তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অভিনব পত্র
পত্রে লেখা ছিল;–
——হইল না। অপেক্ষা করিবার সময় নাই, থাকিলে করিতাম–কি করিব, দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত দেখা হইল না। আমি কোন বিশেষ প্রয়োজনে বালিগঞ্জের দিকে চলিলাম। হয় ত সেখানে আমি ধরা পড়িতে পারি। যদি ধরা পড়ি, আমি সেইরূপে আত্মহত্যা করিব; তুমি তা জান। আমার মৃত্যুর দিন হইতে ত্রিশ দিন পৰ্য্যন্ত আমি কবরের মধ্যেও জীবিত থাকিব; সেই সময়ের মধ্যে তুমি আমায় উদ্ধার করিবে। যদি আমাকে উদ্ধার করিতে তোমার আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের এক রাত্রি পূৰ্ব্বে বরং চেষ্টা পাইবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের এক রীত্রি পরে চেষ্টা না পাও; তাহা হইলে চেষ্টা বিফল হইবে।
কবর হইতে আমাকে বাহির করিয়া যদি দেখ, দাতকপাট লাগিয়াছে, তবে জোর করিয়া ছাড়াইবে। তাহার পর সেই শিশি হইতে আট ফোট ঔষধ আমার মুখে দিবে। যেন আট ফোটার এক ফোটা কম কি বেশি না হয়, খুব সাবধান।
তাহার পর আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করিবে। তুমি যদি আমার এই সকল অনুরোধ উপেক্ষা না কর, আধ ঘণ্টার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পারিব। তুমি বলিয়াছ, আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাস। এমন কি, যদি আমি তোমার স্ত্রী হই, তুমি আমার আগেকার অসংখ্য পাপ—যে সকল আমি স্বহস্তে করিয়াছি, তুমি গ্রাহ্যই করিবে না।
বাঁচাও—আমায় রক্ষা কর; আমি তোমারই হইব। স্মরণ থাকে যেন—পুর্ণমাত্রায় ত্রিশ দিন—এক মুহূৰ্ত্ত উত্তীর্ণ হইয়া গেলে আর তুমি আমায় কিছুতেই বাঁচাইতে পরিবে না—আমি মরিব।
তুমি আমার জীবন দান কর—এ জীবন চিরকাল তোমারই অধিকারে থাকিবে।
তোমার প্রেমাকাঙ্খিণী
জুমেলা।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বন্দোবস্ত
রামকৃষ্ণ বাবু সবিস্ময়ে বলিলেন, “একি অদ্ভুত কাণ্ড! দেবেন্দ্র বাবু, সত্যই সে কবর থেকে উঠে গেছে না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত তাহাই বিশ্বাস।”
“কখনও তা’ হ’তে পারে?”
“হ’তে পারে কি? হয়েছে।”
“শ্রীশচন্দ্র একটা বড় ভুল করেছে, যার নামে পত্র লেখা হয়েছে, তার নামটা যদি সেই সকল টুকরা কাগজগুলা থেকে কোন রকমে বেছে বের করতে পারত—বড়ই ভাল হ’ত।”
“সন্ধান করেছিল, পায় নি। এখন এক কথা হচ্ছে, রামকৃষ্ণ বাবু।”
“কি?”
