষ আবশ্যক আছে ।”
হামিদা বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুকে চিনিত । খুব খাতির করিয়া তাঁহাকে মজিদ খাঁর ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল ।
বসিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আমি তোমাকে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই । যাহা জান, সত্য বলিবে ।”
হামিদা বলিল, “আপনার সঙ্গে মিথ্যাকথা কি, মশাই? আমি মিথ্যাকথা কখনও কহি না-আমাকে এখানকার সকলেই জানে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মজিদ খাঁর ঘর কে পরিষ্কার করে?”
হামিদা বলিল, “আমি-আর কে কর্বে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মনে পড়ে, তুমি এ ঘরে কখনও একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি টেবিলের উপরে প’ড়ে থাক্তে দেখেছ?”
হামিদা অঙ্গুলীতে অঞ্চল জড়াইতে জড়াইতে চিন্তা করিতে লাগিল । অনেকক্ষণ পরে বলিল, “হাঁ, একখানা বাঁটভাঙ্গা ছুরি দেখেছি বটে ।”
হরি । কতদিন পূর্ব্বে?
হামি । বেশি দিন না-এই সেদিন হবে । কোন্ দিন তা, ঠিক আমার মনে হচ্ছে না । একদিন সন্ধ্যার সময়ে খাঁ সাহেব বাড়ীতে এলেন । এসেই পকেট থেকে একখানা ভাঙ্গা ছুরি বের ক’রে এই টেবিলের উপরে রাখ্লেন- আমি তখন এই ঘরটা পরিষ্কার করছিলেম । তার পর তিনি গা ধুতে নীচে চ’লে গেলেন; তখনই তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে উপরে উঠে এলেন, আবার কাপড়-চোপড় প’রে বেরিয়ে গেলেন । যাবার সময়ে আমাকে খানা তৈয়ারী রাখ্তে মানা ক’রে দিলেন । বল্লেন, “ফির্তে অনেক রাত হবে, হোটেলেই খাবেন,” আমার তা’ বেশ মনে আছে ।
হরি । ছুরিখানা কি তখনও টেবিলের উপরেই প’ড়ে ছিল?
হামি । সেই ছুরিখানা? হাঁ, টেবিলের উপরেই পড়েছিল বৈকি । তা’ আমি সেখানা একখানা ছবির পাশে তুলে রেখে দিই । কেন-কি হয়েছে?
হরি । রাত্রে মজিদ খাঁ ফিরে এসেছিল?
হামি । হাঁ, অনেকরাত্রে । রাত তখন শেষ হ’য়ে এসেছে ।
হরি । তখন মজিদের মেজাজ্ কেমন ছিল?
হামি । বড় ভাল নয়-মুখ চোখের ভাবে আমি তা’ বেশ বুঝ্তে পারলেম । বাড়ীর ভিতরে এসে সরাসর উপরে উঠে গেলেন । এমন কি আমাকে সাম্নে দেখ্তে পেয়েও আমার সঙ্গে একটী কথা কহিলেন না ।
হামিদার নিকটে আর বিশেষ কিছু সংবাদ পাওয়া গেল না । হরিপ্রসন্ন বাবু হামিদার বাটী ত্যাগ করিয়া পুনরায় জোহেরার সহিত দেখা করিতে তাহাদিগের বাড়ীর দিকে চলিলেন ।
অনন্তর জোহেরার সহিত দেখা করিয়া তিনি হামিদার প্রমুখাৎ যাহা কিছু শুনিয়াছিলেন সমুদয় তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন । তাহার পর বলিলেন, এখন বুঝিতে পারিতেছ, মজিদ খাঁর অনুকূলে একটা খুবই প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে । মজিদ খাঁ এই ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করে নাই, তাহা এখন আমি হামিদাকে দিয়া সপ্রমাণ করিতে পারিব ।”
জোহেরা বলিল, “তাহাতে এখন আমাদের এমন বিশেষ কি কাজ হইবে? ঐ ছুরিতে খুন না করিলেও, তিনি অপর ছুরি দ্বারা দিলজানকে খুন করিয়াছেন, এই কথাই এখন তাঁহার বিপক্ষেরা বলিলেন ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলেও ত মোকদ্দমা অনেকখানি হালকা হইয়া গেল । দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃঢ় ধারণা, ঐ ছুরি দ্বারা দিলজান খুন হইয়াছে । মজিদ যে এই খুন করিয়াছে, তিনি এ পর্য্যন্ত তাহার আর এমন কোন কারণ দেখিতে পান নাই । কেবল ওই ছুরিখানা মজিদের ঘরে পাওয়ায় তিনি সন্দেহের বশেই তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন ।”
জো । তবে এখন উপায়?
