“মেহেদী-বাগানের হত্যাকাণ্ডের ন্যায় অদ্ভুত হ্ত্যাকাণ্ড আর কখনও ঘটে নাই| রাত তিনটার সময়ে মোবারক-উদ্দীন, বিখ্যাত ধনী রাজাব-আলির বাটী হইতে মেহেদী-বাগানের ভিতর দিয়া নিজের বাসায় ফিরিতেছিলেন| তিনি সেইখানকার একটা নির্জ্জন গলিপথে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ দেখিতে পান| এবং তখনই তিনি নিকটবর্ত্তী ঘাটির পাহারাওয়ালাদিগকে ডাকিয়া সেই মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠাইবার বন্দোবস্ত করেন| হাঁসপাতালে সেই লাস্ পরীক্ষা করা হইয়াছে| রমণীর প্রতি যে কোনরূপ বলপ্রয়োগ করা হইয়াছে, এরূপ কোন চিহ্ণ দেখিতে পাওয়া যায় নাই| গলদেশের একপার্শ্বে সামান্য একটু ক্ষত্চিহ্ণ, তাহাতে মৃত্যু ঘটিতে পারে না| দেখিয়া বোধ হয়, হত্যাকারী রমণীর কণ্ঠভূষা জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়াছে ! তাহা ছাড়া কোনপ্রকার সাঙ্ঘাতিক আঘাতের চিহ্ণ নাই|
“কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় স্থির হইয়াছে, রক্ত বিষাক্ত হওয়ায় রমণীর মৃত্যু হইয়াছে| রমণীর দেহ বিবর্ণ, স্থানে স্থানে ফুলিয়া উঠিয়াছে, জিহ্বাও বক্রভাবে মুখের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছে – মুখমণ্ডল কালিমাঙ্কিত – এ সকলে বিষ প্রয়োগেরই লক্ষণ| রমণীর গলদেশে যে সামান্য একটু ক্ষতচিহ্ণ দেখিতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা বিষাক্ত ছুরি বা অন্য কোন অস্ত্র-প্রয়োগেরই চিহ্ণ|
“স্থানীয় থানার ইন্স্পেক্টর রমণীর আকৃতি ও বেশভূষা বর্ণনা করিয়া এই হত্যাকাহিনীর একখানি বিজ্ঞাপন শহরের সর্ব্ব্ত্র প্রচার করিয়া দিয়াছেন| সকল রাজপথের গৃহ-প্রাচীরে সেই বিজ্ঞাপন সংলগ্ন করিয়া দেওয়া হইয়াছে; তথাপি এখনও মৃতার কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই|
“সুযোগ্য ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের উপরে এই মোকদ্দমার তদন্তের ভার পড়িয়াছে; সুতরাং আশা করা যায়, প্রকৃত হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িবে; এবং সেই মৃতা স্ত্রীলোকটি যে কে, তাহাও জানিতে পারা যাইবে| দুর্ভেদ্য রহস্যের ভিতর হইতে হত্যাকারীকে চিনিয়া বাহির করিবার তাঁহার কত বড় ক্ষমতা, তাহা আমরা সবিশেষে অবগত আছি| তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইতে এ পর্য্যন্ত আমরা কখনও কোন অপরাধীকে নিষ্কৃতিলাভ করিতে দেখি নাই|”
» ১.০৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দেবেন্দ্রবিজয়
যখনকার কথা লিপিবদ্ধ করিতেছি, তখন সুদক্ষ ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নাম-ডাক খুব | সর্ব্বাপেক্ষা তাঁহারই প্রাধান্য | যে সকল বড় বড় কেসে অপরের নিকটে কোন সুফলের আশা করা যায় না, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতেই আসে; সুতরাং মেহেদী-বাগানের সেই অত্যাশ্চর্য্য নারী-হ্ত্যার কেস্টা তাঁহারই হাতে পড়িল |
কেস্টা হাতে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমে একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন | কিরূপে হত্যাকারীর সন্ধান হইবে এবং কিরূপে সেই অপরিচিতার মৃত্দেহ সনাক্ত করিবেন, এমন কোন সূত্র পাইলেন না | মৃতাকে দেখিয়া বোধ হয় না, সে বারাঙ্গনা কিম্বা কোন ইতর-বংশীয়া | রাত্রি-জাগরণ, অতিরিক্ত মদ্যপান ও অপরিমিত ইন্দ্রিয়-পরিচালনায় বেশ্যাদিগের চোখে-মুখে যে একটা কালিমা পড়ে, তাহা তাহার মুখে আদৌ নাই – মৃতার মুখ কেবল মৃত্যুবিবর্ণীকৃত | মুখ দেখিয়া সহজে বুঝিতে পারা যায়, সে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্গতা হইবে; কিন্তু এরূপ নির্জ্জন পথিমধ্যে, গভীর রাত্রে কোন্ সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের কন্যা কাহার দ্বারা খুন হইল ? দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, ভদ্রকন্যা হইলেও এই রমণী চরিত্রহীনা; নতুবা সদভিপ্রায়ে কোন্ ভদ্রমহিলা অরক্ষিত অবস্থায় গভীর রাত্রে গৃহের বাহির হইয়া থাকে ? এরূপ স্থলে কে ইহাকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া সম্ভব হয় ? যাহার জন্য এই সুন্দরী গভীর রাত্রে গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল, সেই ব্যক্তি কি ইহাকে হত্যা করিয়াছে ? এমন কোন কারণ থাকিতে পারে, যাহাতে ইহাও অসম্ভব নহে | হয়ত কোন কারণ বশতঃ সেই ব্যক্তি ইহাকে খুন করিয়া থাকিবে; অথবা এই রমণীর স্বামী, স্ত্রীর চরিত্রহীনতার কথা কোন রকমে জানিতে পারিয়া থাকিবে; তাহার পর সংগোপনে স্ত্রীর অনুসরণে আসিয়া সকলেই স্বচক্ষে দেখিয়াছিল, এবং পাপিষ্ঠার পাপের এইরূপ প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিয়াছে; অথবা এমনও হইতে পারে, এই রমণী যাহার জন্য গোপনে রাত্রে গৃহত্যাগ করিত, তাহার আর কোন প্রণয়পাত্রী কিম্বা প্রণয়াকাঙিক্ষণীর দ্বারা খুন হইয়াছে; কিন্তু পথিমধ্যে এরূপ একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা করা অল্প সাহসের পরিচয় নহে | স্ত্রীলোক সহসা কি এতটা সাহস করিতে পারে ? দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না | বুঝিতে পারিলেন – যতক্ষণ না মৃতকে সনাক্ত করিতে পারা যায়, ততক্ষণ এইরূপ গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যেই তাঁহাকে থাকিতে হইবে | প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া ঠিক করতে হইবে , যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে , – সে কে – কোথায় থাকিত , এবং তাহার চরিত্র কিরূপ ছিল ; এইগুলি যদি প্রথমে সন্ধান করিয়া ঠিক করিতে পারা যায় , তাহা হইলে তখন হত্যার কারণ এবং হত্যাকারীকে ঠিক করিতে বিশেষ শ্রমস্বীকারের আবশ্যকতা হইবে না |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, এমন কোন সূত্র নাই, যাহা অবলম্বন করিয়া তিনি প্রথমতঃ সেই মৃতাকে সনাক্ত করিতে পারেন | পরিহিত বস্ত্রাদিতে যে রজকের চিহ্ণ থাকে, তাহার দ্বারাও অনেক সময় অনেক কাজ হয়, তাহা থাকিলে দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমতঃ কাজে হস্তক্ষেপ করিবার একটা সুবিধা পাইতেন; কিন্তু মৃতার পরিহিত কপড়, জামা, ওড়না প্রভৃতি সকলেই সিল্কের | তাহাতে রজকের কোন চিহ্ণ ছিল না, সুতরাং সে সুবিধাও দেবেন্দ্রবিজয়ের অদৃষ্টে ঘটিল না |
স্থানীয় থানায় মৃতার পরিহিত বস্ত্রাদি রক্ষিত হইয়াছিল | দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন তন্মধ্যে ওড়্নাখানি তাঁহার কিছু উপকারে আসিতে পারে | সেইখানির চতুষ্প্রান্তে রেশমের ফুল-লতার সূক্ষ কারুকার্য্য ছিল | রেশমী বস্ত্রের উপরে রেশমের এইরূপ সুন্দর সূচী-কার্য্যে করিমের মা খুব নিপুণা | ইহাতে বৃদ্ধা করিমের মা সুনামের সহিত যথেষ্ট অর্থোপার্জ্জনও করিয়াছে | অনেকেই তাহাকে জানে, এবং দেবেন্দ্রবিজয়েরও সহিত তাহার পরিচয় আছে | বৃদ্ধা এখন বয়োদোষে নিজের হাতে কাজ করিতে না পারিলেও, তাহার কন্যাকে এই শিল্পকার্য্যে এমন সুশিক্ষিতা ও সুনিপুণা করিয়া তুলিয়াছে যে, সেই কন্যা হইতে তাহার সুনাম সম্পূর্ণরূপে অব্যাহত আছে | করিমের পিতা একজন নামজাদা চিকন্দার জরদ্-দর্জ্জি ছিল; কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে নিজের অর্থাগমের বড় কিছু সুবিধা করিতে পারে নাই | মৃত্যুপূর্ব্বে সে স্ত্রীর জন্য অর্থাদি তেমন কিছু রাখিয়া যাইতে পারে নাই; কিন্তু সে স্ত্রীকে যে বহুবিধ সূচি-শিল্প শিক্ষা দিয়াছিল, তাহাতেই স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যুর পরে অর্থাভাবে কিছুমাত্র কষ্ট পাইতে হয় নাই | এক্ষণে বৃদ্ধা করিনের মার দুই-তিনখানা ভাড়াটিয়া বাড়ী, হাতে নগদ টাকাও আট-দশ হাজার | করিমের মা সেই টাকায় গহনা, বাড়ী জমি ইত্যাদি বন্ধক রাখিয়া সুদে খাটাইতেছে – সকল রকমে এখন তাহার মাসিক আড়াই শত টাকা আয় ; কিন্তু বুড়ী নিজে বড় কৃপণ; এত টাকার আয় – তথাপি বুড়ী বালিগঞ্জের নিকটে পেয়ারা-বাগানে একখানা একতলা বাড়ীতে থাকে | বাড়ীতে একটি মাত্র ঘর, সেই এক ঘরেই মা ও মেয়ে থাকে | ঘরখানির সম্মুখে অনেকটা খালি জমি রাংচিতা গাছের বেড়াতে ঘেরা | সেখানে সময়ে সময়ে লাউ, কুম্ড়া, শশা, বেগুন, পটল প্রভৃতি অনেক রকমের গাছ দেখিতে পাওয়া যায় | ইহাতে করিমের মার একটা আয় আছে, বৃদ্ধা সেই সকল লাউ, কুম্ড়া, শশা, বেগুন এক আনা রকম নিজের জন্য রাখে, বাকী পনের আনা বিক্রয় করিয়া ফেলে |
দেবেন্দ্রবিজয় সেই রেশমের ফুল-লতার কাজ করা ওড়্নাখানি একখানি কাগজে জড়াইয়া লইয়া একবারে করিমের মার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন |
করিমের মা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া বলিল, ” এই যে গো, তুমি নিজেই এসে হাজির হয়েছ ! আমি এখনই তোমার কাছে যাব, মনে করছিলাম |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কেন, ব্যাপার কি ? ”
করিমের মা বলিল, “মুন্সী জোহিরুদ্দীনের স্ত্রী সৃজান বিবিকে এক রাশ টাকা ধার দিয়ে ব’সে আছি; এখন শুন্ছি, মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে কোথায় স’রে গেছে – কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না | আমার টাকাগুলোর যে কি কিনারা হবে, ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুধু হাতে টাকা ধার দিয়েছিলে না কি ?”
