সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী|”
এ কি ভয়ানক পত্র! শুনিয়া রেবতীর আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিল| শচীন্দ্র চিন্তিত হইল| বুঝিতে পারিল, তাহার মাতুল মহাশয় এবার একজন শক্ত লোকের পাল্লায় পড়িয়াছেন| শ্রীশচন্দ্র খুব মনোযোগের সহিত পত্রের আদ্যোপান্ত শুনিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমানের ন্যায় মস্তকান্দোলন করিয়া বলিল, “হাঁ, দেখা যাবে!”
শচীন্দ্র বলিল, “আমিও তবে আপনার সহিত যোগ দিব না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, শচী, তুমি এই সেদিন অসুখ হইতে উঠিয়াছ; তোমার শরীর এখনও ভাল রকম সারে নাই| তাহা না হইলেও তোমাকে দরকার নাই; আমি নিজেই সব ঠিক করে ফেলিব|”
শচীন্দ্র বলিল, “পত্রখানা দেখিয়া বুঝিতে পারা যাইতেছে, লোকটা বড় সহজ নহে; তাই বলিতেছিলাম|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোকটা সহজ না হইতে পারে; কিন্তু আমিও তাহার অপেক্ষা বড় সহজ নহি| লোকটা আমাকে ঠিক জানে না; তাহা হইলে কি সে আমাকে এমন পত্র লিখিতে সাহস করে? নারী-পিশাচী জুমেলিয়ার ঘটনা তোমার মনে পড়ে?”
শচীন্দ্র সহাস্যে বলিলেন “খুব! জুমেলিয়ার কথা এ জীবনে ভুলিবার নহে|”
জুমেলিয়ার নামে রেবতীর অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল| পিশাচী তাঁহাকে কত কষ্ট না দিয়াছে-কি ভয়ানক বিপদেই না ফেলিয়াছে-সমুদয় মনে পড়িয়া গেল! রেবতী শিহরিয়া কহিলেন, “সে কি মেয়ে? পুরুষের বাবা!”
শ্রীশ বলিল, “ডাকিনী – ডাকিনী-মাগীটা আমাকে ত আর একটু হ’লেই গঙ্গায় ডুবিয়ে মারত|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহার কথা ছাড়িয়া দাও, পিশাচী আমার শিক্ষাগুরু অরিন্দম বাবুকে পর্য্যন্ত নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিয়াছিল| (শচীন্দ্রের প্রতি) অরিন্দম বাবুকে এখিতে গিয়াছিলে?”
শচীন্দ্র বলিল, “হাঁ, এই কতক্ষণ হইল, আমি সেখান হইতে ফিরিতেছি|”
দে| তিনি কেমন আছেন?
শ| বড় ভাল নহে| বোধ হয়, তিনি এ যাত্রা রক্ষা পাইবেন না| একেবারে স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছে| ডাক্তারেরাও চিন্তিত|
দে| এই কেস্টা হাতে লইয়া অবধি আমি কয়দিন একবারও দেখিতে যাইতে পারি নাই-সময় পাই নাই| আমার কথা তাঁহাকে বলিয়াছ যে, আমি একটা খুনের মাম্লা লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি, সেজন্য কয়েকদিন যাইতে পারি নাই?
শ| বলিয়াছিলাম| এই খুনের সম্বন্ধে যাহা কিছু জানিতাম, তাহাও আমি তাঁহাকে সমুদয় বলিয়াছি|
দে| শুনিয়া তিনি কি বলিলেন?
শ| আপনাকে একবার যাইতে বলিয়াছেন|
দে| কিছু মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন?
শ| আপনার নাম করিয়া বলিলেন যে, অনুসন্ধানের ঠিক পথ এখনও অবলম্বন করিতে পারেন নাই|
দে| তা’ হইবে| আজিকার কথা শুনিলে তিনি কখনই এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিতে পারিতেন না| ভাল, দুই-একদিনের মধ্যে আমি একবার তাঁহার সহিত দেখা করিব|
রেবতী বলিলেন, “মা কালী করুন, দাদামশাই যেন শীঘ্র ভাল হইয়া উঠেন| তাঁহার মত সদাশয় পরোপকারী লোক থাকিলে এ জগতের অনেক উপকার আছে| আমাদের জন্য তিনি অনেক করিয়াছেন; তাঁহার কথা চিরকাল মনে থাকিবে| আমি আর একদিন তাঁহাকে দেখিতে যাইব|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “চল শ্রীশ, তোমাকে একবার আমার সঙ্গে যাইতে হইবে| আর বিলম্ব করিলে চলিবে না|”
শ্রীশ বলিল, “কোথায়? আমাকে কি করিতে হইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যাহা বলিব, তাহই করিতে হইবে| কোন একটা বাগানে তোমাকে লুকাইয়া থাকিতে হইবে| সেখানে দুইজন লোককে পরে দেখিতে পাইবে, একজন স্ত্রীলোক, একজন পুরুষ| তাহাদের কি কথাবার্ত্তা হয়, সব শুনিয়া আসিবে- খুব মন দিয়া শুনিবে, যেন একটি কথাও ভুল বা ছাড় না হয়|”
রেবতী বলিলেন, “আবার এখনই যাইতে হইবে? তবে একটু জল খেয়ে যাও|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখন জল খাবার সময় নয়, ঠিক সময়ে পৌঁছাইতে না পারিলে সব মাটি হইয়া যাইবে|”
রেবতী কহিলেন, “একটু মিষ্টি মুখে দিয়া এক গ্লাস জল খাইতে আর কত সময়ে যাইবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এতক্ষণ দিলে কথায় কথায় খাইয়া ফেলিতে পারিতাম-এখন আর নয়| এস শ্রীশ, আর বিলম্ব নয়|” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সত্বর উঠিয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িলেন| শ্রীশচন্দ্র তাঁহার অনুসরণ করিল| শচীন্দ্রও সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইয়া গেল|
রেবতী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া গৃহকার্য্যে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করিলেন|
২.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – জোহেরা
জোহেরা সুন্দরী| অসীম রূপ-লাবণ্য তাহার সর্ব্বাঙ্গে ঝল্মল্ করিতেছিল| যৌবনের প্রথম বিকাশে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটা গভীর প্রগাঢ় প্রশান্তভাবে ও সৌন্দর্য্যে জোহেরা যেন ভরিয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু উদ্দাম যৌবনের বসন্ত-চাঞ্চল্যে তাহা এখনও কূলপ্লাবী হয় নাই| মাধুর্য্যে যাহা কিছু-সকলই যেন সেই সুকুমার অবয়বের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে স্ফুটতররূপে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে-বাহিরের চারিদিকে যেন তাহারই কেবল একটা উজ্জ্বল আভা প্রতিক্ষণে ঠিক্রিয়া পড়িতেছে| যেন তাহার অন্তরাকাশের দূর দিগন্ত হইতে মৃদু মলয়ানিল বহিয়া বিশ্বপৃথিবীকে কি এক মোহন বাসন্তীশ্রীতে ডুবাইয়া দিয়াছে| তাহার সেই কুঞ্চিত-কৃষ্ণ-কুন্তলাবলীপরিবেষ্টিত সুন্দর ঢল ঢল মুখখানি নবীন সূর্য্যাগ্রে বিকাশোম্মুখ পদ্মের সৌন্দর্য্যে, সৌকুমার্য্যে, ভাবে ভঙ্গিতে অতি সুন্দর! দেখিলে যেন দর্শন-বুভুক্ষা আরও বাড়িয়া উঠে-যেন তৎপ্রতি চিত্ত আরও আকৃষ্ট হইয়া পড়ে| উন্নত পরিপুষ্ট দেহ – সেই দেহের তেমনই সুন্দর, বসন্তসমীরসঞ্চালিত, নবপুষ্পিত ব্রততীর মন্দান্দোলনতুল্য সেই দেহের তেমনই কি সুন্দর ললিত কোমল মনোমোহন ভঙ্গী| একবার দেখিলে আর ভুলিতে পারা যয় না| তিমির-তরঙ্গের ন্যায় কেশদাম, অপ্রশস্ত নির্ম্মল ললাট, তন্নিম্নে তুলিকাচিত্রিতবৎ বিচিত্র ভ্রূযুগ, তন্নিম্নে নীলেন্দীবরতুল্য চক্ষু, তন্মধ্যে মধুময় চঞ্চল দৃষ্টি,পদ্মারক্ত অধরপুটে বিমল হাসির লীলা-একবার দেখিলে তাহা হৃদয়ের মর্ম্মকোষে গাঁথিয়া যায়|
