চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়বাবু সেই হল্ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া গিয়া, একটা চেয়ার টানিয়া বসিতে বলিলেন। আমি বসিলে তিনি বলিলেন, ” আপনাকে অনর্থক কষ্ট দিলাম, যেরকম দেখিতেছি, কাজে কিছুই হইবে না। মোক্ষদা একেবারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে – সে কিছুতেই কর্ণপাত করে না। শশিভূষণের উপরে তাহার অত্যন্ত রাগ – শশিভূষণ তাহার অধঃপতনের মূল কারণ – শশিভূষণ পূর্ব্বকৃত অঙ্গীকার বিস্মৃত হইয়া তাহার অমতে বিবাহ করিয়াছে – তাহার সহিত ঘোরতর প্রবঞ্চনা করিয়াছে, এইসব কারণে শশিভূষণের উপর মোক্ষদার নিদারুণ ঘৃণা। এমনকি তাহাকেও যদি শশিভূষণের সহিত ফাঁসীর দড়িতে ঝুলিতে হয় – সেভি বহুৎ আচ্ছা; কিছুতেই সে নিরস্ত হইবার পাত্রী নয়। আপনি যে তাহাকে কোনরকমে বাগ মানাইতে পারিবেন, সে বিশ্বাস আমার আর নাই। দেখুন, চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি আছে। আমি তাহাকে পাঠাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া অক্ষয়কুমারবাবু উপরে উঠিয়া গেলেন।
অনতিবিলম্বে মোক্ষদা নামিয়া আসিল। আমি তাহাকে আর কখনও দেখি নাই। ইতিমধ্যে বর্ণনার দ্বারা অক্ষয়বাবু আমার ধারণাপটে মোক্ষদা-চিত্র যেভাবে অঙ্কিত করিয়াছিলেন, এখন মোক্ষদাকে প্রত্যক্ষ করিয়া এবং তাহার ভাবভঙ্গীতে ও গর্ব্বক্ষিপ্ত চরণ চালনায় তাহা যথার্থ বলিয়া অনুমিত হইল। পরে কথাবার্ত্তায় আরও বুঝিলাম, শশিভূষণ তাহার সহিত অত্যন্ত অসদ্ব্যবহার করায় সে অবধি সে তাহাকে অতিশয় ঘৃণা করে; সেই রাক্ষসী ঘৃণার নিকটে শশিভূষণের মৃত্যুটা তখন একান্ত প্রার্থনা প্রায় হইয়া উঠিয়াছে। এমনকি আমি শশিভূষণের দিকে টানিয়া দুই-একটি কথা বলাতে, তাহার দৃষ্টিতে আমার উপরেও যেন সামান্য ঘৃণার লক্ষণ প্রকাশ পাইল। বোধহয়, যদি শশিভূষণের হইয়া আমি আরও কিছু বাড়াবাড়ি করিতাম, তাহা হইলে সেই লক্ষণটা অনতিবিলম্বে তাহার মুখ দিয়া বর্ষিত হইতে দেখিতাম। তাহাতেই আমি বুঝিলাম, তাহার সেই ঘোরতর ঘৃণা তখন সীমাতিক্রম করিয়া একটা অদম্য ও অব্যর্থ ক্রোধে পরিণত হইয়াছে; এবং তাহা একান্ত আন্তরিক এবং একান্ত অকপট। কিছুতেই মোক্ষদা বশীভূত হইবার নহে। তখন সে আমাদিগের চেষ্টার বাহিরে – অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে অস্পর্শা পতীতা ও বেশ্যা হইলেও তথাপি আমি তাহার দুটি হাত ধরিয়া অনেক বুঝাইলাম – অনেক চেষ্টা করিলাম। আশ্চর্য্য ! কিছুতেই আমি তাহার মতের একতিল পরিবর্ত্তন করিতে পারিলাম না। সে হাত ছাড়াইয়া সরিয়া দাঁড়াইল। এবং অতি দ্রুতপদে আমার দৃষ্টি-সীমার বহির্ভূত হইয়া গেল। দেখিলাম, বিপদ অনুত্তীর্য্য।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
মোক্ষদা চলিয়া গেলে অক্ষয়বাবু পুনরায় আমার কাছে আসিয়া বসিলেন। এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, ” এখনও কি আপনি শশিভূষণকে নির্দ্দোষ বলিয়া বিশ্বাস করেন?” এই বলিয়া তিনি আমার মুখের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।