“শুধু হাতে টাকা !” বৃদ্ধা চক্ষুর্দ্বয় ললাটে তুলিল | তাহার পর হাসিতে হাসিতে বলিল, ” আমাকে কি তেম্নি ন্যাকাহাবা পেয়েছ ? একছড়া জড়োয়া কণ্ঠহার বাঁধা রেখে টাকা দিয়েছি | তা’ কণ্ঠহার ছড়াটা মুন্সী সাহেবরই হবে – খুব দামী | সেই কণ্ঠহার নিয়ে একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে হয় না ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তবে আর ভাবনা কি ? এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেই ত সকল গোল মিটে যায় |”
করিমের মা বলিল, ” দিন-কতক সবুর ক’রে দেখি; ইহার মধ্যে সৃজার বিবির যদি কোন খবর পাই, তা’ হলে আর আমার এ সব গোলযোগে দরকার নাই | যার জিনিষ সে নিজে এসেই খালাস ক’রে নিয়ে যাবে | আমার বোধ হয়, সৃজান বিবি ফারখৎ দিয়ে মনিরুদ্দীনকে নিকে করবে; তখন সে এই কণ্ঠহার খালাসের জন্য আমার কাছে আবার আস্তে পারে | কবে আস্বে, কোথায় গেছে কতদিন পরে খবর পাব, কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না – বড়ই মুস্কিল হ’ল আমার দেখ্ছি |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” যখন কণ্ঠহার তোমার লোহার সিন্দুকে আছে, তখন এ মুস্কিল একদিন-না-একদিন আসান্ হয়ে যাবে-তার জন্য এত ভাবনা কেন ? এখন সে কথা থাক, আমি একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমার কাছে এসেছি | দেখ দেখি, এই রেশমের কাজ তোমার হাতের কি না ?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কাগজের মোড়া খুলিয়া সেই ওড়্নাখানি করিমের মার হাতে দিলেন |
১.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মা ও মেয়ে
ওড়নাখানি খুলিয়া দেখিয়া করিমের মা বলিল, ” এ ওড়্না আমাদেরই তৈয়ারী; এ রকম ফুল-লতা-মোড়ের কাজ আর কোথাও হয় না| গোয়েন্দা বাবুর বৌ-এর জন্য এ রকম একখানি ওড়্না চাই না কি? তা’ ইহার অপেক্ষাও যাতে ভাল হয়, তা’ আমি ক’রে দিব| বৌ-এর হুকুমে বুঝি আজ তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না, সে রকম হুকুম আপাততঃ আমার উপরে পড়েনি; পড়্লেই তামিল করবার জন্য এখানে ছুটে আসতে হবে, সেজন্য বিশেষ চিন্তা নাই|”
করিমের মা বলিল, “তবে এ ওড়্না সঙ্গে কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” কে তোমাকে এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, বলিতে পার?”
করিমর মা হাসিয়া বলিল, ” কেন-তাকে আবার কেন? পাছে তোমার কাছে বেশি নিই, তাই কত খরচ পড়েছে, সেটা আগে তার কাছে খবর নিয়ে আস্বে -মনে করেছ? তাতে দরকার নাই, খুব কম খরচে ক’রে দিব, সে তোমার গায়েই লাগ্বে না| কি মুস্কিল ! তোমার কছে কি আমি বেশে নিতে যাব !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না করিমের মা, তুমি যা’ মনে করেছ, সেটা ঠিক নয়| কার জন্য এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করেছিলে বল দেখি; কাজ আছে-বিশেষ দরকার|”
করিমের মা ওড়্নাখানি ভাঁজ করিতে করিতে বলিল, ” তাকি আর এখনও মনে আছে ! কত লোকের কত রকম ওড়্না ক’রে দিচ্ছি-সে কি আর মনে রাখা যায় ! এ বয়সে সব কথা আর মনে থাকে কি? দেখি, আমার মেয়ের যদি মনে থাকে-সে নিজের হাতেই এই ওড়্নায় রেশমের ফুল তুলেছে|”
এই বলিয়া করিমের মা মেয়েকে ডাকিল| মেয়ে ঘরের ভিতরে জানালার ধারে বসিয়া শিল্পকার্য্যে মনোনিবেশ করিয়াছিল; তখন উঠিয়া আসিল| মেয়ে সেই ওড়্না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিল, এবং সে নিজের হাতে সেই ফুল তুলিয়াছে, বলিল|
মেয়ের বয়স ত্রিশ বৎসরের কম নহে| তাহারও মহিমের মা কি জালিমের মা-এই রকমেরই একটা কিছু নাম হইবে| তাহার নামে আমাদিগের বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই| করিমের মা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই ওড়্নাখানি কে তৈয়ারী করতে দিয়েছিল, মনে আছে কি?”
মেয়ে বলিল, ” সে আজকের কথা কি? প্রায় সাত-আট মাস হ’ল, একজন বাইজী এই ওড়্নাখানি তৈয়ারী করতে দিয়েছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলের, ” কে সেই বাইজী, নাম কি?”
“লতিমন বাইজী|”
‘কোথায় থাকে?”
” বামুন-বস্তিতে| সেখানে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে আপনি সবই জানতে পারবেন| আমার ঠিক মনে পড়্ছে এ নিশ্চয় সেই লতিমন বাইজীর ওড়্না|”
“আর তার দেখা পাওয়া যাবে না; সে আর নাই|”
“নাই কি ! কোথায় গেল?”
“যেখানে সকলে যায়-সকলকে যেতে হবে| লতিমন মরিয়াছে|”
“সে কি ! কবে-কি হইয়াছিল?” বলিয়া করিমের মা চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল|
দেবেন্দ্রবিজয় সেই ওড়্খানি পুনরায় নিজের হাতে লইয়া কহিলেন, ” এই ওড়্না যদি লতিমনেরই হয়, তা’ হলে লতিমন আর এ জগতে নাই| তার মৃত্যু হয়েছে|”
“কি সর্ব্বনাশ|” বলিয়া করিমের মা আবার বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলিপথে লতিমনকে কে খুন ক’রে গেছে|”
“কি সর্ব্বনাশ গো ! কে খুন করিল?”বলিয়া করিমের মা বিস্ময়স্থিরনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল|
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” যে খুন করেছে, সে এখনও ধরা পড়ে নাই| যাতে শীঘ্র সন্ধান ক’রে ধরতে পারি, সেইজন্য যে খুন হয়েছে, তার নাম জান্বার চেষ্টায় এখানে এসেছি; আমার সে চেষ্টাও প্রায় সফল হয়েছে, এখন আর একটু চেষ্টা করলেই খুনীকে ধরতে পারব|”
করিমের মা বলিল, “লতিমন বাই যে খুন হয়েছে-তার এখন ঠিক কি? লতিমন এই ওড়্না যদি আর কাকে দিয়ে থাকে-কি আর কারও জন্যে আমাদের এখানে তৈয়ারী করিয়ে থাকে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন আমাকে সেটা সন্ধান ক’রে ঠিক করতে হবে| যখন একটা নাম পাওয়া গেছে, তখন সহজেই সব কাজই শেষ করতে পারব| এখন চল্লেম, দরকার হয় আবার দেখা করব|” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন|
১.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – লতিমন
দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর সন্ধানে বামুন-বস্তিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন | লতিমনের প্রকাণ্ড দ্বিতল বাটী, বামুন-বস্তির আবালবৃদ্ধবনিতার পরিচিত | লতিমনও তদ্রূপ | তাহার জন্য দেবেন্দ্রবিজয়কে বিশেষ কষ্ট-স্বীকার করিতে হইল না; পাড়া প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে তিনি অল্পায়াসে লতিমন বাইজীর সম্বন্ধে অনেকখানি সংবাদ গ্রহণ করিয়া ফেলিলেন | লতিমন সর্ব্বদা বাটীর বাহির হয় না-কখন কখন দেশে-বিদেশে মজ্রো কর্তে যায়-সুতরাং লতিমন এখন বাড়ীতে আছে, কি বিদেশে গাওনা করিতে গিয়াছে, এই সম্বন্ধে কেহ কোন সন্তোষজনক উত্তর করিতে পারিল না | দেবেন্দ্রবিজয় আরও একটা সংবাদ পাইলেন, মনিরুদ্দীনেরও সেখানে যাতায়াত আছে | লতিমনের বাড়ীতে দিলজান নামে আর একটি ষোড়শী সুন্দরী বাস করে; মনিরুদ্দীন কোথা হইতে তাহাকে এখানে আনিয়া রাখিয়াছে | লতিমনের বাড়ী দ্বিমহল, ভিতর মহলে লতিমন নিজে থাকে; বাহির মহলের দ্বিতলে একটা প্রকাণ্ড হলঘরে দিলজান বাস করে |
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, দিলজানের সহিত দেখা করিলে লতিমন সম্বন্ধে সমুদয় সংবাদ পাওয়া যাইবে; তা’ ছাড়া মনিরুদ্দীনের সম্বন্ধেও অনেক বিষয় জনিতে পারা যাইবে |
দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন | একজন ভৃত্য তাঁহাকে উপরে একটী সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া বসাইল এবং সংবাদ লইয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, গৃহটী মূল্যবান্ আস্বাবে পূর্ণ | গৃহতলে গালিচা বিস্তৃত | গৃহ-প্রাচীরে উৎকৃষ্ট তৈল-চিত্র ও দেয়ালগিরি | একপার্শ্বে একখানি প্রকাণ্ড দর্পণ-সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়াইলে তাহার মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত তাহাকে প্রতিবিম্বপাত হয় | অপরপার্শ্বে গবাক্ষের নিকটে একটি হারমোনিয়ম রহিয়াছে, নিকটে একখানি মখমলমণ্ডিত চেয়ার ও একখানি কৌচ | দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, হয়ত দিলজান বিবি ঐ চেয়ারে বসিয়া হারমোনিয়মের স্বরে কণ্ঠস্বর-সংযোগপূর্ব্বক শব্দতরঙ্গে সেই সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠ প্লাবিত করিতে থাকে, আর মনিরুদ্দীন সেই কৌচে কান পাতিয়া পড়িয়া থাকেন |
