ক্রমে লোকমুখে বিশেষতঃ লীলার ভাই নরেন্দ্রের মুখে শুনিলাম , লীলার স্বামী লীলার প্রতি পশুবৎ ব্যবহার করিয়া থাকে ; এমন কি , যেদিন বেশী নেশা করে , সেদিন প্রহার পর্য্যন্ত। নরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা হইলে সে প্রতিবারেই বন্ধুভাবে এই সকল কথা আমার কাছে উত্থাপন করিয়া যথেষ্ট অনুতাপ করিত , এবং পিতৃনিন্দানামক মহাপাপে লিপ্ত হইত।
অনুতাপদগ্ধ লীলার পিতা এখন ইহলোক হইতে অপহৃত হইয়াছেন , সুতরাং তাঁহার অমোঘ একজ্ঞায়িতার পরিণাম তাঁহাকে দেখিতে হয় নাই।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এইরূপে আর একটা বৎসর অতিবাহিত হইল। লীলার স্বামী শশিভূষণের বাটী লীলার পিতৃগৃহ হইতে অধিক দূরে নহে , এক ঘণ্টায় যাওয়া-আসা যায় ; তথাপি শশিভূষণ লীলাকে এপর্য্যন্ত একবারও পিতৃগৃহে আসিতে দেয় নাই। নরেন্দ্রের কাছে শুনিলাম লীলারও সেজন্য বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। পিতার মৃত্যুকালে লীলা একবার মাত্র পিতৃগৃহে আসিবার জন্য তাহার স্বামীর নিকট অত্যন্ত জেদ্ করিয়াছিল ; কিন্তু দানবচেতার নিকটে তাহা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছিল। সেই অবধি লীলা আর পিতৃগৃহে আসিবার নাম মুখে আনিত না।
এ বৎসর পূজার সময়ে লীলা একবার পিতৃগৃহে আসিয়াছিল। শারদীয়োৎসবোপলক্ষে নহে , লীলার মার বড় ব্যারাম , তাই সে আসিয়াছিল। মাতার আদেশে একবার নরেন্দ্রনাথ শশিভূষণকে অনেক বুঝাইয়া হাতে-পায়ে ধরিয়া , কাঁদিয়া-কাটিয়া ভগিনীকে নিজের বাড়ীতে আনিয়াছিল।
আমি নরেন্দ্রের রুগ্না মাতাকে দেখিবার জন্য যেমন প্রত্যহ তাহাদের বাড়ীতে যাইতাম , সেদিনও তেমনি গিয়াছিলাম। সেখানে আমার আবাল্য অবারিত দ্বার। যখন ইচ্ছা হইত , তখনই যাইতাম ; কোন নির্দ্দিষ্ট সময়সাপেক্ষ ছিল না। সেদিন যখন যাই , তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল।
সন্ধ্যার পর শুক্লাষ্টমীর কি সুন্দর চন্দ্রোদয় হইয়াছে। জ্যোৎস্না-প্লাবনে নক্ষত্রোজ্জ্বল নির্ম্মেঘ আকাশ কর্প্পূরকুন্দধবল। অদূরবর্ত্তী প্রবাহমানা তটিনীর সুন্দর কলগীতি অস্পষ্ট শ্রুত হইতেছিল। সম্মুখস্থ পথ দিয়া কোন যাত্রাদলের বালক “দাসী বলে গুণমণি মনে কি পড়েছে তোমার” , গায়িয়া গায়িয়া আপন মনে ফিরিতেছিল। গায়ক বালকের হৃদয়ে কত হর্ষ ! কি উদ্দাম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ! তুষানলদগ্ধ জীবন্মৃত আমি – আমি কি বুঝিব? হৃদয়ে যে নরকাগ্নির স্থাপনা করিয়াছি , তাহা আজীবন ভোগ করিতে হইবে। যেদিকে দৃষ্টিপাত করি , সকলই যেন হাস্যপ্রফুল্ল – উৎফুল্ল চন্দ্র ; উৎফুল্ল নক্ষত্রমালা ; উৎফুল্ল সমীরণ ; উৎফুল্ল আম্রশাখাসীন পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর কণ্ঠ ; উৎফুল্ল আলোকাম্বরা শোভনা প্রকৃতির চারুমুখ। কেবল আমি – শান্তিশূন্য – আশা শূন্য – কর্ত্তব্যচ্যুত – উদ্দেশ্যহীন কোন্ দূরদৃষ্ট পথের একমাত্র নিঃসঙ্গ যাত্রী।
বাটীর সম্মুখ-দ্বারেই নরেন্দ্রের সহিত আমার দেখা হইল। তখন সে ডাক্তারের বাড়ী যাইতেছে ; সুতরাং তাহার সহিত বিশেষ কোন কথা হইল না।
