জুমেলিয়া বলিল, “থাম, আর এক কথা, এখন তুমি আমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করিবে?”
“কি, বল?”
“তুমি আজ তোমার অস্ত্র ব্যবহার করিবে না?”
“যদি না করিতে হয়—করিব না।”
“কি জন্য তুমি অস্ত্র ব্যবহার করিবে, স্থির করিয়াছ?”
“তোমার পত্রে যে সকল কথা স্থিরীকৃত আছে, সেই সকলের মধ্যে যদি একটার ও কোন ব্যতিক্রম ঘটে।”
“এই জন্য?”
“হাঁ, আরও কারণ আছে।”
“কি, বল।”
“যদি আমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে অবশ্যক হয়।”
“আবশ্যক হইবে না, আমি বলিতেছি—কোন আবশ্যক হইবে না, তোমার অস্ত্র ব্যবহারে তোমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে তুমি কোন ফল পাইবে না।”
“তা হ’লে অস্ত্র ব্যবহার করিব না।”
“নিশ্চয়?”
“নিশ্চয়।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভিক্ষুক-বেশী
জুমেলিয়া। দেবেন, কেহ তোমার সঙ্গে এসেছে?
দেবেন্দ্র। না, তোমার কথামত কাজই করা হয়েছে।
জু। শচীন্দ্র এ সকল বিষয়ের কিছু জানে না?
দে। তুমি ত জান সে শয্যাশায়ী হয়েছে।
জু। হঁ, জানি।
দে। তবে জিজ্ঞাসা করিতেছ, কেন?
জু। তুমি যে এখানে একাকী আসিয়াছ, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।
দে। অবিশ্বাসের কারণ কি আছে? আমি একাকী আসিয়াছি।
জু। দেবেন, তুমি যতই সতর্ক হও—যতই বুদ্ধিমান হও, কিছুতেই জুমেলিয়াকে ছাপাইয়া উঠিতে পরিবে না; আমি চক্ষের নিমেষে তোমায় খুন করিতে পারি।
দে। পার যদি, করিতেছ না কেন? আমার প্রতি এত দয়া প্রকাশের হেতু কি?
জু। আপাততঃ আমার সে ইচ্ছা নাই, আমিও প্রস্তুত নহি।
দে। জুমেলিয়া, অনৰ্থক বিলম্বে তোমার অনর্থ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ৷
জু। [ সহাস্তে ] মাইরি!
দে। শোন—মিথ্যা আমরা সময় নষ্ট করিতেছি, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাইবে বলিয়া পত্র লিখিয়াছিলে না?
জু। হাঁ।
দে। কোথায়?
জু। এমন কোথাও নয়; এই ঘে– [অঙ্গুলি নির্দেশে] দোতলা বাড়ীখানা দেখিতে পাইতেছ, উহার মধ্যে—ঐখানে তোমার রেবতী আছে। দেখিবে?
দে। চল, দেখিব।
জু। আর একটা প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে।
দে। কি, বল?
