চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ধরা পড়িল
দুবার উপর্যুপরি পিস্তলের শব্দ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তখনই শচীন্দ্র তথায় উপস্থিত হইবে। পাঠক অবগত আছেন, দুইবার পিস্তলের শব্দ তাঁহীদের একটা নির্দিষ্ট সঙ্কেতমাত্র। শচীন্দ্র তখনই অতি নিঃশব্দে আসিয়া জুমেলিয়ার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিতে পাইলেন; জুমেলিয়া কিছুই জানিতে পারিল না। এখন আর শচীন্দ্রের সে ভিক্ষুকের বেশ নাই, ইতোমধ্যে তৎপরিবর্তে পুলিশের ইউনিফর্ম ধারণ করিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলা, তুমি একদিন বলেছিলে না যে, মৃত্যুর পরেও তুমি আমার অনুসরণ করবে? যদি আমি মরিতাম, আমিও তোমার পিছু নিতাম; ভূতের মত অলক্ষ্যে তোমারও পশ্চাতে দাঁড়াতেম; তুমি কিছুই জানতে পারতে না; তার পর তোমার হাত দুটা পিছু-মোড়া করে ধরতেম, তোমার আর নড় বার শক্তি থাকত না—বুঝতে পেরেছ?
জু। না।
দে। এইবার?
তখন শচীন্দ্র জুমেলিয়ার হাত দুখান পিছু-মোড়া করিয়া ধরিল। জুমেলিয়া জোর করিতে লাগিল; চীৎকার করিয়া উঠিল, কিছুতেই শচীন্দ্রের হাত হইতে মুক্তি পাইল না।
জুমেলিয়ার সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের উপযুক্তি কথোপকথনের যে কথাগুলি নিম্নে কৃষ্ণরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা হইল, দেবেন্দ্রবিজয় জুমেলিয়াকে না বলিয়া প্রকারান্তরে শচীন্দ্রকেই বলিতেছিলেন। শচীন্দ্র আদেশ পালন করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলিয়া, এইবার তুমি অসহায়— পলায়নের কোন উপায় নাই; এইবার আমি তোমার হাতে হাতকড়ী, পায়ে বেড়ী দিব; তার পর তোমারি মন্ত্রণা মত সেই সব যন্ত্রণা তোমাকেই দেওয়া হবে।”
তখনই জুমেলিয়াকে হাতকড়ী ও বেড়ী পরাইয়া দেওয়া হইল। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া চেয়ারের সহিত লৌহশৃঙ্খলে তাহাকে বন্ধন করিলেন। তখন জুমেলিয়া শচীন্দ্রকে দেখিতে পাইল—এতক্ষণ দেখিতে পায় নাই; বলিল, “পোড়ারমুখ আমার। কই, আমি ত আগে কিছুই জানতে পারি নাই।”
শচীন্দ্র বলিল, “যাকে তুমি পাহারা দিতে বাগানে রেখেছিলে, তাকে যদি না হাত মুখ বেঁধে গাছতলায় আমি ফেলে রেখে আসতেম— জানতে পারতে, আমি এসেছি। জুমেলিয়া, এখন আমাদের দয়ার উপর তোমার পাপপ্রাণ নির্ভর করছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ—জুমেলা, যাকে ভালবাস, এখন তারই দয়ার উপর তোমার জীবন নির্ভর করছে।”
জুমেলিয়া। তবে দেবেন, তুমি তবে আমার সঙ্গে সন্ধি করতে চাও না?
দেবেন্দ্র | সন্ধি? না—কেন করিব?
জু। তুমি রেবতীকে রক্ষা করিবে না?
দে। যদি পারি—করিব।
জু। তবে কেন তুমি তাতে সাধ করিয়া ব্যাঘাত ঘটাইতেছ?
দে। কি প্রকারে?
জু। আমার সহিত সন্ধির কোন বন্দোবস্ত না করিয়া।
দে। তুমি ত বলেছ, তাকে পরিত্রাণ দেবে না।
জু। তখন আমি তোমার হাতে পড়ি নাই।
দে। এ কথা নিশ্চয়—আমি ভুলে গেছ লেম; যাতে তার জ্ঞান হয়, এখন সে ঔষধ আমার হাতে দেবে কি?
জু। দিতে পারি, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে দাও—আমাকে এখান থেকে পালাবার জন্য আটচল্লিশ ঘণ্টা মাত্র সময় দাও—হাঁ, তাহা হইলে আমি দিতে পারি। .