“এস, আমরা জুমেলিয়ার কবরটা আগে খুড়ে দেখি, ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে; তার পর অন্ত কথা।”
“বেশ, আমি প্রস্তুত আছি।”
“আজই বৈকালে।”
“হাঁ।”
“বেল তিনটার সময়ে এখানেই হ’ক, কি সেখানেই হ’ক, আমাদের দেখা হ’বে।”
“এখানে তুমি ঠিক বেলা দু’টার সময়ে অতি অবশ্য আসবে; যাবার সময়ে গঙ্গাধরকে সঙ্গে নেওয়া যাবে। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে তার বাড়ী হ’তে গাড়ীতে তুলে নেব, তার পর সকলে মিলে গোরস্থানে যাওয়া যাবে।”
“আমার গাড়ী আমি নিয়ে আসব, সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না; আমি ঠিক সময়েই আসব। পারি যদি শচীন্দ্রকে সঙ্গে আনব। তুমি
তমধ্যে ঠিক বন্দোবস্ত ক’রে ফেল।”
“এদিককার যোগাড় আমি সব ঠিক ক’রে রাখব।”
“দেখে, আমার কথা যেন স্মরণ থাকে; নিশ্চয়ই কবর-গহবর শূন্য প’ড়ে আছে, দেখতে পাবে।”
“বেশ বেশ, দেখা যাবে, দেবেন্দ্র বাবু।”
“জুমেলিয়া তার মৃত্যুর পরেও যে আমার অনুসরণ করবে ব’লে ভয় দেখিয়েছিল—সে কথা কি আমি তোমায় আগে বলি নাই?”
“কই না।”
“তার কবর সম্বন্ধে আমার সতর্ক থাকার এই এক কারণ; এই জন্যই আমি তার কবরের উপর বিশেষ নজর রেখেছিলাম। এখন আমি তার সেই ভয়-প্রদর্শনের প্রকৃত কারণ বুঝতে পারছি; এইজন্যই সে বলেছিল, তার মৃত্যুর পরেও সে তার প্রতিজ্ঞ পুর্ণ করবে।”
“তখন বুঝি, তোমার মনে এ ধারণা হয় নাই? এখন তুমি তার মনের অভিপ্রায় বেশ বুঝতে পেরেছ?”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সমাধিক্ষেত্র
ঠিক বেলা দুইটার সময়ে পূৰ্ব্বোল্লিখিত থানার সম্মুখে একখানি গাড়ী আসিয়া দাঁড়াইল; তন্মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় ও তাঁহার ভাগিনেয় শচীন্দ্র বসিয়াছিলেন।
তখন রামকৃষ্ণ বাবু সাদাসিধে পরিচ্ছদে এবং গঙ্গাধর বাবু [অন্য একজন ইনস্পেক্টর] পুলিশের ইউনিফৰ্ম্মে দেবেন্দ্রবিজয়ের গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন। কোচ ম্যান গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে গাড়ীতে তুলিয়া লওয়া হইল।
যথা সময়ে সকলে সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। যথায় নারী-পিশাচী ডাকিনী জুমেলিয়াকে প্রোথিত করা হইয়াছিল, তথায় সকলে উপস্থিত হইলেন।
তথায় দুইজন ধাঙ্গড় তাহাদের কোদাল, সাবল ইত্যাদি যন্ত্র লইয়া উপস্থিত ছিল।
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট অনুমতি করিলে তাহারা জুমেলিয়ার কবর খননে প্রবৃত্ত হইল।
যখন কবর হইতে শবাধার উত্তেলিত ও উন্মুক্ত হইবে, তখন তাহাদিগের সম্মুখে কি যে একটা অভিনব দৃপ্ত প্রদর্শিত হইবে, তাহাই তখন সেই পুলিশ-কৰ্ম্মচারিত্রয় ও গোয়েন্দাদ্বয় ভাবিতেছিলেন। আগ্রহপূর্ণলোচনে উদ্গ্ৰীব হইয়া প্রত্যেকেই নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভূগর্ভ হইতে শবাধার বহিষ্কৃত হইল – শবাধার অত্যন্ত ভারযুক্ত; তদনুভবে তথাকার সকলেই বুঝিতে পারিলেন, তাহা শূন্য নহে, সেই শবাধার মধ্যে জুমেলিয়ার মৃতদেহ আছে। দেবেন্দ্রবিজয় যথেষ্ট অপ্রতিভ ও চিন্তাযুক্ত হইলেন। সত্যই কি তাহাকে তাহাদের নিকট অপমানিত হইতে হইল? ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া, পরিহাসব্যঞ্জক ভ্রভঙ্গি করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় অনুমানে এই রহস্তের ভাব এখন অনেকটা বুঝিয়া লইতে পারিলেন। পরক্ষণে যখন সেই শবাধারের আচ্ছাদন উন্মুক্ত করা হইল, তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের স্নান মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল—সকলেরই কণ্ঠ হইতে এক প্রকার বিস্ময়স্থচক শব্দ নিঃস্থত হইল। সকলেই চমকিতচিত্তে, বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে শবাধারের প্রতি চাহিয়া রছিলেন। তাঁহারা সেই শবাধারে শব দেখিতে পাইলেন বটে, কিন্তু সে শব ত জুমেলিয়ার নহে-স্ত্রীলোকের নহে–পুরুষের ভদ্রোচিত পরিচ্ছদধারী কোন সুন্দর যুবকের—এ কি হইল!
