সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরদিন বেলা ঠিক তিনটা বাজিবার মুখে অক্ষয়কুমারবাবু আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেদিন দেখিলাম , তিনি অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত এবং তাঁহার মুখ সহাস্য। দেখিয়া বোধ হইল , আজ যেন তিনি রাশি রাশি প্রয়োজনীয় সংবাদে কূলে কূলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছেন। আমাকে সজোরে টানিয়া একটি চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন , ” বসুন মহাশয় , বসুন , ব্যস্ত হইবেন না।” তাঁহার এইরূপ আগ্রহ ও অভ্যর্থনায় বোধ হইল , যেন সেটি আমার বাড়ী নহে , আমিই তাঁহার সহিত দেখা করিতে তাঁহার বাড়ীতেই সমুপস্থিত হইয়াছি।
সে যাহাই হউক , আমি উত্তেজিতকণ্ঠে বলিলাম , ” এবার বোধ হয় আপনি এ কেস্টার একটা কিছু কিনারা করিতে পারিয়াছেন।”
তিনি বলিলেন , ” হ্যাঁ , সাহস করে বলতে পারি , এখন কেস্টাকে ঠিক আমার মুঠোর ভিতরে আনিতে পারিয়াছি। বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার ! আমার মত বিচক্ষণ ডিটেক্টিভের হাতে যত কেস্ আসিয়াছে , একটি ছাড়া এমন অত্যাশ্চর্য্য কোনটিই নহে। যে বয়স আমার , তাতে “বিচক্ষণ” , বিশেষণটার আমার কিছু অধিকারও থাকতে পারে , কি বলেন? ( হাস্য ) কাল মোক্ষদার সহিত আপনার কথাবার্ত্তায় কেস্টা একেবারে পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। আর কোন গোল নাই। বলিতে কি মোক্ষদা মেয়েটি ভারী ফিচেল – ভারী চালাক , এমন সে ভাণ করিতে পারে , ঠিক হুবাহুব। যদি তাকে কোন থিয়েটারে দেওয়া যায় , সে শীঘ্রই একটি বেশ নামজাদা , এক্ট্রেস্ হতে পারে।”
আমি শ্রুতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিলাম , ” কেন , কাল আপনি বল্ছিলেন যে -”
বাধা দিয়া অক্ষয়বাবু বলিলেন , ” কি আপদ ! কল্যকার কথা আজ কেন? ব্যস্ত হইবেন না – আমি যা বলি , তা মন দিয়ে শুনুন। আপনার নব্য বয়স , রক্ত গরম – সুতরাং ধৈর্য্যটি অত্যন্ত কম। কাল যদি আপনাকে সমুদয় প্রকৃত কথা ভাঙিয়া বলিতাম , তাহা হইলে আপনি হয়ত আমার সকল শ্রম পণ্ড করিয়া ফেলিতেন। মোক্ষদা মেয়েটি ভারী চালাক – যতদূর হইতে হয়।” এই বলিয়া তিনি সুখ্যাতিবাদের আবেগে নিজের হস্তে হস্ত নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন।
আমি ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম , ” মোক্ষদা হইতে কি আপনি এ খুন-রহস্যের কোন সূত্র বাহির করিতে পারিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন , ” দেখুন যোগেশবাবু , আপনার কথাটাই ঠিক। এই হ্ত্যাকাণ্ডে শশিভূষণের কিছুমাত্র দোষ নাই। আরও একটা কথা – কি জানেন , হত্যাকারী শশিভূষণকে খুন করিতে গিয়া ভ্রমক্রমে লীলাকে খুন করিয়াছে।”
