চতুর্থ পরিচ্ছেদ
****
পত্রপাঠ সমাপ্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া গেল—মলিন মুখ আরও মলিন হইয়া পড়িল; শ্রীশচন্দ্রকে দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্রীশ, এ পত্র তুমি কোথায় পাইলে?
শ্ৰীশ। বাড়ীর সামনে।
দেবেন্দ্র। কে দিয়েছে?
শ্ৰী। একটা ছোড়া।
দে। সে কোথায় পাইল, জিজ্ঞাসা করেছিলে?
শ্ৰী। ই, সে বললে, একটা বুড়ী এসে তার হাতে পত্ৰখানা দিয়ে আমাদের বাড়ী দেখিয়ে দেয়; বুড়ী তাকে একটা চকচকে টাকা দিয়ে গেছে।
দে। আচ্ছ, এখন তুমি যাও।
শ্ৰীশচন্দ্র প্রস্থান করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পত্ৰখানি পড়িয়া দেখ।”
শচীন্দ্র মনে মনে পত্ৰখানি আগাগোড়া পড়িয়া লইল। তৎপরে জিজ্ঞাসিল, “মামা-বাবু, আপনি কি তবে সেখানে যাবেন?”
“হাঁ, যাইতে হইবে বৈকি।”
“যাইয়া কি করিবেন?”
“না যাইয়াই বা করিব কি?”
“যাইয়াই বা করিবেন কি?”
“জুমেলিয়া পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“এ সত্য, তার অন্তান্ত সত্যের ন্যায়।”
“আমার বিশ্বাস, এবার সে পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“তবে আপনি যাইবেন?”
“হাঁ।”
“সে না প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, আপনাকে হত্যা করিবে?”
“হাঁ, তা? আমি জানি—মনে আছে।”
“শুধু আপনাকে নয়, মামী-মাকে, শ্ৰীশকে আর আমাকে ৷”
“হাঁ।”
“মামা-বাবু, এ আবার জুমেলিয়ার নূতন ফাঁদ; এ ফাঁদে মামী-মাকে আর আপনাকে সে আগে ফেলিতে চায়।”
“এ কথা আমি বিশ্বাস করি।”
“তথাপি আপনি যাইবেন?”
“তথাপি আমি যাইব।”
“আমাকে সঙ্গে লইবেন না?”
“না।”
“কেন?”
“তাহা হইলে আমার অভিপ্রায় পুর্ণ করিতে পারিব না।”
“সে অভিপ্রায় কি?”
“সময়ে সব জানিতে পারিবে, এখন এই যথেষ্ট; তবে এইটুকু জানিয়া রাখ, ডাকিনী আমাকে ডাকে নাই নিজের মৃত্যুকে ডাকিয়াছে—তার দিন ফুরাইয়াছে।”
“মামা-বাবু, আপনি তার প্রস্তাবে সম্মত হবেন?”
“কি তার প্রস্তাব, আগে জানি; তার পর সে বিষয়ের মীমাংসা হবে।”
“আমি এখন কি করিব?”
“কিছুই না।”
“বড় শক্ত কাজ!”
“তা আমি জানি; থাম—বলছি।”
“বলুন।”
“সন্ধ্যার একঘণ্টা পরে, তুমি ভিক্ষুকের বেশে ঐ বাগানের ভিতরে যাবে; যে কাঠের ঘরের কথা পত্রে আছে, সেই ঘরের কাছে কোন গাছের আড়ালে লুকাইয়া থাকিবে; দেখিবে, কে কি করে, কে কোথায় যায়। খুব সাবধান, কেউ যেন তোমায় দেখিতে না পায়। আমি রাত এগারটার সময় যাইব।”
“নিরস্ত্র অবস্থায় যাবেন কি?”
