* * * * *
কিয়ৎপরে আবার উভয়ের উদ্যানের অপর পার্শ্বে সাক্ষাৎ ঘটিল।
আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিল, “কই, শুড়ি-মামার কাছে গেলে না?
শচীন্দ্র সবিস্ময়ে বলিল, “তাই ত হে কৰ্ত্তা, আবার যে তুমি! আবার ঘুরেফিরে তোমারই কাছে এসে পড়েছি যে, নিশ্চয়ই পৃথিবী বেটী গোলাকার; নইলে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক তোমার কাছে আবার এসে উপস্থিত হ’ব কেন? আসি মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।”
উদ্যান হইতে বহির্গমনের পথ ধরির শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিল। আগন্তুক অতি তীব্রভৃষ্টিতে—যতক্ষণ তাহাকে দেখিতে পাওয়ার গেল—দেখিতে লাগিল। না, এ লোককে ভয় করার কোন কারণ নাই; মাতাল—আধ-পাগল; যাক, আগে ভেবেছিলাম, বুঝি গোয়েন্দার কোন চর-টর হবে।” এই বলিয়া যে পথ দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া গমন করিয়াছিল, সেই পথে গমন করিতে লাগিল—
লোকটা জুমেলিয়ার চর।
———– ———
তখন ভিক্ষুক-বেশী শচীন্দ্র বেশীদূরে যায় নাই। যতক্ষণ না আগন্তক একেবারে দৃষ্টিপথ অতিক্রম করিল, ততক্ষণ শচীন্দ্র নিকটস্থ একটি বৃক্ষপার্শ্বে লুকাইয়া রহিল; তাহার পর সুবিধা মত গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইল; যে পথ দিয়া আগন্তুক চলিয়া গিয়াছিল, সেই পথ ধরিয়া চলিল।
শচীন্দ্রের গমনকালে বারংবার হস্তস্থিত ঘষ্টি হস্তচু্যত হইয়া ভূতলে পড়িয়া যাইতে লাগিল; বারংবার সে তাহা ভূতল হইতে প্রসন্নচিত্তে হাস্তমুখে তুলিয়া লইতে লাগিল।
এ হাসির কারণ বুঝিয়াছেন কি? দেবেন্দ্রবিজয় যে সকল ধান ছড়াইয়া নিশান করিয়া গিয়াছিলেন, ‘শচীন্দ্র এক্ষণে যষ্টি উঠাইবার ছলে, সেই সকল ধান দেখিয়া গন্তব্যপথ ধরিয়া চলিয়াছে।
০৩. পিশাচীর প্রেম – তৃতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড – পিশাচীর প্রেম
প্রথম পরিচ্ছেদ
আর এক ভাব
অনতিবিলম্বে জুমেলিয়া এবং তাহার অনুবর্তী হইয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই অসংস্কৃত অন্ধকারময় নিভৃত অট্টালিকা-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
জুমেলিয়া কহিল, “এই বাড়ীর ভিতরে তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।”
“স্বচ্ছন্দে,” দেবেন্দ্রবিজয় প্রত্যুত্তরে কহিলেন।
“রেবতী এখানে আছে।”
“বেশ, আমাকে তার কাছে লইয়া চল।”
“এখন নয়, সুবিধা মত; আগে তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলি কথা আছে, এস।”
উভয়ে সেই বাটিমধ্যে প্রবেশিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন অন্ধকারময় প্রাঙ্গণে পড়িলেন, অমনি বস্ত্রাভ্যন্তরস্থ গুপ্তলণ্ঠন বাহির করিলেন, চতুর্দিক আলোকিত হইল; জুমেলিয়া, একবার চমকিত হইয়া উঠিল—কিছু বলিল না।
তাহার পর উভয়ে উত্তরপার্শ্বস্থিত সোপানীতিক্রম করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন; তথাকার একটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। জুমেলিয়া সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে একটি মোমের বাতি জালাইয়া রাখিল; রাখিয়া বলিল, “দেবেন্দ্রবিজয় জান কি, কেন আমি তোমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছি?”