দেবেন্দ্রবিজয় পশ্চাদ্ভাগে হাত দুইখানি গোট করিয়া সেই কক্ষমধ্যে পরিক্রমণ করিতে করিতে গৃহের সমগ্র সামগ্রী সবিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলেন | কিয়ৎপরে সহসা তাঁহার দৃষ্টি হারমোনিয়মের উপরিস্থিত মরক্কো-মণ্ডিত দুইটি ক্ষুদ্র বাক্সের উপরে পড়িল | বাক্স দুইটি দেখিতে একপ্রকার | দৈর্ঘ্যে অর্দ্ধ-হস্ত এবং প্রস্থে পাঁচ-ছয় অঙ্গুলি পরিমিত | দেবেন্দ্রবিজয় একটি বাক্স তুলিয়া লইলেন, এবং ডালাখানি ধীরে ধীরে খুলিয়া দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি সুদীর্ঘ সূক্ষাগ্র, ধারাল ছুরিকা রহিয়াছে | ছুরিখানির মূলদেশ উজ্জ্বল হস্তিদন্তনির্ম্মিত | অপর বাক্সটিও লইয়া খুলিয়া দেখিলেন | দেখিলেন, তন্মধ্যে কিছুই নাই, কিন্তু তন্মধ্যে যে ঠিক সেইরূপ একখানি ছুরি ছিল, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের বুঝিতে বাকী রহিল না |
বাক্স দুইটি একই ধরণের তৈয়ারী | হস্তস্থিত বাক্সটি যেখানে ছিল, সেইখানেই রাখিয়া দিলেন | তাহার পর গবাক্ষের সম্মুখে আসিয়া ছুরিখানি ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া বিশেষ মনোনিবেশ পূর্ব্বক দেখিতে লাগিলেন | দেখিলেন, ছুরিখানির অগ্রভাগ তেমন উজ্জ্বল নহে-নীলাভ এবং খুব সূক্ষ; বিষাক্ত বলিয়া বোধ হইল | দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, এখন রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা দেখিতে হইবে, এই ছুরিখানি বিষাক্ত কি না | তাহার পর কোন একটা বিড়াল বা কুকুরের গায়ে বিদ্ধ করিলেই বুঝিতে পারিব, এই বিষে কতক্ষণে কিরূপ ভাবে মৃত্যু ঘটে | মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কক্ষের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া দেখিলেন, কেহ কোথায় নাই | তখন ছুরিখানি ব্যগ্রভাবে একখানি কাগজে জড়াইয়া নিজের পকেটে ফেলিলেন ; এবং একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া রুমালে মুখ মুছিতে লাগিলেন |
অনতিবিলম্বে পার্শ্ববর্ত্তী দ্বারপথ দিয়া একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল | তাহাকে দেখিতে তেমন সুন্দরী নহে – শ্যামবর্ণা-বয়ঃক্রমও ত্রিশ বৎসর হইবে | মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ণ | সর্ব্বাঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারে শোভিত | পায়ে জরীর কাজ করা চটিজুতা | দেবেন্দ্রবিজয় তাহার আপাদমস্তক সাভিনিবেশ দৃষ্টিসঞ্চালন করিতে লাগিলেন | ভাবিলেন, কে এ ! দিলজান কখনই নয়-মনিরুদ্দীন কি ইহারই প্রেমে মুগ্ধ হইয়া এ যাবৎ বিবাহ করে নাই ? একান্ত অসম্ভব !
সেই স্ত্রীলোকটি অপরিচিত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে বিস্মিত চিত্তে চাহিয়া বলিল “আপনি কি সেই দিলজানের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিল্লেন, “হাঁ, বিশেষ প্রয়োজন আছে, অপনার নাম কি দিল -”
বাধা দিয়া স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না, আমার নাম দিলজান নয় | আপনার কি প্রয়োজন বলুন-আমি দিলজান্কে তাহা বলিব |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তাহার সহিত আমার দেখা করা দরকার |”
স্ত্রী | এখন দেখা হইবে না-দিলজান এখন এখানে নাই | আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন ?
দে (ইতস্ততঃ করিয়া ) আমি-আমি-এই মনিরুদ্দীনের নিকট হইতে আসিতেছি |
স্ত্রী | আপনি মিথ্যা বলিতেছেন |
দে | কেন ?
স্ত্রী | মনিরিদ্দীন এখন অখানে নাই | দিলজান্কে সঙ্গে লইয়া তিনি কোন্ দেশে বেড়াইতে গিয়াছেন |
দেবেন্দ্রবিজয় বড় বিভ্রাটে পড়িলেন | দেখিলন, কথাটা ঠিক খাটিল না; পাছে অপ্রতিভ হইতে হয়, মনে করিয়া তিনি সে কথাটি একেবারে চাপা দিয়া বলিলেন, “ওঃ ! তা হবে; কিন্তু আরও একটা কথা আছে, আপনি বাহিরের খবর কিছু রাখেন ?”
স্ত্রী | কি খবর বুঝিলাম না | তা’ বাহিরের খবরের জন্য এখানে আমার কছে কেন ? বাহিরে অনেক লোক আছে |
দে | এখানে প্রয়োজন আছে |
স্ত্রী | আপনার কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না-আপনার অভিপ্রায় কি, স্পষ্ট বলুন | আপনার নামটি জানিতে পারি কি ?
দে | আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি পুলিস-কর্ম্মচারী |
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল | বিস্মিতনেত্র দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কি প্রয়োজন, বলুন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লতিমন সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন ?”
পুনরপি স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল; বলিল, “সে ত ঘরের সংবাদ – জানি | আপনি তাহার সম্বন্ধে কি জানিতে চাহেন বলুন |”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” লতিমন বাই খুন হইয়াছে-মেহেদী-বাগানে তাহার লাস পাওয়া গিয়াছে |”
স্ত্রীলোকটি বলিল, “আপনার ভ্রম হইয়াছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমার ত তা’ বোধ হয় না | এই দেখুন দেখি, এটা চিনিতে পারেন কি না |” বলিয়া তিনি সাগ্রহে কাপড়ে জড়ান সেই ওড়্নাখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন | ওড়্নাখানি দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটির হৃদয় অত্যন্ত উদ্বেগপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং মুখমণ্ডলে সে চিহ্ণ সুস্পষ্ট প্রকটিত হইল | সোদ্বেগে কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ, চিনিতে পারিয়াছি-ইহা আপনি কোথায় পাইলেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহারই গায়ে ইহা ছিল |”
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি দুইপদে পশ্চাতে হটিয়া গেল-কি এক ভয়ানক আশঙ্কায় তাহার চোখ-মুখ একবারে বিবর্ণ হইয়া গেল | রুদ্ধশ্বাসে কহিল, ” কি সর্ব্বনাশ ! এ কি ভয়ানক ব্যাপার !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” ব্যাপার গুরুতর, লতিমন খুন হইয়াছে |”
দারুণ উৎকণ্ঠার সহিত সেই স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না-পনি ভুল করিয়াছেন, লতিমন খুন হয় নাই |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” আপনি কিরূপে জানিলেন, লতিমন খুন হয় নাই ?”
স্ত্রীলোকটি ব্যাকুল্ভাবে বলিল, “আমারই নাম লতিমন |”
দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়বিহলনেত্রে লতিমনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন |
১.০৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – নুতন রহস্য
লতিমন মলিল, “হাঁ, ওড়্না আমারই বটে, আপনি কিরূপে ইহা জানিতে পারিলেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমি এই ওড়না লইয়া করিমের মার কাছে গিয়াছিলাম | তাহারই মুখে শুনিলাম, আপনি তাহার নিকট হইতে এই ওড়্না তৈয়ারী করিয়া লইয়াছেন | এই ওড়না যদি আপনার-আপনারই নাম লতিমন বাই-তবে মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, সে কে ?”
এবার লতিমন বাই আকুলভাবে কাঁদিয়া ফেলিল | দেবেন্দ্রবিজয় কারণ বুঝিতে না পারিয়া আরও বিস্মিত হইলেন |
লতিমন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “হায় ! হায় ! কি সর্ব্বনাশ হ’ল গো-আমাদেরই সর্ব্বনাশ হয়েছে ! মেহেদী-বাগানে যে মেয়েমানুষটি খুন হয়েছে-তার কাপড়-চোপড় কি রকম ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” সকলই নীলরঙের সিল্কের তৈয়ারী | সাঁচ্চার কাজ করা |”
লতিমন বাই হতাশভাবে বলিল, “তবেই ঠিক হয়েছে |
“ঠিক হয়েছে কি?”
