পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সাক্ষাতে
সেই দিবস রাত্রি সাড়ে দশটার পর দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে বাহির হইলেন। লাহিড়ীদের উদ্যানে উপস্থিত হইতে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা অতিবাহিত হইল। এগারটা বাজিতে আর বেশি বিলম্ব নাই। দেবেন্দ্রবিজয় উদ্যানের পশ্চিম-প্রান্তের নির্দিষ্ট ঘরের সান্নিধ্যে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কেহই তথায় নাই।
স্থানটি সম্পূর্ণরূপে নির্জন এবং নীরব। কেবল কদাচিৎমাত্র ভগ্নবিশ্রাম কোন বিহঙ্গের পক্ষস্পন্দনশব্দ—কোথায় ক্বচিৎ শুষ্কপত্রপাতশব্দ– অতি দুরস্থ কুক্কুররব। বায়ু বহিতেছিল—দেহস্নিগ্ধকর, অতিমন্দ নিঃশব্দবায়ুমাত্র। যামিনী মধুর, পূর্ণেন্দুবিভাসিত, একান্ত শব্দমাত্রবিহীনা। মাধবী ঘামিনীর পরিষ্কৃত সুনীলগগনে স্নিগ্ধকিরণময় সুধাংশু নীরবে, ধীরে ধীরে নীলাঙ্গরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি উত্তীর্ণ হইতেছিল।
বৃক্ষমূলপার্শ্বে শচীন্দ্র লুকাইয়া ছিল; দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে সেইদিকে পড়িল—শচীন্দ্রও তাহার মাতুল মহাশয়কে দেখিল। উভদে উভয়কে দেখিলেন, কেহ কোন কথা কহিলেন না, আবশ্যক বোধ করিলেন না।
কিয়ৎক্ষণপরে—ঠিক যখন রাত্রি এগারটা, দেবেন্দবিজয় জ্যোংস্নালোকে কিয়দ্দূরে এক রমণীমূৰ্ত্তি দেখিতে পাইলেন। সে মূর্তি তাঁহার দিকে অতি দ্রুতগতিতে আসিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে মূৰ্ত্তি আর কাহারও নহে—সেই পিশাচী জুমেলিয়ার।
জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দুর হইতে দেখিবামাত্র জিজ্ঞাসিল, “এই যে দেবেন্দ্ৰ! এসেছ তুমি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “হাঁ, এসেছি আমি।”
জুমেলিয়া। মনে কিছুমাত্র ভয় হয় নাই?
দে। না, কাহাকে ভয় করিব?
জু। কেন, আমাকে?
দে। তোমাকে? না।
জু। তোমার মনে কি এখন কোন ভয় হইতেছে না?
দে। না।
জু। তোমার নিজের কথা বলছি না; অন্ত কাহারও জন্য তোমার ভয় হ’তে পারে হয়েছে কি?
দে। জুমেলা, আমি তোমাকে ভয় করি না।
জু। সঙ্গে কোন অস্ত্র আছে কি?
দে। তুমি যে নিষেধ করিয়াছ।
জু। ঠিক উত্তর হইল না।
দে ৷ হইতে পারে।
জু। তুমি কি সশস্ত্র?
দে। তুমি?
জু। হাঁ।
দে। তবে আমাকেও তাহাই জানিবে।
জু। কই, তা হ’লে তুমি আমার কথামত কাজ কর নাই।
দে। তোমার কথামত আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি—অস্ত্র থাক বা না থাক, তোমার সে কথায় এখন প্রয়োজন কি? যখন আমার হাতে কোন অস্ত্র দেখিবে, তখন জিজ্ঞাসা করিয়ো।
জু। তুমি সঙ্গে অস্ত্ৰ আনিয়াছ কেন?
দে। আবশ্যক হইলে তাহার সদ্ব্যবহার হইবে বলিয়া।
জু। নিৰ্ব্বোধ!
দে। নির্ববুদ্ধিতা আমার কি দেখিলে?
জু। আমি কি পূৰ্ব্বে তোমায় বলি নাই—যদি তুমি আমার আদেশ মত কাৰ্য্য না কর, তোমার স্ত্রী মরিবে?
দে। হাঁ, বলেছিলে।
জু। তবে কেন তোমার এ মতিভ্রম হইল? আমি যদি এখন এখান হইতে চলিয়া যাই—তুমি আমার কি করিবে?
দে। মনে করিলেই এখন আর যাইতে পার না।
জু। কি করিবে?
দে! এক পা সরিলে তোমাকে আমি হত্যা করিব।
জু! নিৰ্ব্বোধ, আবার?
দে। আবার কি?
জু। তোমায় নিতান্ত মতিছন্ন ধরিয়াছে দেখিতেছি—আমাকে হত্য করিলে তুমি তোমার প্রিয়তম স্ত্রীকে হত্যা করিবে, স্মরণ আছে?