হ । উপায় আমি করিতেছি । মুন্সী সাহেব এখন বাড়ীতে আছেন কি?
জো । আছেন । সৃজান বিবি গৃহত্যাগ করার পর তিনি আর বাহিরে যান না, কাহারও সহিত দেখাও করেন না -দিনরাত উপরের বৈঠকখানায় একা ব’সে থাকেন ।
হ । তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে হইবে ।
জো । কেন?
হ । সৃজান বিবির সম্বন্ধে দুই – একটি কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাস্য আছে । সৃজান বিবি কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিল, কখন তিনি তাহা প্রথম জানিতে পারিলেন-
জো । (বাধা দিয়া) তাহাতে কি উপকার হইবে? সে সম্বন্ধে বোধ হয়, তিনি আপনাকে বিশেষ কিছু বলিতে পারিবেন না । হয় ত রাগও করিতে পারেন । আপনি জনিতে চাহেন, সৃজান বিবি গৃহত্যাগের পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল কি না-যদিই সেখানে গিয়া থাকে, তাহাতে আমাদের এমন কি উপকার হইবে?
হ । তোমার বয়স কম, বুদ্ধিও সেরূপ অপরিপক্ক-কি উপকার হইবে কি না, তুমি তাহার কি বুঝিবে? ইহাতে হয়তো পরে কেস্টা এমন হইয়া যাইতে পারে যে, তখন মজিদ খাঁকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করিতে আর আমাদিগকে বিশেষ কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না ।
৩.১৪ – চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে
জোহেরা হরিপ্রসন্ন বাবুকে সঙ্গে লইয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীনের কক্ষে প্রবেশ করিলেন । ধুমপানরত মুন্সী সাহেব মুখ হইতে শট্কার নল নামাইয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি মনে ক’রে, উকীল বাবু?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার নিকটে আসিয়াছি । বোধ করি, আপনি শুনিয়া থাকিবেন, পুলিস দিলজানের হত্যাপরাধে মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়া হাজতে রাখিয়াছে ।”
মুন্সী । কই, আমি ত ইহার কিছুই শুনি নাই ।
হরি । ডিটেক্টিভ-ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় তাহার বিপক্ষে । মজিদ এখন বড় সঙ্কটাপন্ন, তাহার প্রণরক্ষা করা দরকার ।
মুন্সী । খুনীর প্রাণরক্ষা! কিরূপে তাহা হইবে?
জোহেরা । মজিদ খুনী নহেন-নির্দ্দোষী হইয়াও এখন তাঁহাকে দোষী হইতে হইয়াছে ।
মুন্সী সাহেব শট্কার ফরসীর উপর দৃষ্টি স্থির রাখিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন “মজিদ খাঁর উপরে এখনও তোমার সেই অন্ধ অনুরাগ সমভাবে আছে দেখিতেছি ।” কথাটা জোহেরাকে বলিলেন কি ফর্সীটাকে বলিলেন, তাহা ঠিক বুঝিতে পারা গেল না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “মজিদ খাঁ যে দোষী নহে, আমিও তাহা জানি । অন্যায় ভাবে এই হত্যাপরাধটা তাহার স্কন্ধে চাপিলেও, সে এখন কোন একটা অনির্দ্দেশ্য কারণে মুখ ফুটিয়া কিছু প্রকাশ করিতে পারিতেছে না! এখন যদি আমরা তাহাকে এই বিপদ্ হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা না করি, তাহা হইলে তাহাকে বিনা দোষেই ফাঁসী যাইতে হয় ।”
মুন্সী । তা’ আমার দ্বারা আপনার কি সাহায্য হইতে পারে?
হরি । অনেক সাহায্য হইতে পারে । আমার বিশ্বাস, খুবই সম্ভব-আপনার স্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ।
মুন্সী সাহেব বিরক্তভাবে বিবর্ণমুখে বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! কিরূপে তাহা হইবে? আপনি একান্ত অবিবেচক-তাই এই সকল কথা আমার কাছে উত্থাপন করিতে আসিয়াছেন । আমি আপনাকে সাবধান করিয়া দিতেছি, আপনি ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের সম্ভ্রম রাখিয়া অবশ্য আপনার কথা কহা উচিত ।”
হরি । দায়ে পড়িয়াই আমাকে আপনার পতিতা স্ত্রীর কথা আপনারই সমক্ষে উত্থাপন করিতে হইতেছে; নতুবা একজন নির্দ্দোষীর জীবন রক্ষা হয় না । আপনার স্ত্রীর দ্বারা যে, এই হত্যাকাণ্ড সমাধা হইয়াছে, এমন কথা আমি বলিতেছি না । আমার অনুমান, খুনের রাত্রে এগারটার পর মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে মজিদ খাঁর সহিত আপনার স্ত্রীর একবার দেখা হইয়াছিল ।
মুন্সী । মজিদ এখন তাহাই বলিতেছে না কি?