দে। সে আশা বৃথা।
জু। তবে তুমি তোমার স্ত্রীর জীবন রক্ষা করতে অসম্মত?
দে। সে যে রক্ষা পাবে না, এ বিশ্বাস আমার নাই। এবারে তোমার যন্ত্রণা আরম্ভ হবে। [ শচীন্দ্রের প্রতি ] শচী! এখনই এই ছুরি দিয়া জুমেলিয়ার চোখ দুটা উৎপাটন করিয়া ফেল।
জু। [ সচীৎকারে ] বাঁচাও! দয়া কর!
দে। কিসের দয়া?
জু। আমি রেবতীকে বাঁচাতে পারি—বাঁচাব।
দে। বাঁচাও তবে—তাকে।
জু। ছেড়ে দাও আমায়।
দে। সে আশা ক’রো না।
জু। তুমি কি এখন আমার সে প্রস্তাবে সম্মত হবে?
দে। আমি কিছুতেই সম্মত নই।
জু। তবে আমি কখনই তাকে বাঁচাব ন—মরুক সে—চুলোয় যাক সে!
দে। জুমেলা, বাঁচাও তাকে; সে যদি আমাকে তোমার ছেড়ে দিতে বলে, নিশ্চয় তোমাকে আমি মুক্তি দিব; মনে বুঝে দেখ, তোমার ভবিষ্যৎ তার হাতে।
জু। রেবতীর? ভাল, যদি সে স্বীকার করে, তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে? আমি এখনই তাকে বাঁচাব। ছেড়ে দাও আমায়; আমি মিথ্যা বলি না।
দে। না।
জু। তবে কি ক’রে তাকে বাঁচাতে পারি?
দে। কি করলে তার জ্ঞান হবে, আমাকে ব’লে দাও—আমিই সে কাজগুলি করব—তুমি না। যদি তাতে তার জ্ঞান না হয়, তোমার সেই নিজের স্থিরীকৃত যন্ত্রণাগুলি তোমাকেই উপভোগ করতে হবে।
জু। সে যদি বাঁচে, তা’ হ’লে তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?
দে। যদি রেবতী স্বীকার পায়।
জু। যে ঘরে তোমাকে আগে নিয়ে যাই, সেই ঘরে টেবিলের ভিতরে একটি ছোট কাঠের বাক্স আছে, নিয়ে এস—যেমন আছে, তেমনই নিয়ে আসবে; সাবধান, যেন খুলিয়ো না।
তখনই দেবেন্দ্রবিজয় সেই বায়ু লইয়া আসিলেন।
জু। ঐ বাক্সের ভিতর থেকে সতের নম্বরের শিশিট বাহির কর, পাঁচ ফোঁটা ঔষধ রেবতীকে খেতে দাও।
দে। কোন ঔষধে তুমি রেবতীকে এখন অজ্ঞান ক’রে রেখেছ—কত নম্বর?
জু। এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
দে। প্রয়োজন আছে।
জু। নম্বর সাত।
দে। বেশ, যদি এই সতের নম্বরের ঔষধে কিছু ফল না হয়, তোমাকে সাত নম্বরের ঔষধ জোর করিয়া খাওয়াইব।
জু। ফল হবে।
দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে রেবতীর অবসন্ন, তুষারশীতল মস্তক নিজের ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন। তখন তাঁহার মনে যে যন্ত্রণা হইতেছিল, তিনি তেমন যন্ত্রণা ইতিপূৰ্ব্বে কখনও ভোগ করেন নাই। তাঁহার সেই প্রাণের যন্ত্রণার কোন চিহ্ন মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল না। তাহার পর তিনি রেবতীর মুখ-বিবরে বিন্দু বিন্দু করিয়া সেই শিশিমধ্যস্থিত গাঢ় লোহিত বর্ণের তরল ঔষধ ঢালিতে লাগিলেন।
মুহূর্তের পর মুহূৰ্ত্ত কাটিতে লাগিল, গৃহ নিস্তব্ধ—কোন শব্দ নাই।
তাহার পর যখন প্রায় একদণ্ড উত্তীর্ণ হইয়া গেল, সহসা রেবতী চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় প্রকোষ্ঠের চতুর্দিকে চাহিতে লাগিলেন।