জোহেরা যখন বড় বালিকা, তখন তাহার পিতামাতার মৃত্যু হয়| তাঁহাদিগের কথা স্বপ্নের মত এখনও এক-একবার জোহেরার মনে পড়ে| জোহেরার পিতার নাম নাজিব-উদ্দীন চৌধুরী| তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত, অতি সদাশয় জমিদার ছিলেন| তাঁহার জমিদারীর আয় বাৎসরিক প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা| ইহার উত্তরাধিকারিণী এক্ষণে একমাত্র জোহেরা| নাজিব-উদ্দীন মৃত্যুপূর্ব্বে মুন্সী জোহিরুদ্দীনকে তাঁহার সমগ্র বিষয়ৈশ্বর্য্যের অছি নিযুক্ত করিয়া যান্| এবং যাহাতে পরে তাঁহার একমাত্র কন্যা, সুশিক্ষিতা এবং সুপাত্রে পরিণীতা হয়, সেজন্য তাঁহার প্রধান নায়েব জোহিরুদ্দীনের উপরে তাঁহার একটি বিশেষ আদেশ ছিল|
মুন্সী জোহিরুদ্দীন, নাজিব-উদ্দীনের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন| নাজিবউদ্দীন সকল রকমে তাঁহাকে খুব বিশ্বাস করিতেন| এমন কি সকল বিষয়ে তাঁহাকে নিজের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ মনে করিতেন| তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া তাঁহার নিজের জমিদারীতে তাঁহাকে নায়েবের পদ দিয়াছিলেন| তখন তাঁহার বার্ষিক আয় চল্লিশ হাজার টাকা ছিল, কিন্তু জোহিরুদ্দীনের নৈপুণ্যে তাহা অচিরকাল মধ্যে পঞ্চাশ সহস্রে পরিণত হইল| জোহিরুদ্দীনেরও মাসিক দেড়শত টাকা বেতন আড়াইশতে পরিণত হইল| মৃত্যুপূর্ব্বে নাজিব-উদ্দীন যখন তাঁহাকে সমগ্র বিষয়ের অছি নিযুক্ত করিয়া গেলেন, তখন তিনি তাঁহার বেতন তিন শত টাকা নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন|
জোহিরুদ্দীন মনে করিলে জোহেরার অনেক সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই| একান্ত বিশ্বস্তভাবে তিনি নিজের সেই মৃত বন্ধু বা প্রভুর আদেশ পালন এবং নিজের কর্ত্তব্যসাধন করিয়া আসিতেছিলেন| তিনি প্রভু-কন্যাকে সুশিক্ষিতা করিয়া তুলিলেন; কিন্তু অদ্যাপি তাহাকে সুপাত্রে পরিণীতা করিতে পারেন নাই| পাত্রীকে বিষয়ৈশ্বর্য্যশালিনী দেখিয়া পাত্র অনেক জুটিল বটে; কিন্তু কেহই সে সৌভাগ্যলাভে কৃতকার্য্য হইল না| জোহেরা বিবাহে একান্ত নারাজ-শিক্ষার গুণে সে নিজে অনেক পরিমাণে স্বাধীন প্রকৃতির হইয়া উঠিয়াছিল| কেবল তাহাই নহে, মজিদ খাঁ ইতঃপূর্ব্বে তাহার চিত্তহরণ করিয়াছিলেন| মজিদের সহিত জোহেরার বিবাহ হয়, এ ইচ্ছা মুন্সী জোহিরুদ্দীনের আদৌ ছিল না; তিনি জোহেরার জন্য মনিরুদ্দীনকেই সুপাত্র স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু মনিরুদ্দীনের চরিত্রহীনতার জন্য জোহেরা তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত; সুতরাং বিবাহ স্থগিত রহিল| মজিদ ভিন্ন জোহেরা আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না বলিয়া দৃঢ় পণ করিয়া বসিল; কিন্তু মৃত বন্ধুর আদেশ স্মরণ করিয়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন কিছুতেই তাহাতে মত দিতে পারিলেন না-অভিভাবকের বিনানুমতিতে জোহেরাও বিবাহ করিতে পারিল না| এখনও সে নাবালিকা-অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া স্বেচ্ছায় কোন কাজই করিতে পারে না; সুতরাং বিবাহ আপাততঃ স্থগিত রহিল| আইনের নির্দিষ্ট বয়সে যখন সে সাবালিকা হইবে, তখন আর তাহাকে অভিভাবকের মুখপ্রেক্ষী থাকিতে হইবে না; তখন সে নিজেি মজিদকে বিবাহ করিতে পারিবে মনে করিয়া, জোহেরা দিনাতিবাহিত করিতে লাগিল| সত্যকথা বলিতে কি, ইহাতে জোহেরা মনে মনে জোহিরুদ্দীনের উপরে অত্যন্ত উষ্ণ হইয়া উঠিল| জোহিরুদ্দীনও মেয়েটাকে এইরূপ অবাধ্য দেখিয়া মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন| জোহিরুদ্দীনের ইহাতে বিশেষ কোন দোষ দেখি না, তাঁহার বিশ্বাস, পাত্র সঙ্গতিসম্পন্ন হইলেই সুপাত্র| বিশেষতঃ মনিরুদ্দীন জমিদার-পুত্র; এক্ষণে তিনি নিজে একজন জমিদার, সমৃদ্ধির ইয়ত্তা হয় না| অতএব জোহিরুদ্দীনের মতে তিনি একটি সুপাত্র| তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহ হইলে তাঁহার পরলোকগত প্রভুর আত্মা নিশয়ই সুখানুভব করিবেন, ইহা জোহিরুদ্দীনের স্থির বিশ্বাস| পূর্ব্বেই বলিয়াছি, নিজের সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতে না পারিয়া জোহিরুদ্দীন জোহেরার ব্যবহারে মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন; কিন্তু মজিদকে তাঁহার সঙ্কল্পসিদ্ধির অন্তরায় হইতে দেখিতে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিলেন| মজিদকে তাঁহাদিগের বাড়ীতে আসিতে নিষেধ করিয়া দিলেন| এবং জোহেরাকেও নিষেধ করিয়া দিলেন, সে যেন মজিদের সাক্ষাতে বাহির না হয় ও তাঁহার সহিত কথাও না কহে|
কাজে তাহার কিছুই হয় না| প্রণয় বাধা মানে না-যেখানে বাধা, সেখানে প্রণয়ের চাতুর্য্য প্রকাশ পায়; এবং সেখানে প্রণয় প্রবঞ্চনা করিতে জানে| প্রায়ই জোহেরা ও মজিদ রাত্রে গোপনে গৃহসংলগ্ন উদ্যান মধ্যে মিলিত হইতেন| পরষ্পর পত্র লেখালেখিও চলিত| তাহাতে তাঁহাদের যেন আরও সুখবোধ হইত| মুন্সী জোহিরুদ্দীন আপনার কাজ লইয়া ব্যস্ত, ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিতেন না| তিনি মনে করিয়াছিলেন, জোহেরার সম্মুখ হইতে মজিদকে কিছুদিনের জন্য সরাইয়া ফেলিতে পারিলে, জোহেরার মন পরিবর্ত্তিত হইতে পারে; কিন্তু সেটি তাঁহার মস্ত ভ্রম| বাধাপ্রাপ্ত প্রণয় ভাদ্রের রুদ্ধ নদীর ন্যায় একান্ত খরপ্রবাহ ও কূলপ্লাবী হইয়া উঠে|
