অষ্টম পরিচ্ছেদ
শেষ
বৈঠকখানা গৃহে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবিষ্ট হইলেন, তথার কেহ নাই। একপার্শ্বে একটা অৰ্দ্ধমলিন শয্যা ছিল, তাহার উপরে ক্লান্তভাবে বসিয়া পড়িলেন। অনেকক্ষণ পরে উদ্যানের বাহিরে একটা সচল গাড়ীর ঘর্ঘর ধ্বনি উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় গবাক্ষ দিয়া জ্যোৎস্নালোকে দেখিলেন, একখানি গাড়ী ফটক দিয়া উদ্যান-মধ্যে আসিল; বুঝিতে পারিলেন, তন্মধ্যে জুমেলিয়া ও তাহার পত্নী আছে, উপরে যে ব্যক্তি বসিয়াছিল, সে সেই গিরিধারী সামন্ত।
গাড়ীখান ক্রমে অট্টালিকার দ্বারসমীপ্লাগত হইয়া দাঁড়াইল—লাফাইয়া গিরিধারী সামন্ত অগ্ৰে ভূতলে অবতরণ করিল।
“পাহাড় সিং! পাহাড় সিং!” জুমেলা চীৎকার করিয়া ডাকিল। পাহাড় সিং উত্তর করিল না। কে উত্তর দিবে?
গিরিধারী সামন্ত বলিলেন, “মরুক্ ব্যাটা—হতভাগা পাজী! গেল কোথায়?”
জুমেলিয়া বলিল, “হয় ত ব্যাট সিদ্ধি গাঁজা খেয়ে, বেহুস হয়ে পড়ে আছে—মরুক সে! গিরিধারী, তুমি আমার ভগিনীকে তুলে নিয়ে যাও।”
“ভগিনী! জুমেলিয়ার?” মৃদুগুঞ্জনে ডিটেক্টিভ আপনা-আপনি বলিলেন–তাঁহার আপাদমস্তক বিকম্পিত হইল।
গিরিধারী জিজ্ঞাসিল, “ম’রে গেছে না কি?”
ঈষদ্ধান্তে জুমেলিয়া বলিল, “মরেছে? না—এখনও মরে নি; যাও ইহাকে তুলে নিয়ে যাও।”
গিরি। কোথায় নিয়ে রাখব?
জু। বৈঠকখানা ঘরে।
বৈঠকখানার ভিতরে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদের অপেক্ষায় ছিলেন। গিরিধারী সেই কক্ষেই আসিবে জানিয়া, দ্বারপার্শ্বে লুক্কায়িত রছিলেন। তখনই সংজ্ঞাহীন রেবতীকে লইয়া গিরিধারী তথায় প্রবিষ্ট হইল। তথায় আলো না থাকায় সে দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিতে পাইল না। পশ্চিমপার্শ্বস্থিত অৰ্দ্ধোন্মুক্তবাতায়নপ্রবিষ্ট জ্যোৎস্নালোকে ঘরটি অস্পষ্টভাবে আলোকিত; তৎসাহায্যেই গিরিধারী শয্যাটী দেখিতে পাইল, তদুপরি রেবতীকে রাখিয়া বহির্গমনোদ্যোগ করিল।
এমন সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহাকে আক্রমণ করিলেন; যেরূপে তিনি পাহাড় সিংকে বন্দী করিয়াছিলেন, সেইরূপে গিরিধারীকেও বন্দী করিলেন; কোন শব্দ হইল না; অথচ কাৰ্য্যসিদ্ধ হইল। তাহার মৃতকল্পদেহ পালঙ্কের নিম্নে রাখিয়া দিলেন।
তৎপরেই তিনি রেবতীর নিকটস্থ হইলেন, তাঁহার মুখের নিকট মুখ লইয়া সেই অস্পষ্টীলোকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, রেবতী এখন ক্লোরফৰ্ম্মের দ্বারাই অচেতন আছে মাত্র। আশঙ্কার কোন কারণ নাই। দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “হতভাগিনি! তোমার দুর্দিন এইবার শেষ হইবে।”
বাহির হইতে জুমেলিয়া ডাকিল, “গিরিধারি! গিরিধারি!”
