অষ্টম পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার পত্র
“মায়াবিনী জুমেলিয়া, যথার্থই মায়াবিনী।” দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার বাটী ত্যাগ করিয়া যখন পথে বহির্গত হইলেন; আপনা-আপনি অনুচ্চস্বরে বলিলেন।
কবর অনুসন্ধান করা হইয়াছে এবং সে যে জীবিত আছে, এ কথা তিনি অবগত হইয়াছেন, তাহ জুমেলিয়া যে জানিতে পারিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় অনুভবে তাহা বুঝিয়া লইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় গিরোজা বাইএর বাটীতে যে পত্ৰখানি পাইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি সে বিষয়ের যথাসম্ভব প্রমাণও প্রাপ্ত হইলেন। কবীরের বাসায় তাহার ভগিনী বলিয়া যে সপ্তাহাধিককাল অবস্থিতি করিতেছিল, সে যে জুমেলিয়া ছাড়া আর কেহই নয়, তাহা বুঝিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বড় বিলম্ব হইল না।
পত্ৰখানি নূতন ধরণের—অতিশয় অলৌকিক! তাহার প্রতি ছত্রে জুমেলিয়ার সেই পৈশাচিক হৃদয় এবং কল্পনার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, আমরা তাহ অবিকল লিপিবদ্ধ করিলাম; —
“শ্ৰীল শ্রীযুক্ত মরণাপন্ন গোয়েন্দা
দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র
আমার হতগৰ্ব্ব প্রতিদ্বন্দী
মহাশয় সমীপেযু;—
আবার আমরা উভয়ে সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ। এইবার তোমার প্রতি আমার ভীষণ আক্রমণ অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমি ধীরে ধীরে, একটির পর একটি করিয়া, এক-একটি কাজ সমাধা করিয়া আসিতেছিলাম; এবার এখন হইতে তোমার বিরুদ্ধজনক আমার সকল উদ্যম অতি দ্রুত স্বসম্পন্ন হইবে।
তুমি কিছুই জানবে না—শুনবে না—জানতেও পারবে না, এমন ভাবে হঠাৎ আমি তোমাকে নিহত করিব। থাম—পত্রপাঠ অল্পক্ষণের নিমিত্ত একবার বন্ধ ক’রে আগে মনে মনে ভাল ক’রে ভেবে দেখ দেখি, আমি তোমাকে কত ঘৃণা করি! কেমন মেয়ে আমি!
আমি ভাবিয়াছিলাম, আঁধারে আঁধারে—গোপনে আমার এই কাৰ্য্য সিদ্ধ করিব; তাহ হইল না। আমি জীবিত আছি, তাহা তুমি জানিতে পারিয়াছ। পারিয়াছ? ক্ষতি কি?
আমি ভয় পাইবার—জুজু দেখিয়া আঁৎকে উঠিবার মেয়ে নহি! এ জুমেলিয়া! তোমাকে এক নিমেষে সাত-সমুদ্র তের-নদীর জল আস্বাদন করাইয়া আনিতে পারে।
গোয়েন্দা মহাশয় গো, এ বড় শক্ত মেয়ের পাল্লা—বড় শক্ত! বুঝিয়া-সুঝিয়া সুবিধা মত কাজে হাত দিলে ভাল করিতে। তুমি কি করিবে? তোমার পত্নীর বৈধব্য যে অবশ্যম্ভাবী।
জুমেলিয়া কেমন তোমাকে কাণে ধরিয়া ঘুরপাক খাওয়াইতেছে, বুঝিতে পারিতেছ কি? তা কি আর পার নাই!