মুন্সী জোহিরুদ্দীন লোকটা বরাবরই মিতব্যয়ী| তিনি যৌবনকাল হইতে এই পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত নায়েবগিরি করিয়া নিজেও অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছেন| কলিকাতার মধ্যে পনের ষোলখানি বড় বড় ভাড়াটীয়া বাড়ী তৈয়ারী করিয়াছেন; জায়গা-জমিও কিছু কিছু করিয়াছেন; বেতন ছাড়াও এদিকেও তাঁহার মাসে অন্যূন তিনশত টাকার আয় হইয়া থাকে| সংসারে ব্যয় কিছুই ছিল না-প্রথম যৌবনে একবার বিবাহ করিয়াছিলেন, সন্তানাদি হয় নাই; তাঁহার চল্লিশ বৎসর বয়সে স্ত্রী-বিয়োগ হয়| আট-দশ বৎসর পরে আবার একটী বিবাহ করেন| দুর্ভাগ্যবশতঃ এবারকার স্ত্রীটি একান্ত অমিতব্যয়িনী ছিলেন; কিন্তু সেজন্য জোহিরুদ্দীনের বিশেষ কিছু আর্থিক ক্ষতি হয় নাই-কিছুদিন পরে সেই স্ত্রীটি হঠাৎ তাঁহার স্কন্ধ পরিত্যাগ করিয়াছেন| তাঁহারই নাম সৃজান|
২.০৮. অষ্টম পরিছেদ – উদ্যানে
মনিরুদ্দীন সৃজান বিবিকে লইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন; কিছুদিন পরে যখন জোহিরুদ্দীন ইহা জানিতে পারিলেন; তখন তাঁহার সুর একেবারে বদ্লাইয়া গেল| এ সময়ে যদি জোহেরা তাহার অভিভাবকের নিকটে মজিদকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব উপস্থিত করিতে পারিত, তিনি নিশ্চয়ই জোহেরাকে নিজের অপেক্ষা বুদ্ধিমতী জ্ঞান করিতেন-আর অন্যমত করিতে পারিতেন না|
এই বৃদ্ধ বয়সে অপমানে, ঘৃণায় মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মাথটা যেন কাটা গেল; তিনি একেবারে মুমূর্ষুর মত হইয়া পড়িলেন| তিনি আর বাটীর বাহির হইতেন না| কাহারও সহিত দেখা করিতেন না| তিনি সৃজান বিবিকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; যাহাকে একদণ্ড চোখের অন্তরাল করিতে প্রাণ চাহিত না, সে আজ অই বিশ্বাসঘাতকতা করিল! আর মনিরুদ্দীন যে তাঁহার বুকে এমনভাবে বিষমাখা বাঁকা ছুরিকা বসাইবে, তাহাও তিনি একবার স্বপ্নেও ভাবেন নাই|
জোহেরাও ইহাতে অত্যন্ত অপমান বোধ করিল| যদিও সৃজান তাহার কোন আত্মীয়া নহে; তথাপি সে তাহার অভিভাবকের বিবাহিতা পত্নী এবং সকলের এক বাটীতে বাস| পাছে কাহারও সহিত দেখা হইলে কেহ এই সকল কথা উত্থাপন করে, এই ভয়ে জোহেরাও আর বাড়ীর বাহির হইত না; এবং কাহারও সহিত দেখা করিত না| কেবল মজিদকে কয়েকবার আসিবার জন্য গোপনে পত্র লিখিয়াছিল| পত্রত্তোরে একটা-না-একটা অজুহাত দেখাইয়া মজিদ নিশ্চিত হইলেন; আসিতে পারিলেন না| জোহেরা মজিদের এরূপ ভাব বৈলক্ষণ্যের কারণ বুঝিতে না পারিয়া, অত্যন্ত চিন্তিত ও বিমর্ষ হইল| যখন জোহেরার মনের এইরূপ অবস্থা, এমন সময়ে মজিদের প্রেরিত সেই পত্র তাহার হস্তগত হইল| এ পত্রে মজিদ তাহাকে রাত্রে গোপনে তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছেন| তিনি নিজেই আজ দেখা করিতে আসিতেছেন| ইহার অর্থ কি? জোহেরা পত্র পড়িয়া আরও চিন্তিত হইল| এবং মজিদের সহিত দেখা করিবার জন্য তাহার মন নিরতিশ্রয় ব্যগ্র হইয়া উঠিল|
বাটীর পশ্চাদ্ভাগে প্রকাণ্ড উদ্যান| জোহেরা যথাসময়ে সেই উদ্যানে প্রবেশ করিল| কিছুদূর গিয়া দেখিল, পুষ্করিণীর নিকটে লতামণ্ডপ পার্শ্বে মজিদ খাঁ দাঁড়াইয়া| পরে পরষ্পর সাক্ষাৎ হইল; এবং নির্জ্জন স্থান পাইয়া নির্ভয়ে স্বাভাবিক স্বরে কথোপকথন আরম্ভ করিয়া দিলেন| তাঁহারা ঘুণাক্ষরে জানিতে পারিলেন না, বাহিরে অন্তরালে দাঁড়াইয়া দেবেন্দ্রবিজয়-প্রেরিত শ্রীশচন্দ্র নামক একটি চতুর বালক অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তাঁহাদিগের কথোপকথন শ্রবণ করিতেছে|
যখন মজিদ এখানে আসিতেছিলেন, পথে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশকে দূর হইতে তাঁহাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন| শ্রীশচন্দ্র অলক্ষ্যে মজিদের অনুসরণে বাগানের মধ্যে আসিয়া যথাস্থানে লুক্কায়িতভাবে অপেক্ষা করিতেছিল|
রাত্রি প্রহরাতীত| চন্দ্রোদয়ে চারিদিকে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে| বড় অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না; কিন্তু তাহা বিশ্বজগতের স্বপ্নময় আবরণের মত বড় মধুর! মলিন জ্যোৎস্নামণ্ডিত আকাশের স্থানে স্থানে তরল মেঘখণ্ড রহিয়াছে-ম্রিয়মাণ চন্দ্রের ম্লান কিরণে শুভ্রকায় মেঘ-সন্ততিগুলি স্নান করিতেছে| বিমলিনজ্যোৎস্নাব-গুণ্ঠনমণ্ডিতা নিসর্গসুন্দরী মৃদুহাস্যে উর্দ্ধনেত্রে সেইদিকে চাহিয়া রহিয়াছে| ঝিল্লিরবে সেই বিজন উদ্যানভূমি মুখরিত| অগণ্য-তরুলতা-ফলপুষ্পবিশোভিত উদ্যানভূমি ছায়ালোক-চিত্রিত হইয়া সুচিত্রকর-অঙ্কিত একখানি উৎকৃষ্ট চিত্রের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে| সম্মুখে স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় নীলজলপূর্ণ প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা অনেকদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে; এবং তাহার উর্ম্মি চঞ্চল বক্ষে চন্দ্রকর-লেখা খেলা করিতেছে| যে লতাবিতানে বসিয়া মজিদ ও জোহেরা কথোপকথন করিতেছিল, সেখানে পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া চন্দ্রকিরণ প্রবেশ করায় ঈষদালোক সঞ্চিত হইয়াছিল| সেই ঈষদালোকে শ্রীশ বহির হইতেও লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী দুইজনকে দেখিতে পাইতেছিল| কিরূপ ভাবে হাত-মুখ নাড়িয়া, কোন্ কথা কিরূপ ভঙ্গীতে তাঁহারা বলিতেছিল, শ্রীশ তাহাও নিবিষ্টচিত্তে লক্ষ্য করিতেছিল| ইতিপূর্ব্বে লতামণ্ডপের বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগের কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাহা শ্রীশ শুনিবার জন্য সুবিধা করিতে পারে নাই| লতামণ্ডপমধ্যে প্রবেশ করিয়া তদুভয়ে যাহা বলাবলি করিতে লাগিলেন, শ্রীশ তাহার প্রত্যেক শব্দটি যেন গলাধঃকরণ করিতে লাগিল|
লতামণ্ডপ মধ্যস্থ শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তোমার উপরেই কি লোকটার সন্দেহ হইতেছে?”