“না—জানি না।”
“তুমি জান, আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তোমাকে হত্যা করিব?”
“জানি।”
“শুধু তোমাকে নয়—তোমার সংসর্গে যারা আছে, তাদেরও?”
“তাহাও জানি।”
“তুমি কি বিশ্বাস কর, আমি প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিতে পারিব?”
“যদি পার—পূর্ণ করিবে।”
“আমি পারি।”
“ক্ষতি কি?”
“কিন্তু এখন আমার সে ইচ্ছা নাই; আমি তোমার সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করিতে চাই।”
“বটে! কোন বিষয়ে?”
“তুমি সে বিষয়টা কিছু অভিনব, কিছু আশ্চৰ্য্য বোধ করিবে। আমি এখনই আমার প্রতিহিংসা হইতে তোমাকে—তোমার স্ত্রীকে — শচীন্দ্রকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত আছি।”
“বটে, এর ভিতরেও তোমার অবশ্যই কোন গুঢ় অভিপ্রায় আছে।” “ছ, যদি তুমি আমার কথা রাখ—আমাকে সাহায্য কর, আমি ইচ্ছা করিতেছি—যত পাপ কাজ-সমস্তই ত্যাগ করিব; এখন হইতে সৎস্বভাব হইব।”
“সে সময় এখন আর আছে কি, জুমেলা?”
“আছে, এখনও অনেক সময় আছে—শুধরাইবার অনেক সময় আছে।”
“বল।”
“দেখ দেবেন, তুমি মনে করিলে আমি যাদের প্রাণনাশ করিতে একান্ত ইচ্ছুক, সামান্ত উপায়ে তাদের তুমি আমার প্রতিহিংসা হইতে উদ্ধার করিতে পার। সে উপায় কি? তুমি আমার স্বভাবের গতি ফিরাও, আমার মতি ফিরাও—যাতে আমি এখন হইতে সচ্চরিত্ৰ হ’তে পারি—সেই পথে নিয়ে যাও। তুমি আমাকে সদা-সর্বদা ‘পিশাচী’ কখন বা ‘দানবী’ বলে থাক; সেই দানবীকে—সেই পিশাচীকে তুমি মনে করিলে দেবী করিতে পার।”
“জুমেল, তোমার এ সকল কথার অর্থ কি?”
“উত্তর দাও, দেবেন! আমার কথার ঠিক ঠিক উত্তর দাও। ঠিক ক’রে বল দেখি, আমি কি বড় সুন্দরী?” [মৃদুহাস্যে কটাক্ষ করিল]
“হাঁ, তুমি সুন্দরী, এ কথা কে অস্বীকার করিবে?”
“কেমন সুন্দরী?”
“যদি তোমার অন্তরের জঘন্ততা তোমার মুখে প্রতিফলিত না হইত, দেখিতাম, তুমি সুন্দরী—তোমার মত সুন্দরী আমি কখনও দেখিয়াছি কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকিত।”
“মনোরমার* চেয়ে সুন্দরী?”
“রেবতীর চেয়ে?”
“হাঁ।”
“তুমি কি সুন্দরীর সৌন্দৰ্য্য ভালবাস না?”
“প্রশংসা করি বটে!”
“যদি আমার অন্তর হতে সমস্ত পাপের কালি মুছে যায়, তা’ হ’লে আমি তোমার মনোমত সুন্দরী হ’ব কি, দেবেন?”
“না, আমি তোমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।”
“যদি কোন স্থানে তোমার মন বাধা না থাকিত, তা হ’লে তুমি কি আজ আমাকে ভালবাসিতে পারিতে, দেবেন?”