আমার মস্তিষ্কের ভিতর দিয়া বিদ্যুতের একটা সুতীব্র শিখা সবেগে সঞ্চালিত হইয়া গেল ; আমি অত্যন্ত চমকিত হইয়া উঠিলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমারবাবু বলিতে লাগিলেন , ” স্থির হন , ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। শশিভূষণের কোন দোষ থাক বা না থাক , সে এখন আর এ জগতে নাই , সে কাল রাত্রে হাজত ঘরেই আত্মহত্যা করিয়াছে। বোধ হয় , আপনি জানেন , শশিভূষণের শয়ন-গৃহটি দক্ষিণ দিকের সরু গলিটার ধারেই। একটি অনতি উচ্চ প্রাচীর এবং কয়েকটি বড় বড় ফলের গাছ ব্যবধান মাত্র। শশিভূষণের শয়ন-গৃহে দুইটি শয্যা ছিল। একটিতে লীলা তাহার শিশু-পুত্রকে লইয়া শয়ন করিত , অপরটিতে শশিভূষণ একাকী শয়ন করিত। যে রাত্রে লীলা খুন হয় , সে রাত্রে মোক্ষদার বাড়ীতে শশিভূষণ যায় নাই – সেইজন্য মোক্ষদা রাত্রে চুপি চুপি শশিভূষণের বাড়ীতে আসিয়াছিল। সেদিন শশিভূষণ অত্যন্ত বেশী মদ খাইয়াছিল ; সেই ঝোঁকে শয়ন-গৃহে গিয়া লীলাকে অত্যন্ত প্রহারও করিয়াছিল। সে রাত্রে তাহাদের ঐ গলির দিকের একটি জানালা খোলা থাকায় সেই গলিতে দাঁড়াইয়াও ঘরের সেইসব ব্যাপার দেখিবারও বেশ সুযোগ ছিল। যাক্ , তাহার পর শশিভূষণ একটি বিছানায় শুইয়া , মদের ঝোঁকে খানিকটা এপাশ-ওপাশ করিয়া নিদ্রিত হইল। এবং লীলাও তাহার খানিকটা পরে ঘুমাইয়া পড়িল। তাহার একঘন্টা পরেই হত্যাকারী সেই গলিপথ দিয়া প্রাচীর , বৃক্ষ এবং উন্মুক্ত গবাক্ষের সাহায্যে সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া লীলাকে হত্যা করে। পরে পুনর্ব্বার উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া নামিয়া যায়। তখন লীলার স্বামী মদের ও নিদ্রার ঝোঁকে একেবারে সংজ্ঞাশূন্য। যোগেশবাবু , আমার কথা আপনার বড় আশ্চর্য্য বলিয়া বোধ হইতেছে , বোধহয় ; কিন্তু ইহার একটি বর্ণও মিথ্যা নহে – আমি এ সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ পাইয়াছি। আপনার এই কেস্ হাতে লইয়া প্রথমে আমি শশিভূষণের পারিবারিক বৃত্তান্তগুলি জানিতে চেষ্টা করি। তা সে চেষ্টা যে একেবারে বৃথা গেছে , তাহা নহে। তাহাতেই জানিতে পারি যে , শশিভূষণের দুইটি বিছানা ছিল। একটি বড় – সে বিছানায় লীলা তাহার ছোট ছেলেটিকে লইয়া শয়ন করিত। আর যেটি ছোট , সেইটিতে শশিভূষণ নিজে শয়ন করিত। তাহাদের এক বিছানায় না শয়ন করিবার কারণ , শশিভূষণ অনেক রাত্রে মদ খাইয়া আসিত , যতক্ষণ না ঘুম আসিত , ততক্ষণ পড়িয়া পড়িয়া সে ছট্ফট্ করিত। সেরূপ অবস্থায় আরও দুইটি প্রাণীর সহিত একত্রে শয়ন করা সে নিজেই অসুবিধাজনক বোধ করিয়া এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিল। বিশেষতঃ নিত্য মধ্যরাত্রে পার্শ্ববর্ত্তী শিশুপুত্রের তীব্রতম উচ্চ ক্রন্দনে বারত্রয় তাহার সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। সেদিন প্রাতঃকালে সকলেই লীলার মৃতদেহ তাহার স্বামীর বিছানায় থাকিতে দেখিয়াছিল। সেই