নরেন্দ্রের মাতা বলিলেন, ” না বাবা , আর বাঁচিতে ইচ্ছা নাই। নরেনের জন্য ভাবি না , সে বেটাছেলে , লেখাপড়া শিখিয়াছে , বড় ঘরে তাহার বিবাহও দিয়াছি – সে যেমন করিয়া হউক , আজ না হয় , দুদিন পরেও মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে। কেবল লীলার জন্য – লীলার স্বামী মাতাল – বদ্রাগী লোক – আমার সোনার লীলার যে দশা করিয়াছে দেখিলে চোখে জল আসে। লীলার জন্য আমার মরণেও সুখ হইবে না। লীলা এখন এখানে আছে , অনেক করিয়া তবে তাহাকে এবার আনিয়াছি।”আমি বলিলাম , ” হ্যাঁ , এইমাত্র আমি তাহাকে দেখিয়াছি – আমি প্রথমে লীলাকে চিনিতে পারি নাই। ”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জননী বলিলেন , “লীলা এখন সেই রকমই হইয়াছে।” তাঁহার চক্ষে দুই বিন্দু অশ্রু সঞ্চিত হইল।তাহার পর বলিলেন , “লীলার একটি ছেলে হইয়াছে , দেখ নাই?”
আমি শুষ্ক হাস্যের সহিত বলিলাম , ” না।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পাশের ঘরে লীলা ছিল , লীলার মা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন , ” লীলা , প্রবোধচাঁদকে একবার এ ঘরে নিয়ে আয় – তোর যোগেশ দাদা এসেছে – দেখ্বে।”
বলা বাহুল্য শিশুর ক্রন্দনে এবং লীলার ব্যস্ততায় তাহা আমি পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। অনতিবিলম্বে শিশুপুত্র ক্রোড়ে লীলা আমাদিগের ঘরে প্রবেশ করিল – দেখিলাম , সেই সেদিনের খেলাঘরের বালুকাকে অন্ন , কচুপাতাকে ঘণ্টে , ইঁটের ক্ষুদ্র টুকরাগুলিকে মৎস্যে এবং পরমান্নে পরিণত করিবার অসীমক্ষমতাধারিণী পাচিকা , হাস্যচপলা ছোট লীলা আজ মাতৃপদাধিষ্ঠাত্রী।
লীলা গৃহতলে বসিল। শৈশবে দুইজনে একসঙ্গে খেলা করিয়াছি , ছুটাছুটি করিয়াছি , ঝগড়া করিয়াছি ; ভাবের পর একসঙ্গে বসিয়া কত গল্প করিয়াছি। বুঝিতে পারিলাম না , কেমন করিয়া কোন্ দিন সহসা সে শৈশবস্বর্গচ্যুত হইলাম। শুধু স্মৃতিমাত্র রহিয়া গেল।
যাহা হউক , যদিও এখন সে-লীলা নাই , তথাপি লীলা আমাদের পাড়ার মেয়ে , তাহাকে আমি এতটুকু হইতে দেখিয়া আসিয়াছি , আমাকে দেখিয়া তাহার লজ্জা করিবার কোন আবশ্যকতা ছিল না। সে মাথায় একটু কাপড় দিয়া বসিল। আমি সস্নেহে তাহার শিশুপুত্রকে বুকে করিলাম।
সুন্দর টুকটুকে ছেলেটি – মুখ, চোখ, ও কপালের গড়ন ঠিক লীলার মত। বুঝিলাম , লীলাকে প্রবোধ দিতেই এই প্রবোধচাঁদের জন্ম , এবং লীলা হইতেই তাহার এইরূপ নামকরণ।
তাহার পর লীলার মাতা লীলার অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিয়া এবং লীলার স্বামীর প্রতি অনেক দুর্ব্বচন প্রয়োগ করিয়া নিন্দাবাদ করিতে লাগিলেন। তাহাতে লীলার মলিন মুখ আরও অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। স্বামীনিন্দা হিন্দুরমণীমাত্রেরই নিকট অপ্রীতিকর। তা লীলা শিক্ষিতা এবং সদ্কুলোদ্ভবা। লীলার স্বামীভক্তি অচলা হউক , লীলার চরিত্রহীন স্বামী দেবতুল্য হউক , লীলা সুখী হউক , আমি তাহাতেই সুখী।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
