এমন সম্মুখীন ভীষণ বিপদে হঠাৎ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে কাৰ্য্য সফল হওয়া দুরে থাক, বরং ইষ্ট করিতে বিষময় ফল প্রসব করিবে, তাহা দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন।
এখন তাঁহাকে ধীর ও সংযতচিত্তে একটির পর একটি করিয়া অনেকগুলি কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। রেবতীকে যে জুমেলিয়া অপহরণ করিয়াছে, তদ্বিয়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।
এইজন্যই কি জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে পত্রে জানাইয়াছিল যে, তাহার পত্রপাঠ সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে তিনি পরাজিত হইলেন? রেবতী গোয়েন্দা-পত্নী—তাঁহাকে গৃহের বাহির করা বড় সহজ ব্যাপার নহে— সুবলীলায় সমাধা হইবারও নহে, জুমেলিয়া প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়াছে—অতি কৌশলপূৰ্ণ চাতুরীর খেলা খেলিয়াছে।
০২. শঠে শাট্যং সমাচরেৎ – দ্বিতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড – শঠে শাট্যং সমাচরেৎ
প্রথম পরিচ্ছেদ
সন্ধানে
রেবতী যতই কেন বুদ্ধিমতী হউন না, জুমেলিয়ার প্রতারণ-জলে ছিন্ন করা তাহার সাধ্যাতীত। যে লোক সংবাদ আনিয়াছিল, সে পাহারাওয়াল-পুলিশের লোক—বিশেষতঃ সেখানকার থানার ও রামকৃষ্ণ বাবুর তাঁবের; তাহাকে রেবতী কি প্রকারে সন্দেহ করিবেন? যদি সন্দেহের কিছু পাকিত, শচীন্দ্র পূৰ্ব্বেই চুটিয়া আসিয়া তাহাকে প্রকৃত সংবাদ জানাইত; কিন্তু তাহা না করিয়া সেই শচীন্দ্রই যখন তাঁহাকে যাইবার জন্য পত্র লিথিয়াছে, তখন আর রেবতীর অবিশ্বাসের
কারণ কোথায়?
আরও একটা বিশেষ চিন্ত দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তষ্ক একেবারে অস্থির করিয়া তুলিল; শচীন্দ্র এখনও ফিরিল না কেন, জুমেলিয়া কি প্রকারে তাহার প্রত্যাগমনে বাধা ঘটাইল?
পত্ৰখানি—যাহা শচীন্দ্রের লিখিত বলিয়া স্থিরীকৃত, সম্পূর্ণরূপে জাল; অবিকল শচীন্দ্রের হস্তলিপি, বেবতী তাহাতে সহজেই প্রবঞ্চিত হইয়াছেন। যাহাতে সামান্তমাত্র সন্দেহের সম্ভাবনা না থাকে, এইজন্য ষড়যন্ত্রকারীরা শচীন্দ্রের প্রস্থানের পর আরও একঘণ্টা সময় অপেক্ষা করিয়া, শচীন্দ্রের নামে জাল পত্র লিখিয়া আনিয়া রেবতীর হস্তে অর্পণ করিয়া থাকিবে।
কি ভয়ানক জটিল চাতুরী! এখন—এমন –সময়ে—এই বিপৎকালে দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা করিয়া থাকা ভিন্ন আর কি করিবেন? গায়ের জোরে রাস্তার ছুটিয়া বাহির হইলেই বা কি হইবে – কি উপকার দর্শিবে? কাহাকে উপায় জিজ্ঞাসিবেন? দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা আর কে এ
সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞাত আছে?
কাজেই তখন তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে এবং কি করিবেন, তাহাই ভাবিয়া ঠিক করিয়া লইতে হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিতে লাগিলেন, “অসম্ভব। শচীন্দ্রকে জুমেলিয়া এই দিনের বেলায় কখনই নিজের করায়ত্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, অন্ত কোন কৌশলে তাকে মিথ্যানুসরণে দুরে ফেলেছে; তাই সে এখনও ফিরে নাই; পিশাচী জুমেলিয়া সহজে স্বকাৰ্য্য সমাধা করেছে; আপাততঃ কোন সুবিধার অপেক্ষায় থাকা আমার কর্তব্য।”
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্ৰীশচন্দ্র ৩৫নং পাহারাওয়ালাকে সমভিব্যাহারে লইয়া উপস্থিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই পাহারাওয়ালাকে “তুমি এইখানে বস; এখনই আমি আসছি, বলিয়৷ শ্ৰীশচন্দ্রকে লইয়া কক্ষান্তরে গমন করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ, কি বুঝলে?”