দেবেন্দ্রবিজর ভিন্ন আর সকলেই এককালে স্তম্ভিত ও প্রায় বিলুপ্তচৈতন্ত্য হইয়া পড়িলেন।
অনেকক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু প্রকৃতিস্থ হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, এ কি ব্যাপার হে! কিছু বুঝতে পার কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কছিলেন, “যা’ ঘটেছে, তা সহজেই আমি বুঝতে পেরেছি।”
রা। তা’ তুমি পার; এখন আমাদের বুঝা ও দেখি; আমার ত বোধ হচ্ছে, আমি এখন স্বপ্ন দেখছি।
দে। [ মৃতদেহ নির্দেশে ] এই লোকটাকেই জুমেলিয়া নিশ্চয়ই সেই পত্ৰখানা লিখে থাকবে; এই লোকটারই সে স্ত্রী হ’তে চেয়েছিল। তার কথামত এই যুবক কাজ করে। জুমেলিয়া একে যেমন যেমন ব’লে দিয়েছিল, এ লোকটি সেই সেই উপায়ে জুমেলিয়াকে উদ্ধার ক’রে থাকবে। তার পর সেই পিশাচী তার এই উদ্ধারকতাঁকে হত্যা করেছে; নিজের শবাধারে এই মৃতদেহ পুর্ণ ক’রে নিজেরই কবর-গহবরে প্রোথিত ক’রে শেষে পলায়ন করেছে। আমার বিশ্বাস, জুমেলিয়া এখন এই দেশেই আছে; তার কারণ এই যে, এ ব্যক্তিই জুমেলিয়াকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছিল, এ তার এই গুপ্তরহস্য ও তাহার জীবিত থাকার কথা অবগত ছিল; পাছে এই লোকটা পরে সেই সকল কথা অন্তের কাছে প্রকাশ করে, এই ভয়ে জুমেলিয়া ইহাকে হত্যা করেছে। মনে করেছে সে, সে এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ হ’তে পেরেছে; সকলেই এখন বুঝবে, জুমেলিয়ার মৃত্যু হয়েছে, এখন আর কেহ তার সন্ধানে ফিরবে না।
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সেখানকার সকলেই অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।
রামকৃষ্ণ বাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, তোমার সেই পত্রের সঙ্গে একটা বিষয় ঠিক মিলছে না; তোমার সেই পত্রের হিসাবে যদি ধরা যায়, তা’ হ’লে এই লোকটার মৃতদেহ পাঁচদিন এইখানে আছে, কেমন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হঁ৷ ”
বুামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এ মৃতদেহ পাঁচদিনের বলে কিছুতেই বোধ হয় না; বেশ টাটুকা রয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এর দুটী কারণ আছে।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট জিজ্ঞাসিলেন, “পাঁচদিনের মড়া এমন টাট্কা থাকবার কারণ কি, বলুন দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “প্রথম কারণ, লোকটাকে হঠাৎ হত্য করা হয়েছে, শরীরের সমস্ত রক্ত বাহির হইতে পারে নাই। দ্বিতীয় কারণ, মৃত্যুর পরেই বিনা-বিলম্বে কবরস্থ করায় বাহিরের বাতাস অধিকক্ষণ এ মৃতদেহে সঞ্চালিত হ’তে পারে নাই।