হরি । না, মজিদ কোন কথাই প্রকাশ করিতে চাহে না-সে একেবারে মুখ বন্ধ করিয়াছে । একজন স্ত্রীলোকের সহিত যে, সেদিন রাত্রিকালে তেমন সময়ে তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহা নিশ্চয়; কিন্তু কে সে স্ত্রীলোক, এ পর্য্যন্ত তাহা আবিষ্কার করিতে পারা যায় নাই । আমার অনুমান, সেই স্ত্রীলোক আপনার পতিতা স্ত্রী ব্যতীত আর কেহই নহে । আমার এই অনুমানটা কতদূর সত্য জানিতে হইলে, আপনারই সহায়তার প্রয়োজন । আপনার স্ত্রী কখন গৃহত্যাগ করিয়াছিলেন, জানিতে পারিলে আমি এক-রকম সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হইতে পারি; একমাত্র আপনার কাছেই সে সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে ।
মুন্সী । সে সংবাদ আমার কাছে কিরূপে পাইবেন? আমি জানিতে পারিলে কখনই এমন দুর্ঘটনা ঘটিতে না ।
হরি । না, আমি সে কথা বলিতেছি না । আপনার স্ত্রী গৃহত্যাগের কথা কখ্ন আপনি প্রথমে জানিতে পারিলেন? তখন রাত কত-রাত বারটার পূর্ব্বে কি?
মুন্সী । না, রাত তখন শেষ হইয়া আসিয়াছে ।
হরি । রাত বারটার সময়ে আপনার স্ত্রী বাড়ীতে ছিলেন কি না, তাহা জানেন?
মুন্সি । না, তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারিলাম না । আমি কোন কাজে বাহির হইয়াছিলাম; রাত এগারটার পর আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসি । তখন বাড়ীর সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে । আমি নিজের শয়ন-কক্ষে শয়ন করিতে গেলাম; দেখিলাম, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ । অনেকবার ডাকিলাম, আমার স্ত্রীর কোন উত্তর পাইলাম না । ঘুরিয়া আসিয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, তখনই এই বৈঠকখানায় আসিয়া শয়ন করিলাম । তাহার পর শেষ-রাত্রিতে উঠিয়া আমি এই দুর্ঘটনার কথা জানিতে পারিলাম । আমি ত পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, আমার নিকটে আপনি বিশেষ কোন সংবাদ পাইবেন না ।
হরিপ্রসন্ন বাবু কি বলিতে যাইতেছিলেন-এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি কার্ড দিলেন । মুন্সী সাহেব কার্ডখানি একবার চক্ষুর নিকটে লইয়া, তৎক্ষণাৎ হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, “আপনার সেই দেবেন্দ্রবিজয় বাবু আসিয়া উপস্থিত ।আপনি ইচ্ছা করিলে এখন তাঁহার কাছে অনেক সংবাদ পাইতে পারেন । ঠিক সময়েই তিনি আসিয়াছেন, দেখিতেছি । তাহার পর ভৃত্যকে বলিলেন, “তাহাকে এখানে আসিতে বল ।”
ভৃত্য চলিয়া গেলে হরিপ্রসন্নবাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় বাবু লোকটা বড় সহজ নহেন । অবশ্যই একটা কোন গুরুতর মত্লব মাথায় করিয়া এখানে আসিয়া উপস্থিত । যে অভিপ্রায়ে আসিয়াছেন, আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াছি । তিনি মজিদ খাঁকে গ্রপ্তার করিয়াছেন, এখন মজিদ খাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবার প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছেন ।”
এমন সময়ে সেই প্রকোষ্ঠ মধ্যে ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন । সম্মুখদিকে একটু মাথা নাড়িয়া আগে জোহেরার, তাহার পর মুন্সী সাহেবের সম্মান রক্ষা করিলেন । তাঁহারাও সেইরূপ ভাবে সম্মান জানাইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিলেন ।
৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য
আসন পরিগ্রহ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সংযতস্বরে হরিপ্রসন্ন বাবুকে বলিলেন, “কেমন আছেন, মহাশয়? অনেকদিন আপনাকে দেখি নাই; এখানে আজ কি মনে করিয়া? বোধ করি, এক অভিপ্রায়েই আমাদের উভয়েরই এখানে আগমন হইয়াছে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “ঠিক তাহা নহে-মহাশয়, বরং বিপরীত-আপনি মজিদ খাঁকে ফাঁসীর দড়ীতে লট্কাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত; কিন্তু আমি সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু, এইখানেই আপনি একটা মস্ত ভুল করিয়া ফেলিয়াছেন । আমিও সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; আমারও বিশ্বাস, মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তবে আপনি তহাকে গ্রেপ্তার করিলেন কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাঁহার বিরুদ্ধে যে বলবৎ প্রমণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে তাঁহকে গ্রেপ্তার করা অন্যায় হয় নাই । সম্প্রতি দেখিতেছি, কয়েকটা বিষয়ে আমি বেশ বুঝিতেও পারিয়াছি, মজিদ খাঁ প্রকৃত পক্ষে দোষী ব্যক্তি নহেন ।”