দেবেন্দ্রবিজয় গিরিধারীর কণ্ঠস্বর অনুকরণ করিয়া বলিল, “আবার কি –কি হয়েছে? চ’লে এস না তুমি।”
জুমেলিয়া বাহির হইতে বলিল, “এখান থেকে ঔষধের বাক্সট আর কাপড়গুলো নিয়ে যাও।”
পূৰ্ব্ববৎ দেবেন্দ্রবিজয়, “রেখে দাও—তোমার কাপড় আর বাক্স, আমি তোমার বোনকে নিয়ে দস্তুরমত একটা আছাড় খেয়েছি।” শুনিতে পাইলেন, জুমেলিয়া তাহার কথা শুনিয়া অত্যন্ত হাসিতেছে; গবাক্ষ দিয়া দেখিলেন, জুমেলিয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল; তাহার হস্তে সেই কিরীচ উন্মুক্ত রহিয়াছে, চন্দ্ৰকরে সেটা বিদ্যুদ্ধত ঝক ঝক করিতেছে।
ক্রমে জুমেলিয়া বৈঠকখানা গৃহের নিকটস্থ হইল; দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিম্নকণ্ঠে ডাকিল, “গিরিধারী!”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গুপ্ত লণ্ঠন বাহির করিয়া স্প্রীং টিপিয়া দিলেন; উজ্জল স্বতীব্র আলোকরশ্মিমালা জুমেলিয়ার চক্ষু ধাঁধিয়া তাহার মুখের উপরে পড়িল।
কর্কশকণ্ঠে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “গিরিধারী এখানে নাই; তোমার অপেক্ষায় আমিই আছি, জুমেলা।”
“দে-বে-দ্র-বি-জ-য়!” জুমেলিয়া সবিস্ময়ে বলিল।
“হাঁ, দেবেন্দ্রবিজয়—তোমার যম—তোমার শক্ৰ—তোমার পরম শক্ৰ ৷ এক পা যদি নড়বে, এখনই তোমাকে গুলি করব—এতদিন তুমি আমাকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছিলে; তোমার জন্য কতদিন আমার অনাহারে কেটে গেছে; এমন কি নানাপ্রকার দুর্ঘটনায় আমার মস্তিক্ষও তুমি বিকৃত ক’রে দিয়েছ; আজ তোমার নিস্তার নাই; দেবেন্দ্রের হাতে তোমার কিছুতেই নিস্তার নাই—এক পা অগ্রসর হইলেই গুলি করব।” দেবেন্দ্রবিজয় ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিলেন; তাঁহার চক্ষু দিয়া তখন যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছিল।
জুমেলিয়া ভয় পাইল না; তাহার অখণ্ড প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া স্মিতমুখে বলিতে লাগিল, “মাইরি! গুলি করবে? তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়! জুমেলিয়াকে? পার না—তোমার সাধ্য নয়—তোমার হাতে মৃত্যুতেও জুমেলিয়ার কলঙ্ক আছে। দেবেন! তোমার হাতে মরব! হায়! হ’য়ে কেন মরি নাই! মাতৃস্তন্য – কেন আমার বিষ হয় নাই! যাকে ভালবাসি, তার হাতে আমি মরব! কষ্টকর— বড় কষ্টকর—সে মৃত্যু বড় কষ্টকর, দেবেন! দেবেন, এখনও বলছি, তোমাকে আমি ভালবাসি—আগে বাসতাম, এখনও বাসি— – ম’রেও ভুলতে পারব, এমন বোধ হয় না। ভালবাসি বলিয়াই ত আমি আজ না এই বিপদগ্রস্ত; নতুবা এতদিন তোমাকে আমি কোন কালে এ সংসার থেকে বিদায় দিতাম। অনেকবার মনে করেছি— পারি নাই; ঐ মুখ দেখেছি—ভুলে গেছি—সব ভুলে গেছি। আপনাকে ভুলে গেছি, আপনার কর্তব্য ভুলে গেছি, জগৎ-সংসার ভুলে গেছি। শোন দেবেন, যদি তুমি আমার প্রতিদ্বন্দী না হ’তে, তোমার অপেক্ষ সহস্ৰগুণে শ্রেষ্ঠ কোন গোয়েন্দা আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিত, সে কখনই আমার কেশস্পর্শও করতে পারত না। অবলীলাক্রমে আমি তাহাকে নিহত করতেম। এই তুমি—তোমার রূপে—তোমার গুণে যদি না আমি ভুলতেম—তা’ হ’লে তুমি এতদিন কোথায় থাকতে—কি হ’ত তোমার, কে জানে? এতদিন তুমি আবার কোথায় নূতন জন্মগ্রহণুy করতে। তোমাকে ভালবাসিয়াই ত সৰ্ব্বনাশ করেছি—নিজের মৃত্যু— নিজের অমঙ্গল নিজে ডেকেছি। কি করব? মন আমার বশীভূত নয়। আমি মনের দাস। যখন তুমি তোমার গুরু অরিন্দম গোয়েন্দার সাহচৰ্য্য কর, আমার গুরুই বল, স্বামীই বল—ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার কর, তখন হ’তে তোমাকে আমি কি চোখে দেখেছি, তা জানি না। দেবেন, এটা যেন চিরকাল স্মরণ থাকে—যে জুমেলা তোমার পরম শক্ৰ, সেই জুমেলাই তোমার প্রেমাকাজিহ্মণী; যে জুমেলার তুমি পরম শক্ৰ, সেই জুমেলার তুমি প্রাণের রাজা। তোমার হাতে মৰ্বতে, মৃত্যুযন্ত্রণা বড় ভয়ানক হবে; নিজে মরি—দেখ—তোমার সামনে মরি—হাসতে হাসতে মরতে পারব। তুমিও জুমেলার মৃত্যু হাসিমুখে দেখতে থাক, জুমেলাও তোমাকে দেখতে দেখতে হাসিমুখে মরুক।” এই বলিয়া জুমেলিয়া সেই কিরীচ নিজের বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিল। ভলকে ভলকে অজস্ৰ শোণিত নিঃসৃত হইতে লাগিল। বুকের ভিতরে অত্যন্ত যন্ত্রণা হইতে লাগিল, করতলে বুকের সেই ক্ষতস্থান চাপিয়া বাত্যাবিচ্ছিন্ন বল্লরীর ন্যায় জুমেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে গৃহতলে পড়িয়া গেল। মুখ ও দৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে মৃত্যুচ্ছায়ান্ধকারমান হইয়া আসিল। তখনও সেরূপ প্রবলবেগে তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ পরিহিত বসন ও গৃহতল প্লাবিত করিয়া শোণিতপাত হইতে লাগিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন বাতবিকম্পিত, রক্তচন্দনাক্ত রক্তপদ্মবং জুমেলিয়া। সেইখানে পড়িয়া লুটাইতে লাগিল—তখনই তাহার মৃত্যু হইল।
দেবেন্দ্রবিজয়ের পরম শত্রু এইখানে এইরূপে পরাভূত ও নিহত হইল।