বিষণ্ণভাবে মজিদ বলিলেন, “আমার ত তাহাই বোধ হয়| দেবেন্দ্রবিজয় লোকটা বড় সহজ নহে| আমি যে কিরূপে আত্মপক্ষ-সমর্থন করিব, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না| দায়ে পড়িয়া আমাকে মুখবন্ধ করিয়া থাকিতে হইবে, দেখিতেছি|”
জো| কেন?
ম| কেন? তাহার সন্দেহভঞ্জন করিতে হইলে আমাকে সে রাত্রের সমূদয় ঘটনা প্রকাশ করিতে হইবে| কিছুতেই আমি তাহা পারিব না|
জো| কেন পারিবে না?
মজিদ কোন উত্তর করিতে পারিল না-নীরবে নতমুখে রহিলেন| তাঁহার ভাব দেখিয়া জোহেরার মুখ ম্লান হইয়া গেল-জোহেরা চিন্তিত হইল| ক্ষণপরে বলিল, “ইহার ভিতর একটা কারণ আছে-কোন বিশেষ কারণ, কেমন?”
মজিদ মুখ না তুলিয়া বলিলেন, “হাঁ, জোহেরা|”
জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “এই কারণটার ভিতরে কোন স্ত্রীলোকের অস্তিত্ব আছে কি?”
মজিদ মাথা নাড়িয়া জানাইলেন, ‘আছে’| মুখে কিছুই বলিলেন না|
জোহেরার মলিনমুখে যেন আর একখানা বিষাদের মেঘ ঘনাইয়া আসিল|
একটু পরে ঘৃণাভরে উঠিয়া কঠিন হাস্যের সহিত বলিল, “এ বড় মন্দ রহস্য নহে, মজিদ! এই খোস-খবর দিবার জন্য কি তুমি আজ আমার সঙ্গে দেখা করিতে চাহিয়াছিলে? আমি মনে জানি, তুমি আমাকে আন্তরিক ভালবাস-আমি তোমার মুখ চাহিয়া রহিয়াছি-আর তুমি-তুমি মজিদ, আমার কাছে অনায়াসে অন্য একজন স্ত্রীলোকের নাম লইয়া-”
বাধা দিয়া বিচলিতভাবে মজিদ বলিলেন, “নির্ব্বোধের ন্যায় কি বলিতেছ? আমি যে স্ত্রীলোকের কথা বলিতেছি, তাহার সহিত প্রণয়ের কোন সংশ্রব নাই| কোনবিশেষ কারণে আমি কোন বিষয়ে তাহার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছি| প্রতিজ্ঞাভঙ্গ ভিন্ন দেবেন্দ্রবিজয়ের ও তোমার সন্দেহ-ভঞ্জনের আর কোন উপায় দেখি না; কিন্তু আমি কিছুতেই তাহা পারিব না| আমার কথায় কি তোমার বিশ্বাস হয় না? সত্য কি তুমি মনে করিতেছ, আমি তোমার সহিত প্রবঞ্চনা করিতেছি? এত সহজে আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না| আমি তাহা নহি|”
জোহেরা সন্দেহপূর্ণদৃষ্টিতে ক্ষণেক মজিদের মুখপ্রতি চাহিয়া বিষণ্ণভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করিতে নাই|”
দুই হাতে জোহেরার হাত দুইখানি ধরিয়া মজিদ হাসিয়া বলিলেন, “সকলেই কি সমান? আমাকে অবিশ্বাস করিতে হয়-এখন না| যতক্ষণ না, আমি মুখ ফুটিয়া সে সকল কথা প্রকাশ করিতেছি, ততক্ষণ তুমি আমাকে অবিশ্বাসী ভাবিয়ো না| আমি একান্ত তোমারই|”
সাগ্রহে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “তাহা হইলে তুমি সে সকল কথা প্রকাশ করিতে সম্মত আছ?”
মজিদ বলিলেন, “যখন দেখিব, বিপদ্ অত্যন্ত গুরুতর-আর গোপন করিলে চলিবে না-তখন অবশ্যই আমাকে তাহা প্রকাশ করিতে হইবে; কিন্তু সহজে আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিব না-সহজে আমি বিচলিত হইব না|”
২.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বিশ্রম্ভালাপে
জোহেরা কোমল বাহুদুটি প্রসারণ করিয়া সবেগে মজিদের কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া ধরিল| মজিদ সাগ্রহে জোহেরার সুন্দর মুখখানি লইয়া তদুপরি দুইটী চুম্বনরেখা অঙ্কিত করিয়া দিলেন| জোহেরা অনেকক্ষণ বাহ্যজ্ঞানপরিশূন্যা হইয়া রহিল| এইরূপে তাঁহাদিগের বিবাদ একেবারে মিটিয়া গেল| তাহার পর উভয় প্রেমিক-প্রেমিকার প্রমালাপে কত কথাই হইল-কত প্রাণের কথা-কত মানাভিমানের কথা, কত বিরহের কথা, বালক শ্রীশচন্দ্র তাহার একটি বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না; এবং যুক্তাক্ষরসঙ্কুল বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের ন্যায় তাহা শ্রীশচন্দের নিকটে একান্ত কঠিন ও দুর্ব্বোধ্য অনুমিত হইল|
তাহার পর মজিদ খাঁ পুনরায় নিজের কাজের কথা পাড়িলেন| এখন বিপদের বজ্র তাঁহার মাথার উপর ছুটিতেছে| তিনি বুঝিয়াছিলেন, নিশ্চিন্তে প্রেমালাপের সময় ইহা নহে| বলিলেন, “জান কি জোহেরা, গত বুধবার রাত্রে সৃজান বিবি কখন কোথায় গিয়াছিল, কোথায় কি করিয়াছিল?”
জোহেরা বলিল, “কিছু কিছু খবর আমি বলিতে পারি| সেদিন রাজাব-আলির বাড়ীতে আমাদিগের নিমন্ত্রণ ছিল| সৃজান আর আমি দুইজনেই একসঙ্গে সেখানে যাই|”
ম| কখন গিয়াছিলে?
জো| রাত নয়টার পর|
ম| রাজাব-আলির বাড়ী হইতে কখন তোমরা ফিরিয়া আসিলে?
জো| সৃজান বিবির মাথা ধরায় বেশিক্ষণ সেখানে আমরা থাকিতে পারি নাই| রাত সাড়ে দশটার সময়ে আমরা সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম|
ম| বাড়ীতে ফিরিয়া সৃজান বিবি কি করিল?
জো| তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য একটি স্ত্রীলোক অপেক্ষা করিতেছিল| সৃজান বিবি তখনই তাহার সহিত দেখা করিতে গেল|
ম| (সবিস্ময়ে) স্ত্রীলোক! কে সে?
জো| তা’ আমি ঠিক জানি না| তাহাকে আমি দেখি নাই| তাহার পর সৃজান বিবির সহিত আমার আর দেখা হয় নাই| বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকটি মনিরুদ্দীনের কোন সংবাদ আনিয়া থাকিবে| রাত সাড়ে এগারটার সময়ে সে চলিয়া যায়|
ম| কিরূপে জানিলে|
জো| সাখিয়ার মুখে শুনিয়াছি|
ম| সাখিয়া কে?
জো| সৃজান বিবির বাঁদী|
ম| তাহার কাছে আর কি শুনিয়াছ? মুন্সী জোহিরুদ্দীন সাহেব তখন কোথায় ছিলেন?