দেবেন্দ্রবিজয় এমনভাবে কথাগুলি বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা তাহাতে অবিশ্বাসের কিছুই দেখিতে পাইলেন না দেখিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলে আপনিও আমাদের দলে আসিতেছেন, দেখিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমিই আপনার দলে যাই-আর আপনিই আমার দলে আসুন, এখন তাহা একই কথা । মজিদ খাঁর নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা এখন হইতে আমাদের উভয়ের প্রধান উদ্দেশ্য রহিল । এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে, প্রকৃত হ্ত্যাকারী গ্রেপ্তার করা ঘটনাক্রমে অনেকটা পরিমাণে সহজ হইয়া আসিতে পারে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সকলই ত বুঝিলাম-আপনারা উভয়েই মজিদ খাঁর প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট; আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হউক; কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, আপনি আজ কি অভিপ্রায়ে আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন, সে সম্বন্ধে ত কোন কথাই বলিলেন না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এইবার বলিতেছি-কাজের কথা আমি কখনও ভুলি না । যে কথাটা উঠিয়াছে, তাহা শেষ করিয়া অন্য কথা আরম্ভ করাই ঠিক । আমি আপনার স্ত্রীর সম্বন্ধে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই । বোধ করি, আপনি কোন ত্রুটি লইবেন না!”
হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা সবিস্ময়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন । বুঝিলেন, তিনি মিথ্যা বলেন নাই-তাঁহারা যে উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন, তিনিও ঠিক সেই সেই উদ্দেশ্যে মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে উপস্থিত ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার স্ত্রী সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন কি?”
মুন্সী । এ কথা আপনাকে কে বলিল?
দেবেন্দ্র । কেহ বলে নাই । গিয়াছিলেন কি?
“আমি কিছুই জানি না ।” বলিয়া মুন্সী সাহেব যাহা জানিতেন, দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন । ইতিপূর্ব্বে হরিপ্রসন্ন বাবুকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহারই পুনরাবৃত্তিমাত্র-সুতরাং তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন ।
দেবেন্দ্রবিজয় তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি সেদিন রাত এগারটার পরই বাড়ীতে ফিরিয়াছিলেন । তাহার পর আর বাড়ী হইতে বাহির হন্ নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেব যেন একটু বিব্রত হইয়া উঠিলেন । বলিলেন, “না ।”
দেবেন্দ্র । (হরিপ্রসন্নের প্রতি) আপনার কি বোধ হয়, হরিপ্রসন্ন বাবু? সেদিন রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদ খাঁর দেখা হয়, কে সে? কখনই সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী নহেন । আমার অনুমানই ঠিক- সে দিলজান না হইয়া যায় না-সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী বাড়ীতেই ছিলেন ।
মুন্সী । কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?
দেবে । সাখিয়া বাঁদীর মুখে শুনিয়াছি ।
জোহে । হাঁ, আমাকেও সে ইহা বলিয়াছে । তাহা হইলে-তাহা হইলে-
সহসা মধ্যপথে থামিয়া গিয়া জোহেরা সকলের মুখের দিকে একান্ত ব্যাকুলভাবে বারংবার চাহিতে লাগিল ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা হইলে কে সে স্ত্রীলোক, কিরূপে এখন ঠিক হইতে পারে? যখন মজিদ খাঁ নিজে কোন কথা প্রকাশ করিবেন না, তখন আমাদিগকে অন্য উপায় অবলম্বন করিতে হইবে । এখন মুন্সী সাহেবের পলাতক স্ত্রীর সন্ধান লইতে হইবে; তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে পারিলে, এই খুন-রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হইয়া যাইবে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সে দিলজানের খুন সম্বন্ধে কি জানে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বেশী কিছু না জানিলেও তাঁহার ভগিনীর খুনের কারণটা হয় ত তিনি কিছু কিছু জানেন-”
সকলে । (সবিস্ময়ে) তাঁহার ভগিনী!