“আমাদের দিলজানই খুন হয়েছে |” বলিয়া লতিমন দুই হাতে মুখ ঢাকিল |
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন রহস্য ক্রমশঃ নিবিড় হইতেছে-এই রহস্যের মর্ম্মভেদ বড় সহজে হইবে না | তিনি একখানি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়া লতিমনকে দিয়া কহিলেন, “চিনিতে পারো কি ?”
লতিমন বাই দেখিবামাত্র কহিল, ” এ দিলজান বাইএর চেহারা; কিন্তু মুখখান যেন কেমন-এক-রকম ফুলো ফুলো দেখাইতেছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” দিলজানের মৃত্যুর পর এই ফোটো লওয়া হইয়াছে-বিষে মুখখানা ফুলিয়া উঠিয়াছে |”
“বিষে?”
“হাঁ, গত বুধবার রাত্রে কেহ বিষাক্ত ছুরিতে তাহাকে হত্যা করিয়াছে |”
“গত বুধবার রাত্রে ! সেইদিনেই সে আমার নিকট হইতে এই ওড়্না লইয়া বাহির হইয়াছিল,” বলিয়া লতিমন বাই পুনরায় ক্রন্দনের উপক্রম করিল |
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” দেখুন, এখন কান্নাকাটি করিলে সকল দিক নষ্ট হইবে | দিলজান সম্বন্ধে আপনি যাহা কিছু জানেন, আমাকে বলুন | দিলজানের হত্যাকারীর অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত হইয়াছি-যাহাতে হত্যাকারী ধরা পড়ে, সেজন্য আপনার সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করা উচিৎ | বোধ হয়, আপনার সাহায্যে আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে সহজে গ্রেপ্তার করিতে পারিব |”
লতিমন বাই চোখের জল মুছিয়া ভাল হইয়া বসিল | বলিল, “যাহাতে হত্যাকারী ধরা পড়ে সেজন্য যতদূর সাহায্য আমার দ্বারা হইতে পারে, তাহা আমি করিব | দিলজানকে আমি সহোদরা ভগ্নী অপেক্ষাও স্নেহ করিতাম | আমি যাহা কিছু জানি, সমুদয় আপনাকে এখনই বলিতেছি; কিন্তু কে তাহাকে হত্যা করিল-আমি ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছি না | কে জানে, কে তাহার এমন ভয়ানক শত্রু ! সে কাহারও সঙ্গে মিশিত না-কাহারও সঙ্গে সঙ্গে তাহার বাদ-বিসংবাদ ছিল না-একমাত্র মনিরুদ্দীনকে সে খুব ভালবাসিত | মনিরুদ্দীন তাহাকে কোথা হইতে আনিয়া আমার এখানে রাখিয়াছিলেন | মনিরুদ্দীন তাহাকে বিবাহ করিবে বলিয়া মধ্যে মধ্যে আশা দিতেন | দিলজানও সেজন্য তাঁহাকে যখন-তখন পীড়াপীড়ি করিত | ইদানীং মনিরুদ্দীন বড় একটা এদিকে আসিতেন না-আসিলে তখনই চলিয়া যাইতেন | তিনি ইদানীং আর একজন সুন্দরীর রূপ-ফাঁদে পড়িয়াছিলেন |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” আমি তাহাকে জানি-সে সুন্দরীর নাম সৃজান নয় কি ?”
লতিমন সবিস্ময়ে কহিলেন, “হাঁ, সৃজান | আপনি কিরূপে নাম জানিলেন ? এই সৃজান বিবিকে লইয়া দিলজানের সহিত মনিরুদ্দীনের প্রায় বচসা হইত | সপ্তাহ-দুই হইবে, আমি মজ্রো করিতে বিদেশে যাই | যখন ফিরিয়া আসিলাম-দেখি, দিলজানের সে ভাব আর নাই-মনিরুদ্দীনের উপরে সে একবারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে | শুনিলাম, দিলজান কিরূপে জানিতে পারিয়াছে-মনিরুদ্দীন সৃজানকে কুলের বাহির করিবার মতলব ঠিক করিয়াছে | দিলজানকে আমি অনেক করিয়া বুঝাইতে লাগিলাম; আমার একটা কথাও তাহার কানে গেল না | সে বলিল, যদি তাহাই হয়-তাহা হইলে সে দুইজনকে খুন না করিয়া ছাড়িবে না | গত বুধবার রাত্রে মনিরুদ্দীন সৃজানকে লইয়া সরিয়া পড়িবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল | সেইদিনেই দিলজান একটা মতলব ঠিক করিল-চতুরের সহিত চাতুরী করিতে হইবে | সৃজানকে কোন রকমে আটক করিয়া নিজেই মনিরুদ্দীনের সঙ্গ গ্রহণ করিবে |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তাহা হইলে মেহেদী-বাগানের খুনের রাত্রেই এখানে এই ঘটনা হয় |”
লতিমন বলিতে লাগিল, ” সেইদিন অপরাহ্ণে দিলজান যখন মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়, তখন মনিরুদ্দীন বাড়ীতে ছিলেন না | যে বাঁদী মাগী ইহার ভিতরে ছিল, তাহাকে কিছু ইনাম্ দিয়া দিলজান তাহার নিকট হইতে বেবাক্ খবর বাহির করে | কখন কোন্ সময়ে ঘটনাটা ঘটিবে-কোথায় গাড়ী ঠিক থাকিবে, তামাম খবর লইয়া সে সন্ধ্যার পর আবার এখানে ফিরিয়া আসে | তাহার পর রাত দশটার সময়ে নিজে সাজিয়া-গুজিয়া বাহির হইয়া যায়; যাইবার সময়ে আমার ওড়্নাখানি চাহিয়া লইয়াছিল | তাহার পর আমি আর তাহার কোন খবর পাই নাই | মনে করিয়াছিলাম, সে তাহার মতলব ঠিক হাসিল্ করিয়াছে-সৃজানকে ফাঁকি দিয়া সে নিজেই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” আপনি কি ইতিপূর্ব্বে মেহেদী-বাগানের খুনের কথা কিছুই শোনেন নাই ?”
লতিমন বাই কহিল, “শুনিয়াছিলাম, কিন্তু ঐ খুনের সঙ্গে আমাদের দিলজানের যে কোন সংশ্রব আছে, এ কথা আমার বুদ্ধিতে আসে নাই |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “মেহেদী-বাগানের নিকটে মনিরুদ্দীনের বাড়ী | বুধবার রাত্রে দিলজান মেহেদী-বাগানে গিয়া যে খুন হইয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই | এখন দেখিতে হইবে খুনী কে ? আপনি জানেন কি দিলজানের প্রতি কাহারও কখন কোন বিদ্বেষ ছিল কি না ?”
” না, কই এমন কাহাকেও দেখি না|”
দেবেন্দ্রবিজয় চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন | বলিলেন, আচ্ছা, আমি সময়ে আবার আপনার সহিত দেখা করিব | আর একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে; ইহার ভিতরে কি ছিল বলিতে পারেন ?” বলিয়া সেই ছুরির বাক্স দুইটি লতিমনের হাতে দিলেন |
লতিমন কহিল, “কি সর্ব্বনাশ ! দুইখানি ছুরি যে নাই, দেখ্ছি |”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “একখানি আমার কাছে আছে-আর একখানি কোথায় গেল ?”
লতিমন কহিল, “বুধবার রাত্রে দিলজান যাইবার সময়ে একখানা ছুরি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল | যদি কৌশলে তাহার সঙ্কল্প সিদ্ধ না হয়, সেই ছুরি দ্বারা সে নিজের সঙ্কল্প সিদ্ধ করিবে স্থির করিয়াছিল | আমি ত পূর্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, মনিরুদ্দীনের উপরে সে একবারে এমন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছিল যে যদি মনিরুদ্দীন তাহাকে নিরাশ করেন, মনিরুদ্দীনকেও সে হত্যা করিতে কুণ্ঠিত নহে | সেই অভিপ্রায়েই দিলজান ছুরিখানা সঙ্গে লইয়াছিল |”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে প্রয়োজনমত মনিরুদ্দীনকেই হত্যা করিবার উদ্দেশ্যে দিলজান ছুরিখানি সঙ্গে লইয়াছিল, নিজেকে নিজে খুন করে, এমন অভিপ্রায় তাহার ছিল না ?”
লতিমন কহিল, “না, আত্মহত্যা করিবার কথা তাহার মুখে একবারও শুনি নাই-সে অভিপ্রায় তাহার আদৌ ছিল না | দিলজানের এদিকে সব ভাল ছিল-কিন্তু রাগলেই মুস্কিল-একেবারে মরিয়া | সে কথা যাক্, আপনি এখন এ ছুরিখানা লইয়া কি করিবেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” এখানা আমার অনেক কাজে লাগিবে বলিয়া, আমি ছুরিখানি লইয়াছি | প্রথমতঃ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে, এই ছুরি বিষাক্ত কিনা | যদি বিষাক্ত হয়-দিলজান যে ছুরিখানি লইয়া গিয়াছে-সেখানিও বিষাক্ত হওয়া ষোল আনা সম্ভব | বাক্স দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি, দুইখানি একই প্রকার | তাহার পর এই ছুরি কোন একটা বিড়াল বা কুকুরের গায়ে বিদ্ধ করিলেই বুঝিতে পারিব-ইহার বিষে কতক্ষণে কিরূপভাবে মৃত্যু ঘটে, মৃত্যুর পরের লক্ষণই বা কিরূপ হয় | যদি লক্ষণগুলি দিলজানের সহিত ঠিক মিলিয়া যায়-তবে বুঝিতে পারিব, এই একজোড়া ছুরির অপরখানিতেই দিলজানের মৃত্যু ঘটিয়াছে |”
লতিমন শিহরিত হইয়া কহিল, “দিলজানের ছুরি লইয়া দিলজানকেই খুন করিয়াছে, কে এমন লোক ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এখন তাহার সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে |”
লতিমন কহিল, ” হতভাগী আত্মহত্যা করে নাই ত ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আত্মহত্যা করিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না ; আর স্ত্রীলোকে পথে-ঘাটে এইরূপে কখনও আত্মহত্যা করে না | খুবই সম্ভব, দিলজানের কোন শত্রু তাহাকে রাত্রে নির্জন গলিমধ্যে একা পাইয়া খুন করিয়াছে ! যাহা হউক, সময়ে সকলেই প্রকাশ পাইবে-এখন উঠিলাম |”
লতিমন জিজ্ঞাসা করিল, ” আবার কখন আপনার দেখা পাইব ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “দুই-একদিনের মধ্যে আবার আমি আসিতেছি |” এখন একবার সন্ধান লইতে হইবে, খুনের রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কি ব্যাপার ঘটিয়াছিল |”
উপস্থিত অনুসন্ধান অনেকাংশে সফল হইয়াছে মনে করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় প্রসন্নমনে লতিমনের গৃহত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন |
১.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্র
লতিমনের বাটী ত্যাগ করিয়া বাহির হইবামাত্র একটী মুসলমান বালক ছুটিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে একখানি পত্র দিল। বলিল, “বাবু, আপনার পত্র।”
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, পত্রের খামে তাঁহারই নাম লিখিত রহিয়াছে। বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পত্র তুই কোথায় পাইলি?”