জো| তখন তিনি বাড়ীতে ছিলেন না; কোন কাজে তিনি বাহিরে গিয়াছিলেন; রাত বারটার সময়ে তিনি ফিরিয়া আসেন| জানিতে পারিয়া, সৃজান বিবি অভিমানের ভাণে তখন অন্য একটা ঘরে গিয়া দ্বাররুদ্ধ করিয়া শয়ন করে| তাহার পর সে কখন উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, কেহ তাহা জানে না| বোধ হয় শেষ রাত্রিতে, সৃজান বিবি পলাইয়া গিয়াছে|
ম| কাহারও জন্য কোন পত্র রাখিয়া গিয়াছিল?
জো| তাহা আমি ঠিক জানি না| কেন মজিদ, এ সকল কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ?
ম| ফাঁসীর দড়ী থেকে নিজের গলাটা বাঁচাইবার জন্য, আর কেন? আমি বিভ্রাটে পড়িয়াছি; জোহেরা! কি করিব, কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছি না| শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহার নাম দিলজান| সে মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা| গত বুধবার সন্ধ্যার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে তাহাকে আমি একবার দেখিয়াছিলাম| সেইদিনই রাত এগারটার পর সেখানে আমার সহিত আর একটি স্ত্রীলোকের দেখা হইয়াছিল| দেবেন্দ্রবিজয়ের ধারণা, রাত্রে যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, সে স্ত্রীলোক দিলজান ভিন্ন আর কেহই নহে; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে দিলজান নহে| সেইদিন রাত বারটার সময়ে আমি মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাই| মেহেদী-বাগানেই আমাকে যাইতে হইয়াছিল; সেইখানে মোবারক উদ্দীনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়| যেখানে সাক্ষাৎ হয়, তাহার অল্পদূরেই দিলজানের লাস পাওয়া গিয়াছে| যদি এখন আমি এই হত্যাপরাধে ধৃত হই, ঘটনাচক্রে আমাকেই দোষী হইতে হইবে| রাত্রে আমার সহিত যে, দিলজানের আর দেখা হয় নাই, এ কথা আমি কিছুতেই সপ্রমাণ করিতে পারিব না-কেহই ইহা বিশ্বাস করিবে না| প্রতিজ্ঞালঙ্ঘন ভিন্ন তখন নিজের নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করিবার আর কোন উপায়ই থাকিবে না|
জো| সকলই বুঝিলাম; কিন্তু ইহাতে সৃজান বিবির কি সংশ্রব আছে, বুঝিতে পারিলাম না|
ম| না, তা’, আমি মনে করি নাই| (চিন্তিতভাবে) প্রকৃতপক্ষে তা’ আমি মনে করি নাই| তবে আমি জানিতে চাই, মনিরুদ্দীন সে রাত্রে কখন কোথায় ছিল-কি করিয়াছিল-কোথায় গিয়াছিল, এ সকল সংবাদ সংগ্রহ করা এখন আমার অত্যন্ত দরকার হইতেছে| আমি এখন ঘটনাচক্রে কিরূপ অবস্থাধীন হইয়া পড়িয়াছি, কি গুরুতর বিপদ্ চারিদিক্ হইতে আমাকে গ্রাস করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে-বুঝিতে পার নাই কি? যদি আমি এখন ধরা পড়ি, অথচ মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসে, তাহা হইলে আর আমার নিস্তার নাই|
জো| কেন?
ম| মনিরুদ্দীন ফিরিয়া না আসিলে, কিছুতেই আমি নিজেকে নির্দ্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারিব না|
জো| তুমি কি সত্যই নির্দ্দোষ?
ম| আমাকে কি সন্দেহ হয়?
জো| না|
ম| তবে আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না|
তাহার পর অন্যান্য দুই-একটি কথার পর মজিদ খাঁ বিদায় গ্রহণ করিলেন| জোহেরা দ্রুতপদে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল| এবং শ্রীশচন্দ্র অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের সহিত দেখা করিতে ছুটিল|
২.১০. দশম পরিচ্ছেদ – ঘটনা-সূত্র
শ্রীমান্ শ্রীশচন্দ্রের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর| শিক্ষকের নিকটে মেধাবী ছাত্র যেমন মুখস্থ পাঠ আবৃত্তি করিতে থাকে, ঠিক তেমনই ভাবে শ্রীশচন্দ্র, মজিদ ও জোহেরার কথোপকথনের যাহা কিছু শুনিয়াছিল, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সমুদয় ‘জলবত্তরলং’ বলিয়া গেল| অধিকন্তু তাঁহারা যেরূপভাবে হাত-মুখ নাড়িয়া কথা কহিয়াছিলেন, সুদক্ষ অভিনেতার ন্যায় শ্রীশ তাহাও দেবেন্দ্রবিজয়কে ঠিক প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করিল না| ইহাতে অনেক স্থলে শ্রোতা দেবেন্দ্রবিজয়কে অতিকষ্টে হাস্যসংবরণ করিতে হইয়াছিল|
শ্রীশের মুখে দেবেন্দ্রবিজয় যাহা শুনিলেন, তাহাতে এ পর্য্যন্ত তিনি এই হত্যাকাণ্ডের যে সকল সূত্র বাহির করিয়াছিলেন, সেই সূত্রাবলীতে আর একটি নূতন গ্রন্থির সংযোগ হইল| অনন্তবিধ চিন্তায় তাঁহার মস্তিক পূর্ণ হইয়া গেল| কিছুতেই তিনি ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না, মজিদ কেন এরূপ ব্যবহার করিতেছেন| খুনের রাত্রিতে দিলজানের সহিত যে তাঁহার দেখা হইয়াছিল; কেন তিনি ইহা কিছুতেই এখন স্বীকার করিতে চাহেন না? কারণ কি? তিনি এখন বলিতেছেন, যে স্ত্রীলোকের সহিত তাঁহার দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান নহে; ইহাতে তাঁহার কি ফলোদয় হইতেছে? কে তাঁহার কথা বিশ্বাস করিবে? যাহাতে তাঁহার প্রতি কাহারও সন্দেহ না হয়, সেইজন্য তিনি এই মিথ্যাকথা বলিয়া অনর্থক নির্দ্দোষ সপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতেছেন| রাত্রি এগারটার পর গনির মা দিলজানকে পুনরায় আসিতে দেখিয়াছে| আর গনির মা’র যদি ভুলই হয়-সে দিলজান না হইয়া যদি আর কেহই হয়-তাহা হইলে কে সে স্ত্রীলোক? মজিদের কথার ভাবে বুঝিতে পারা যাইতেছে, রাত্রিতে সেখানে এমন কোন স্ত্রীলোক আসিয়াছিল, যাহার নাম প্রকাশ করিলে সম্ভ্রমের হানি হইতে পারে| ভাবে বোধ হয়, মজিদ যেন কোন ভদ্রমহিলার সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই এইরূপ ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতেছেন| যদি তাহা সত্য হয়, সেই স্ত্রীলোক দিলজান না হইতে পারে| দিলজান ভদ্রমহিলা ছিল না, এবং হানি হইতে পারে-এমন সম্ভ্রমও তাহার কিছুই ছিল না| কে তবে সেই স্ত্রীলোক? কাহার জন্য মজিদ এমন বিব্রত হইয়া উঠিয়াছেন? মজিদ অতি অদ্ভুত প্রকৃতির লোক-এ জগতে তাঁহার দ্বিতীয় নাই দেখিতেছি| আমাকে তাঁহার অন্তরের ভিতরে ভাল করিয়া প্রবেশ করিতে হইবে; নতুবা সহজে তাঁহাকে ঠিক বুঝিতে পারিব না|
