ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সপ্তাহ শেষে একদিন সন্ধ্যার কিছু পরে আমি শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করিলাম। তখন সে একাকী তাহার একতল বৈঠকখানার উন্মুক্ত ছাদে বসিয়া মদ খাইতেছিল। এবং এক একবার এক একটা বিরাট রাগিণী ভাঁজিয়া সেই নির্জ্জন ছাদ এবং নীরব আকাশ প্রতিধ্বনিত করিতেছিল। কি জানি , কেন সেদিন শশিভূষণ আমার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিল না। তাহার সেই অপ্রসন্ন ভাব দেখিয়া বুঝিলাম , তাহার মনের অবস্থা আজ বড় ভাল নহে।
ক্রমে রাত দশটা বাজিয়া গেল। তখন আমি উঠিলাম। আমাকে উঠিতে দেখিয়া শশিভূষণ গলিল , ” চল , আমিও নীচে যাইব।” বলিয়া উঠিল।
বাড়ীর সম্মুখে একখানি ছোট সুন্দর বাগান। চারিদিকে ফলের গাছ , সম্মুখে নানাবিধ ফুলের গাছ , এবং রঞ্জিতপল্লব ক্রোটনশ্রেণীতে বাগানবাড়ী বেশ একরকম সুন্দর সাজান। ছাদের সোপান হইতে নামিয়াই আমরা সেই বাগানে আসিযা পড়িলাম।
তখন শশিভূষণ আমাকে বলিল , ” যোগেশ , তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”
আমি বিস্মিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলাম।
শশিভূষণ বলিল , ” কাল হইতে তুমি আর এখানে আসিয়ো না , তুমি যে মৎলবে যাওয়া-আসা করিতেছ , আমি মাতাল বলে তাহা কি বুঝিতে পারি না? আমি তেমন মাতাল নই। সহজ লোক নও তুমি – চোরের উপর বাটপাড়ী করিতে চাও?”
কথাগুলি বজ্রাঘাতের ন্যায় আমার বুকে আঘাত করিল। সেদিন তাহারই মুখে তাহার নীচাশয়তার কথা শুনিয়া আমি ক্রোধে আত্মহারা হইয়াছিলাম। কেবল লীলার জন্য আমি দ্বিরুক্তি করি নাই – করিতে পারি নাই। আজ সহসা শশিভূষণের এই কটূক্তি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় সবেগে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল। আজ ক্রোধ সম্বরণ আমার পক্ষে একান্ত অসাধ্য হইয়া উঠিল। আমি বলিলাম , ” শশিভূষণ , তুমি পশু অপেক্ষা অধম , তোমার মন যেমন কলুষিত , তাহাতে তুমি এইরূপ না বুঝিয়া ইহার অধিক আর কি বুঝিবে? আমার মনের ভাব বুঝিতে তোমার মত নারকীর অনেক বিলম্ব আছে ; কেবল লীলার মুখ চাহিয়াই আমি তোমার অমার্জ্জনীয় অপরাধ সকল উপেক্ষা করিয়াছি।”
শশিভূষণ বিকৃত কণ্ঠে কহিল , ” লীলা , লীলা তোমার কে? তুমিই বা লীলার কে – তাহার কথা লইয়া তোমারই বা এত আন্তরিকতা প্রকাশ কেন? আমি আমার স্ত্রীকে যাহা খুসী তাহাই করিব , তাহাতে তোমার এত মাথাব্যাথা কেন হে? আমি কি কিছু বুঝি না বটে? যাও যাও , তোমার মত ভণ্ড তপস্বী আমি অনেক দেখিয়াছি। মারের চোটে গন্ধর্ব্ব ছুটিয়া যায় , তাহাতে আর আমি তোমার চিন্তাটি লীলার মাথার ভিতর হইতে বাহির করিয়া ফেলিতে পারিব না?”