বালক কহিল, “একজন বাবুলোক দিয়ে গেছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই খাম ছিঁড়িয়া, পত্রখানি বাহির করিয়া পড়িতে লগিলেন;-
“দেবেন্দ্রবিজয়!
বৃথা চেষ্টা-তুমি আমাকে কখনও ধরিতে পারিবে না-তোমার ন্যায় নির্ব্বোধ গোয়েন্দার এ কর্ম্ম নহে। আমি তোমাকে গ্রাহ্যই করি না। তোমার মত বিশ-পঁচিশটা গোয়েন্দাকে আমি কেনা-বেচা করিতে পারি-সে ক্ষমতা আমার খুব আছে। যাহা হোউক, এখনই এমন কাজে ইস্তফা দাও নতুবা প্রাণে মরিবে। তোমার মত শতটা অকর্ম্মা গোয়েন্দা আমার কিছুই করিতে পারিবে না। তোমাকে আমি এখন হইতে সাবধান করিয়া দিতেছি, আমাকে বিরক্ত করিতে চেষ্টা করিয়ো না। এ পত্র পাইয়াও যদি তুমি বাহাদুরী দেখাইতে যাও-তাহা হইলে যদি কিছু বিষয়-সম্পত্তি থাকে, তাহা উইল করিয়া কাজে হাত দিবে। আমার ত মনে খুব বিশ্বাস, তোমার মত গোয়েন্দার হাতে আমি কখনও ধরা পড়িব না-যদি তেমন কোন সম্ভবনা দেখি-যদি ফাঁসীর দড়ীতে একান্তই ঝুলিতে হয়, তোমাকে খুন করিয়া ফাঁসী যাইব। তুমি যখন যেখানে যাইতেছ, যখন যাহা করিতেছ, আমি সকল খবরই রাখি। আমি সর্ব্বদা তোমার পিছু পিছু ফিরিতেছি। তাহাতে বুঝিতে পারিয়াছি-তুমি এখনও ঘোর অন্ধকারে আছ-অন্ধকারে অন্ধের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি একটা আস্ত বোকা, সেইজন্য তোমাকে আমি একতিল ভয় করি না।
সেই
মেহেদী-বাগানের খুনী।”
পত্রখানি পাঠ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন। বুঝিলেন, তিনি যাহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, সে বড় সহজ লোক নহে। দেবেন্দ্রবিজয় পত্র হইতে দৃষ্টি নামাইয়া সম্মুখস্থ বালকের মুখের দিকে চাহিবামাত্র, সেই বালক তাঁহার খুব উপকার করিয়াছে মনে করিয়া বলিল, “বাবু বখা্শিশ দিনা্। যে বাবু আমার হাতে পত্র দিয়া গেল, সে বাবুর কছে একেবারে একটাকা বখা্শিশ পেয়েছি, এই দেখুন।” বলিয়া বালক বামহস্তের মুষ্টিমধ্যে হইতে চাকচিক্যময় একটি টাকা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখাইল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তুই সে বাবুকে চিনিস? আর কখনও দেখিয়াছিসা্?”
বালক কহিল, “না বাবু।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সেই বাবুর চেহারা কি রকম?”
বালক সেই পত্রদাতার যেরূপ বর্ণনা করিল, তাহাতে পত্রগ্রহীতার কিছুমাত্র উপকার দর্শিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এ পত্র যে আমাকে দিতে হইবে, তুই তা’ কি ক’রে জানা্লি?”
বালক বলিল, ” সেই বাবু আমার হাতে এই পত্রখানা দিয়ে ব’লে গেল এই বাড়ী থেকে এখনই যে একজন বাঙ্গালী বাবু বেরুবে, তার হাতে এই পত্রখানা দিবি।”
দে। সে কতক্ষণের কথা?
বা। এই খানিক আগে।
দে। সে বাবু কোনা্ দিকে গেল।
বা। এইদিক দিয়ে বরাবর সোজা চ’লে গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এখন তাহার অনুসরণ করা বৃথা-এতক্ষণ সে কোথায়-কোনা্পথে চলিয়া গিয়াছে, ঠিক করা কঠিন।
দেবেন্দ্রবিজয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বালক পুনরপি বলিল, “হজুর, আমার বখা্শিশ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” সেই বাবুকে যদি তুই কোন রকমে চিনাইয়া দিতে পারিস, কি তার বাড়ী কোথায় আমাকে ব’লে দিতে পারিসা্ তোকে আমি দশ টাকা বখা্শিশ দিব।”
বালক বলিল, ” আমি দিন-রাত ঘুরে ঘুরে চেষ্টা ক’রে দেখব, যদি তাকে আমি দেখতে পাই, ঠিক আপনাকে খবর দেব। কোথায় আপনার দেখা পাব?”
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে নিজের ঠিকানা বলিয়া দিলেন; কিন্তু মনে মনে বুঝিলেন, এই বালক দ্বারা তাহার বিশেষ কোন কাজ হইবে না; পত্রলেখক লোকটি যেরূপ চতুর দেখিতেছি, তাহাতে অবশ্যই সে ছদ্মবেশে আসিয়া থাকিবে। তিনি বালককে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, ” সে বাবুর দাড়ী গোঁফ ছিল?”
বালক কহিল, “হাঁ, খুব মস্ত মস্ত দাড়ী গোঁফ, মস্ত মস্ত চুল-চোখে নীল রঙের চশমা।”
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার অনুমান ঠিক-লোকটি ছদ্মবেশেই আসিয়াছিল। বালককে বলিলেন, ” তবে আর তুই সে লোককে দেখিতে পাইবি না-তোর অদৃষ্টে আর বখা্শিশের টাকাগুলো নাই দেখা্ছি।”
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় বালককে বিদায় করিয়া দিলেন এবং নিজে মনিরুদ্দীনের বাটী অভিমুখে চলিলেন।
১.১০. দশম পরিচ্ছেদ – অনুসন্ধান
মেহেদী-বাগানের বাহিরে পশ্চিমাংশে মনিরুদ্দীন মল্লিকের প্রকাণ্ড ত্রিতল অট্টালিকা। সম্মুখে অনেকটা উন্মুক্ত তৃণভূমি প্রাচীর-বেষ্টিত। দেবেন্দ্রবিজয় তৃণভূমি অতিক্রম করিয়া বহির্দ্বারে করাঘাত করিলেন। অনতিবিলম্বে রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করিয়া একজন স্থূলাঙ্গী বৃদ্ধা দেখা দিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, সে এখান্কার প্রধানা দাসী অথবা পাচিকা হইবে।
দেবেন্দ্রবিজয়ের অনুমান সত্য। সেই বৃদ্ধা মনিরুদ্দীনের প্রধানা দাসী তাহার নাম কেহ জানে না-এমন কি বোধ হয়, মনিরুদ্দীনও না। সকলে তাহাকে গনির মা বলিয়া ডাকিয়া থাকে-সে অত্যন্ত বিশ্বাসী-আজীবন এই সংসারেই আছে-মনিরুদ্দীনকে সে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে।
বৃদ্ধা গনির মা বলিল, ” কাকে খুঁজেন, মশাই ?”
দেবেন্দ্রবজোয় বলিলেন ” মল্লিক সাহেবের কি এই বাড়ী ?”
বৃ। হাঁ।
দে। তিনি এখন কোথায় ?
বৃ। তিনি এখন এখানে নাই। তাঁকে কি দরকার ?”