তাঁহার কথার ভাবে এবং দৃষ্টিপাতে বুঝিলাম, তিনি অন্তরালে দাঁড়াইয়া সকলই শুনিয়াছেন – সকলই দেখিয়াছেন। বলিলাম, ” হাঁ, এখনও আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই শশিভূষণ নির্দ্দোষ। আমার বিশ্বাস অভ্রান্ত। আপনি কি বিবেচনা করেন? আমার বোধহয়, মোক্ষদার কথা সর্ব্বতোভাবে মিথ্যা। ইহাতে এমন -”
আমার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া তিনি বলিলেন, ” – কিছুই নাই যাহা বিশ্বাস্য ! বেশ, সেটা আমি আরও একবার ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিব; ভাল বুঝি, কেস্টা নিজের হাতে রাখিব – নয় ছাড়িয়া দিব। আপনি অপর কোন উপযুক্ত ডিটেক্টিভের সহিত বন্দোবস্ত করিবেন। যাক্ সে কথা, কাল আপনার বাড়ীতে কখন গেলে আপনার সহিত নিশ্চয়ই দেখা হইবে, বলুন দেখি।”
আমি। আপনি কখন যাইবেন, বলুন। সেই সময়ে আমি নিশ্চয়ই বাড়ী থাকিব।
অক্ষয়। বেলা তিনটা পর?
আমি। আচ্ছা।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমি অক্ষয়বাবুর নূতন বাগান হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম , কে একটা লোক অনতিদূরস্থ একটা গাছের পার্শ্বে , তথাকার সীমাবদ্ধ ছায়ান্ধকার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে। আমি সেদিকে আর দৃষ্টিপাত না করিয়া সেই তরুচ্ছায়াঘন সন্ধ্যাধূসর জনমানবশূন্য গ্রাম্যপথের বিপুল নিস্তব্ধতা নিজের পদশব্দে কম্পিত করিতে করিতে গৃহাভিমুখে চলিলাম।
কিছুদূরে আসিয়া আমি একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম , সেই লোকটাই , অনেক তফাতে আসিতেছে। একবার একটু মনে সন্দেহ হইল ; তাহার পর মনে করিলাম , হয়ত তাহারও এই গন্তব্য পথ। তাহার পর যখন আমি আমার বাড়ীর সম্মুখবর্ত্তী হইলাম , তখনও সেই লোকটাকে দেখিতে পাইলাম ; কিন্তু এবারে তাহাকে আমার পশ্চাতে দেখিলাম না। সে কখন কোথা দিয়া আসিয়া আমাদের বাড়ী ছাড়াইয়া আরও তিন-চারিখানা বাড়ীর পরে একটা গলিপথের ধারে দাঁড়াইয়া আছে ; এবং আমার দিকে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতেছে। তখন বুঝিলাম , সে আমারই অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে। অবশ্যই লোকটার একটা কোন উদ্দেশ্য আছে। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে যতদূর পারা যায় দেখিলাম – আকৃতি এবং বেশভূষায় তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হয় না। ভদ্র বা ইতর যেই হোক – লোকটা কে? লোকটার উদ্দেশ্য কি?
সন্দেহে মনটা কিছু চঞ্চল হইয়া উঠিল। মনে করিলাম , তখন নিজের বাড়ীতে না যাইয়া , আরও খানিকটা এদিক-ওদিক করিয়া লোকটাকে তফাৎ করিয়া দিই। অনেকরকম দুর্ভাবনায় মনটা তখন অত্যন্ত পীড়িত ছিল ; সুতরাং মনের ইচ্ছা মনেই রহিয়া গেল। আমি দ্রুতপদে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলাম , এবং পরক্ষণেই এ ক্ষুদ্র ঘটনা আমার মন হইতে একেবারে অপসৃত হইয়া গেল।