আমি অনিবার্য্য ক্রোধে আত্মসম্ভ্রমবোধশূণ্য হইলাম। কহিলাম , ” শোন শশিভূষণ , আমি জীবিত থাকিতে তুমি লীলার একটি মাত্র কেশের অপচয় করিতে পারিবে না। ইহার পর লীলার প্রতি যদি কখনও তোমার কোন অত্যাচারের কথা শুনি , সেই দণ্ডে আমি তোমাকে খুন করিব। তাহাতে যদি আমাকে ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলিতে হয় , তাহাও শ্রেয়ঃ – আমি আর কখনই তোমাকে ক্ষমা করিব না।”
শশিভূষণ অত্যন্ত রোষাবিষ্ট হইয়া , মস্তকান্দোলন করিয়া কহিল , ” বেশ বেশ , কে কাহাকে খুন করে দেখা যাবে। আগে আমি লীলাকে খুন কর্ব – তারপর তোকে খুন কর্ব – ‘কি স্পর্ধা , লীলার একটা কেশের অপচয় কর্লে আমাকে খুন কর্বে ! আমি যদি আজ লীলার রক্ত-দর্শন না করি , তাহলে আমার নাম শশিভূষণ নয় ; দেখি , তুই আমার কি করিস্।”
দুর্বৃত্ত তখন অত্যন্ত মাতাল হইয়াছিল ; তাহার সহিত আর কোন কথা কহা যুক্তি-সঙ্গত নহে মনে করিয়া , আমি তাহার বাগান হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। সে চলিয়া গেল , কি দাঁড়াইয়া রহিল , একবার ফিরিয়া দেখিলাম না।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
রাস্তায় আসিয়া মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। নিজেকে বারংবার ধিক্কার দিতে লাগিলাম। কেন আমি শশিভূষণকে এমন রাগাইয়া দিলাম? এই রাগের মুখে হয় ত আজ মদোন্মত্ত পিশাচ অভাগিনী লীলাকে কতই না যন্ত্রণা দিবে? এতদিন এত সহিয়াছি – আজ কেন আমি এমন করিলাম? কি কুক্ষণে কোন্ দুর্ম্মুখের মুখ দেখিয়া আজ আমি শশিভূষণের সহিত দেখা করিতে , বাটীর বাহির হইয়াছিলাম। কেন আমি এমন সর্ব্বনাশ করিলাম ! হায় হায় ! আমি লীলার ভাল করিতে গিয়া অগ্রেই তাহার মন্দ করিয়া ফেলিলাম ! মনুষ্য যা মনে করে – নির্দ্দয় বিধাতা এমনই তাহার বিপরীত ঘটাইয়া দেয়।
আমার মানসিক প্রবৃত্তি সমূহে তখন কেমন একটা গোলমাল পড়িয়া গেল। কি ভাবিতেছি – কি ভাবিতে হইবে – কি হইল , এইসব তোলাপাড়া করিতে করিতে যেন আমি কতকটা আত্মহারা হইয়া গেলাম। অশেষ সদ্গুণাভরণা , সৌম্যশ্রী লীলার সুখ দুঃখ যে এখন এমন একটা দয়াশূণ্য , ক্ষমাশূণ্য , নিষ্ঠুরতম বর্ব্বরের হাতে নির্ভর করিতেছে , এ চিন্তা প্রতিক্ষণে আমার হৃদয়ে সহস্র বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা অনুভব করাইতে লাগিল। কি করিব ? কোন উপায় নাই। নিজের বুকে বিষাক্ত দীর্ঘ ছুরিকা শতবার আমুল বিদ্ধ করিতে পারি ; কিন্তু মুঢ় শশিভূষণের গায়ে একবার একটা আঁচড় দিই , এমন ক্ষমতা আমার নাই।
নির্জ্জন পথিমধ্যে প্রতিমুহূর্ত্তে আমার বেশ স্পষ্ট অনুভব হইতে লাগিল যে , নির্ব্বিঘ্নে চিন্তারাক্ষসী আমার হৃদ্পিণ্ড শোষণ করিয়া রক্তশোষণ করিতেছে। আমি মুমূর্ষের ন্যায় গৃহে ফিরিলাম। তাহার পর – হে সর্ব্বজ্ঞ ! সর্ব্বশক্তিমান ! তুমি জান প্রভো ! তাহার পর যাহা ঘটিয়াছিল।