জু। আমার বিনানুমতিতে এমন কি তুমি তোমার স্ত্রীকে স্পর্শও করিতে পারিবে না;
দে। তাহাই হইবে, সম্মত হ’লেম, চল।
জু। যথেষ্ট।
দে। তবে চল।
জু। এস।
* * * * *
দেবেন্দ্রবিজয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া উদ্যানভূমি অতিক্রম করিয়া জুমেলিয়া ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে চলিল।
সে অট্টালিকা উদ্যানের বাহিরে নয়, উদ্যানমধ্যে—পুৰ্ব্বপ্রান্তে; বহুদিন মেরামত না ঘটায় অনেক স্থলে জীর্ণ ও ভগ্নোমুখ—অনেক স্থানে বালি খসিয়া ইট বাহির হইয়া পড়িয়াছে—কোন কোন স্থান ইট খসিয়া একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া যখন ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তখন ভিক্ষুকবেশী শচীন্দ্র বৃক্ষান্তরাল হইতে বাহির হইল; কোন পথে তাঁহারা কোন দিক্ দিয়া যাইতেছেন, তাহ স্থিরদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল; এইরূপে প্রায় পাঁচ মিনিট কাটিল। শচীন্দ্র সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিল।
যখন শচীন্দ্র সেইদিকে যাইবার জন্য একপদ সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে, আর এক ব্যক্তিকে সে সেইদিকে আসিতে দেখিল; তখনই তাড়াতাড়ি নিজের ছিন্ন শতগ্রন্থিযুক্ত উত্তরীয় বৃক্ষতলে পাতিয়া শয়ন করিল; কৃত্রিম নিদ্রার ভানে চক্ষু নিমীলিত করিয়া নাসিকা-স্বর আরম্ভ করিয়া সেই নীরব উদ্যানের নিদ্রিত পক্ষিবৃন্দকে ক্ষণেকের জন্য অত্যন্ত চমকিত ও মুখরিত করিয়া তুলিল।
সে লোকটা অতি শীঘ্রই শচীন্দ্রের নিকটে আসিল; আসিয়া সজোরে তাহার স্কন্ধে একটা সোহাগের চপেটাঘাত করিল।
শচীন্দ্র নিমীলিত নেত্রে পার্শ্বপরিবর্তন করিল। আবার সেই চপেটাঘাত। নিমীলিতনেত্রেই ভিক্ষুক বেশী শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা তুমি, পথ দেখ না, বাবা।”
সোহাগের সেই চপেটাঘাতের শব্দটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ এবার কিঞ্চিৎ পরিমাণে উচ্চে উঠিল। শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, পাহারাওয়ালাজী নাকি? বাবা, গাছতলায় পড়ে একপাশে ঘুমাচ্ছি, তা’ তোমার কোমল প্রাণে বুঝি আর সইল না? আদর ক’রে যে গুরুগম্ভীর চপেটাঘাতগুলি আরম্ভ ক’রে দিয়েছ, তা আমার অপরাধটা দেখলে কি?”
আগন্তুক বলিল, “আরে না, আমি পাহারাওয়াল নই।”
শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, তবে তুমি? উপদেবতা নাকি? কেন বাবা গরীব মানুষ একপাশে পড়ে আছি, ঘাটাও কেন, বাবা? ভদ্রলোকের ঘুমটা ভেঙে দিয়ে তোমার কি এমন চতুৰ্ব্বৰ্গ লাভ হবে?”
আগন্তুক বলিল, “আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করতে এসেছি।”
শচীন্দ্র বলিল, “আমাকে জিজ্ঞাসা কেন? আমার চেয়ে মাথায় বড়, ভারিক্কেদরের তালগাছ রয়েছে, কিছু জিজ্ঞাসা করবার থাকে, তাকে কর গে; এখান থেকে পথ দেখ না, চাঁদ ”
আগন্তুক। আমি এদিকে এসে পথটা ঠাওর করতে পারছি না; যদি তুমি বলে দাও, বড় উপকার হয়।
শচীন্দ্র ৷ পথ দেখ; সিধে লোক-সিধে পথ দেখ।
আ। আমি পদ্মপুকুরের দিকে যাব; কোন পথ জান কি?
শ। কি, শ্বেতপদ্মের না নীলপদ্মের? আবার কি রামরাজা এই ঘোর কলিতে দুর্গোৎসব আরম্ভ করেছে না কি?
আ। আমাকে পদ্মপুকুরের পথটা ব’লে দাও; আমি তোমাকে একটা পয়সা দিচ্ছি।
শ। কেন বাপু, এতদিনের পর দাতাকর্ণের নামটা আজ হঠাৎ লোপ করবে?
আ। পাগল না কি তুমি?
শ। পাঁচজনে মিলে আমাকে তাই করেছে, দাদা; আর খোঁয়াড়ি ধরলে পাগল ত পাগল, সকল দিকেই গোল লেগে যায়। তবে চললেম মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।
আ। কোথায় যাচ্ছ, তুমি?
শ। আর কোথায় যাব, শুঁড়ি-মামার সন্দর্শনে।
শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিলে অপর দিক দিয়া আগন্তুক চলিয় গেল।