দে। তাঁকে বিশেষ কোন দরকার নাই। তাঁর সম্বন্ধে আমি দুই একটা কথা জানিতে চাই।
মনিরুদ্দেনের নামে যে অপবাদ গ্রামের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা বৃদ্ধা গনির মায়েরও কাণে উঠিয়াছিল; সুতরাং দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সে বড় বিব্রত হইয়া উঠিল। বিরক্তভাবে বলিল, “তা এখানে কেন-এখানে কি জান্বেন ? আপনি যান্-মশাই।” বলিয়া দ্বার রুদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বেগতিক দেখিয়া তাড়াতাড়ি দ্বারের ভিতরের দিকে একটা পা বাড়াইয়া দিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমি মনিরুদ্দীনের ভালর জন্যই আসিয়াছি। যা’ বলি শোন, আমাকে তাড়াইলে ভাল কাজ করিবে না। বিশেষ একটা কথা আছে।”
বৃদ্ধার বিরক্তি অদম্য কৈতূহলে পরিণত হইল। বলিল, ” তবে ভিতরে এসে বসুন; মনিরুদ্দীনের কিছু খারাপী ঘটেছে না কি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না-না, তিনি ভাল আছেন-সেজন্য কোন ভয় নাই। তবে একটা বেজায় গাফিলী হয়েছে-বসো-স্থির হ’য়ে সব শোন।”
বৃদ্ধা দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহিরের বৈঠকখানা ঘরে লইয়া বসাইল।
বৈঠকখানাটি অতি সুন্দররূপে সজ্জিত। গৃহতলে মূল্যবান গালিচা বিস্তৃত; তদুপরি দুই-তিনখানি মখমলমণ্ডিত কৌচ; একপার্শ্বে একটি মর্ম্মর প্রস্তরের ছোট টেবিল। টেবিলের উপরে সুদীর্ঘলাঙ্গলবিশিষ্ট রৌপ্যনির্ম্মিত আলবোলা শোভা পাইতেছে। গবাক্ষপার্শ্বে দুইটি কারুকার্য্য-বিশিষ্ট আল্মারী। তন্মধ্যে সুন্দররূপে বাঁধান, স্বর্ণাক্ষরে শোভিত অনেকগুলি ইংরাজী ও বাঙ্গালা উপন্যাস সাজান রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় সর্ব্বাগ্রে একখানি কৌচের উপরে নিজের দেহভার অর্পণ করিয়া দিলেন। গনির মা অদূরে দ্বার-সম্মুখে গালিচার উপরে বসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেখ, আমি মল্লিক সাহেবের ভালর জন্যই এসেছি। যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করি-ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে যাবে, মিথ্যা বল্লেই মুস্কিল। আমি কে, সে পরিচায়টাও তোমাকে এখনই দিয়ে রাখ্ছি; তা’ না হলে তোমার কাছে যে, সব কথা সহজে পাওয়া যাবে না, তা আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি। আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি পুলিশের লোক।”
শুনিয়া বৃদ্ধার চক্ষুঃস্থির; অত্যন্ত ভীতভাবে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, সভয়ে কম্পিতস্বরে বলিল, ” কি মুস্কিল, ওমা! পুলিসের লোক এখানে কেন গো ! মনিরুদ্দীন আমাদের কি করেছে !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-না, মনিরুদ্দীন এমন কিছু করে নাই। তবে কি জান, তার পিছনে অনেক শত্রু লেগেছে-সেই শত্রুদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করবার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি।”
বৃদ্ধা বলিল, ” তা আমাকে কি করতে হবে ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশেষ কিছু করতে হবে না-আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তোমাকে তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। দিলজানকে তুমি জান ?”
ক্রুদ্ধভাবে বৃদ্ধা বলিল, ” না দিলজান-ফিলজানকে আমি জানি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ফিলজানকে না জান, তাতে ক্ষতি নাই, দিলজানকে জানা দরকার হচ্ছে। যা জিজ্ঞাসা করি, উত্তর দাও; নতুবা তোমাকেও বড় মুস্কিলে পড়্তে হবে।”
গনির মা প্রথমটা মনে করিয়াছিল, কিছু বলিবে না, কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয়ের রুষ্টভাব দেখিয়া সে নিজে একটু নরম হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কোন্ দিন থেকে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে নাই ?”
বৃদ্ধা বলিল,” গত বুধবার রাত্রে কোথায় গেছেন এখনও ফিরেন নাই।”
দে। কোথায় গেছেন।
বৃ। তা’ জানি না।
দে। সঙ্গে কেহ আছে ?
বৃ। কি জানি মশাই, তা’ আমি ঠিক জানি না-পাঁচজনের মুখে ত এখন পাঁচ রকম কথা শুনতে পাচ্ছি-সত্যি-মিথ্যা কি ক’রে জানব বাবু ?
দে। গত বুধবারে দিলজান কি এখানে এসেছিল ?
বৃ। এসেছিল।
দে। কখন ?
বৃ। সন্ধ্যার আগে।
দে। কেন এসেছিল ?
বৃ। মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে।
দে। দেখা হয়েছিল কি ?
বৃ। না, মনিরুদ্দীন বাড়ীতে ছিল না। দিলজান রাত্রে দেখা কর্তে আস্বে ব’লে তখনই চ’লে যায়।
দে। রাত্রে আবার এসেছিল।
বৃ। এসেছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সঙ্গে তার দেখা হয় নাই। দিলজানের আসিবার আগে মনিরুদ্দীন আবার বেরিয়ে গিয়েছিল।
দে। সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীন সৃজানকে নিয়ে পালাবে, তা’ দিলজান জান্তে পেরেছিল ?
বৃ। তা আমি ঠিক জানি না।
দে। মনিরুদ্দীনের দেখা না পাওয়ায় দিলজান তখন কি করিল ?
বৃ। মজিদ তখন এখানে ছিল। উপরের একটা ঘরে ব’সে তার সঙ্গে দিলজান অনেকক্ষণ ধ’রে কি পরামর্শ কর্তে লাগ্ল।
দে। মজিদ এসেছিল কেন ?
বৃ। মজিদ এমন মাঝে মাঝে এখানে আসে।
দে। তাদের পরামর্শ কিছু শুনেছ ?
বৃ। কিছু না। আমিই বা তা’ শুন্তে যাব কেন ? আমাকে কি বাপু, তেমনি ছোটলোকের মেয়ে পেয়েছ ? যা হো্ক শেষকালটা তাদের মধ্যে যেন কি খুব রাগারাগির মতন হয়। দুজনেই যেন খুব জোরে জোরে কথা বল্ছিল।
দে। তখন রাত কত হবে ?
বৃ। এগারটার কম নয়।
দে। সেই রাগারাগির পর দিলজান কি একা এখানে থেকে চ’লে যায় ?
বৃ। একা; কিন্তু তার একটু পরেই মজিদও তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায়।
দে। মজিদ যাবার সময়ে তোমাকে কিছু বলেছিল ?
বৃ। কিছু-না-কিছু না।
দেবেন্দ্রবিজয় বিষম সমস্যায় পড়িলেন। তাঁহার মনে হইল, মজিদও এই খুন-রহস্যের মধ্যে অবশ্য কিছু-না কিছু জড়িত আছে। দিলজানের সহিত তাহার রাগারাগির কারণ কি ? তাহার মুখে এমন কি কথা শুনিল, যাহাতে দিলজানের ক্রোধসঞ্চার হইয়াছিল ? এ প্রশ্নের সদুত্তর এখন একমাত্র মজিদের নিকটে পাওয়া যাইতে পারে। সেই সময়ে সহসা আর একটা কথা দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে পড়িয়া গেল; মোবারক-উদ্দীন দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের অনতিকাল পূর্ব্বে মেহেদী-বাগানের মোড়ে মজিদকে সেই গলির ভিতর হইতে ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা হইলে মজিদের কি এই কাজ ? মজিদই কি দিলজানের হত্যাকারী ? দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি ক্রমেই এক গভীর রহস্য হইতে অন্য এক গভীরতর রহস্যে উপনীত হইতেছেন; কিন্তু সেই রহস্যোদ্ভেদের কোন পন্থা না দেখিতে পাইয়া তিনি মনের মধ্যে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। স্থির করিলেন, এখনই তিনি একবার বালিগঞ্জে যাইয়া মোবারক-উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিবেন। তাহার নিকটে যাহা জানিবার, তাহা জানিয়া পরে মজিদের সহিত দেখা করিবেন। এখানে গত বুধবার রাত্রে তাঁহার সহিত দিলজানের কি কি কথা হইয়াছিল, তদুভয়ের বাগ্বিতণ্ডার কারণ কি; এবং নিজেই বা তিনি তেমন সময়ে মেহেদী-বাগানে কেন গিয়াছিলেন, এই সকল প্রশ্নের সদুত্তর না দিতে পারে-তাহা হইলে সে যে এই খুনের ভিতরে জড়িত আছে, সে সম্বন্ধে আর তখন সন্দেহের কোন কারণ থাকিবে না।
গনির মা দেবেন্দ্রবিজয়কে অনেকক্ষণ নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিল, “মশাই, যা কিছু আমি জানি, সব আপনাকে বলেছি; এখন আপনার যা’ইচ্ছে হয় করুন। আমি ত এখনও কিছু বুঝ্তে পার্ছি না। কি হয়েছে ?
দেবেন্দ্রবিজয় সংক্ষেপে বলিলেন, ” খুন।”
বুড়ী বসিয়াছিল, খুনের কথা শুনিয়া যেন সবেগে তিন হাত লাফাইয়া উঠিল; চোখ-মুখ কপালে তুলিয়া কহিল, ” কি মুস্কিল ! কে খুন হয়েছে-আমাদের মনিরুদ্দীন না কি ?”
“না, দিলজান।”
“দিলজান !”
“হাঁ, দিলজান মজিদের সঙ্গে রাগারাগি ক’রে যাবার পরে মেহেদী-বাগানের একটা গলি-পথে খুন হয়েছে।”
বৃদ্ধা ব্যগ্রভাবে কহিল, ” তা হ’তে পারে, মজিদের কোন দোষ নাই-সে কখনই খুন করে নাই, আমি তা বেশ জানি ! সে কেন দিলজানকে খুন করতে যাবে ? সে ওদিকে বড় মেশে না; মদ, বাইজীর সখ তার নাই-জোহেরার সঙ্গে তার খুব আস্নাই হয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” তবে শুন্লেম, মনিরুদ্দীনের সঙ্গেই না কি, জোহেরার সাদি হবে, ঠিক হ’য়ে গেছে?”