আর বেশি দিন ঘুরিতে হইবে ন!—শীঘ্রই মরিবে—যমপুরী আলো করিবে। কেন বাপু, প্রাণটি খোয়াইতে জুমেলিয়ার সঙ্গে লাগিয়াছিলে? এই বেলা উইল-পত্র যাহা করিতে হয়, করিয়া ফেল। চিত্রগুপ্তের তালিকা-বহিতে তোমার নাম উঠিয়াছে।
যখন তুমি আর তোমার দুই-চারিজন বন্ধু আমার গোর খুড়ে শবাধার বহিরু কর, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ আমি সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হই; গোপনে তোমাদের সকল কাৰ্য্যই দেখিয়াছি—সকল কথাই শুনিয়াছি।
কেমন করিয়া তুমি আমার এ গুপ্তচক্র ভেদ করিতে পারিলে— কেমন করিয়া তুমি গুপ্তসংবাদ জানিতে পারিয়াছিলে, তাহা আমি জানি না; কিন্তু বুঝিতে পারিয়াছিলাম, থিরোজ বিবির বাড়ীর ঠিকানা অনুসন্ধানে তোমরা পাইবে, এবং তাতে আমি কোথায় থাকিব, তাহী বুঝিয়া লইতে পারিবে।
দেবেন, তুমি ধূৰ্ত্ত বটে! বুদ্ধিমান বটে! যদি তুমি সৎপথাবলম্বী ন হইতে, যদি তুমি বুদ্ধিমান হইয়া এমন নিৰ্ব্বোধ না হইতে, আমি তোমাকে সত্য বলছি, তোমার এই তীক্ষবুদ্ধির জন্য আমি তোমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসতেম।
ডাক্তার ফুলসাহেব ছাড়া আমার সমকক্ষ হইতে পারে, এ পর্য্যন্ত আর কাহাকেও দেখি নাই; কেবল তোমাকেই এক্ষণে দেখিতেছি; তা’ বলিয়া তোমাকে আমি ভয় করিয়া চলি না—চলিবও না। আমি ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, জুমেলিয়া ভয় পাইবার মেয়ে নয়।
ফুলসাহেব বয়সে বড় ছিলেন; তুমি যুবা বটে, কিন্তু বড় ধৰ্ম্মভীরু। কি ভ্রম, তোমাকে ভালবাসিতে আমার প্রাণ চায়; চাহিলে হইবে কি, তুমি যা’ চাহিবে, তা আমি জানি; তুমি যে আমাকে ভালবাসিবে না—তা আমি জানি, তাই ত তোমার উপরে আমার এত ঘৃণা।
জুমেলিয়া শুধু ঘৃণা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু হিংসা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু শঠতা করিতে জানে না—জুমেলিয়া প্রাণ দিয়া ভালবাসিতেও জানে। যদি তুমি আমার প্রতি একবার প্রেম-কটাক্ষপাত করিতে, তাহা হইলে জানিতে পারিতে, জুমেলিয়া কেমন প্রাণ সঁপিয়া ভালবাসিতে জানে, কেমন সোহাগ করিতে জানে, কেমন আদর করিতে জানে, কেমন স্বৰ্গীয় সুখসাগরে প্রেমিককে ভাসাইতে জানে; বুঝিতে পারিতে, জুমেলিয়ার মুখচুম্বনে কত সুখ পাওয়া যায়! জুমেলিয়ার বুকে বুক বাখিলে কেমন তৃপ্তি হয়।
তুমি আমাকে মনোরমার বিষয়-সম্পত্তির অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়াছ, সেইজন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি—তোমার স্ত্রীকে ঘৃণা করি—শচীন্দ্রকে ঘৃণা করি—শ্ৰীশচন্দ্রকে ঘৃণা করি—মনোরমাকে ঘৃণা করি—আরও দুই-চালিজনকে ঘৃণা করি।
তুমি আমাকে ভাল রকমে জান, আমি কোন অভিপ্রারে এত কথা লিখিতেছি, মনে মনে বুঝিয়া দেখিয়ো।
যাহাদের আমি ঘৃণা করি, তাহারা শীঘ্রই মরিবে।
আমি আমার বাসনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত বেশ একটা সদ্বপায় স্থির করিয়া রাখিয়াছি; যে সময়ে তোমাকে এই পত্র দ্বারা সতর্ক করা হইতেছে, সেই সময়ের মধ্যেই জুমেলিয়ার কাছে তুমি পরাজিত হইলে। সদা সাবধান থাকিয়ো।
আমি তোমার নারী-অরি
জুমেলা।”