ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
থিরোজা বিবি
পরদিন বেলা দশটার সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় বুদ্ধ, মুসলমান-বেশে মেটেবুরুজে থিরোজা বাইএর বাটীতে উপস্থিত হইলেন—হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
দ্বারে বারদ্বয় করাঘাত করিবামাত্র একটী সুন্দরী স্ত্রীলোক দ্বারোদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখা দিল। তাহার বয়স ছাবিবশ-সাতাশ বৎসর হইবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠনপ্রণালী পরিপাটি ও সুন্দর। রমণী সুন্দরী। কৃষ্ণতার নয়নের নিম্নপ্রান্তে অতি স্বল্প কজ্জলরেখা তাহার প্রচুরায়ত নয়ন যুগলের সমধিক শোভাবৰ্দ্ধন করিতেছে। পরিধানে প্রশস্ত সাচ্চাজরীর কাজ করা, সাঁচ্চা সন্মা-চুমকী বসান, ঘন নীলরঙ্গের পেশোয়াজ। উন্নত ও সুঠাম বক্ষোদেশে সবুজ রংএর সাটিনের কাঞ্চলী। তাহার উপরে হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ম ওড়না। টিকল নাসিকায় একটি ক্ষুদ্র নর্থ, একগাছি সরু রেশম দিয়া নথ হইতে কর্ণে টানা-বাধা। রমণী চম্পকবরণী, তাহাতে আবার নীলবসন; তাহার অনন্তরূপে সৌন্দৰ্য্যরাশি উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে। এই সুন্দরীর নাম থিরোজা বাই।
ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখীন হইয়া থিরোজা বাই জিজ্ঞাসিল, “কে আপনি মহাশয়? কাহাকে খুঁজেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখানে কবীরুদ্দীন নামে কেহ থাকে?”
থিরোজা। হা মহাশয়, থাকে বটে।
দেবেন্দ্র। তার সঙ্গে কি এখন আমার সাক্ষাৎ হ’তে পারে?
থি। না, তিনি আজ তিন-চারিদিন কোথায় গেছেন, এখনও ফিরিয়া আসেন নাই। তাঁহার চলিয়া যাইবার পরে তাঁহার এক ভগিনী আসিয়াছেন; তিনিও তাঁহার দাদার সহিত দেখা করিবার জন্য এখনও অপেক্ষা করিতেছেন।
দে। কোন দিন কবীর ফিরবে, তা কি তাহার ভগিনী জানে?
থি। বলিতে পারি না।
দে। তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ দেখি?
থি। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি।
দে। কোথায়, কোন ঘরে কবীর থাকে?
থি। ত্রিতলের একটা বড় ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন।
দে। কবীরের ভগিনী আমার পর নয়, আমি তার কাকা হই; তার সঙ্গে দেখা করতে উপরে যেতে আমার বাধা কি? তুমিও আমার সঙ্গে এস।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ছদ্মবেশে
থিরোজ বাই দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া ত্রিতলে উঠিল; তথায় যে কক্ষ কবীরুদ্দীনের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহা দেখাইয়া বাহিরে দণ্ডায়মান রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন, তন্মধ্যে কেহ নাই। একপার্শ্বে একখানা টেবিল—নিকটেই একখানা চেয়ার পড়িয়া রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় টেবিলের উপর দুইখানি পত্র পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন। থিরোজাকে ডাকিয়া বলিলেন, “কই, কেহ নাই ত!”
“চ’লে গেছেন–কখন গেলেন! কি আশ্চৰ্য্য, একি কথা! আমাকে কিছু বলে যান নি ত।” এই বলিয়া থিরোজ বাই সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল; বলিল, “তিনি ত বলিয়াছিলেন, তাহার দাদার সঙ্গে দেখা না ক’রে যাইবেন না।”
কক্ষমধ্যে টেবিলের উপর যে দুইখানি পত্র পড়িয়া ছিল, তাহার একখানি থিরোজ বাইএর, অপরখানি ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নামে।
“দুইখানি পত্র রেখে গেছে—একখানি ত আমার দেখছি; অপরখানি বুঝি তোমার—এই লও,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় একখানি নিজে লইয়া অপরখানি থিরোজার হাতে দিলেন।
থিরোজ বাই বলিল, “তাই ত, আপনার জন্যও একখান লিখে গেছেন; আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, এ ইচ্ছা বোধ হয়, তার নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কবীরের না থাকতে পারে; কিন্তু তার ভগিনী আমার ভয়ে পালাবে কেন? কবীর যে পালাবে, তা আমি জানি। কবীর ভারি বখাট্, যতদূর ফিচেল ছোকরা হতে হয়—ছোঁড়াটা আমাকে চিরকাল জ্বালিয়ে মারলে!”