বৃদ্ধা বলিল, “না, না-সে কোন কাজের কথাই নয়। জোহেরা কখনই মনিরুদ্দীনকে সাদি কর্বে না-সে মজিদকেই সাদি কর্বে-মজিদের সঙ্গে তার খুব ভাব। আপনি কি মনে করেছেন, মজিদ দিলজানকে খুন করেছে ? আপনি মজিদকেই খুনী ব’লে চালান দিবেন না কি ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, মজিদের বিরুদ্ধে তেমন বিশেষ কোন প্রমাণ এখনও কোন পাই নাই।”
অন্যান্য আরও দুই-একটী কথার পর দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিলেন। বৃদ্ধা গনির মা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।
১.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দারুণ সন্দেহ
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই মোবারক-উদ্দীনের সহিত দেখা করিতে বালিগঞ্জের দিকে চলিলেন। তাঁহার মন অত্যন্ত চিন্তাপূর্ণ এবং অত্যন্ত সন্দেহপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। তিনি পথে চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিলেন, মজিদ দিলজানকে কেন হত্যা করিবে ? আপাততঃ ইহার তেমন কোন কারণ দেখিতেছি না। সেদিন রাত্রে রুষ্টভাবে দিলজান মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিবার পরক্ষণেই মজিদও বাহির হইয়া যায়। ইহাতে বোধ হইতেছে, মজিদ নিশ্চয়ই কোন কারণে দিলজানের অনুসরণ করিয়াছিল। মেহেদী-বাগানের পথে সেই রাত্রে মোবারক-উদ্দীনও মজিদকে একা ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা যেন হইল, কিন্তু দিলজান বাড়ীতে ফিরিবার অন্য সোজা পথ থাকিতে রাত এগারটার পর এই গলি পথে কোনা্ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিয়াছিল ? না, কুয়াসা ও অন্ধকারে হতভাগিনী পথ ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল ? তাহার মত বুদ্ধিমতী যুবতী স্ত্রীলোকের কি সহসা এতটা ভুল হইতে পারে ? ইহা সম্ভবপর নহে। হয় ত পথে এমন কোন পরিচিত ব্যক্তির সহিত তাহার দেখা হইয়া থাকিবে যে , কোন কারণে তাহাকে এই গলির ভিতরে ডাকিয়া লইয়া যাইতে পারে; কিন্তু এত অধিক রাত্রে এই নির্জ্জন পথে কোন পরিচিতের সহিত দেখা সাক্ষাত্ হওয়াও অসম্ভব। অর্থলোভে কোন দুর্ব্বৃত্ত যে এ কাজ করিয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। তাহা হইলে দিলজানের গায়ে যে দুই-একখানি স্বর্ণালঙ্কার ছিল; তাহা দেখিতে পাইতাম না। বিশেষতঃ এখনও এ দেশের তস্কর ও দস্যুদিগের মধ্যে বিষমাখা ছুরির ব্যবহার প্রচলন হয় নাই। তবে যদি কেহ, দিলজানের কাছে যে ছুরি ছিল, সেই ছুরি লইয়া-দূর হউক, এ সকল কোন কাজের কথাই নয়। যতক্ষণ না মজিদের সহিত দেখা করিয়া আমার জ্ঞাতব্য বিষয়গুলির সন্তোষজনক উত্তর পাইতেছি, ততক্ষণ এ জটিল রহস্যের উদ্ভেদ সুদূরপরাহত।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় যখন বালিগঞ্জে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। শ্যামল তরুশ্রেণীর অন্তরালে রক্তরাগোজ্জ্বল রবি সুবৃহত্ স্বর্ণপাত্রের ন্যায় দেখাইতেছে। তাহার হেমাভকিরণচ্ছটা পশ্চিমাকাশ হইতে সমগ্র আকাশে উজ্জ্বলভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বায়ুচঞ্চল বৃক্ষশিরে সেই স্বর্ণকিরণ শোভা পাইতেছে। এবং তখন হইতে সন্ধ্যার বাতাস ধীরে ধীরে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় মোবারক-ইদ্দীনের বাসায় উপনীত হইলেন, তখন মোবারক একখানি ইংরাজী সংবাদপত্র হাতে লইয়া দ্বার-সম্মুখে ধীরে ধীরে পদচারণা করিতেছিলেন। এবং তাঁহার একটা পোষমানা কুকুর দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া ঘন ঘন লাঙ্গুলান্দোলন করিতেছিল। দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া কুকুরটা লাফাইয়া গর্জ্জন করিয়া উঠিল। মোবারক তাহাকে একটা ধমক দিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে কহিলেন, “কি দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, এদিকে কোথায় ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার কাছে।”
মোবারক-উদ্দীন ললাট কুঞ্চিত এবং ভ্রূযুগ সঙ্কোচ করিয়া বলিলেন, ” আমার কাছে কেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেই খুনের মামা্লা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “হাঁ, তা’ কি হইয়াছে, আমি যাহা জানি, সকলেই তা আপনাদিগকে বলিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আরও দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে।”
মোবারক বলিলেন, “বেশ, চলুন ঘরের ভিতরে গিয়া বসি।”
মুবারক দেবেন্দ্রবিজয়কে একটি ঘরের ভিতরে লইয়া গেলেন। কুকুরটাও লাঙ্গুলান্দোলন করিতে করিতে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইল, এবং দুই-একবার এদিকা্ ওদিকা্ করিয়া ঘরের মাঝখানে শুইয়া পড়িল। দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারপার্শ্বে একখানি চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিলেন। এবং মোবারক কিছু তফাতে ঘরের অপর পার্শ্বস্থ একটি ক্ষুদ্র শয্যার উপরে বসিয়া, সই ইংরাজী খবরের কাগজখানা নাড়িয়া-নাড়িয়া নিজের দেহের উপরে ব্যজন করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসিলেন, “কেসা্টার কিছু সুবিধা করিতে পারিলেন কি ?”
ইতিমধ্যে যতটা সুবিধা করিতে হয়, তা’ করিয়াছি। অনেক সন্ধান-সুলভও হইয়াছে।”
“বটে, কে খুন করিয়াছে, তাহা কিছু ঠিক করিতে পারিলেন কি ? কে সে, কি নাম ?”
“খুনির নাম এখনও ঠিক করিতে পারি নাই; তবে যে খুন হইয়াছে, তাহার নাম পাইয়াছি।”
“বটে, কে সে, কি নাম ?”
“দিলজান।”
“কই, এ নাম ত পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই; কে সে, কোথায় থাকিত ?”
“মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা। বামুন-বস্তিতে, লতিমন বাইজীর বাড়ীতে থাকিত। মনিরুদ্দীন তাহাকে কোথা হইতে আনিয়া সেখানে রাখিয়া ছিল, বলিতে পারি না।”
“অন্ধকার রাত্রে মেহেদী-বাগানে সেই অন্ধকার গলির ভিতরে সে কেন গিয়াছিল ? কিরূপে আপনি এ সকল সন্ধান পাইলেন ?”
“আমি সমুদয় আপনাকে বলিতেছি; কোন কোন বিষয়ে এখন আপনার সাহায্য আমাদের অবশ্যক হইতেছে।”
“সেজন্য চিন্তা নাই-আমি সাধ্যমত আপনাদের সাহায্য করিব-তাহার কোন ত্রুটি হইবে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “মেহেদী-বাগানে যে লাস পাওয়া যায়, তাহার সেই রেশমের কাজ করা ওড়া্নাখানি অবলম্বন করিয়া আমি এতদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছি। আমি প্রথমে সেই ওড়া্নাখানি লইয়া করিমের মা’র কাছে যাই; সেখানে শুনিলাম, তাহারাই সেই ওড়া্না বামুন-বস্তির লতিমন বাইজীকে তৈয়ারী করিয়া দিয়াছিল। তখন আমি মনে করিলাম, তবে লতিমন বাইজীর খুন হইয়াছে; কিন্তু লতিমন বাইজীর বাড়ীতে গিয়া দেখিলাম, আমার সে অনুমান ঠিক নহে; লতিমন বাইজী বেশ সবল ও সুস্থদেহে বাঁচিয়া আছে। তাহার কাছে শুনিলাম, গত বুধবার রাত্রে দিলজান তাহার নিকট হইতে সেই ওড়া্নাখানি চাহিয়া লইয়াছিল। সেই ওড়া্না গায়ে দিয়া সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল।”
মো। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন ?
দে। সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িবার উদ্যোগ করিতেছিল, তাহা দিলজান কিরূপে জানিতে পারে; কিন্তু কার্য্যতঃ সেটা যাহাতে না ঘটে, সেই চেষ্টায় দিলজান রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়; কিন্তু মনিরুদ্দীন তার আগেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। সেখানে মজিদ খাঁ ছিলেন; তাঁহারই সহিত দিলজানের দেখা হইয়া যায়; তাহার পর লি কথা লইয়া দু’জনের কিছু বচসা হয়। রাত প্রায় বারটার পর দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া যায়; মজিদ খাঁ তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইয়া পড়েন। মজিদ খাঁ দিলজানকে শেষজীবিত থাকিতে দেখিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, “তা’ হইলে দিলজান রাত্রে আর বাড়ী ফিরে নাই। কিন্তু যখন সে দেখিল, মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার সাক্ষাত্ হইল না, তখন সে সেখান হইতে বরাবর নিজের বাড়ীতে না আসিয়া, এত অধিক রাত্রে মেহেদী-বাগানের সেই ভয়ানক অন্ধকার গলিপথে কি উদ্দেশ্যে গিয়াছিল, বুঝিতে পারিলাম না। মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বামুন-বস্তিতে যাইবার ত একটা বেশ সোজা পথ রহিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তা’ আমি ঠিক বলিতে পারি না। হয় সে পথ ভুল করিয়া থাকিবে, নতুবা ইহার ভিতরে আরও কোন লোক জড়িত আছে।”
মোবারক কহিলেন, ” এ কোন কাজের কথাই নয়। ইহার ভিতরে আবার কে জড়িত আছে ?”
দে। আছে-মজিদ খাঁ।
শুনিয়া মোবারক লাফাইয়া উঠিলেন; বলিলেন, “মজিদ খাঁ-কি সর্ব্বনাশ !” তালু ও জিহ্বার সংযোগে বারদ্বয় এক প্রকার অব্যক্ত শব্দ করিয়া বলিলেন, “না-ইহা কখনই সম্ভব নয়; আমি মজিদ খাঁকে বরাবর খুব রকমেই জানি; খুব ভাল চরিত্র-তিনি কখনই খুন করেন নাই; এমন একটা ভয়ানক খুন কখনই তাঁহার দ্বারা হইতে পারে না। আপনার এ সন্দেহ একান্ত অমূলক।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” শুনিয়াছি, সেদিন রাত্রে আপনি যখন বাসায় ফিরিতেছিলেন, দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব্বে এই মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হইয়াছিল। তাহা বোধ হয়, এখন আপনার স্মরণ আছে ?”
রুষ্ট ও উদ্বিগ্নভাবে মোবারক বলিলেন, “কি ভয়ানক লোক আপনি ! মজিদ আমার বন্ধু, যাহাতে তিনি বিপদে পড়েন, তাঁহার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা আমার ঠিক হয় না। আপনি কি সেইজন্য এখানে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আপনি তখন মজিদ খাঁকে কিরূপে দেখিয়াছিলেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, সেই সকল জানিবার জন্য আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি। আপনি কি তাহা আমাকে বলিবেন না ?”
