——————-
[* জুমেলিয়ার জটিল রহস্তপূর্ণ অন্যান্য ঘটনাবলী গ্রন্থকারের “মনোরমা” ও “মায়াবী” নামক পুস্তকে লিখিত হইল। প্রকাশক।]
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আবেগে
জুমেলিয়া বলিতে লাগিল,-“দেবেন, কত সুখ তাতে; মরি! মরি! মরি! আমার হও, আমার হও তুমি—এক বৎসরের জন্য। দেখ দেবেন, আমি প্রাণের মধ্যে–হৃদয়-পটে কেমন মুখের সুন্দর ছবি এঁকেছি। এ কথা মনে করতে আমার আনন্দের সীমা থাকছে না। তোমাকে ভালবাসতে হবে না—তুমি আমাকে ভালবাস কি না, সে কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই না; আমি জানি, আমি এত নিৰ্ব্বোধ নই, তুমি কখনই আমাকে ভালবাসবে না—ভালবাসতেও পারবে না। কিন্তু ছল—ছলনায় আমাকে বুঝায়ো, তুমি আমায় বড় ভালবাস; কেবল একটি বৎসরের জন্য। আমি সাধ ক’রে তোমার প্রতারণায় প্রতারিত হ’তে স্বীকার করছি—এ প্রতারণায়ও সুখ আছে। আমি জানি, আমি যা আশা করেছি, তা আশার অতীত। তুমি আমাকে ছলনায় ভুলায়ে যে, তুমি আমার ভালবাস, আর কিছু না, তাই যথেষ্ট। আমি নিজেকেই বুঝাব যে, তুমি প্রকৃতই আমাকে ভালবাস; তুমি আমার—আমার! রেবতী রক্ষা পাবে, সে তোমার বাড়ীতে নির্বিবঘ্নে পৌছিবে; সেখানে সে তোমার অপেক্ষায় থাকবে, সে কখনই জানতে পারবে না, তার জীবন-রক্ষার্থে তোমায়-আমার কি বন্দোবস্ত হয়েছে— সে তোমার এ বিষয়ের কোন প্রমাণই পাবে না। বৎসর শেষে তুমি স্বচ্ছন্দে তার কাছে ফিরে যেতে পারবে; তখন যা’ তোমার প্রাণ চায়— করিয়ো; ঘাতে তুমি সুখী হও—হইয়ো। কেবল একবার তুমি ক্ষণেকের জন্য স্বর্গের সুষমার আভাসটুকু আমায় দেখাও,—যা” আমি সারাজীবনে কখনও অনুভব করিতে পারি নাই। তোমার স্ত্রী কিছুই জানবে না, কেহই না; কেবল তুমি আর আমি। এক বৎসর পরে তুমি হাসতে হাসতে তার কাছে ফিরে যাবে; আমি মরিব, সত্যসত্যই মরিব; কেবল এ গুপ্তরহস্তা তোমারই জ্ঞাত থাকিবে—লোকের কাছে তোমাকে কলঙ্কের ভাগী হইতে হইবে না।” জুমেলিয়া উঠিল—আরও দুইপদ অগ্রসর হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহুবেষ্টিত করিতে চেষ্টা করিল। দেবেন্দ্রবিজয় ঘৃণাভরে তাহাকে সরাইয়া দিলেন।
জুমেলিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় বলিতে লাগিল—“শোন দেবেন, আমি বুঝেছি, আমি মরিব; এ কথা তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না; আমি বৎসর ফুরালে তোমার সাক্ষাতে বিষপান করব। যখন আমি ম’রে যাব, কি সংজ্ঞাশুন্ত হ’য়ে পড়ব, তখন তুমি শতবার শাণিত ছুরিকা দিয়ে আমার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ ক’রো, তা’ হ’লে ত তখন তোমার অবিশ্বাসের আর কোন কারণ থাকবে না। এখন আমরা একদিকে—বহুদূরে চলে যাব; কেবল এই এক বৎসরের জন্য; আমরা কামরূপেই চলে যাব। আমি যে সকল দ্রব্যগুণ জানি, তোমাকে সকলগুলিই শিখাব; শিখালে সহজেই শিখতে পারবে; ত’তে তোমার উপকার বৈ অনুপকার হবে না। তুমি যে দেশ ছেড়ে চলে যাবে, সেজন্য একটা কোন ওজর করলেই চলবে। তোমার স্ত্রীকে সদা-সৰ্ব্বদা তোমার ইচ্ছামত পত্রাদি লিখতে পারবে; কিন্তু তুমি প্রাণান্তেও তোমার স্ত্রীর নাম আমার কাছে এই এক বৎসরের জন্য ক’রো না; যাতে আমার মনে এমন একটা ধারণ হ’তে পারে যে, তুমি আমাকে ভালবাস ন—এমন কিছু আমাকে দেখিয়ে না—জানতে দিয়ে না। আমি ত বলেছি, আমি নিজেকে নিজেই প্রতারিত ক’রে রাখব; তুমি আমার হৃদয়ের রাজ্য হবে – তুমি আমার প্রাণের ঈশ্বর—তুমি আমার সৰ্ব্বস্ব! তার পর এক বৎসর কেটে গেলে আমি নরকের দিকে চ’লে যাব। তোমাকে এক বৎসর পেয়ে, তোমার বৎসরেক প্রেমালাপে আমি যে সুখ লাভ করব, ত’তে আমি হাসিমুখেই নরকের দিকে চলে যাব। এই এক বৎসর আমার