নবম পরিচ্ছেদ
কুসংবাদ
পত্রের একস্থানে লিখিত আছে, জুমেলিয়ার প্রাগুক্ত পত্রপাঠ-সময়ের মধ্যেই দেবেন্দ্রবিজয় তাহার নিকটে পরাজিত হইয়াছেন। জুমেলিয়া যদিও মানবী—কিন্তু তাহার কল্পনায়—তাহার অভিরুচিতে—তাহার আচরণে—সে পিশাচী অপেক্ষা ও ভয়ঙ্করী।
দেবেন্দ্রবিজয় নিজের জন্য ভীত নহেন, তাহার স্নেহাম্পদগণের জন্য তিনি চিন্তিত ও উৎকন্তিত।
কে জানে, জুমেলিয়া এক্ষণে কাহাকে প্রথম আক্রমণ করিবে? কাহাকে সে প্রথম লক্ষ্য করিবে? দেবেন্দ্রবিজয় পকেটে পত্ৰখানি রাখিয়া গৃহাভিমুণে দ্রুতবেগে গমন করিলেন।
বাটীর সদর দরজায় শ্ৰীশচন্দ্র দণ্ডায়মান ছিল, দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া তাহার নয়নদ্বয় আনন্দোদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহা দেখিতে পাইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ! তুমি এখানে? ব্যাপার কি?”
শ্ৰীশচন্দ্র উত্তরে কহিল, “যাই হ’ক , আপনাকে দেখে এখন ভরসা হ’ল, মাষ্টীর মশাই, বড়ই ভাবনা হচ্ছিল; মনে করেছিলাম না জানি, কি সৰ্ব্বনাশ হয়েছে!”
দেবেন্দ্র। কেন, এ কথা বলিতেছ কেন? কি হইয়াছে?
শ্ৰীশ। শুনলেম, আপনাকে না কি কে বিষ খাইয়েছে—আপনার জীবনের আশা নাই।
দে। কে এ সংবাদ দিল? কতক্ষণ এ সংবাদ পেয়েছ?
শ্ৰী। কেন? প্রায় দুইঘণ্টা হবে।
দে। কে এ সংবাদ দিয়েছে?
শ্ৰী। একজন পাহারা ওয়ালা।
দে। সংবাদটা কি?
শ্ৰী। পাহারাওয়ালাট এসে বললে, কে একট। মেয়ে মানুষ আপনাকে বিষ খাইয়েছে; আপনি অজ্ঞান হ’য়ে থানায় পড়ে আছেন; আপনার তাতে জীবনসংশয় ভেবে সেখানকার সকলেই ভয় পেয়েছে, সেইজন্য সে তাড়াতাড়ি মামী-মাকে* নিয়ে যেতে
এসেছিল।
দে। কোথায় যেতে হবে?
শ্ৰী। থানায়।
দে। তার সঙ্গে তিনি গেছেন? ত্র। না।
দে। ধন্য ঈশ্বর।
শ্ৰী। মামী-ম। তখনই তার সঙ্গে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে শচী দাদা এসে পড়েন।
দে। ঠিক সেই সময়ে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। শচী দাদা এসে বললেন, তিনিই আপনাকে দেখতে যাবেন। মামী-মা তার সঙ্গে যেতে চাইলেন।
দে। তার পর?
শ্ৰী। তিনি মামী-মার কথায় কাণ দিলেন না।
দে। [ সহৰ্ষে ] শচীন্দ্র ভাল করেছে—বুদ্ধিমান ছোকরা—বুদ্ধির কাজই করেছে।
শ্ৰী। তিনি বললেন, ‘আমি আগে যাই, তাতে যদি মামা-বাবু আপনাকে নিয়ে যেতে বলেন, আমি খবর পাঠাব’। এ কথা মামী-ম। কিছুতেই শুনিবেন না; শেষে শচী দাদা অনেক ক’রে বুঝিয়ে রেখে একাই চ’লে গেলেন।
দে। যা হউক, বিপদটা ভালয় ভালয় কেটে গেছে; তোমার মামীমাকে গিয়ে বল, আমি এসেছি।
শ্রী। কই, এখনও মামী-মা ফিরে আসেন নি।
দে। [ সবিস্ময়ে ] ফিরে আসেন নি কি!
শ্ৰী। না, মাষ্টার মহাশয়।
দে। কোথায় গেলেন তিনি?
শ্রী। আপনাকে দেখতে।
দে। আমাকে দেখতে! এই না তুমি আমাকে বললে, শচীন্দ্রের নিকট হ’তে কোন খবর না এলে তিনি যাবেন না?
