দশম পরিচ্ছেদ
নিজের হাজত ঘরে আমাকে উপস্থিত দেখিয়া শশিভূষণ অত্যন্ত আল্হাদিত হইল ; এবং আমার উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়াছে বলিয়া – আরও আমার সহিত যে সমুদয় অন্যায় ব্যবহার করিয়াছে , তাহার উল্লেখ করিয়া বারংবার আমার নিকটে অশ্রু-সংরুদ্ধকণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল। তাহার পর বলিল , ” ভাই যোগেশ , তুমি আমাকে ক্সমা করিলে ; কিন্তু অভাগিনী লীলা কি এমন নরকের কীটকে কখন ক্ষমা করিবে ? আমি আজ আমার পাপের ফল পাইলাম। ধর্ম্মের বিচার অব্যাহত – আজ না হউক , দুদিন পরে নিশ্চয়ই সকলকে স্বকৃত পাপ-পুণ্যের ফলভোগ করিতে হইবে , কেহই তাহার হাত এড়াইতে পারে না। আমি লীলার প্রতি যে সকল নিষ্ঠুরাচরণ করিয়াছি , বোধ করি , কোন কঠোর রাক্ষসেও তাহা পারে না। আমি মনুষ্য নামের একান্ত অযোগ্য – আমার ন্যায় মহাপাপীর নাম এ জগৎ হইতে চিরকালের জন্য মুছিয়া যাওয়াই ভাল। ভাই যোগেশ , আজ সকলেই বিশ্বাস করিয়াছে , আমি লীলার হত্যাকারী। তুমিও যে এরূপ বিশ্বাস কর নাই , তাহাও নহে। জগতের সকলেরই মনে আমার মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এই ধারণা – এই বিশ্বাস চিরন্তন অটুট এবং অটল থাকিয়া যাক্ – বরং তাহাতে আমি সুখী ; কিন্তু যোগেশ , তুমি যেন আর সকলের মত তাহা মনে করিয়ো না , এই কথা বলিবার জন্যই আমি তোমার সহিত দেখা করিতে এত উৎসুক হইয়াছিলাম। আমার সত্য নাই – ধর্ম্ম নাই – এমন কিছুই নাই , যাহা সাক্ষ্য করিয়া স্বীকার করিলে তুমি কিছুমাত্র বিশ্বাস করিতে পার – আমি ধর্ম্মবিচ্যুত , মনুষ্যত্ত্ব-বিসর্জ্জিত , সয়তানের মোহমন্ত্রপ্রণোদিত , জগতের অকল্যাণের পূর্ণ প্রতিমূর্ত্তি – আমার কথায় কে বিশ্বাস করিবে ? ভাই যোগেশ , তুমি তাই অবিশ্বাস করিয়ো না , তাহা হইলে মরিয়াও আমার সুখ হইবে না – এ জগতে এমন একজন থাক্ , সে যেন জানে , আমি একটা মহাপাপী ছিলাম বটে , কিন্তু স্ত্রীহন্তা নই।”
বলিতে বলিতে শশিভূষণের কণ্ঠ কম্পিত এবং বাষ্পরুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। সে দুই হাতে মুখ চাপিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিতে লাগিল।
বলিতে কি তাহার সেই সকরুণ অবস্থা তখন আমার মর্ম্মভেদ ও সহানিভূতি আকর্ষণ করিয়াছিল। অনেক করিয়া তাহার পর আমি তাহাকে শান্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , ” শশিভূষন , এ পর্য্যন্ত যাহা ঘটিয়াছে , তুমি অকপটে সব আমাকে বল ; কোন কথা গোপন করিতে চেষ্টামাত্রও করিয়ো না। যদি এ দুঃসময়ে আমি তোমার কোন উপকারে আসিতে পারি।”
শশিভূষণ বলিল , ” আমি প্রভাতে উঠিয়া প্রথমেই দেখিলাম , লীলা রক্তাক্ত হইয়া আমার বিছানার পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। ধরিয়া তুলিতে গেলাম – দেখিলাম , দেহে প্রাণ নাই। দেখিয়াই আমার বুকের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল। বুঝিলাম , লীলা এ পিশাচকে জন্মের মত পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে – বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে খুঁজিলে আর তাহাকে ফিরিয়া পাইব না – পাইবার নহে। বলিতে কি , যোগেশ প্রথমে আমার বোধ হইল , মদের ঝোঁকে আমিই তাকে রাত্রে হত্যা করিয়াছি। তাহার পর যখন দেখিলাম , আমারই ছুরিখানা , লীলার বুকে তখনও আমূলবিদ্ধ রহিয়াছে , তখন আমার সে ভ্রম দূর হইল। আমার এখন বেশ মনে পড়িতেছে , ছুরিখানি আমার বৈঠকখানায় যেখানে থাকিত , সেখানে ছুরিখানা কাল রাত্রে দেখিতে পাই নাই , পরে খুঁজিয়াও কোথাও পাওয়া গেল না। আমি সে কথা তখনই লীলাকে বলিয়াছিলাম। সেজন্যই মনে একটু সন্দেহ হইতেছে ; নতুবা এখনও আমার মনে বিশ্বাস , কাণ্ডজ্ঞানহীন আমিই লীলার হত্যাকারী ; কিন্তু সেই ছুরিখানা যোগেশ , আরও ইহার ভিতরে আর একটা কথা আছে , আমার বোধ হয় – ঠিক বলিতে পারি না – যদি – যদি -”
শশিভূষণকে ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া নিজেও যেন একটু ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলাম। সে ভাব তখনই সামলাইয়া আমি তাহাকে বলিলাম , ” কথা কহিতে এমন সঙ্কুচিত হইতেছ কেন ? তুমি যা জান বা বোধ কর , আমাকে স্পষ্ট বল।”
শশিভূষণ বলিল , “লীলার বুকে ছুরি বসাইতে পারে , একজন ছাড়া তাহার এমন ভয়ানক শত্রু আর কেহ না। তাহারই উপর আমার কিছু সন্দেহ হয় -”
আমি অত্যধিক ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম , ” কে সে ? – প্রকাশ কর নাই কেন ?”