থিরোজা বাই তখনই তাহার পত্ৰখানি আপন-মনে পাঠ করিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় নিজের পত্ৰখানি নিজের চোখের সম্মুথে ধরিলেন বটে, কিন্তু দৃষ্টি রাখিলেন–থিরোজার পত্রের উপর। থিরোজার পত্রে বড় বেশি কিছু লেখা ছিল না, কেবল দুই-একটা বাজে কথামাত্র।
“তাই ত, স্ত্রীলোকটি এখন কিছুদিনের জন্য এখান থেকে চ’লে গেলেন। ব্যাপার কি, কিছু ত বুঝতে পারলেম না। লিখছেন, তার ভাই কবীর এখন আর ফিরবেন না।” গিরোজ বই এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কোথায় গেল, ত’ কিছু তোমার ত্রে লিখে নাই?”
“না, কই আমার পত্রে ত তা’ কিছু লেখেন নাই—আপনার পত্রে?”
“কিছু না—কিছু না।”
“কি জানি, তাদের মনের কথা কি?”
“আমার ভয়েই তা’র পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
“কেন, আপনাকে তাদের এত ভয় কেন?”
“আছে, একটা মস্ত ভয়ের কাজ কবীর ক’রে ফেলেছে।”
“কি রকম! কি রকম?”
“ইদানীং সে কি বড় ভাবত, বড় খিটখিটে মেজাজ হ’য়ে পড়েছিল?”
“হাঁ, তা কতকটা হয়েছিল বটে।”
“মুখখানা শুকিয়ে আমসী হ’য়ে গেছল কি না, বল দেখি?”
“হাঁ, মুখখান কেমন এক রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে দেখাত।”
“বড় একটা কারও সঙ্গে কথাবার্তা, কি কোন বিষয়ে গল্প-সল্প করত না?”
“না, একেবারেই তিনি মুখ বন্ধ করেছিলেন।”
“কতদিন তুমি তাকে এ রকম দেখে আসছ?”
“প্রায় সপ্তাহ তিনেক।”
“এর ভিতর অনেক কথা আছে—শোন ত, বুঝতে পারবে।”
“বলুন।”
“হাঁ, তিন সপ্তাহ হবে, কবীর অন্ত আর একজনের নামে একখানা দলিলে জাল সই করেছে।”
“জাল!”
“হাঁ, জাল; এখন সেই কথা আদালতে উঠিবার উপক্রম হয়েছে—
সব প্রকাশ পেয়েছে।”
“অ্যাঁ, তবে ত বড় সৰ্ব্বনেশে কথা!”
“হাঁ, তবে একটা উপায় আছে।”
“কি?”
“সে যে নাম সহি করেছে, সে আমারই নাম।”
“তার পর?”
“তাই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম; এখন আমি তার সকল অপরাধ মার্জন করতে প্রস্তুত আছি; তার এ কলঙ্কের কথা ভুলে যেতে প্রস্তুত আছি; তার জন্য—তার এই বিপত্নদ্ধারের জন্য আমি শতাবধি টাকা সঙ্গেও এনেছি; মনে করেছিলাম, তাকে সেইগুলো দিয়ে যাতে ভবিষ্যতে আর এমন বদখেয়ালীতে হাত না দেয়, তা বুঝিয়ে বলব।”
“আপনি বড়ই সদাশয়, বড়ই দয়ালু আপনি।”
“দয়ালু হ’লে কি হবে? সে যে পাজীর পা-ঝাড়া—সে কি আমার দয়া চায়—না আমাকে মানে? বেকুব –বেকুব – বড়ই বেকুব বড় দুঃখের বিষয়, আমি তাকে কত ভালবাসি, সে একদিনও মনে বুঝে দেখলে না। যাই হ’ক, তুমি একটু অনুগ্রহ—”
[বাধা দিয়া] “কি বলুন, অনুগ্রহ আবার কি?”
“সে কিংবা তার সেই ভগিনী, আবার এখানে ফিরে আসতে পারে।”
“আমার তা’ ত বিশ্বাস হয় না।”
“চিঠি-পত্ৰও তোমাকে লিখতে পারে।”
“তা’ লিখতে পারেন, সম্ভব।”
“তা সে লিখ বেই লিখবে।”
“বেশ বেশ, তা’ হ’লে আমি তাকে পত্রদ্বারা আপনার কথা জানাব।”
“না, থিরোজা বিবি, তা হ’লে বড় মুস্কিল বেধে যাবে; সে ভারি একগুঁয়ে—ভারি বেয়াড় বদ্স্বভাব তার, আমার কথা এখন তার কাছে কিছুতে প্রকাশ ক’রে না—তাকে এখন কিছু ব’লে না—সে কোথায় থাকে, কেবল তাই তুমি গোপনে আমাকে পত্র লিখে জানাবে, তা’ হ’লেই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারব। আমার জন্য যে পত্ৰখানা রেখে গেছে, সে পত্রের কথা যদি জিজ্ঞাসা করে, তুমি ‘জানি না’ ব’লে একেবারে উডিয়ে দিয়ে। দাও, তোমার পত্রের একপাশে আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যাই।” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার হস্তস্থিত পত্ৰখানি লইয়া তাহার একপার্শ্বে উডেনপেন্সিলে অপ্রকৃত নামে নিজের ঠিকানা লিখিয়ু দিলেন। বলিলেন, “এখন তবে আসি—সেলাম।”
“সেলাম।”