“না।”
এই কথাটাই চূড়ান্ত হইল, জুমেলিয়ার হৃদয় দুর দুর করিতে লাগিল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি বন্ধ হইল, মুখমণ্ডল একবার মুহূর্তের জন্য আরক্তিম হইয়া পরক্ষণেই একেবারে কালিমাছন্ন হইয় গেল। কিয়ৎপরে প্রকৃতিস্থ হইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষী মৃদুস্বরে, জুমেলিয়া বলিল, “তা’ হ’লেও তুমি আমাকে ভালবাসিতে পারিতে না, দেবেন—তা’ হ’লেও না?”
“ন!—তা’ হ’লেও না।”
“দেবেন্দ্রবিজয়! আমার বয়স এখন ছত্রিশ বৎসর। এই ছত্রিশ বৎসরের মধ্যে আমাকে অনেকে ভালবেসেছে; কিন্তু সে সকল লোকের মধ্যে আমি এমন কাহাকেও দেখি নাই, যাহাকে আমি তার ভালবাসার প্রতিদানেও কিছু ভালবাসিতে পারি; কিন্তু তুমি—তুমি— তোমাকে দেখে আমার মন একেবারে ধৈর্য্যহীন হ’য়ে পড়েছে। তুমি আমাকে ভালবাস না—ভালবাসা ত বহুদুরের কথা—তুমি আমার শক্ৰ—পরম শত্রু; তথাপি আমার প্রাণ তোমার পায়ে আশ্রয় পাবার জন্য একান্ত ব্যাকুল। আমি পুৰ্ব্বেই জানতে পেরেছিলাম, আমার এ লালসা আশাহীন, তাই আমি তোমাকে হত্যা করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’য়েছিলাম; স্থির করেছিলাম, তোমাকে হত্যা করতে পারলে হয় ত ভবিষ্যতে এক-সময়ে-ন-এক-সময়ে তোমাকে ভুলে যেতে পারব; আজ তোমাকে কেন ডেকেছি জান, দেবেন? তোমার সঙ্গে আমি একট। বন্দোবস্ত করতে চাই।”
“কি, বল?”
“আশা করি, তুমি আমার কথা রাখবে।”
“হাঁ, তোমার কথা রাখতে যদি কোন ক্ষতি স্বীকার করতে না হয়, অবশ্যই রাখব।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি।”
“তুমি তার জীবন রক্ষা করতে ইচ্ছ। কর?”
“হাঁ, করি।”
“তার জীবন রক্ষা করতে তুমি কিছু ত্যাগ-স্বীকার করতে পার?”
“হাঁ, পারি।”
“তুমি তোমার ভালবাসা ত্যাগ করতে পার?”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পারলেম না।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পার?”
“তাকে আমি পরিত্যাগ করিব।”
“হাঁ, তাকে—তোমার স্ত্রীকে—তোমার সেই ভালবাসার সামগ্রীকে কেবল এক বৎসরের জন্য; এক বৎসর—বেশি দিন না—চিরকালের জন্য না;–তুমি তাকে মনে মনে যেমন ভাবেই রাখ, কিন্তু কেবল এক বৎসরের জন্য তুমি আমার হও। বৎসর ফুরালে তোমাকে আমি মুক্তি দিব; তখন অবাধে তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে পারবে। এক বৎসর– কেবল একটি মাত্র বৎসর; শেষে আমিও মরিব—তুমিও নিশ্চিন্ত হ’তে পারবে, আমি নিজের বিষে মরিব; তুমি তখন মুক্তি পাইবে. জুমেলিয়ার হাত হ’তে তুমি আজীবন মুক্ত থাকিবে।”
এই বলিয়া জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে একপদ অগ্রসর হইয়া, জানু পাতিয়া তাহার অতি নিকটে অতি দীনভাবে উপবেশন করিল— তখন সে প্রাণের আবেগে মহা উন্মাদিনী।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহার অভিনব অভিপ্রায় শুনিয়া চমকিত হইলেন। তাঁহার সৰ্ব্বাঙ্গ তখন প্রস্তর-প্রতিমুক্তির ন্যায় শীতল, নীরব ও নিশ্চল।