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে ঝাঁ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল| তবে কি সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাটীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদের সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সে সৃজান বিবি? হয়তো সৃজান মনিরুদ্দীনের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল, ঘটনাক্রমে মজিদের সহিত তাহার দেখা হইয়া গিয়াছিল| মজিদ হয়তো ভিতরের কথা সকলই জানিতেন| যাহাতে সৃজান বিবি এই গর্হিত সঙ্কল্প পরিত্যাগ করে, সেজন্য হয় ত তাহাকে অনেক বুঝাইয়া থাকিবেন; এবং সেই কথা লইয়াই হয়তো দুজনের বচসা হইয়া থাকিবে| অসম্ভব নয়, তাহাই ঠিক-তেমন গভীর রাত্রে ভিন্ন স্থানে গিয়া নির্জ্জনে একজন পর-পুরুষের সহিত সাক্ষাৎ করা কোন ভদ্রমহিলার পক্ষে একান্ত অবৈধ ও নিন্দনীয় সে কথা সাধারণে প্রকাশ করাও ঠিক নহে| এই সকল কারণ বশতঃ অবশ্যই মজিদ এখন কথা একেবারে চাপিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছেন| এখন তাহা প্রকাশ করিলে সৃজান বিবির সম্ভ্রম হানি না হইতে পারে; কেন না, সে নিজের মান-সম্ভ্রম একেবারে জলাঞ্জলি দিয়া মনিরুদ্দীনের সহিত উধাও হইয়া গিয়াছে; কিন্তু মজিদের চরিত্রে সকলেই দোষারোপ করিবে|
এই অনুমান সত্য হইলেও ইহার সহিত দিলজানের খুনের কি সংশ্রব আছে? কিছুই না| দিলজানকে কে খুন করিল? সৃজান বিবি কি তবে দিলজানকে খুন করিয়াছে? না, তাহা কখনই সম্ভবপর নহে|
শ্রীশের মুখে দেবেন্দ্রবিজয় যে সকল কথা শুনিয়াছিলেন, তাহাই মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন| সহসা তাঁহার চিন্তাস্রোত ভিন্ন পথে প্রবেশ করিল| তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সৃজান বিবি যে শেষ রাত্রিতে গৃহত্যাগ করিয়াছিল, মজিদ ও জোহেরার কথোপকথনে তাহার প্রমাণও পাওয়া যাইতেছে| তাহা হইলে সেদিন রাত্রে এগারটার পর যে রমণীর সহিত মজিদের দেখা হইয়াছিল,-সে কখনই সৃজান হইতে পারে না| এখন আমাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে, মনিরুদ্দীনের বাটীতে রাত্রিতে মজিদের সহিত যাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল সেই রমণীই বা কে; এবং এদিকে ঠিক সেই রাত্রে যে রমণী সৃজানের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল, সেই রমণীই বা কে| আরও সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, ঠিক কোন্ সময়ে সৃজান গৃহত্যাগ করিয়াছিল| এই সকলের প্রকৃত সন্ধান যতক্ষণ না পাইতেছি, ততক্ষণ আমাকে অন্ধকারের মধ্যেই থাকিতে হইবে| আর যদি কাল গোলাদিঘীতে গিয়া কার্য্যোদ্ধার করিতে পারি, তাহা হইলে সকল রহস্যই প্রকাশ পাইবে-আর কোন সন্ধানের আবশ্যকতা থাকিবে না| হত্যাকারী বড় সহজ নহে; তাহাকে যে সহজে ধরিতে পারিব, এমন বোধ হয় না| উপন্যাসের সর্ব্বশক্তিমান্, সর্বজ্ঞ নিরাকার গোয়েন্দাদিগের মত ক্ষমতা এবং প্রভাব মাংসাস্থিবিশিষ্ট কাহারও থাকে না-আমারও নাই| গ্রন্থকারের কল্পনায় তাহারা সকল বিষয়েই অবলীলাক্রমে কৃতকার্য্যে হইতে পারে; সকল বিষয়েই অমানুষিক প্রভাব বিস্তার করিতে পারে|
তাহাদিগের মত অনন্যসুলভ ক্ষমতা, সর্ব্বজ্ঞতা আমার মত এ শরীরী গোয়েন্দা কোথায় পাইবে? অনেকস্থলে আমার ভ্রম হইতে পারে, ভ্রমক্রমে আমি ভিন্ন পথেও চালিত হইতে পারি; এবং সকল বিষয়ে কৃতকার্য্যে না হইতেও পারি| তবে চেষ্টা করিলে এক-সময়ে-না-এক-সময়ে যে, যথাস্থানে আমি উপনীত হইতে পারিব, এ বিশ্বাস আমার নিজের মনে খুব আছে| হয় ত ইহাতে দিলজানের হত্যাকারীর কোন একটা উদ্দেশ্য আছে| যে উদ্দেশ্যই থাক্ না কেন, আমি কাল রাত্রি নয়টার পর গোলদিঘীতে গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিব-ধরিবার চেষ্টা করিব| দেখা যাক্, কাজে কতদূর কি করিতে পারি|
দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে নোটবুকখানি টানিয়া বাহির করিয়া এইরূপ মন্তব্যগুলি লিখিতে লাগিলেন;-
১| হত্যাকারী কোন্ উদ্দেশ্যে এরূপ পত্র লিখিতেছে? আমাকে যদি সে ভয়ই না করে, তবে হাজার টাকার উৎকোচ দিতে চাহে কেন?
কাল রাত নয়টার পর গোলদিঘীতে গেলে, তাহা অনেকটা বুঝিতে পারিব| যদি তাহার উদ্দেশ্যটা মন্দ হয়-বলিতে পারি না-তাহাকে ধৃত করিবার জন্য লোক মোতায়েন রাখিতে হইবে|
মন্তব্য-কাল রাত নয়টার পর গোলদিঘীতে যাইতে হইবে|
২| গত বুধবার (যে রাত্রে দিলজানের লাস মেহেদী-বাগানে পাওয়া গিয়াছিল) রাত্রি এগারটার হইতে বারটার মধ্যে কোন্ স্ত্রীলোক মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল, তাহার সন্ধান গ্রহণ|
একমাত্র মজিদের নিকটে সে সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে| গনির মা বলিতেছে, দিলজান; কিন্তু মজিদ তাহা একেবারে উড়াইয়া দিতেছেন| এখন দেখিতে হইবে, তদুভয়ের মধ্যে কে প্রকৃত মিথ্যাবাদী|
মন্তব্য-মজিদের সহিত দেখা করিয়া যে কোন কৌশলে হউক, সেই স্ত্রীলোকের নামটি বাহির করিয়া লইতে হইবে|
৩| সেই খুনের রাত্রিতে যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল, তাহার আকৃতি কিরূপ, বয়স কত, যদি সম্ভবপর হয়, নামটা জানিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে| এই খুনের মাম্লায় কোন-না-কোন বিষয়ে সেই স্ত্রীলোক জড়িত থাকিতে পারে| মুন্সী জোহিরুদ্দীনের বাটীর কোন-না-কোন ভৃত্যের নিকটে ইহার সন্ধান হইতে পারে|
মন্তব্য-ভৃত্যদিগের মধ্যে যে এ বিষয়ের কিছু জানে, এমন একজনকে হস্তগত করিতে হইবে|
৪| সেই খুনের রাত্রে ঠিক কোন্ সময়ে দিলজান গৃহত্যাগ করিয়াছিল; গৃহত্যাগ করিবার পূর্ব্বে ও পরে কখন কোথায় গিয়াছিল-কোথায় কি করিয়াছিল, তাহার গতিবিধির অনুসন্ধান করিয়া দেখা খুব প্রয়োজন|
চেষ্টা করিলে তাহাদের কোন ভৃত্যের নিকটে ইহারও কিছু-না-কিছু জানিতে পারিব|
মন্তব্য-রহস্যটা একটু পরিষ্কার হইয়া আসিলে-ঘটনা-সূত্রে ইহা আপনা হইতেই সব প্রকাশ হইয়া পড়িবে|
৫| যে বিষাক্ত ছুরিকায় দিলজান খুন হইয়াছে, সেই ছুরিখানা কোথায় গেল, তাহা খুঁজিয়া বাহির করা চাই|
সম্ভব ইহা মজিদের নিকটে পওয়া যাইবে|
মন্তব্য-গোপনে তাহার শয়ন-গৃহ অনুসন্ধান করিতে হইবে| নিজের দ্বারা বিশেষ সুবিধা হইবে না; অপর কাহারও দ্বারা-শ্রীশ আছে|
৬| দিলজানের পূর্ব্বজীবনী সংগ্রহ করিতে হইবে|
লতিমন বাইজীর নিকটে কিছু কিছু সংগ্রহ হইতে পারে| দিলজান অনেক দিন তাহার নিকটে ছিল; অবশ্যই দিলজানের কিছু কিছু খবর লতিমন জানে|
