ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শেষ উদ্যম
যখন দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, লোকটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছে; জিজ্ঞাসিলেন, “কি হে ভদ্রলোক! আমি এখন তোমাকে যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করব, ঠিক ঠিক তার উত্তর দেবে কি? যদি না আমার হাত থেকে সহজে নিস্তার পাবে না—তোমার জিহ্বাটা টেনে ছিড়ে ফেলে দিব।”
সেই লোকটা ভয়ে ভয়ে বলিল, “আপনি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান?”
দেবেন্দ্র। জুমেলা কি প্রকারে মুক্তি পাইল?
লোক। আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি।
দে। সেখানে আর একটা যে স্ত্রীলোক ছিল, সে কিছু বলে নাই?
লো। আমি আগেই তাকে তার অলক্ষ্যে ক্লোরফৰ্ম্ম ক’রে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি।
দে! গাড়ী! কোথাকার গাড়ী?
লো। পুৰ্ব্বদিক্কার পথের ধারে আগে একখানা গাড়ী এনে ঠিক করে রেখেছিলেম।
দে। কার আদেশে?
লো। জুমেলিয়ার।
দে! কি জন্য গাড়ী এনে রেখেছিলে?
লো। জুমেলিয়ার মুখে শুনলেম, তার সঙ্গে আপনি কোথা যাবেন বলেছিলেন।
দে। সে গাড়ীতে আর কে আছে?
লো। গিরিধারী নামে আমারই একজন বন্ধু—আমার সেই বন্ধুকেই আপনার সঙ্গী লোকটা নীচে বেঁধে ফেলে রেখেছিল; আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করি; তার পর আপনাদের এখানকার ব্যাপার চুপিসারে এসে দেখি; সুবিধাক্রমে কাজ শেষ করি—তারা এখন সব চ’লে গেছে।
দে। তুমি গেলে না কেন? তুমি যে বড় থেকে গেলে?
লো। আপনাকে খুন করবার জন্য।
দে। আমাকে খুন করিয়া তোমার লাভ?
লো। জুমেলিয়ার লাভ।
দে। তা’তে তোমার কি?
লো। জুমেলিয়ার লাভে আমার লাভ।
দে। গাড়ীখানা কোথায় গেল?
লো। দমদমার দিকে।
দে। দমদমার কোথায়—কোন ঠিকানায়?
লো। ঠিকানা ঠিক জানি না—তবে বেলগাছি ছাড়িয়ে যেতে হবে।
দে। বেলগাছি ছাড়িয়ে কত দূর যেতে হবে?
লো। শুনেছি, বেশি দূর না—দু-চারখানা বাগানের পরেই একটা গেটওয়ালা বাগান আছে, সেই বাগানের ভিতরে।
দে। ও বুঝেছি! হরেকরামের বাগান বুঝি?
লো। হাঁ—হাঁ—ঠিক ঠাওরেছেন।
দে। যদি তা’ না হয়—যদি মিথ্যা ব’লে থাক—তোমায় আমি—
বাধা দিয়া আহত ব্যক্তি বলিল, “আমি মিথ্যাকথা বলি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “জুমেলিয়ার সঙ্গে তোমার আর তোমার বন্ধুর কতদিন পরিচয় হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ হ’বে।”
“সে বাগানে আর কেউ আছে?”
“একজন দরওয়ান—তার নাম পাহাড় সিং।”
“জুমেলা আর তোমার বন্ধু গিরিধারী কতক্ষণ গেছে?”
“আমি যখন আপনার সঙ্গীকে গুলি করি, তার একটু আগে।”
“আমাকে খুন করতে তুমি থেকে যাও, কেমন? আমাকে খুন, করবার কারণ কি? জুমেলিয়ার লাভ কি রকম?”
“জুমেলা যাবার সময় ব’লে গেছে, আপনাকে খুন করলে সে আমাকে বিবাহ করবে।”
“তুমি কি তাকে বিশ্বাস কর?”
“আগে করেছিলাম বটে।”
শচীন্দ্রের ক্রমে জ্ঞান হইতে লাগিল; অল্পক্ষণ পরে উঠিয়া বসিল। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, ‘শচী, চলিতে পারিবে?”