আমি বাটীর মধ্যে যাইয়া যে ঘরে নরেন্দ্রের মাতা ছিলেন , সেই ঘরের প্রবেশ-দ্বারে দাঁড়াইলাম। দেখিলাম , রোগশয্যায় নরেন্দ্রের মাতা পড়িয়া আছেন। পার্শ্বে বসিয়া একজন কঙ্কালসর্ব্বস্ব স্ত্রীলোক তাঁহার মস্তকে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিতেছে। প্রদীপের আলো আসিয়া সেই উপবিষ্টা স্ত্রীলোকের অধিলুলিতচিবুক , প্রকটগণ্ডাস্থি অরক্তাধর ম্রিয়মাণ মুখের একপার্শ্বে পড়িয়াছে। প্রথমে চিনিতে পারিলাম না। তাহার পর বুঝিলাম – এ সেই লীলা। আজ দুই বৎসরের পরে লীলাকে এই দেখিলাম। যাহা দেখিলাম , তাহা না দেখিলেই ভাল ছিল।
লীলার সেই শরন্মেঘমুক্তচন্দোপম স্মিত মুখমণ্ডল রৌদ্রক্লিষ্ট স্থলপদ্মের ন্যায় একান্ত বিবর্ণ এবং একান্ত বিষণ্ণ। সেই লাবণ্যোজ্জ্বল দেহলতা নিদাঘসন্তপ্তকুসুমবৎ শ্রীহীন। সেই ফুল্লেন্দীবরতুল্য স্নেহ-প্রফুল্ল আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু কালিমাঙ্কিত ! বিষাদ-বিদীর্ণ হৃদয়ে লীলাকে দেখিতে লাগিলাম – ক্ষণেকে আমার আপাদমস্তক স্বেদাক্ত হইল। কি আশ্চর্য্য , দুই বৎসরে মানুষের এমন ভয়ানক পরিবর্ত্তনও হয় !
মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলাম , হে করুণাময় ! হে অনাথের নাথ ! দীনের অবলম্বন , নিরাশ্রয়ের আশ্রয় ! যাহার আশা আমি ত্যাগ করিয়াছি – যাহার চিন্তাতেও আমার আর অধিকার নাই ; কেন প্রভু ! আবার তাহাকে এ মূর্ত্তিতে আমার সামনে ধরিলে? প্রভো ! আমার হৃদয় অসহ্য বেদনাভারে ভাঙিয়া-চুরিয়া যাক্ , অবিশ্রান্ত তুষানলে পুড়িয়া খাক্ হইয়া যাক্ , ক্ষতি নাই ; লীলাকে সুখী কর – তাহার অন্ধকার মুখ হাসিমাখা করিয়া দাও। আমি আর কিছুই চাহি না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমাকে দেখিতে পাইয়া লীলা মাথায় কাপড় দিল। এবং তাড়াতাড়ি উঠিয়া , জড়সড় হইয়া লজ্জানম্রমুখে যেমন ঘরের বাহির হইতে যাইবে , তাহার ললাটের একপার্শ্বে কবাটের আঘাত লাগিল। লীলা সরিয়া দাঁড়াইল।
আমি কতকটা অপ্রকৃতিস্থভাবে তাহাকে বলিলাম , ” লীলা , বসো। তুমি কি আমাকে চিনিতে পার নাই?”
আমার বিশ্বাস – লীলাকে চিনিতে প্রথমে আমার মনে যেমন একটা গোলমাল উপস্থিত হইয়াছিল , সেইরূপ তাহারও কিছু একটা ঘটিয়া থাকিবে। এ-লীলা , সে-লীলার মত নয় বলিয়া আমার মনে এইরূপ ধারণা হইয়াছিল। যাক , এমন সময়ে পার্শ্ববর্তী গৃহমধ্যস্থ কোন দুগ্ধপোষ্য শিশুর করুণ ক্রন্দন শ্রুত হইল। লীলা মৃদুনিক্ষিপ্ত শ্বাসে “আসছি”, বলিয়া ঘরের বাহির হইয়া গেল।
আমি চিন্তিত মনে রুগ্নার শয্যার পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলাম। রুগ্না নিদ্রিতা। অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়াছিলেন , সুতরাং আমি পূর্ব্বে তাহা বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , “এখন কেমন আছেন?”
তাহাতেই তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমাকে দেখিয়াই বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার শয্যার একপার্শ্বে বসিলাম। তাহার পর তিনি বলিতে লাগিলেন “বড় ভাল নয় বাবা , এ যাত্রা যে রক্ষা পাইব , এমন মনে হয় না। নরেন রহিল – লীলা রহিল , উহাদের তুমি দেখিয়ো। আমি জানি , তুমি উহাদের ছোট ভাই ভাই-বোনের মত দেখ ; এখন উহাদের আর কেহ রহিল না ; তুমি দেখিয়ো। তুমিই উহাদের বড় ভাই।”
আমি বলিলাম , ” সেজন্য আমাকে বিশেষ কিছু বলিতে হইবে না। নরেন্দ্র ও লীলা যে আমাকে বড় দাদার ন্যায় ভক্তি করে , তাহা কি আমি জানি না? আমি আজীবন তাহাদের মঙ্গল-চেষ্টা করিব। ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি এখন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করিলে সকল দিক রক্ষা হয়।”