জয়জয়কার, দেবেন। দেবেন—প্রাণের দেবেন্! তুমি কি আমার মনের কথা—প্রাণের বেদন বুঝতে পার্ছ না—আমি তোমাকে কতমতে আরাধনা করছি? তুমি মুখে আমার ভালবাস, তাতেও আমি মুখী হ’ব-আমি জোর করে বিশ্বাস ক’রে লইব, তুমি আমায় প্রকৃত ভালবাস। আমার কথার উত্তর দাও; বল-—স্বীকার পাও—প্রতিজ্ঞ কর, আমি তোমাকে যা বললেম, তা’তে তোমার আর অমত নাই; আমি এখনি তোমাকে রেবতীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি—সে এখন মড়ার মত প’ড়ে আছে। যে ঔষধে তার জ্ঞান হবে, সে ঔষধ আমি তোমার হাতেই দিব, তুমি সেই ঔষধ তাকে খেতে দিয়ে; সেই মুহুর্তেই তা’র জ্ঞান হবে—শরীরের অবস্থা ফিরে যাবে; যেমন তাকে তুমি আগে দেখেছ, এখনও ঠিক তাকে তেমনি দেখ বে। অস্বীকার কর যদি, নিশ্চয় স্ত্রীর মৃত্যু হবে; ত’ হ’লে তোমার কাছে আমি যেমন সজলনয়নে দাঁড়িয়ে আছি—আর আমার সম্মুখে তুমি যেমন প্রস্তরপ্রতিমূৰ্ত্তির ন্যায়, নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া আছ, ইহা যেমন নিশ্চয়— তেমনই নিশ্চয় তা’র মৃত্যু জানবে। জগতের কোন বিজ্ঞান তা’র চৈতন্ত সম্পাদন করতে পারবে না—কোন চিকিৎসক তার জীবন দান করতে পারবে না। যে ঔষধের প্রক্রিয়ায় সে এখন অচেতন, আমিই কেবল-তার প্রতীকারের উপায় জানি। এমন লোক দেখি না, আমার সাহায্য বিনা তাকে বাঁচাইতে পারে। যদি তুমি আমার হাত পা লোহশূঙ্খলবদ্ধ কর, এখনই এখানে সুতপ্ত লৌহখণ্ড দিয়ে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ ঝলসিত কর, গোছায় গোছায় আমার মাথার চুলগুলি ছিড়িয়া ফেল, সাড়াশি দিয়ে এক-একটি ক’রে সকল দাত মূলোৎপাটিত কর, আমার কর্ণরন্ধে, সৰ্ব্বাঙ্গে গলিত সীসক ঢেলে দাও—ঘত প্রকার যন্ত্রণা আছে—যে সকল চিন্তার অতীত—আমাকে দাও, আমার মনের দৃঢ়তা কখনই তুমি নষ্ট করতে পারবে না; সে যাতে শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যুমুখে পড়ে, তা আমি করব; তাতে আমি জানব, আমার প্রতিহিংসা সফল হয়েছে; তাতে তোমার মনে যে যন্ত্রণা হবে, সে যন্ত্রণার কাছে আমার শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ বিবেচনা করব। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, বড় বেশি কিছু নয়—দেবেন, একটি বৎসর মাত্র; এই এক বৎসরের জন্য আমার হও—কেবল আমারই। তার পর তোমার সংসারে সানন্দে তুমি ফিরে যেয়ো—সুখী হ’য়ো। সম্মত হবে কি? তুমি ত বলিয়াছ, রেবতীর প্রাণরক্ষার্থ সকলই করিতে পার; কেবল এক বৎসরের জন্য আমি তোমার কাছে তোমাকেই চাহিতেছি। উত্তর দিবার আগে বেশ ক’রে ভেবে দেখ—দেবেন, বেশ ক’রে বিবেচনা ক’রে দেখ; আমার কথা আমি কিছুতেই লঙ্ঘন হ’তে দিই নাই; আমার অভিপ্লায়ের একবিন্দু পরিবর্তিত হবে
না।”
জুমেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে-সাশ্রনেত্ৰে— মানমুখে—স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয়ও সেইরূপ স্থিরভাবে রহিলেন। তাঁহার এখনকার মনের অতিশয় অধীরতা মুখে কিছুমাত্র প্রকাশ পাইল না।
জুমেলিয়া জিজ্ঞাসিল, “কি বল দেবেন, সন্মত আছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রেবতী কোথায়?”
জুমেলিয়া। এইখানেই আছে।
দেবেন্দ্র। তার কাছে আমাকে নিয়ে চল।
জু। কি জন্য?
দে। তোমাকে এখন কি উত্তর দিব? আমি তাকে দেখে সে সম্বন্ধে একটা বিবেচনা করতে পারব।
জু। আমি এখনি তার কাছে নিয়ে যেতে পারি।
দে | নিয়ে চল।
জু। তার পর তুমি আমার কথার উত্তর দিবে?
দে। হাঁ।
জু। তবে আমার সঙ্গে এস, দেবেন; তুমি অবশ্যই স্বীকার পাবে : তুমি যেরূপ তাহাকে ভালবাস, তাতে তাকে দেখলে—তার মুখ দেখলে কখনই তুমি আমার প্রস্তাবে অস্বীকার করতে পারবে না—এস।