লীলার মা সে যাত্রা রক্ষা পাইলেন না। তাঁহার পবিত্র আত্মা পরলোকগত স্বামীর উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল। দুইমাস পরে পিতৃমাতৃহীনা লীলা স্বামীগৃহে উপস্থিত হইল , এবং পূর্ব্বের ন্যায় এবারেও দুর্ভাগিনী , কাণ্ডজ্ঞানহীন মদ্যপ স্বামীর নিকটে উৎপীড়িত হইতে লাগিল।
ক্রমে আমি ধৈর্য্য হারাইলাম , যেমন করিয়া পারি , লীলার কষ্ট দূর করিতে হইবে। কি উপায় করি? অনেক চিন্তার পর স্থির করিলাম , পূর্ব্বে শশিভুষণের সহিত আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল – আবার তাহার সহিত সেই বন্ধুত্ব গাঢ় করিয়া তুলিতে হইবে। যদি তাহার সহিত মিলিয়া মিশিয়া ক্রমে তাহার সেই হেয়তম ঘৃণ্য চরিত্রের কিছুমাত্র সংশোধন করিতে পারি।
কার্য্যে তাহাই ঘটিল। আমি মধ্যে মধ্যে – তাহার পর প্রত্যহ শশিভূষণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আরম্ভ করিলাম। উভয়ের মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠতা নামক পদার্থটি অত্যন্ত নিবিড় হইয়া আসিতে লাগিল। এখন তাহাদের বাড়ীতে গেলে শশিভূষণ আমাকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করিত।
দুই-চারিদিনের মধ্যে মধ্যে কথায় কথায় বুঝিতে পারিলাম , শশিভূষণ লীলাকে অত্যন্ত ভালবাসে। শুনিয়া সুখী হইলাম বটে , কিন্তু এ অত্যন্ত ভালবাসার উপরে , এ অত্যন্ত অত্যাচারের কারণ কিছুতেই নির্দ্ধারণ করিতে পারিলাম না।
যাহাই হউক , তাহার সেই মনোভাবে আমার মনে অনেকটা আশার সঞ্চার হইল। মনে করিলাম , আমার প্রচুর উপদেশ-বৃষ্টিবর্ষণে তাহার প্রেমতৃষ্ণার্ত্ত মরুহৃদয়ে এক সময়ে-না এক সময়ে সৎ প্রবৃত্তির বীজ উপ্ত হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমি বহু শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করিয়া এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ফুটনোট করিয়া বুঝাইতাম যে , ধর্ম্মপত্নীর উপর দুর্ব্ব্যবহার করা শাস্ত্রবিগর্হিত কাজ ; এবং তজ্জন্য অধঃপতন অনিবার্য্য। নরেন্দ্রের সহিত একান্ত হৃদ্যতায় আমার যে এই অযাচিতভাবে উপদেশ প্রয়োগে কিছু অধিকার আছে , তাহা শশিভূষণ বুঝিত ; এবং ভবিষ্যতে যাহাতে আমার উপদেশ রক্ষা করিয়া কাজ করিতে পারে , সেজন্য যথেষ্ট আন্তরিকতা প্রকাশ করিত।
এইরূপে তাহাকে অনেকটা প্রকৃতিস্থ করিলাম। কিছুদিন সে আমার কথা রক্ষা করিয়াছিল ; পরে আবার যে-কে-সেই। যেদিন বেশি মদ খাইত , সেদিন লীলার প্রতি দুর্বৃত্তের অত্যাচার একেবারে সীমাতিক্রম করিয়া উঠিত। তখন আমি উপদেশের পরিবর্ত্তে রুষ্ট হৃদয়ে তাহাকে যথোচিত তিরস্কার করিতাম। কখন সে মৌন থাকিত এবং কখনও বা অসন্তোষ প্রকাশ করিত।
