দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শচীন্দ্রের প্রবেশ
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন; বুঝিলেন, শচীন্দ্রের অপেক্ষায় আর বিলম্ব করা শ্রেয়ঃ নহে। যখন তিনি আবশ্যক মত ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া গমনোদ্যত হইয়াছেন, বহির্দ্বারে বানাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল; কে যেন সজোরে দ্বার উন্মুক্ত করিয়া ফেলিল—তৎপরে অতিদ্রুত পদশব্দ। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে পদশব্দ শচীন্দ্রের। তখন শচীন্দ্র অতিদ্রুত সোপানারোহণ করিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তাহার দুই হস্ত ধরিয়া টানিয়া লইয়া শয়নকক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শচীন্দ্র, ব্যাপার কি! কি হয়েছিল তোমার?”
শচীন্দ্র। এতক্ষণ আমি অজ্ঞান হ’য়ে পড়েছিলাম; একটা লোক পিছন দিক থেকে আমায় লাঠী মারে।
দেবেন্দ্র। কখন, কোথায়?
শ। পদ্মপুকুরের বড় রাস্তা ছেড়ে যেমন জেলে-পাড়ার ভিতর ঢুকেছি।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে?
শ। মাথার উপরে। ,
দে। কে মেরেছে, জান?
শ। আমি তাকে দেখি নি, তখুন সেখানে যারা ছিল, তাদের মুখে শুনলেম, একজন মুসলমান।
দে। সে পালিয়েছে?
শ। হাঁ।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে দেখি, মাথা ফেটে যায় নাই ত?
শ। না, উপরকার একটু চামড়া কেটে গিয়ে খানিকট রক্ত বেরিয়ে গেছে। আঘাত সাঙ্ঘাতিক নয়—ব্রজেন্দ্র ডাক্তারের ডিস্পেন্সারীর সম্মুখে অজ্ঞান হ’য়ে পড়ি; ডাক্তার-বাবু তখন তথায় ছিলেন। আমাকে তখনই তার ডিস্পেন্সারীতে তুলে নিয়ে গিয়ে যেখানটা কেটে গিয়েছিল, সেখানটায় ঔষধ দিয়ে রক্ত বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। ষা’ই হ’ক, মামী-মা’র জন্যই আমার সন্ধান নিতে যাওয়া —মামী-মা কোথায়? .
দে। নাই—বাড়ীতে নাই!
শ। সে কি!
দে। ষড়যন্ত্রকারীরা আবার লোক পাঠিয়েছিল; তোমার নাম জাল ক’রে একখানা পত্র লিখে পাঠায়।
শ। তবে মামী-মা কি আবার জুমেলিয়ার হাতে পড়েছে?
দে। জুমেলিয়া ভিন্ন কে আর এমন সাহস করবে? কার সাহস হবে? কে আর দেবেন্দ্রের উপর এমন চাতুরীর খেলা খেলতে পারে? আমি এখনই চললেম।
শ। কোথায়?
দে। রাজার বাগানে নীলু মিস্ত্রীর বাড়ীতে।
শ। সেখানে কেন, মামা-বাবু? কি হয়েছে—আমায় সব কথা ভেঙে বলুন।
দে। আবদুল পাহারাওয়ালার চাপ্রাস চুরি গেছে। নীলু মিস্ত্রীকে সে চাপ্রাস পালিস করতে দিব বলেছিল; তার অজ্ঞাতে তার স্ত্রীর কাছ থেকে নীলু মিস্ত্রী সে চাপ্রাস চেয়ে নিয়ে যায়; এখন অস্বীকার করছে—এখন আমাকে—
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথা সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে সদর দরজায় আবার একটা উচ্চ শব্দে আঘাত হইল; তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া আসিয়া শ্ৰীশচন্দ্র একখানি পত্র হস্তে সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল, পত্ৰখানি সে দেবেন্দ্র বিজয়ের হাতে দিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার দ্বিতীয় পত্র
দেবেন্দ্রবিজয় তখনই সেই পত্র পাঠ করিলেন;–
“দেবেন্দ্রবিজয়!