মন্তব্য-লতিমন বাইজীর সঙ্গে আর একবার দেখা করিতে হইবে|
২.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদে
পরদিন রাত্রি নয়টার সময় দেবেন্দ্রবিজয় গোলদিঘীতে উপস্থিত হইলেন| ইতিপূর্ব্বে তিনি স্থানীয় থানা হইতে কয়েকজন অনুচর ঠিক করিয়া লইয়াছিলেন| তাহাদিগকে স্থানে স্থানে লুকাইয়া রাখিলেন; এবং নিজে গোলদিঘীর ভিতরে গিয়া হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া আসিল| দেবেন্দ্রবিজয় কোথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না-হত্যাকারী আসিল না| সম্মুখবর্ত্তী পথ দিয়া পথিকগণ যে যাহার গন্তব্যস্থানে যাইতেছে; কত লোক যাইতেছে-আসিতেছে-কাহাকেও তাঁহার প্রতি লক্ষ্য করিতে দেখিলেন না-সকলেই আপন মনে ফিরিতেছে|
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে| অষ্টমীর অর্দ্ধচন্দ্রের কিরণ তেমন উজ্জ্বল নহে-কেবল যেন একটু অন্ধকার-মাখা হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে| তুলারাশিবৎ লঘু মেঘখণ্ডগুলি আকাশতলে দুষ্ট বালকের মত উদ্দামভাবে ছুটাছুটি করিতেছে| চন্দ্রদেব মৃদুহাস্যে সেই অশিষ্ট মেঘশিশুদিগের সেই ক্রীড়া দেখিতেছেলন; কখনও বা কহাকেও আপনার বুকের উপরে টানিয়া লইতেছিলেন| অন্যত্র অদূরস্থিত অশ্বত্থশাখাসীন কলকণ্ঠ পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর স্বরতরঙ্গ আকাশ ভেদ করিয়া উঠিতেছিল এবং দক্ষিণ দিক্ হইতে বৃক্ষশাখা কাঁপাইয়া, পথের ধূলিরাশি উড়াইয়া হু হু শব্দে বাতাস বহিয়া আসিতেছিল| স্থান ও কাল উভয়ই সুন্দর| দেবেন্দ্রবিজয়ের সেদিকে লক্ষ ছিল না-তিনি হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতেছিলেন| এবং চারিদিকে তাঁহার সতর্কদৃষ্টি ঘন ঘন সঞ্চালিত হইতেছিল|
চন্দ্র অস্ত গেল| ক্রমে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর উর্ত্তীণ হইল-তথাপি কেহই আসিল না|
দেবেন্দ্রবিজয় হতাশ হইলেন; নিজের অনুচরবর্গকে বিদায় করিয়া দিলেন| এবং নিজে শীঘ্র বাড়ী পৌঁছিবার জন্য একটা গলিপথে প্রবেশ করিলেন| পথ একান্ত নির্জ্জন| চারিদিকে গভীর অন্ধকার-গলিপথে অন্ধকার গভীরতর; গগনস্পর্শী বৃক্ষগুলির নিম্নে অন্ধকার আরও গভীর হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে| সেই গভীর অন্ধকারবেষ্টিত সমুন্নশীর্ষ বৃক্ষসমূহের চতুষ্পার্শ্বে অসংখ্য খদ্যোৎ,হীরকখণ্ডবৎ জ্বলিতেছে-নিবিতেছে-নিবিয়া আবার জ্বলিতেছে| কেহ কোথায় নাই-কেবল অদূরে কতকগুলা শৃগাল ও কুকুর দল-বাঁধিয়া চীৎকার করিয়া ছুটাছুটি করিতেছে| দেবেন্দ্রবিজয় ক্রমশঃ অগ্রসর হইয়া চলিলেন| সহসা একটা পেচক কর্কশকণ্ঠে হাঁকিয়া তাঁহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল| দেবেন্দ্রবিজয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না, পূর্ব্ববৎ দ্রুতবেগে চলিতে লাগিলেন|
এমন সময়ে কে তাঁহাকে পশ্চাদ্দিক হইতে বলিল, “আমার সঙ্গে চালাকি-এইবার মজাটা দেখ!” দেবেন্দ্রবিজয় যেমন পশ্চাতে ফিরিয়াছেন, দেখিলেন একটা পাহারাওয়ালা উদ্যত সুদীর্ঘ বংশযষ্টিহস্তে দাঁড়াইয়া| দেবেন্দ্রবিজয় আত্মরক্ষারও সময় পাইলেন না-সেই উদ্যত যষ্টি সবেগে তাঁহার মস্তকের উপরে আসিয়া পড়িল|
তিনি একান্ত নিঃসহায়ভাবে সেইখানে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন|
২.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সংজ্ঞালাভে
দেবেন্দ্রবিজয়ের যখন জ্ঞান হইল, তখন রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে| তিনি হস্তপদাদি-বিক্ষেপপূর্ব্বক চক্ষুরন্মীলন করিবামাত্র দুইটা শৃগাল তাঁহার মুখের নিকট হইতে সভয়ে দূরে পলাইয়া গেল| দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন| দারুণ আঘাতে তাঁহার মস্তকের একস্থানে কাটিয়া গিয়াছিল;এবং রক্তে তাঁহাদের পরিধেয় বস্ত্রাদি ভিজিয়া গিয়াছিল|
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সারারাত তিনি অজ্ঞান অবস্থায় একান্ত নিঃসহায়ভাবে একা পথিমধ্যে পড়িয়া আছেন| সুযোগ বুঝিয়া শৃগাল কুক্কুর দন্তনখরসংযোগে যে এখনও তাঁহার দেহের মাংস কাটিয়া খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া দেয় নাই, সেজন্য তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করিলেন, এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন|
এদিকে রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে| ঊষার রক্তরাগ তখনও পূর্ব্বাকাশে অনুরঞ্জিত করে নাই| পাখীরা জাগিয়া, কুলায়ে বসিয়া কূজন আরম্ভ করিয়াছে| এবং ঊষার স্নিগ্ধবাতাস বহিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের ললাট স্পর্শ করিতেছে| তখনও দেবেন্দ্রবিজয়ের মাথা ঘুরিতেছে-শরীর একান্ত দুর্ব্বল| তাঁহার মনে পড়িল, তিনি মূর্চ্ছিত হইবার পূর্ব্বমুহূর্ত্তে একজন পাহারাওয়ালাকে উদ্যত বংশযষ্টি হস্তে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন| তাহারই উদ্যত বংশদণ্ড মস্তকে নিপতিত হওয়ায় তাঁহার যে এই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে, তাহা নিশ্চিত; কিন্তু একজন পাহারাওয়ালা যে কেন তাঁহার প্রতি এমন সদ্ব্যবহার(?) করিল, ইহার মর্ম্মগ্রহণ তাঁহার অত্যন্ত কঠিন বোধ হইল| একবার ভাবিলেন, অর্থলোভে সামান্য বেতনভোগী পাহারাওয়ালাদিগের মধ্যে কেহ কেহ এরূপে অর্থসঞ্চয় করিতে পারে| দেবেন্দ্রবিজয় জামার পকেটে হাত দিলেন| তাঁহার যে কয়েকটি টাকা সঙ্গে ছিল, তাহা যথাস্থানেই রহিয়াছে; অঙ্গুলির দিকে দৃষ্টি করিলেন, হীরার আংটীটাও যথাস্থানে রহিয়াছে; এ পর্য্যন্ত কেহ তাহা খুলিয়া লয় নাই| বুক-পকেটে দুইখানি দশ টাকার নোট ছিল. দেবেন্দ্রবিজয় তাহাও টানিয়া বাহির করিয়া দেখিলেন| সেই নোট দুখানির সঙ্গে আর একখানি কাগজ দেখিতে পাইলেন; রাত্রিশেষের অস্পষ্টালোকে তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সেখানি কি কাগজ! পকেট হইতে দিয়াশলাই-কাঠি বাহির করিয়া জ্বালিয়া দেখিলেন, একখানি পত্র| পত্রখানি খুব দ্রুতহস্তে উড্পেন্সিলে লেখা|
দেবেন্দ্রবিজয় দিয়াশলাই-কাঠি জ্বালিয়া জ্বালিয়া পত্রখানি পড়িয়া শেষ করিতে লাগিলেন;-
“দেবেন্দ্রবিজয়!
