পঞ্চম পরিচ্ছেদ
একি ইন্দজাল!
চক্ষুরুন্মীলন করিয়া রেবতী যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
জুমেলিয়া রেবতীকে ক্লোরোফৰ্ম্ম করিয়া এখানে লইয়া আসে; সে ঘোর কাটিতে-না-কাটিতে সে আবার নিজের অমোঘ ঔষধ প্রয়োগ করে, তাহাতে রেবতী সেই অবধি সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞাহীন। প্রথমে তিনি দেখিলেন, তিনি যে কক্ষে শায়িত আছেন—সে কক্ষ তাহার অপরিচিত—তাহার সম্মুখে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান—দেবেন্দ্রবিজয়ের পার্শ্বে ম্লানমুখে শচীন্দ্র এবং কিছুদূরে হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ী দেওয়া লোহশূঙ্খলে আবদ্ধ জুমেলিয়া একখানি চেয়ারে বিনতমস্তকে বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন আছ?”
রেবতী! ভাল আছি।
দেবেন্দ্র। উঠিতে পরিবে কি?
রে। পারিব। [ দণ্ডায়মান ]
দে। চলিতে পারিবে?
রে। হাঁ, কেবল মাথাটা একটু ভারি বোধ হচ্ছে।
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় দুই-একটি কথাতে অতি সংক্ষেপে এ পর্য্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সকলই রেবতীকে বলিলেন; কেবল জুমেলিয়ার সেই অবৈধ প্রেম-প্রস্তাব সম্বন্ধে কোন কথার উল্লেখ করিলেন না; তজ্জন্য ডাকিনী জুমেলিয়া বারেক সন্তুষ্টনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখপ্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে বলিলেন, “এখন তোমার হাতে জুমেলার ভবিষ্যতের ভালমন্দ নির্ভর করছে; আমি জুমেলার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, তোমার কথামত আমি কাজ করব; তুমি উহাকে মুক্তি দিতে চাও—দিব, না চাও–না দিব, যা তোমার ইচ্ছা। স্বীকার করি, জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুখ থেকে ত্রাণ করেছে; কিন্তু সেই জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুথে তুলে দিয়েছিল; এখন আমি এখান হ’তে বাহিরে যাচ্ছি—এখন এখানে থাকা আমার আবশ্যক করে না; আমার সাক্ষাতে জুমেলা তোমার নিকটে কোন প্রার্থনা জানাতে লজ্জিত হবে; তুমিও কিছুই ভালরূপে মীমাংসা ক’রে উঠতে পারবে না; তবে বাহিরে যাবার আগে তোমাকে একটি কথা ব’লে রাখা প্রয়োজন। সাবধান, তুমি জুমেলিয়াকে স্পর্শ করিয়ো না!—এমন কি নিকটেও যাইয়ো না।”
দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া, তথা হইতে বহির্গত হইয়া বাহির হইতে কবাটে শিকল দিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ও শচীন্দ্র বাহিরে অপেক্ষায় রহিলেন।
পনের মিনিট অতিবাহিত হইল, কোন সংবাদ নাই।
আর দশ মিনিট কাটিল – তথাপি কোন সাড়াশব্দ নাই, একটিমাত্র ভিত্তি ব্যবধানে তাহারা দণ্ডায়মান; কোন শব্দ নাই। তখন দেবেন্দ্রবিজয় অস্থির হইতে লাগিলেন। বাহির হইতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “অরি আমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিব, যা হয়, ঠিক করিয়া লও।” দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন। সেইরূপ নিঃশব্দে আরও পাঁচ মিনিট কাটিল।
দেবেন্দ্রবিজয় তখন সশব্দে সেই কক্ষদ্বার উদঘাটন করিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাকে স্তম্ভিত হইতে হইল, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতে অনেক বিলম্ব হইল।
যে গৃহমধ্যে তিনি এই কতক্ষণ হস্তপদবদ্ধ জুমেলিয়া এবং রেবতীকে রাখিয়া বাহিরে গিয়াছিলেন, সে কক্ষ শূন্য পড়িয়া আছে।
রেবতী নাই।
জুমেলিয়া নাই।
তাহাদের কোন চিহ্নও নাই।
পাছে ভ্রম হইয়া থাকে, এই সন্দেহে নিদারুণোদ্বেগে দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে উভয় নেত্ৰ মৰ্দ্দন করিতে লাগিলেন। একি স্বপ্ন! জুমেলিয়াকে যে চেয়ারে বন্ধন করা হইয়াছিল, সেই চেয়ারের নিকটে অগ্রসর হইলেন; দেখিলেন, যে শৃঙ্খলে জুমেলিয়া আবদ্ধ ছিল, সেটা চেয়ারের নীচে পড়িয়া রহিয়াছে; হাতকড়ী ও বেড়ী ও সেখানে আছে; তাহা অন্য চাবি দিয়া খুলিয়া ফেলা হইয়াছে í
চেয়ারখানার উপরে এক টুকরা কাগজ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহাতে লেখা ছিল;– .
“কেমন মজা; বাহবা কি বাহব্বা-আবার যে-কে সেই! তুমি বোকারাম গোয়েন্দা। আমি আবার স্বাধীন—রেবতী আবার আমার হাতে পার-ক্ষমতা থাকে তাকে উদ্ধার করিয়ো।
সেই
জুমেলা।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “কিরূপে পলাইল? জুমেলা বাঁধা ছিল। কেবল বাঁধা নয়—তার সম্মুখে রেবতীও ছিল। একি ব্যাপার, শচী? শচী, তুমি যে লোকটাকে বাহিরে বেঁধে রেখে এসেছ, সে ত কোন রকমে এদিকে আসতে পারে নাই?”
শচীন্দ্র সেই সন্ধান লইবার জন্য তখনই যেমন লাফাইয়া গৃহ হইতে বাহির হইতে যাইবেন, অমনি আগুনের একটা সুতীব্র ঝটকা আসিয়া তাহাকে তথায় ফেলিয়া দিল। সেই সঙ্গেই ‘ধ্রূম’ করিয়া একটা পিস্তলের শব্দ হইল। মৃতবৎ শচীন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পদপার্শ্বে পতিত হইল। এখন দেবেন্দ্রবিজয় কি করিবেন? এ মুহূৰ্ত্ত চিন্তার নহে—কার্য্যের। তখনই পিস্তল বাহির করিলেন, যেদিক্ হইতে আগুনের ঝটুক আসিয়াছিল, সেইদিক্ লক্ষ্য করিয়া পিস্তল দাগিলেন। তখনই কোন একটা ভারযুক্ত দ্রব্যের পতন শব্দ এবং মানুষের গেঙানি শুনা গেল—তবে পিস্তলের গুলিটা ব্যর্থ যায় নাই।
তখন দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারদেশে নিপতিত শচীন্দ্রকে উল্লঙ্ঘন করিয়া কক্ষের বাহিরে আসিলেন; যেদিক্ হইতে গেঙানি শব্দ আসিতেছিল সেইদিকে দুই-চারিপদ যাইয়াই দেখিতে পাইলেন, একটা লোক মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে; বুঝিলেন, তখনও লোকটা মরে নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।