“অস্ত্রছাড়া তোমার মামা-বাবু কখনও বাড়ীর বাহির হন নাই— হবেনও না। আমি জুমেলিয়ার অনুসরণ করিব, তুমিও অলক্ষ্যে আমার অনুসরণ করিবে। কিন্তু দেখিয়ো—খুব সাবধান, যেন তোমাকে তখন সে দেখিতে না পায়। আমি যাইবার সময়ে পকেটে করিয়া কতকগুলি ধান লইয়া যাইব, যে পথে যাইব, সেই পথে আমি সেগুলি ছড়াইতে ছড়াইতে যাইব; সেগুলি ফেলিবার সময়ে বড় একটা শব্দ হ’বার সম্ভাবনা নাই; তুমি সেই ধানগুলির অনুসরণ করবে, তাহ হইলে আমার অনুসরণ করা হবে।”
“বেশ—বেশ।”
“জুমেলিয়া বড় সতর্ক—বড়ই চতুর; সে নিজের পথ আগে ভাল রকম পরিষ্কার না রেখে এ পথে পা দেয় নাই; আগে সে বুঝেছে, তার বিপদের কোন সম্ভাবনা নাই, তার পর আমাকে ডাকিয়ে পাঠিয়েছে। সে জানে, একবার আমার হাতে পড়িলে তাহার নিস্তার নাই; একবিন্দু দয়াও সে অামার কাছে আশা করিতে পারিবে না। তোমার এখন কাজ হইতেছে, তুমি দেখিবে, সে আত্মরক্ষার জন্য কিরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছে; কে এখন তার সহযোগী হইয়াছে। আমার কথামত ধান দেখিয়া আমার সন্ধান লইবে; যখন সন্ধান পাইবে—যেখানে আমি থাকিব, জানিতে পরিবে, তখন তথায় অপেক্ষণ করিবে; যতক্ষণ না আমি তোমাকে ইঙ্গিতে জানাই, ততক্ষণ অপেক্ষা করিবে।”
“কিরূপে ইঙ্গিত করিবেন?”
“যখন উপর্যুপরি দুইবার পিস্তলের আওয়াজ হইবে, তখনই তুমি আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। যতক্ষণ পৰ্য্যন্ত তুমি পিস্তলের শব্দ শুনিতে না পাও, ততক্ষণ তোমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, কেবল অপেক্ষায় থাকিবে।”
“বেশ, আমি আপনার আদেশমতই কাজ করিব।”
“শচী! আমাদের জীবনের এ বড় সহজ উদ্যম নয়; এ উদ্যম বিফল হ’লে আমাদের মৃত্যু অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমরা যত ভয়ঙ্কর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সে সকলের অপেক্ষা এখন বেশি পরিশ্রম— বেশি বুদ্ধি—বেশি কৌশল আবশ্যক করে। তোমার মামী-মার জীবন ত এখন সঙ্কটাপন্ন; এমন কি আমার প্রাণও আজিকার রাত্রির কাৰ্য্যের উপর নির্ভর করিতেছে; প্রাণনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। অথচ স্বেচ্ছায় সে কাৰ্য্য আমাদিগকে যে প্রকারে হউক, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। আর শচী, যদি সে নারী-দানবী আমাকে পরাস্ত করে—আমার প্রাণনাশ করে, তুমি রহিলে, তুমি প্রাণপণে চেষ্টা পাইবে; তোমার হাতে তখন আমার সকল কৰ্ত্তব্য অর্পিত হইবে। যাও শচী, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও শচী, আমার কথাগুলি যেন বেশ স্মরণ থাকে; সেগুলি যেন ঠিক পালন করিতে পার, আর যদি তোমায় আমায় আর এ জীবনে সাক্ষাৎ না ঘটে, ভাল —সুৰ্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর আছেন, তিনি তোমায় রক্ষা করিবেন—তিনি তোমার সহায় হইবেন—তিনি তোমার মঙ্গল করিবেন—যাও, শচী।”
শচীন্দ্র স্নানমুখে—আর কোন কথা না বলিয়া—নয়নপ্রান্তের অশ্ররেখা মুছিয়া স্থান ত্যাগ করিল।