আজ তোমাকে একটু শিক্ষা দিলাম| যদি ইহাতেও তোমার আক্কেল না হয়, আবার একদিন আমার হাতে এমন শিক্ষা পাইবে, যাহা তুমি সারাজীবন ভুলিতে পারিবে না|
তুমি এখন অজ্ঞান হইয়া আমার পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িয়াছ| মনে করিলে আমি এখনই তোমার লীলাখেলা একেবারে শেষ করিয়া দিতে পারি; তোমার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া কুক্কুর শৃগালের ভোজনেরও সুবন্দোবস্ত করিতে পারি| অনুগ্রহ করিয়া তাহা করিলাম না, এরূপ মনে করিও না-তোমার মত একটা নির্ব্বোধ গোয়েন্দাকে খুন করিয়া আমার মত ব্যক্তির লাভ কি?
তুমি মনে করিয়াছিলে, সহজেই আমার হাতে হাতকড়ি লাগাইবে| কি স্পর্দ্ধা তোমার ! আমাকে তেমন নিরীহ ভালমানুষটি পাও নাই| তুমি বেড়াও ডালে ডালে, আমি বেড়াই পাতায় পাতায়-আমি তোমাকে আমার যোগ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী বোধ করি না, তোমাকে আমি ক্ষুদ্র-কীটাণুকীট মনে করি| যখনই আমি মনে করিব, তখনই তোমাকে পদদলিত করিয়া মারিতে পারিব; কিন্তু সে ইচ্ছা আমার আদৌ নাই| তাহা না হইলে তোমার নাম এতদিন কোন্কালে এ জগতের জীবিত-মনুষ্যের তালিকা হইতে একেবারে মুছিয়া যাইত| তবে তুমি একান্তই বাড়াবাড়ি করিয়া তুলিয়াছিলে বলিয়া, তোমার মত রাস্কেলকে কিছু শিক্ষা দেওয়া গেল|
আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, আমার সহিত তুমি কিছুতেই পারিয়া উঠিবে না| তুমি আমাকে ধরিবার জন্য যে ফাঁদ পাতিয়াছিলে, তাহা আমি পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছিলাম| আমার সঙ্গে “পাল্লা” দেওয়া তোমার মত অর্ব্বাচীনের কর্ম্ম নহে| তোমার মত নিরেট বোকা এ দুনিয়ায় দু’টী নাই| আমি ইচ্ছা করিয়া তোমার সম্মুখে গেলাম, তোমার সহিত কথা কহিলাম, তুমি আমাকে গোয়েন্দার চিহ্ণ দেখাইয়া তোমার সাহায্য করিবার লম্বা হুকুম জারী করিলে; কই, তুমি আমাকে ধরিতে পারিলে কি? আমি জানি, তোমার মত অকর্ম্মা নির্ব্বোধকে ভয় করিবার কোন কারণই নায়| তোমার দ্বারা আমার কোন অনিষ্ট হইতে পারে, যদি এরূপ আশঙ্কা কিছু থাকিত, তাহা হইলে আজই তোমার দেহ হইতে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িত| সাবধান, আর কখনও আমার কছে গোয়েন্দাগিরি ফলাইতে চেষ্টা করিয়ো না| এইবার যদি তুমি আমার কথা না শোন, তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবে, তোমার আয়ুটা একান্ত সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিয়াছে| সাবধান-সাবধান-সাবধান!
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী |”
“পুঃ-তুমি মজিদ খাঁকে অন্যায় সন্দেহ করিতেছ; তিনি একজন নিরীহ ভদ্রলোক| তোমার এ খুনী মোকদ্দমার সহিত তাঁহার কোন সংশ্রব নাই| এতকাল গোয়েন্দাগিরি করিতেছ, আর ভালমন্দ লোক দেখিয়া চিনিতে পার না?”
পত্রপাঠে দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন| ভাবিতে লাগিলেন লোকটা খুব বাহাদুর বটে, আমাকে আজ খুব ঠকাইয়া গিয়াছে; পাহারাওয়ালার ছদ্মবেশে আমার অনুচর সাজিয়া আমার সহিত কথা কহিয়া গেল, আমার সমুদয় গুপ্ত অভিসন্ধি জানিয়া গেল-কি আশ্চর্য্য! আমি তাহাকে তিলমাত্র সন্দেহ করিতে পারিলাম না| এই মহাত্মা যদি পুলিস লাইনে কাজ করিতেন, বোধ করি, খুব একজন পাকা নামজাদা উচ্চ শ্রেণীর গোয়েন্দা হইতে পারিতেন; লোকটার অতুল বুদ্ধি দেখিতেছি| এখন লোকটাকে দেখিবার জন্য আমাকে প্রাণপণ করিতে হইবে| মজিদ কি এই পত্র লিখিয়াছে? অসম্ভব নয়-শেষের কয়েকটি পংক্তি পড়িয়া যেন তাহাই মনে হয়| মজিদ যে নির্দ্দোষ, নিরীহ ভদ্রলোক, হত্যাকারী কোন্ উদ্দেশ্যে ইহা লিখিবে? যাহাতে তাহার উপর আমার আর সন্দেহ না থাকে, সেজন্য সে এরূপ লিখিতে পারে| ইহাও একটা মন্দ চতুরতা নহে! দেখা যাক্ এই হত্যাকাণ্ডের সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য আমাকে পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্তে ছুটিতে হয়-এমন কি যমালয়ের দ্বার পর্য্যন্তও অগ্রসর হইতে হয়-আহাও আমি করিব| সে আমার হাত হইতে সহজে পরিত্রাণ পাইবে না-আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়! যেরূপ হউক, ইহার প্রতোশোধ গ্রহণ করিবই| যে কাজ দশ দিনে শেষ হইবার, এখন তাহা আমাকে দুই দিনে শেষ করিয়া ফেলিতে হইবে| দুই দিনের মধ্যে সেই নারীঘাতক পিশাচকে সমুচিত শিক্ষা দিতে হইবে|
উৎসাহের সহিত দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন; দেখিলেন, প্রভাতোদয় হইয়াছে| নবীন সূর্য্যের কিরণলেখা আকাশের গায়ে অনেক দূর পর্য্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছে| উচ্চবৃক্ষশীর্ষসমূহ হিরণ্য কররঞ্জিত| বৃক্ষশাখায় বসিয়া পাখীরা মধুর কাকলী বর্ষণ করিতেছে| বিরাট বিশ্ব যেন চারিদিক্ হইতে অশান্ত জনকোলহলে একেবারে জাগিয়া উঠিয়াছে| দেবেন্দ্রবিজয় গলির ভিতর হইতে অতি কষ্টে বাহির হইয়া বাটীতে ফিরিবার জন্য একখানি গাড়ীভাড়া করিলেন এবং তন্মধ্যে উঠিয়া বসিলেন| ঠিক সময়ে দূরবর্ত্তী ডোমপাড়া হইতে বাউলের সুরে কে গায়িয়া উঠিল;-
“সামাল মাঝি এই পারাবারে|
(ভারি বান্ ডেকেছে সাগরে)
(এবার) তোমার দফা হলো রফা, প’ড়ে গেলে ফাঁপরে”|
৩.০১ – প্রথম পরিচ্ছেদ – আর এক উদ্যম
তৃতীয় খণ্ড
নিয়তি – রহস্যময়ী