মুন্সী । কে তাহার ভগিনী ।
দেবেন্দ্র । দিলজান-যে মেহেদী-বাগানে খুন হইয়াছে-
মুন্সী । (বাধা দিয়া-বিরক্তভাবে) আপনি পাগল না কি! কে আমার স্ত্রী, তাহা কি আপনি জানেন?
দেবেন্দ্র । খুব জানি-খিদিরপুরের মুন্সী মোজাম হোসেনের দুহিতা । তাঁহার দুই যমজ কন্যা-একজনের নাম মৃজান-মৃজান মনিরুদ্দীনের সহিত পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিয়া দিলজান নাম গ্রহণ করে; অপর কন্যার নাম সৃজান-আপনার সহিতই পরে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল ।
মুন্সী সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ঘৃণাভরে বলিলেন, “ইহাও কি সম্ভব! আমার স্ত্রীর যে মৃজান নামে এক যমজ ভগিনী ছিল, তাহা আমি ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, কিন্তু আমার বিবাহের পূর্ব্বেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মৃজান নামে মরিয়া দিলজান নামে সে এতদিন বাঁচিয়া ছিল । এখন সে একেবারেই মরিয়াছে । যখন দেখা যাইতেছে, সৃজানের গৃহত্যাগ এবং মৃজানের হত্যা এক রাত্রিরই ঘটনা, তখন খুবই সম্ভব, সৃজান বিবি এই হত্যাকাণ্ডে কিছু জড়িত আছেন ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু দেখিলেন, আবার এক নুতন গোলযোগ উপস্থিত । সন্দিগ্ধভাবে দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সৃজান বিবি নিজের ভগিনী দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন, ইহাতে তাঁহার স্বার্থ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ওকালতী অর ডিটেক্টিভগিরি একই জিনিষ নহে, হরিপ্রসন্ন বাবু ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এখন সৃজানকেই খুনী মনে করিতেছেন? ইহাতে তাঁহার কি স্বার্থ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখনও কি আপনারা বুঝিতে পারেন নাই-স্বার্থ কি? উভয় ভগিনী এক ব্যক্তিরই প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী । এরূপ স্থলে একজন অপরকে খুন করিবার যে কি স্বার্থ, তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সৃজানের স্বভাব-চরিত্র কলঙ্কিত হইলেও আমার বিশ্বাস হয় না, স্ত্রীলোক হইয়া সে সহসা এতটা সাহস করিতে পারে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পুরুষের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের সাহস অনেক বেশী; প্রেম-প্রতিযোগীতায় ঈর্ষায় যখন তাহারা মরিয়া হইয়া উঠে, তখন তাহারা সকলই করিতে পারে-একটা খুন ত অতি সামান্য কথা! ”
এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি পত্র দিল । তিনি তখনই পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন । পাঠান্তে বলিলেন, “ঠিক হইয়াছে-এইবার প্রকৃত ঘটনা বুঝিতে পারা যাইবে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি হইয়াছে-ব্যাপার কি?”
রুক্ষস্বরে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সয়তান আর সয়তানী উভয়ই মিলিয়া ফরিদপুরের বাগানে বাস করিতেছে ।”
ব্যগ্রভাবে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “কে-বিবি সাহেবা আর মনিরুদ্দীন?”
মুন্সী । হাঁ, আমি যাহাকে তাহাদের সন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছিলাম, সেই ব্যক্তি তাহাদের সন্ধান করিয়া আমাকে এই পত্র লিখিয়াছে ।
দে । ভালই হইয়াছে-সেখানে গেলে প্রকৃত ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, বুঝিতে পারা যাইবে । আপনি সেখানে যাইবেন কি?
মু । এখন আমি সে কথা বলিতে পারি না; কাল যাহা হয় ঠিক করিয়া বলিব ।
দে । আমরা তিনজনেই কাল একসঙ্গে ফরিদপুরে যাইব । আপনারও সেখানে যাওয়া দরকার ।
মু । কাল সে যাহা হয়, করা যাইবে ।
৪.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে না বিপক্ষে?
চতুর্থ খণ্ড
নিয়তি – ছদ্মবেশা