“এ সে লোক নয়।”
“আমিও তা জানি।”
“এর নাম আবদুল।”
“তুমি একে চেন কি ?”
“ভাল রকম চিনি, ছেলেবেলা থেকে ওকে দেখে আসছি।”
“চেষ্টা করলে তোমার উপরে কিছু চালাকি চালাতে পারে কি?”
“না।“
* * * * *
দেবেন্দ্রবিজয় বৈঠকখানাগৃহে তখনই ফিরিলেন। পাহারাওয়ালাকে জিজ্ঞাসিলেন, “আবদুল, আড়াইঘণ্টা পূৰ্ব্বে তুমি কোথায় ছিলে?”
পাহারাওয়ালা বলিল, “বাড়ীতে মশাই।”
“কোথায় তোমার বাড়ী?”
“এই রাজার বাগানে ৷”
“আজ কোন জিনিষ তুমি হারিয়েছ?”
“ই মহাশয়, আমার চাপ্রাসখানা।”
“কখন—কেমন ক’রে হারালে?”
“তখন আমি ঘুমুচ্ছিলেম, একজন লোক এসে আমার স্ত্রীর নিকটে চাপ্রাসখানা চায়, তাতে আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, কোন চাপ্রাস?”
“যেখানা পাহরাওয়ালা সাহেব মেরামত করতে দিবে বলেছিল।”
“তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন’, আমার স্ত্রী তাকে বলে।”
“তাতে সে বলে ‘আজ আমার হাত খালি আছে, চাপ্রাসথান ঠিকঠাক ক’রে ফেলব; এর পর পেরে উঠব না; আজ সন্ধ্যার পরেই অনেক কাজ আসবে; চাপ্রাস কি—একমাস আমি আর কোন কাজ হাতে করতে পারব না; যদি পার, খুঁজে বের করে এনে দাও, ছ’ঘণ্টার মধ্যে আমি ঠিক ক’রে দিয়ে যাব।’ আমার স্ত্রী তাকে তখন আমার চাপ্রাস খানা বের ক’রে দেয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ইহার মধ্যে তুমি কোন লোককে তোমার চাপ্রাস মেরামতের কথা বলেছিলে?”
পাহারাওয়ালা! হাঁ। এ বড় মজার কথা দেখছি।
দেবেন্দ্র। কি রকম?
পা। তার পর যখন আমার ঘুম ভাঙে, আমার স্ত্রী আমাকে সকল কথাই বললে। কিছুদিন হ’ল, আমি নীলু মিস্ত্রীকে আমার চাপ্রাসটা পালিস করে দিতে বলেছিলেম, তাতে ভাবলেম, নীলু মিস্ত্রীই চাপ্রাসখানা নিয়ে গেছে।
দে। ভাল, তার পর?
পা। আমি তখনই নীলু মিস্ত্রীর কাছে যাই, সে আমার কথা শুনে একেবারে আশ্চৰ্য্য হ’য়ে গেল; চাপরাসের কথা সে কিছুই জানে না।
দে। যে লোকটা তোমার স্ত্রীর কাছ থেকে চাপ্রাসখানা নিয়ে গিয়ে ছিল, তার চেহারা কেমন—তোমার স্ত্রী সে বিষয়ে কিছু বলতে পারে?
পা। তাই ত বলছি মশাই, বড়ই মজার কথা! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে যে চেহারার কথা বললে, তাতে নীলু মিস্ত্রীকেই বেশ বুঝায়।
দে। তুমি এখন কি বুঝছ?
পা। বুঝব আর কি? আমি দশ বৎসর নীলু মিস্ত্রীকে দেখে আসছি, সে খুব ভাল লোক; সে যেকালে কালীর দোহাই দিয়ে, ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বললে, সে আমার চাপ্রাসের কথা কিছুই জানে না, তাতে তার কথা আমি কি ক’রে অবিশ্বাস করি?
দে। তোমার স্ত্রীর নিকট হ’তে চাপ্রাসখানা কেউ ফাকি দিয়ে নিয়েছে ব’লে বোধ হয় কি?
পা। হাঁ, তাই এখন আমার বেশ বোধ হচ্ছে।