শশিভূষণ অনুচ্চস্বরে বলিল , ” তুমি তাহাকে জান , আমি মোক্ষদার কথা বলিতেছি। যেদিন আমার বিবাহ হইয়াছে , সেইদিন হইতে মোক্ষদাও ভিন্নমূর্ত্তি ধরিয়াছে। কি একটা হতাশায় সে যেন একেবারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। অনেকবার সে আমাকে শাসিত করিয়া বলিয়াছে , ‘ইহার ফল তোমাকে ভোগ করিতে হইবে – আমি যে-সে নই – তবে আমার নাম মোক্ষদা। একবাণে কেমন করিয়া দুটা পাখী মারিতে হয় – আমা হতেই তা একদিন তুমি দেখিতে পাইবে।”
শশিভূষণ আবার দুইহাতে দুই চক্ষু আবৃত করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আমি অতিশয় চকিত হইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলাম , ” অসম্ভব ; তাহা কি কখনও হয় ?”
অনুতাপদগ্ধ রোরুদ্যমান্ শশিভূষণ বলিল , ” তাহা না হইলেও আমি তোমাকে বিশেষ অনুনয় করিয়া বলিতেছি , লীলার প্রকৃত হত্যাকারীকে , যাহাতে তুমি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পার , সেজন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিবে।” যাহার পর মুখ হইতে হাত নামাইয়া তাহার অশ্রুসিক্ত করুণ দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া বলিতে লাগিল , ” ভাই যোগেশ , তুমি মনে করিতেছ , আমার নিজের জন্য তোমাকে আমি এমন অনুরোধ করিতেছি – তাহা ঠিক নয় , আমার ফাঁসী হউক আর না হউক , সেজন্য আমি কিছুমাত্র চিন্তিত নহি , একদিন ত সকলকেই মরিতে হইবে – তা দুইদিন আগে আর পরে ; কিন্তু – কিন্তু যোগেশ , যখনই মনে হয় যে , লীলার হত্যাকারী তাহার এ নৃশংসতার কোন প্রতিফল পাইবে না -”
বলিতে বলিতে শশিভূষণের অশ্রুময় দৃষ্টি সহসা মেঘকৃষ্ণ রাত্রের তীব্র বিদ্যুদগ্নির ন্যায় ঝলসিয়া উঠিল। এবং এমন দৃঢ়রূপে সে নিজের হাত নিজের মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিল যে , হাতের কব্জিতে নখরগুলা বিদ্ধ হইয়া রক্তপাত হইতে লাগিল।
যদিও আমি শশিভূষণকে অতিশয় ঘৃণার চোখে দেখিতাম , কিন্তু এখন তাহাকে নিদারুণ অনুতপ্ত এবং মর্ম্মাহত দেখিয়া আমার সে ভাব মন হইতে একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল। শোকার্ত্ত শশিভূষণের সেই কাতরতায় আর আমি স্থির থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম , ” শশিভূষণ , যেমন করিয়া পারি , তোমার নির্দ্দোষিতা সপ্রমাণ করিব। এখন হইতেই আমি ইহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব।”
এইরূপ প্রতিশ্রুতির পর আমি তাহার নিকটে সেদিন বিদায় লইলাম।
হত্যাকারী কে? – ০২ (সমাপ্ত)
দ্বিতীয়ার্দ্ধ