* * * * *
জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া পার্শ্ববৰ্ত্তী কক্ষে গমন করিল। তথায় প্রকোষ্ঠতলে একথানি ছিন্ন গালিচার উপর মৃতপ্রায় রেবতী পড়িয়া।
রেবতীর মুখমণ্ডল অতিস্নান—ঠিক মৃতের মুখের ন্যায়। দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় হৃদয়ের মধ্যে একটা অননুভূতপূৰ্ব্ব, কম্পপ্রদ শৈত্য অনুভব করিলেন; তখনকার মত তাঁহার অৰ্দ্ধোন্মত্ত অবস্থা আর কখনও ঘটে নাই। তখন তাঁহার, প্রাণের ভিতরে যে কি অসহ যন্ত্রণা হইতেছিল, তাহার বর্ণনা হয় না; কিন্তু বাহিরে তাহার সকলই স্থির—প্রাণে যেন উদ্বেগের কোন কারণই নাই। অতি তীব্রভৃষ্টিতে বারেক জুমেলিয়ার মুখপানে চাহিলেন তার পর নিতান্ত রক্ষস্বরে বলিলেন, “জুমেলিয়া, আমার উত্তর, না।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“মরে —মরিবে”
‘না’ এই শব্দমাত্রটাতে সম্ভব জুমেলিয়া খুব বিচলিত ও চমকিত হইয়া উঠিত; কিন্তু তখনকার ভাব জুমেলিয়া অতিকষ্টে দমন করিয়া ফেলিল; কেবল মৃদু হাসিয়া মৃদুগুঞ্জনে বলিল, “ব্যস্ত হ’রো না, দেবেন; বেশ ক’রে ভেবে দেখ।”
বাক্যশেষে তীক্ষকটাক্ষবিক্ষেপ।
“তেবে দেখেছি, না।”
“তুমি তবে স্বীকৃত হবে না?”
“না।”
“দেবেন, তুমি না বড় বুদ্ধিমান্! তোমার স্ত্রীর এই দশা দেখে তুমি কি এই উত্তর স্থির করলে, দেবেন?”
“হাঁ।”
“কি দেখে তুমি এমন ভরসা করছ?”
“আমার স্ত্রীর কিছুই হয় নাই, মুখমণ্ডল যদিও ম্লান, তা’ ব’লে কালিমাময় বা জ্যোতির্হীন নয়! জুমেলা, যতদূর কদৰ্য্যত ঘটতে পারে— তা তোমাতে ঘটেছে। যতই তুমি পাপলিপ্ত হও না কেন, পবিত্রতা যে কি জিনিষ, অবশ্যই তা তুমি জান। তুমি এখনও বলিতেছ, তুমি আমার ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি, দেবেন, এখনও বলছি, তোমার জন্য আমি পাগল হইয়াছি।”
“হ’তে পারে; কিন্তু আমি তোমাকে আন্তরিক ঘৃণা করি।”
“দেবেন, এই কি তোমার উত্তর? কঠিন!”
“আমি অন্যায় কিছু বলি নাই; তুমি আমার কথা ঠিক বুঝিবে কি, জানি না; যদি তুমি প্রকৃত রমণী হইতে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিতে; কিন্তু বিধাতা তোমাকে যদিও রমণী করিয়াছেন, রমণী-হৃদয় দিতে সম্পূর্ণ ভুল করিয়াছেন; আচ্ছ, তুমিই মনে কর, তুমি যেন রেবতী—”
[বাধা দিয়া] “বল – বল—দেবেন, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক; তোমার মুখে এ কথা শুনে আমার হৃদয়ে আনন্দ ধরছে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “তুমি যেন রেবতী, তোমার স্বামী তোমাকে অতিশয় ভালবাসেন, তুমি যেন কোন দুর্ঘটনায় ওখানে ঐরূপ মৃতপ্রায় পড়িয়া আছ, এমন সময়ে অন্য একটী স্ত্রীলোক তোমার এইরূপ অবস্থায় তোমার স্বামীর নিকটে এইরূপ একটা জঘন্ত অভিপ্রায় প্রকাশ করছে; অথচ তোমার সম্মুখে এখন বা যা ঘটছে, তুমি যেন তা মনে মনে জানতে পারছ; তুমি কি তখন তোমার জীবন-রক্ষার্থে তোমার স্বামীকে সেই রমণীর হাতে সমর্পণ করতে সন্মত হ’তে পার? পার কি জুমেলা?”
“অ্যাঁ, – না—ন!—না—না! কখনই না! সহস্রবার না!”
“তবে জুমেলা, তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর নিজে, নিজেরই মুখে পাচ্ছ না? যার প্রাণের পরিবৰ্ত্তে আমাকে তুমি চাও, সে আমাকে ছাড়িয়। তার প্রাণ চাহে না; আর আমার স্ত্রীকে যদি আমি যথার্থ হাঁ ভালবাসি, তবে তার অনভিপ্রেত কাজে আমার হস্তক্ষেপ কর ঠিক হয় না।”
“তবে কি আমার কথার উত্তর না’? তুমি জান, তা’ হ’লে তুমিই তোমার সেই স্ত্রীরই হন্তারক হবে?”
“তথাপি তুমি আমার মত কিছুতেই ফিরাতে পারবে না, জুমেলা।”
“তবে তুমি আমাকে ঘৃণা কর?”
“হাঁ, ভাল রকমে।”
“তবে ভাল রকমে রেবতী ও মরিবে?”