একদিন শশিভূষণ মদের মুখে – অসদ্ভাবে নয় , সরল প্রাণে কলুষিত বদনে এইরূপ আত্ম-পরিচয আমাকে দিতে লাগিল , ” ভাই যোগেশ , আমার মতিগতি যাহাতে ভিন্ন পথে চালিত হয় , সেজন্য তুমি যে যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছ , তাহা যে আমি বুঝিতে পারি নাই , তাহা নহে। যদিও আমি মাতাল , কাণ্ডজ্ঞানহীন ; তথাপি আমি তোমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারি। তুমি আমাকে অনেক বুঝাইয়াছ , বুঝি নাই , ভার্ৎসনা করিয়াছ – আমারই ভালর জন্য। সব বুঝিতে পারি , বুঝিলে হইবে কি , বেশী মদ খাইলে আর আমার কিছুই মনে থাকে না। বাঁচিয়া থাকিতে যে মদ ছাড়িতে পারিব – কখনই না। যদিও পারিতাম , এখন আর তাহা পারিব না। আমার মনের ভিতর কি বিষের হল্কা বহিতেছে , কে জানিবে? মদ খাইয়া অনেকটা ভাল থাকি। ইহার ভিতরে অনেক কথা আছে। কথাটা শুনিয়া যাও , এ পৃথিবীতে আমার মত তোমার ঘোরতর শত্রু আর কেহ নাই। আমি জানি , তুমি লীলাকে ভালবাসিতে , এবং লীলার সহিত তোমার বিবাহ হইবে ; কিন্তু -”
শুনিয়া আমি আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিলাম। শশিভূষণ সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিতে লাগিল , – “লীলা যে তোমাকে ভালবাসে , আমি সে কথা অনুভব করিতে একবারও চেষ্টা করি নাই। যেদিন আমি সৌন্দর্য্য-মণ্ডিতা লীলাকে দেখিলাম , সেইদিন হইতে তাহার একটা অদম্য আকাঙ্খায় আমার সমগ্র হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
স্নেহ , মমতা, প্রেম প্রভৃতির অস্তিত্ব যে আমার হৃদয়ে আছে , সে সম্বন্ধে আমার নিজেরই কিছুমাত্র বিশ্বাস ছিল না ; কিন্তু যেদিন দেবী-প্রতিমার ন্যায় অশেষমহিমাময়ী লীলাকে দেখিলাম , শত সৎপ্রবৃত্তিও যেন হৃদয়দ্বার উদঘাটন করিয়া , সেই দেবী-প্রতিমার অর্চ্চনার জন্য সহস্র ব্যগ্র-বাহু প্রসারণ করিয়া একেবারে আকুল করিয়া উঠিল। সন্ধান লইয়া জানিলাম , তোমার সহিত লীলার বিবাহ হইবে। সেজন্য লীলার মা আর নরেন্দ্রনাথের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আর তোমার আর্থিক অবস্থা যেমনই হউক , তোমার সচ্চরিত্রতার উপর তাঁহাদের এক বিশ্বাস। স্থির করিলাম নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য তাঁহাদের সেই অনন্ত বিশ্বাস দ্রুত ভাঙিতে হইবে।”
আমি স্তম্ভিত হৃদয়ে , সংযতশ্বাসে তাহার হৃদয়হীনতার ও পাষণ্ডপনার ঘৃণ্যকাহিনী শুনিতে লাগিলাম।