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বলিলেন, “তা যেন হ’ল, কিন্তু এখন এ খুনটার তদন্ত করা বিশেষ আবশ্যক। জুমেলিয়ার দ্বারা কি প্রকারে এ খুন হ’তে পারে? তাকে যখন কবর দেওয়া হয়, সঙ্গে কোন অস্ত্র-শস্ত্র দেওয়া হয়েছিল কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিল্লেন, “স্বীকার করি, ছিল না; কিন্তু এই হতভাগ্য যখন জুমেলিয়াকে উদ্ধার করতে আসে, তখন যে এর কাছে কোন প্রকার সাংঘাতিক অস্ত্র ছিল না—এ কথা সম্ভব নয়। ডাকিনী নিজ অভীষ্টসিদ্ধ করবে ব’লে কোন ছলে ইহারই সেই অস্ত্র গ্রহণ ক’রে থাকবে।
ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এস, এখন দেখা যাক, লোকটা কে। সে সন্ধান আগে ক’রে তার পর কিরূপে খুন হয়েছে, সে বিষয়ের মীমাংস হবে।
শবাধার হইতে শবদেহ বাহির করা হইল; শচীন্দ্র তৎ-পরীক্ষার্থে নিযুক্ত হইল; অন্তান্ত সকলে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
মৃতব্যক্তির পরিধানে সূক্ষ্ম দেশীবস্ত্র, ফুলদার মোগল-আস্তিন জামা, সাঁচ্চাজরীর কাজ করা টুপী, দক্ষিণ হস্তের অনামিকা ও মধ্যমাঙ্গুলিতে দুইটা হীরকাঙ্গুরী, জামার বুক পকেটে সোণার ঘড়ী ও চেইন। ভিতর কার পকেটে একখানি কলম-কাটা ছুরি, একটা রীংএ এক গোছা চাবী, বিশ টাকার একখানি নোট, চারিট টাকা, দুইটা সিকি, তিনটা দ্রুয়ানী, দুখানি রেশমী ( একখানি রংদার—একখানি সাদা ) রুমাল, একটা ক্ষুদ্র পিস্তল ও কয়েকখানি পত্র।
পত্রগুলি অন্তান্ত বিষয়-সম্বন্ধে লিখিত। সকলগুলির শিরোনাম ‘সেখ কবীরুদিন, সাং খিদিরপুর, মেটেবুরুজ * নং * * * লেন, লিখিত রহিয়াছে।
সেই মৃত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা সম্বন্ধে আর কাহারও কোন সন্দেহ রহিল না। দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রামকৃষ্ণ বাবু, জুমেলিয়াকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে, তা আমি অনুমানে কতকটা বুঝেছি।”
রামকৃষ্ণ বাবু জিজ্ঞাসিলেন, “কোথায়?”
দেবেন্দ্র। থিরোজা বিবির বাড়ীতে ঐ ঠিকানায় থিরোজা বিবির বাড়ী। রামকৃষ্ণ বাবু, এখন ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে, সব বুঝতে পেরেছ কি?
রাম। বড়ই অদ্ভূত, আমি হতবুদ্ধি হ’য়ে গেছি!
দে। জুমেলিয়াকে এখন কি বোধ কর? এমন অদ্ভূত স্ত্রীলোক আর কোথায়ও দেখেছ কি?
রা। না, পরেও যে কখন দেখতে পাব—বিশ্বাস হয় না। দেবেন্দ্র বাবু, তুমিও তাকে কিছু না-কিছু ভয় কর; কেমন কি না?
দে। তার বিক্রম আর বাহাদুরীকে আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, আর আমার স্ত্রীর উপরে তার যেরূপ গুঢ় অভিসন্ধি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে; কিন্তু ভয়? ‘ভয়’ কাকে বলে, তা আমি জানি না— ভয়’ শব্দটি সুমাৱ জন্মপত্রিকায় লেখা নাই।
রা। এখন তুমি কি করবে?
দে। তার সন্ধানে যাব।
রা। সন্ধান পাবে কি?
দে। সম্ভব—ন পেতে পারি; কিন্তু তা’ হ’লে এই আমার জীবনে প্রথম অকৃতকাৰ্য্যতা।