শ্ৰী। হাঁ তা’ত বললেম।
দে। [ ব্যগ্রভাবে ] তবে আবার তুমি এ কি বলছ?
শ্ৰী। শচী দাদা ত লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। [ সাশ্চর্য্যে ] অ্যাঁ!
শ্ৰী। তিনি ত মামী-মাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। কতক্ষণ?
শ্ৰী। প্রায় একঘণ্টা হ’ল।
দে। [ উদ্বেগে ] অ্যাঁ। তার পর—তার পর? শ্ৰীশ, বল—বল, শীঘ্র বল—যা’ জান তুমি শীঘ্র বল—কে এসেছিল? খবর নিয়ে কে আবার এসেছিল।
শ্ৰী। পাহারাওয়ালা।
দে। যে আগে এসেছিল সে-ই?
শ্ৰী। হাঁ, সে-ই।
দে। তুমি জান তাকে?
শ্ৰী। না।
দে। কি লোক সে?
শ্ৰী। মুসলমান।
দে। সে ফিরে এসে কি বললে?
শ্ৰী। কি বলবে? কিছুই না।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। একখানা চিঠি এনেছিল।
দে। শচীন্দ্রের নিকট হ’তে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। তুমি সে চিঠি দেখেছ?
শ্ৰী। আমার কাছে সেখানা আছে।
দে। কই, কই দাও দেখি।
শ্ৰী। এই নিন। [ পত্র প্রদান ]
দেবেন্দ্রবিজয় সেই কাগজের টুকরাখানি লইয়া তখনই পাঠ করিলেন। তাহাতে লিখিত ছিল —
“মামী-মা! পত্র পাইবামাত্র আসিবেন; আপনার জন্য একখানা গাড়ী পাঠাইলাম—মামা-বাবুর অবস্থা বড় মন্দ।
শচীন্দ্র ”
—————-
[* শ্ৰীশচন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পত্নী রেবতীকে শচীন্দ্রের ন্যায় মামী-মা বলিয়া ডাকিত।]
দশম পরিচ্ছেদ
“৩৫”
দেবেন্দ্রবিজয় হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন; বিস্ময়, ক্রোধ ও আশঙ্কা যুগপৎ তাঁহার হৃদয় অধিকার করিল; এখনকার মত যন্ত্রণাময়, ভীষণ অবস্থা তিনি
জীবনে আর কখনও ভোগ করেন নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় কিঞ্চিৎ চিন্তার পর কহিলেন, “শ্ৰীশ, সে গাড়ীখান তুমি দেখেছ?”
শ্ৰীশচন্দ্র কহিল, “হাঁ, দেখেছি, গাড়ীখানা একেবারে বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ায়।”
“শচীন্দ্র প্রায় দুই ঘণ্টা গেছে?”
“হাঁ, দুই ঘণ্টা বেশ হবে।”
“তোমার মামী-মা একঘণ্টা গেছেন?”
“হাঁ।”
“কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি জানতেন?
“থানায়।”
“যেখানে শচীন্দ্র গেছে?”
“আজ্ঞে, হাঁ।”
“শচীন্দ্র কি যাবার সময় গাড়ীতে গিয়াছিল?”
“না, মহাশয়।”
“শচীন্দ্র যখন যায়, তখন পাহারাওয়ালা সঙ্গে গাড়ী আনে নাই?”
“না, গাড়ী দেখি নাই।”
“তবে হাটিয়া গিয়াছে?”
“হাঁ, তিনি দৌড়ে আপনাকে দেখতে গেলেন।”
“সে পাহারাওয়ালাও তখনই সঙ্গে ফিরে গিয়েছিল কি?”
“আজ্ঞে, গিয়েছিল।”
“শচীন্দ্রের সঙ্গে গিয়েছিল?”
“না মাষ্টার মহাশয়, পাহারাওয়ালা অন্ত পথ দিয়ে ছুটে গেল।”
“তুমি সে পাহারাওয়ালার কত নম্বর, জান?”
“জানি, ৩৫I”
“এখন যদি তুমি সে লোকটাকে দেখ, চিনতে পার?”
“আজ্ঞে হাঁ৷ ”
“তবে তুমি এখনই থানায় যাও, আমার নাম ক’রে রামকৃষ্ণ বাবুকে বল যে, আমি এখনই পয়ত্রিশ নম্বরের পাহারাওয়ালাকে চাই। তিনি তোমার সঙ্গে যেন তাকে পাঠান।”
তখনই শ্ৰীশচন্দ্র ঊর্দ্ধশ্বাসে থানার দিকে ছুটিল। দেবেন্দ্রবিজয় বহিৰ্ব্বাটীতে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।