শ। পারিব।
দে। জুমেলা এখন কোথায় যাইবে আমি জেনেছি – আমি এখনই তার সন্ধানে চললেম; তুমি এখন এখানে থাক—যতক্ষণ না আমি ফিরে আসি, ততক্ষণ তুমি এইখানেই থাক; সুবিধামত কোন পাহারাওয়ালাকে রাস্তায় পেলে তোমার সাহায্যার্থ তাকে এখানে পাঠিয়ে দিব।
দেবেন্দ্রবিজয় এই বলিয়া ক্ষিপ্ৰপদে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।
অতি অল্পক্ষণে তিনি ছুটিয়া আসিয়া জগুবাবুর বাজারের পথে পড়িলেন, তথায় দুই-একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী তখনও আরোহীর অপেক্ষায় ছিল। দেবেন্দ্রবিজয় লাফাইয়া একখানি- গাড়ীর কোচ বক্সে গিয়া উঠিলেন; ঘোড়ার লাগাম ও চাবুক স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া গাড়ী জোরে হাঁকাইয়া দিলেন। গাড়োয়ান তাহার সেই অদৃষ্টপুৰ্ব্ব কাৰ্য্যকলাপ দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল; দেবেন্দ্রবিজয়কে পাগল অনুমানে শঙ্কিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিল, “গাড়ী দমদমায় যাবে, বিশেষ দরকার। বাধা দিয়ো না; বাধা দাও—গাড়ী থেকে ফেলে দিব; চুপ ক’রে বসে থাক; যদি দশ টাকা ভাড়া পেতে চাও- কোন কথাটি ক’রো না, চুপ্ ক’রে বসে থাক।”
গাড়োয়ান অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া চুপ্ করিয়া বসিয়া রহিল। সে দুইদিনে কখন দশ টাকা রোজগার করিতে পারে নাই, এক রাত্রেই দশ টাকা পাইবে শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল।
গাড়ী নক্ষত্ৰবেগে ছুটতে লাগিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
উদ্যমের শেষ
দেখিতে দেখিতে গাড়ীখানা শ্যামবাজার অতিক্রম করিয়া অতি অল্প সময়ের মধ্যে দমদমায় আসিয়া পড়িল। এখনও সেইরূপ তীরবেগে গাড়ী ছুটিতেছে।
যখন সেই গাড়ী হরেক্রামের বাগানের নিকটবৰ্ত্তী হইয়াছে, তখন গাড়ীখানার সম্মুখের একখানি চাকা খুলিয়া গেল-গাড়ী দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় কি এখন চুপ করিয়া থাকিতে পারেন—লাফাইয়া ভূতলে পড়িলেন; নিৰ্ব্বাক্ গাড়োয়ানের হাতে একখানা দশ টাকার নোট ফেলিয়া দিয়া রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় মরুদ্বেগে ছুটিতে লাগিলেন—ক্ষণকালের মধ্যে হরেক্রামের উদ্যান-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উদ্যানের মধ্যে আসিয়া পশ্চিমাভিমুখে চলিলেন, কিয়দর গমন করিয়া একটা দ্বিতল অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন, তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বামপার্শ্বস্থ সোপানীতিক্রম করিয়া উপরে উঠিলেন। বারান্দার বসিয়া পরম নিশ্চিন্তমনে পাহাড় সিং তাম্রকুটধর্ম পান করিতেছিল—দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইলেন। পাহাড় সিং হুঁকার যেমন একট লম্বা টান দিতে আরম্ভ করিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে তাহার গলদেশ টিপিয়া ধরিলেন। সুখটানে বাধা পড়িল—হু কার কলিকা ফেলিয়া পাহাড় সিং গোঁ গোঁ করিতে লাগিল—ক্রমে অজ্ঞান হইয়া পড়িল, চক্ষু উল্টাইয়া গেল। তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গলদেশ ছাড়িয়া দিলেন, তাহারই পরিহিত বস্ত্রে তাহার হস্তপদ বন্ধন করিলেন ও মুখবিবরে খানিকটা কাপড় প্রবেশ করাইয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; তাহার পর দ্রুতপদে নিম্নে অবতরণ করিলেন।