” তাহার পর তোমার রুগ্না মাতাকে লইয়া তুমি বৈদ্যনাথে চলিয়া গেলে। আমি সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। তুমি যেদিন যাও , তাহার দুইদিন পূর্ব্বে বোধ হয় শুনিয়া গিয়াছিলে , হরিহর মুখোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যাটি সহসা অন্তর্হিত হইয়াছে ; সে কাজ আমারই। আমিই সেই ব্রাহ্মণকন্যা মোক্ষদাকে গ্রামের বাহিরে – কেহ না সন্ধান করিতে পারে – এমন একটি গুপ্তস্থানে রাখিয়াছিলাম। সমাজের চক্ষে মোক্ষদা যতই দোষী হউক না কেন , সে তাহার দোষ নহে , তাহাদিগের কৌলীন্য-প্রথার দোষ। তোমার বৈদ্যনাথ যাইবার ছয় মাস পূর্ব্বে মোক্ষদার সহিত আমার পরিচয় হয়। মোক্ষদা আমাকে খুব ভালবাসিত – এখনও তাহার সেই ভাব। হায় , যদি তাহারই সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসায় চিরমুগ্ধ থাকিতাম – যদি রূপৈশ্বর্য্যময়ী লীলা আমার চোখে না পড়িত ; এবং সেই একবার দর্শনে আমার হৃদয় মোহময় করিয়া না তুলিত , তাহা হইলে বোধহয় , পাপেই হউক , আর পুণ্যেই হউক , মোক্ষদাকে লইয়াই এ জীবনে এক রকম সুখী হইতে পারিতাম। সেকথা যাক্ , তাহার পর আমি গ্রামের মধ্যে রটনা করিয়া দিলাম , মোক্ষদার অপহণটি তোমার দ্বারাই হইয়াছে -”
কি নৃশংস !
“- তুমি মোক্ষদাকে আগে বৈদ্যনাথে পাঠাইয়া দিয়াছ , সেখানে তাহাকে কোন স্বতন্ত্র বাটীতে রাখিয়া , অপর একখানি বাটী ভাড়া করিয়া মাতাপুত্রে থাকিবে , এইরূপ অভিপ্রায়ে তুমি মাতার পীড়া উপলক্ষ করিয়া বৈদ্যনাথে গিয়াছ। তাহার পর কতকগুলা মিথ্যা প্রমাণ ঠিক করিয়া এখানকার সকলেরই নিকটে কথাটি খুব বিশ্বাস্য করিয়া তুলিলাম। নরেন্দ্র আর লীলার মা তোমাকে ভাল রকমে জানিতেন – তাঁহারা কথাটা প্রথমে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে শুনিয়াছিলেন বটে ; কিন্তু বিশ্বাস করেন নাই। তাহাতে আমার অভীষ্ট সিদ্ধির কোন ব্যাঘাত ঘটিল না। কেননা , লীলার পিতা ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই দেখিলেন না , এবং সহজেই বিশ্বাস করিলেন। তাহার পর দহ্যমান্ হস্তে একটি ক্ষুদ্র যূথিকাকে বৃন্তচ্যুত করিলাম। সেইদিন স্বহস্তে একটা অক্ষয় চিতা রচনা করিয়া নিজের – শুধু নিজের নহে – লীলার আর তোমার – এক সঙ্গে তিন জনের হৃদ্পিণ্ড ছিন্ন করিয়া সেই চিতানলে নিক্ষেপ করিলাম।”
শুনিয়া অনিবার্য্য ক্রোধে আমার শ্বাসরুদ্ধ হইল। মনে করিলাম , তখনই পদতলে দলিত করিয়া তাহার পাপ প্রাণটা এ পৃথিবী হইতে বাহির করিয়া দিই ; কিন্তু তখনই লীলাকে মনে পড়িল – সেই লীলা। এই দানব সেই দেবীরই স্বামী। আর সেই প্রবোধচাঁদ – তাহাকে কোন অপরাধে পিতৃহীন করিব?
ঈশ্বর যেন কখনও আমার এমন মতি না দেন। শশিভূষণকে হত্যা করিয়া কোন লাভ নাই ; কিন্তু সেইদিন হইতে প্রতিজ্ঞা করিলাম , সদুপায়ে হউক আর অসদুপায়ে হউক , যেমন করিয়া হউক , এই পাষণ্ডের পীড়ন হইতে লীলাকে মুক্ত রাখিবার জন্য প্রানপণ করিব ; এবং সেজন্য হিতাহিত বিবেচনাশূন্য হইব।