তোমার স্ত্রী এখন আমার হাতে পড়িয়াছে ৷ আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারি কি না, তাহ এখন তোমার উপর নির্ভর করিতেছে। সে এখন আমার কোন ঔষধ—কোন দ্রব্যগুণে অচেতন হইয়া আছে; যদি যথাসময়ে ঠিক সেই ঔষধের কাটান ঔষধ দেওয়া যায়, তাহ হইলে তোমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি হইবে না। তার জীবন ও মৃত্যু তোমার হাতে; তুমি জান—তুমি বলিতে পার, সে বাচিবে কি মরিবে।
যদি এখন আমি তাহাকে তাহার সেই অজ্ঞান অবস্থায় তোমার হাতে দিই; কোন ডাক্তার, কোন কবিরাজ, যত নামজাদা ভাল চিকিৎসক হউক না কেন, কেহই রক্ষা করিতে পরিবে না। সকলেই তাহাকে মৃত বলিয়াই বিবেচনা করিবে—কিন্তু সে জীবিত আছে।
তোমার নিকটে আমার এক প্রস্তাব আছে; আমি জানি, তোমার কথা তুমি ঠিক বজায় রাখিয়া থাক ও রাখিতে পার। প্রস্তাব কি—পরে জানিতে পারিবে; আমার প্রাণের ভিতরে এখন আশা ও নৈরাপ্ত উভয়ে মিলিয়া বড়ই উৎপাত করিতেছে।
অন্তরাত্রি ঠিক এগারটার পর বালিগঞ্জের বাগান-বাড়ীতে সাক্ষাৎ করিবে; লাহিড়ীদের বাগান, বাগানের পশ্চিম প্রান্তে যে কাঠের ঘর আছে, সেইখানে সাক্ষাৎ করিবে। আসিবার সময়ে সঙ্গে কোন অস্ত্রশস্ত্ৰ আনিয়ো না; আমার সঙ্গে দেখা হইলে বিনাবাক্যব্যয়ে আমার অনুসরণ করিবে; যেখানে আমি তোমাকে লইয়া যাইব, তোমাকে যাইতে হইবে; ইচ্ছা আছে, তোমার পত্নীকে মুক্তি দিবার জন্য একটা সুপরামর্শ ও সন্ধি স্থির করিব।
যদি তুমি অপর কাহাকেও সঙ্গে লইয়া এস, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না—আমাকে দেখিতে পাইবে না; যদি তুমি আমাকে গ্রেপ্তার করিতে কি আমার কোন ক্ষতি করিতে চেষ্টা কর, তোমার স্ত্রী অসহায় অবস্থায় অতিশয় যন্ত্রণা • পাইরা দন্ধিয়া দন্ধিয়া মরিবে; কেহই তাহাকে বাঁচাইতে পারিবে না; ইতোমধ্যে যদি তুমি আমাকে হত্যা কর, তোমার স্ত্রীর মৃত্যু অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিবে—তুমি আমাকে জান।
যেখানে যখন সাক্ষাৎ করিতে লিখিলাম, আমি ঠিক সেই সময়ে তোমার সহিত একা আসিয়া দেখা করিব। তোমার নিকটে আমি যে প্রস্তাব করিব, তাহাতে যদি তুমি অসম্মত হও, শেষ ফল কি ঘটে, জানিতে পারিবে। আমি তোমার প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছি, তোমার কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অনিষ্ট ঘটিবে না। তুমি একাকী আসিয়ে, আশঙ্কা করিবার কোন কারণ নাই। আমার যাহা অনুরোধ, তোমার নিকটে বলা হইলে, তাহাতে তুমি সন্মত হও বা না হও, স্বচ্ছন্দে তোমার নিজের বাড়ীতে তুমি ফিরিবে। যতক্ষণ না তুমি বাড়ীতে ফিরিয়া যাও, ততক্ষণ জুমেলিয়া তোমার প্রতি শক্ৰতাচরণ করিবে না। তুমি গৃহে উপস্থিত হইলে—যেমন এখন আছ—তোমার যেমন অবস্থা হইতে তোমাকে আমি ডাকিতেছি, যতক্ষণ ঠিক তেমন অবস্থায় না ফিরিবে, ততক্ষণ জুমেলিয়া চুপ করিয়া থাকিবে—তোমার কোন অনিষ্ট করিবে না। এমন কি অপর কোন শক্র কর্তৃক যদি তোমার একটি কেশের অপচয় ঘটিবার কোন সম্ভাবনা দেখে, জুমেলিয়া প্রাণপণে তাহাও হইতে দিবে না।
তুমিই এখনও তোমার পত্নীর জীবন রক্ষা করিতে পার; কি প্রকারে পার, তাহা এখন বলিব না; রাত এগারটার পর দেখা করিলে বলিব।
স্মরণ থাকে যেন, তোমার স্ত্রী এখন বাইশ হাত জলে পড়িয়াছে।
তুমি আমাকে জান—
জুমেল।”