‘মরে —মরিবে।”
“নিশ্চয় মরিবে।”
“তেমনি নিশ্চয়, সে একা মরিবে না।”
“হোঃ—হোঃ—হোঃ [হাস্য] তুমি আমায় বড় ভয় দেখাচ্ছ!”
“হাঁ।”
জুমেলিয়া আবার হাসিল।
সেই অমঙ্গলজনক—পৈশাচিক তীব্র অট্টহাস্য—নির্জ্জলদগগনবক্ষের গম্ভীরবজধ্বনিবৎ। জুমেলিয়া বলিল, “তোমাকে আমি ভয় করি না–করিতে শিখিও নাই।”
দেবেন্দ্র। যদি না শিখিয়া থাক, আজ শিখিবে।
জুমেলিয়া। কেন?
দে। না শিখিলে আমার কাজ সফল হইবে কি প্রকারে?
জু। তোমার কাজ?
দে। হাঁ।
জু। কি কাজ?
দে। তুমি যে কাজ করিতে আমাকে বলিয়াছ।
জু। আমি তোমায় কি কাজ করিতে বলিয়াছি – বল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
দে। তুমি তোমার জন্য পূৰ্ব্বে যে যে যন্ত্রণার উল্লেখ করেছ, সেই সকল যন্ত্রণাই তোমাকে আমি ভোগ করাইব। আমি যে মানুষ, এ কথা আমি এখন যতদুর ভুলে যেতে পারি, ভুলিব; তোমার উপযুক্ত— তোমারই মত হ’তে—পিশাচ হ’তে চেষ্টা করিব। আমি এখন একএকটি ক’রে তোমার মস্তকের সকল কেশ—যতক্ষণ না, তোমারই ওই ষড়যন্ত্রপূর্ণ মস্তক কেশলেশহীন হয়—ততক্ষণ মূলোৎপাটিত করব। তার পর আমার এই ছুরি পুড়িয়ে লাল করব, সেখান তোমার কপালে চেপে ধরব—দুই গালে চেপে ধরব—তা দিয়ে তোমার চক্ষু দুটা উৎপাটিত করব।
জুমেলিয়া হাসিতে গেল—পারিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় পূৰ্ব্ববৎ বলিতে লাগিলেন, “পাছে তুমি নিজের জীবন নিজে বাহির কর, পাছে যদি তোমার কাছে কোন প্রকার বিষা থাকে, আগে তা কেড়ে নেব, তার পর তোমাকে সেই মুণ্ডিতমস্তক, ঝলসিত মুখ অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ তোমার কোন স্বাভাবিক অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ পথে পথে অনাহারে ঘুরিবে।”
জু। [সচীৎকারে] তুমি! তুমি এই সকল করবে?
দে। হাঁ, আমিই সব করব।
জু। [ সচীৎকারে ] তুমি! তমি এই সকল করবে?
জু। তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়!
দে। আঃ, ভুলে যাও কেন, জুমেলা, আমি কেন? দেবেন্দ্রবিজয় মরে গেছে, তার দেহে এক পিশাচের অধিষ্ঠান হয়েছে; সেই পিশাচ, যতক্ষণ না তুমি মর, ততক্ষণ তোমাকে নূতন নূতন যন্ত্রণা দেবে; যখন একটু সুস্থ হবে, আবার নূতন যন্ত্রণা।
জু। [ সরোষে ] নিৰ্ব্বোধ! তুমি কি মনে করেছ, আমি এই সকল যন্ত্রণা সহ করবার জন্য তোমার কাছে ঠিক এমনি ভালমানুষটির মত চুপ্ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকব?
দে। কি করবে, মরবে? পারবে না। যদি তুমি আত্মহত্যা করবার জন্য কোন বিষ বাহির করিতে যাও, পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত চুর্ণ-বিচূর্ণ ক’রে দিব; যদি পালাবার জন্য এক পা নড়বে, এখনই এই গুলিতে তোমার পা ভেঙ্গে দিব।
জুমেলিয়া তিরস্কারব্যঞ্জক কৰ্কশ হাসি হাসিতে লাগিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বজ্রনাদে বলিলেন, “জুমেলা, হাসি নয়—আমি মিথ্য বলি না—শীঘ্র প্রমাণ পাবে।”
“প্রমাণ দেখাও।”
“দেখিবে? তোমার কাণে যে ঐ দুটা দুল আছে, ঐ দুটীর মধ্যেও তুমি কৌশলে বিষ সঞ্চয় ক’রে রেখেছ; তোমার ঐ ফুল দুটির অস্বাভাবিক গড়ন দেখেই তা বুঝতে পারছি—ও দুটি এখনই দূর করাই ভাল।”
বাক্য সমাপ্ত হইতে-না-হইতে দেবেন্দ্রবিজয় উপর্য্যুপরি দুইবার পিস্তলের শব্দ করিলেন, জুমেলিয়ার কর্ণাভরণ দুটা পিস্তলের গুলিতে ভাঙ্গিয়া দুরে গিয়া পড়িল, এবং ঘরটি কিয়ৎকালের নিমিত্ত ধূম্রময় হইয়া উঠিল। ইত্যবসরে দেবেন্দ্রবিজয় পিস্তলটা লুকাইয়া ফেলিলেন।
জুমেলিয়া সভয় চাৎকারে দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গিয়া এক কোণে দাঁড়াইল। যেমন সে হস্তোত্তোলন করিতে যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সাবধান, হাত তুলিয়ে না; এখনি আমি পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত ভাঙিয়া দিব। জুমেলা, এ হাস্যোদীপক প্রহসন নয়, পৈশাচিক ঘটনাপূর্ণ বিয়োগান্ত নাটক।”