সূত্র অবলম্বনে আমি দুইটি অনুমান করিতে পারিয়াছি। প্রথম অনুমান – সেদিন রাত্রে শশিভূষণ বেশী মদ খাইয়াছিল , তেমন খেয়াল না করিয়া ঝোঁকের মাথায় ভ্রমক্রমে তার স্ত্রীর বিছানায় শুইয়াছিল , এবং অনতিবিলম্বে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। লীলা স্বামীকে নিদ্রিত দেখিয়া এবং তদবস্থ স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ করা অনুচিত মনে করিয়া , নিজের ছেলেটিকে লইয়া অপর বিছানায় শয়ন করিয়াছিল। দ্বিতীয় অনুমান – এমন সময় কেহ গবাক্ষদ্বার দিয়া সেই অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। সম্ভব , সে এই দম্পতীর এই অপূর্ব্ব শয়ন-ব্যবস্থা পূর্ব্ব হইতেই জানিত ; সুতরাং অন্ধকারে কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া স্বামীর পরিবর্ত্তে স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছে। এই দুইটি অনুমানের যথেষ্ট প্রমাণও আমি সংগ্রহ করিয়াছি। তখন তাহাদের শয়ন-গৃহে যে অপর কেহ গোপনে উপস্থিত হইয়াছিল , তাহার প্রমাণ – সেই গলিটার পাশে প্রাচীরের উপরে আমি দুই-তিনটি অস্পষ্ট পদচিহ্ণ এবং নীচে গলির ধারে অনেকগুলি সেই পদচিহ্ণ সুস্পষ্ট দেখিয়াছি। সেখানে অনেক গাছপালা এবং পাশেই আবার শশিভূষণের দ্বিতল অট্টালিকা ; সুতরাং সেই গলির ভাগ্যে রৌদ্রস্পর্শ্ব সুখ বহুকাল ঘটে নাই। সেইজন্য সেখানকার মাটি এত স্যাঁতসেঁতে যে , অনতিশুষ্ক কর্দ্দম বলিলে অত্যুক্তি হয় না। তাহাতে সেই কাহারও পায়ের দাগগুলি সেখানে বেশ সুগভীর এবং সুস্পষ্ট অঙ্কিত হইয়াছিল। পরে অনেক কাজে লাগিবে স্থির করিয়া আমি সেইসকল পদচিহ্ণের মধ্যে যেগুলি অধিকতর গভীর এবং নিঁখুত , সেইগুলির উপরে গাছের কতকগুলা শুষ্কা পাতা কুড়াইয়া আগুন ধরাইয়া দিই , সেই পদচিহ্ণগুলি বেশ শুষ্ক হইয়া আসিতে আমি ময়দা দিয়া একটি ছাপ তুলিয়া লই। সেই মাপেরই অতি অস্পষ্ট পদচিহ্ণ শশিভূষণের শয়ন-গৃহের গবাক্ষের বাহিরে আলিসার উপরেও দুই-একটা দেখিয়াছি। আমার কথায় আপনার একটি সন্দেহ হইতে পারে যে , হত্যাকারী সেই অনতি উচ্চ প্রাচীর হইতে একেবারে কি করিয়া সেই অত্যুচ্চ দ্বিতলে উঠিল , কিন্তু সে সন্দেহ আমি রাখি নাই। হত্যাকারী সেইখানকার একটা জামগাছ অবলম্বন করিয়া উঠিয়াছিল। সেই জামগাছের গুঁড়ির কিছু উপরে কতকগুলি খুব ছোট নধর শাখা অঙ্কুরিত হইয়াছিল। তা নামিবার সময়ে হউক বা উঠিবার সময়েই হউক হত্যাকারীর পা লাগিয়া , সেগুলার কতক ভাঙিয়া মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল , কতক গাছেই ঝুলিতেছিল। এইসকল প্রমাণে এই হত্যাকাণ্ডের ভিতরে যে আর একজন কাহারও অস্তিত্ব আছে – সে সম্বন্ধে আমি একেবারে নিঃসন্দেহ এবং আপনার মতের সহিত একমত হইতে পারিয়াছি। শশিভূষণ সম্পূর্ন নির্দ্দোষ। আমি যাহা বলিলাম , আপনি কি তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন?”