মোবারক কহিলেন, “কেন বলিব না ? ইহাতে দোষের কথা কিছুই নাই। রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁকে দেখিয়াছি বলিয়াই যে, তিনি খুনী হইলেন এমন ধারণা ঠিক নহে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” কি ভাবে আপনি তাঁহাকে প্রথম দেখেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কি কথা হয় ?”
মোবারক কহিলেন, “অন্ধকারে আমি তাঁহার ভাব-ভঙ্গী দেখিবার সুবিধা পাই নাই। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরিতেছিলেন। অন্ধকারে তিনি একবারে আমার গায়ের উপরে আসিয়া পড়েন। যে অন্ধকার ! তাহাতে এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটিয়া থাকে, তিনি যদি আমার গায়ের উপরে আসিয়া না পড়িতেন, হয় ত আমিই তাঁহার গায়ের উপরে গিয়া পড়িতাম। যাহা হউক, তার পর আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া নিজের বাসায় আনিবার জন্য জেদাজেদি করিলাম-মনিরুদ্দীনের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম-এই রকম দুই-একটী বাজে কথা হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিতভাবে বলিলেন, “তাই ত ! ঠিক সেইদিন তেমন রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর আবির্ভাব কিছু সন্দেহজনক বলিয়া বোধ হয়।”
মো। আমি ত ইহাতে সন্দেহের কিছুই দেখি না; যদি আপনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে ইহার কারণ দেখাইবেন। বিশেষতঃ তিনি দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন-দিলজানের সহিত তাঁহার সংশ্রব কি ?
দে। খুন করিব মনে করিয়াই যে, মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিয়াছেন, আমি এমন কথা বলিতেছি না; তবে দৈবাত্ কি রকম হ’য়ে গেছে। আপনি এই ছুরিখানা দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন।”
এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন, তাহা বাহির করিয়া দেখাইলেন।
১.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছুরি – বিষাক্ত
সভয়ে মোবারক কহিলেন, “ছুরি কোথায় পাইলেন? এই ছুরিতেই খুন –”
বাধা দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” না, এই ছুরিতেই খুন হয় নাই। ইহার জোড়া ছুরিতে খুন হইয়াছে। লতিমন বাইজীর কছে শুনিলাম, দিলজানের এইরূপ দুইখানি ছুরি ছিল। দিলজান, সৃজান বিবির কথা কিরূপে জানিতে পারে, বলিতে পারি না। সে মনিরুদ্দীনের উপরে রাগিয়া এমন অধীর হইয়া উঠে যে, যদি মনিরুদ্দীনকে বুঝাইয়া সে নিজের কাজ উদ্ধার করিতে না পারে, তবে ছুরিতে কাজ উদ্ধার করিবে স্থির করিয়া গত বুধবার রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়। মনিরুদ্দীন তখন বাড়িতে ছিলেন না। সেখানে মজিদ খাঁর সঙ্গে তাহার দেখা হয়; সম্ভব -এই সকল কথা লইয়া মজিদ খাঁর সঙ্গে বচসাও হয়। সেই সময়ে রাগের মুখে দিলজান রাগভারে মজিদ খাঁকে সেই ছুরি দেখাইয়া থাকিবে। এবং যে সঙ্কল্প করিয়া সে ছুরি লইয়া ফিরিতেছে, তাহাও বলিয়া থাকিবে। হয়ত মজিদ খাঁ তখন তাহাকে প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া আসে। রাগের বশে দিলজান হ্ঠাত্ কি একটা অনর্থ ঘটাইবে মনে করিয়া, মজিদ খাঁ সেই ছুরিখানি তাহার হাত হইতে কাড়িয়া লইবার চেষ্টায় তাহার অনুসরণ করিয়া থাকিবেন; তাহার পর হয় ত মেহেদী-বাগানে আবার উভয়ের দেখা হইয়াছে। মজিদ খাঁ সেই সময়ে দিলজানের সহিত ছুরিখানি লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছেন; এবং অসাবধানবশতঃ ছুরিখানি হঠাত্ দিলজানের গলায় বিদ্ধ হওয়ায় দিলজানের মৃত্যু হইয়াছে। পাছে খুনী বলিয়া অভিযুক্ত হইতে হয়, এই ভয়ে মজিদ খাঁও সে সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য না করিয়া চুপ করিয়া গিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, ” অনেকটা সম্ভব বটে; কিন্তু ইহা কতদূর সত্য, আমি বলিতে পারি না। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের সহিত মজিদ খাঁর কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়া আপনি এখন তাহা তদন্ত করিয়া দেখুন। ইহা ভিন্ন সত্য আবিষ্কারের আর কোন উপায় দেখি না। এই ছুরি লইয়া আপনি এখন কি করিবেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ছুরিখানি বিষাক্ত কি না , তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। যদি এই ছুরিখানি বিষাক্ত হয়, তাহা হইলে ইহার জোড়া ছুরিখানি বিষাক্ত নিশ্চয়। এই খুনটা কোন বিষাক্ত ছুরিতেই হইয়াছে।”
হস্ত প্রসারণ করিয়া মোবারক কহিলেন, ” একবার আমি ছুরিখানি দেখিতে পারি কি?”
“অনায়াসে,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানি মোবারকের হাতে দিতে উঠিলেন। মোবারক একটু তফাতে বিছনার উপরে বসিয়া ছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন তাঁহার দিকে এক পা অগ্রসর হইয়াছেন, সম্মুখে কুকুরটা শুইয়াছিল-একেবারে তাহার ঘাড়ের উপরে পা তুলিয়া দিয়াছেন। কুকুরটা রাগিয়া চীত্কার করিয়া তত্ক্ষণাত্ দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ে কামড়াইয়া দিল। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন চমকিত ভাবে সরিয়া যাইবেন, হাত হইতে ছুরিখানি কুকুরটার উপরে পড়িয়া গেল।
মোবারক উঠিয়া তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে সরাইয়া লইলেন। একটা চপেটাঘাতের সহিত ধমকও দিলেন। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ” কি মহাশয়, আপনাকে কামড়াইয়াছে না কি? দেখি দেখি-”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-দাঁত ফুটাইতে পারে নাই, কাপড়খানা একটু ছিঁড়িয়া গিয়াছে মাত্র।”
কুকুরটা তখন মাটিতে পড়িয়া ছটা্ফট করিতেছে; অথচ চীত্কার করিতেও পারিতেছে না। কুকুরটাকে তদবস্থ দেখিয়া মোবারকের বড় ভয় হইল; দেখিলেন, কুকুরের গলার কাছে অল্প রক্তের দাগ; রক্ত মুছিয়া দেখিলেন, সামান্য ক্ষতচিহ্ণ। একান্ত রুষ্টভাবে বলিলেন, “নিশ্চয়ই আপনার ছুরি বিষাক্ত-কুকুরটা এমন করিতেছে কেন? কি সর্ব্বনাশ কুকুরটাকে মারিয়া ফেলিলেন-কি রকম ভদ্রলোক আপনি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনাকে যদি কাহারও কুকুর এরূপভাবে আক্রমণ করিত, সম্ভব, আপনিও এইরূপ ভদ্রতার পরিচয় দিতেন। যাহা হউক, আপনার এরূপ ক্ষতি করিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম।”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিলেন, “যথেষ্ট হইয়াছে, আর আপনার দুঃখিত হইয়া কাজ নাই; কুকুরটাকে একেবারে মারিয়া ফেলিলেন !”
কুকুরটা ক্রমশঃ অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় বিশেষ মনোযোগের সহিত সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। মোবারক কুকুরটাকে ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন। অবসন্নভাবে কুকুরটা আবার গৃহতলে লুটাইয়া পড়িল। মোবারক পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া বারংবার ক্ষতস্থান মুছাইয়া দিতে লাগিলেন। তখন আর উপায় নাই, জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিতেছে। কুকুরটা দুই-একবার বিকৃত মুখব্যাদনসহকারে জৃম্ভণ ত্যাগ করিল; তাহার পর কয়েকবার অন্তিম বলে উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেল। দুই-একবার এইরূপ করিয়া আর উঠিল না-ধীরে ধীরে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
একান্ত উত্তেজিতভাবে মোবারক বলিলেন, ” আপনি করলেন কি-কুকুরটাকে সত্যসত্যই মারিয়া ফেলিলেন ! আপনার মত বে-আক্কেলে লোক দুনিয়াই নাই !”
দেবেন্দ্রবিজয় ছুরিখানা কাগজে ভাল করিয়া জড়াইতে জড়াইতে বলিলেন, “অপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন; দৈবাত্ –”
বাধা দিয়া ক্রোধভরে মোবারক বলিলেন, ” আর আপনার কথায় কাজ নাই-আপনি নিজের পথ দেখুন। আপনার ছুরি ভনায়ক বিষাক্ত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, নতুবা একটু আঘাতেই আপনার কুকুরটা মরিবে কেন? এ ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, দিলজান যে ছুরিতে খুন হইয়াছে, তাহাও বিষাক্ত। একজোড়া ছুরির একখানিতে দিলজানের অদৃষ্টলিপি গ্রথিত ছিল, অপরখানিতে আপনার কুকুরটা মারা পড়িল।”
মোবারক পূর্ব্ববত্ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “বেশ, এখন আপনার পথ দেখুন-আমি আপনাকে মানে মানে বিদায় দিতেছি-ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট।”
দেবেন্দ্রবিজয় রাগ প্রকাশ করিলেন না। মোবারকের কথা তিনি কানে না করিয়া, আপন মনে ছুরিখানি ভাল করিয়া কাগজে জড়াইয়া, সাবধানে পকেটের মধ্যে রাখিয়া দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। ছুরিখানি বিষাক্ত হওয়ায় তিনি মনে মনে অনেকটা পরিমাণে আনন্দানুভব করিলেন। রাস্তায় আসিয়া আপন মনে বলিলেন, “এইবার একবার মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে পারিলে, এই নিবিড় খুন-রহস্যাটা অনেকটা তরল হইয়া আসিবে।”
২.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – পরিচয়
দ্বিতীয় খণ্ড
নিয়তি – লীলাময়ী