দে। তথাপি আমি তোমাকে হত্যা করিব।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বনভূমিতে
“কর, তোমার পদতলে—তোমার নিকটস্থ গুপ্ত অসির সম্মুখে এই বুক পাতিয়া দিতেছি; কোন অস্ত্র শাণিত কবিয়া আনিয়াছ—জুমেলিয়ার বুকে বসাইয়া দাও। নির্দয় দেবেন–নিষ্ঠুর দেবেন্! সুন্দর বক্ষ অস্ত্রে বিদ্ধ করিতে, একজন স্ত্রীলোকের বক্ষ অস্ত্রদীর্ণ করিতে যদি তুমি কিছুমাত্র কাতর না হও, তাহাতে যদি তোমার আনন্দ হয়—কর পার কর—এই তোমার সম্মুখে বুক পাতিয়া দিলাম!”
এই বলিয়া জুমেলিয়া বক্ষের বসন ও কাঞ্চলী খুলিয়া দুরে ফেলিয়া দিল। জানু পাতিয়া বসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সমক্ষে সেই স্নিগ্ধ শশাঙ্ককরে কামদেবের লীলাক্ষেত্রতুল্য পীনোন্নত বক্ষ পাতিয়া দিল।
পাঠক! একবার ভাবিয়া দেখুন, এ দৃশ্য কতদূর কল্পনাতীত! মাথার উপরে নীলানন্ত নিৰ্ম্মল গগনে থাকিয়া শশী অনন্তকিরণপ্লাবনে জগৎ ভাসাইয়া সুধাহাসি হাসিতেছিল; কাছে—দুরে—এখানে— ওখানে থাকিয়া নক্ষত্রগুলা ঝিকমিক্ করিয়া জলিতেছিল। বৃক্ষাবলীর অগ্রভাগারূঢ়পত্রগুলি ধীরে সমীরে হেলিতে-ফুলিতেছিল; নিম্নে—পার্শ্বে— পশ্চাতে—দুরে—অতিদূরে অনন্ত নিস্তব্ধতা; সেই ঘোর নীরবতার মধ্যে শশিকিরণে আভূমিপ্রণত শুামলতা নীরবে চলিতেছিল; নীরবে জ্ঞতা গুলুমধ্যে শ্বেত, পীত, লোহিত ফুল্লফুলদল বিকসিত ছিল। সেই নির্জন, নীরব উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান; তাঁহার সম্মুখে— দৃষ্টিতলে অদ্ধবিবস্ত্রভাবে জুমেলিয়া চন্দ্রকরোজ্জল অনাচ্ছাদিত পীনোন্নত পীবর বক্ষ পাতিয়া বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় বিচলিত হইলেন, বারেক সৰ্ব্বাঙ্গ কঁপিয়া উঠিল; প্রত্যেক ধমনীর শোণিত-প্রবাহে যেন একটা অনুভূতপূৰ্ব্ব বৈদ্যুতিক প্রবাহ মিশিয়া সৰ্ব্বাঙ্গে অতি দ্রুতবেগে সঞ্চালিত হইতে লাগিল। কি বলিবেন,-স্থির করিতে না পারিয়া দেবেন্দ্রবিজর নীরবে রহিলেন।
জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরবে এবং কিছু বা স্তম্ভিতভাবে থাকিতে দেখিয়া কহিল, “কি দেবেন, নীরব কেন? অস্ত্র বাহির কর; হাত ওঠে না কেন? ওঃ! যতদুর তোমাকে আমি নিষ্ঠুর মনে করেছিলাম, এখন বুঝিতে পারিতেছি, ততদুর তুমি নও; তবে অস্ত্র সঙ্গে আনিয়াছ কেন?”
“সময়ে আবশ্যক হইলে সদ্ব্যবহার-করিব বলিয়া।”
“বেশ, আপততঃ তোমার নিকটে যে-কোন অস্ত্র আছে, আমার হাতে দিতে পার?”
“না।”
“তবে তোমার নিকটে আমার কোন প্রস্তাব নাই; তোমার সঙ্গে তবে আমার সন্ধি হইল না।”
“ক্ষতি কি?”
“তবে কি দেবেন, তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিবে?”
“না, আমার কার্য্যসিদ্ধ করিতে আসিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় এই কথাগুলি স্থির ও গম্ভীরস্বরে বলিলেন। এ স্থৈর্য্য, এ গাম্ভীৰ্য্য ঝটিকাপূৰ্ব্বে প্রকৃতি যেমন স্থির ও গম্ভীরভাব ধারণ করে, তদনুরূপ।
জুমেলিয়া ইহা বিশদরূপে বুঝিতে পারিয়া মনে মনে অত্যন্ত অস্থির হইতে লাগিল; তাহার মনের ভাব তখন বাহিরে কিছু প্রকাশ পাইল না।