এইরূপ জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি আমার উত্তরের জন্য ক্ষণমাত্র অপেক্ষা না করিয়া তন্ময়চিত্তে বলিতে লাগিলেন , ” মোক্ষদা মেয়েটা ভারী চালাক – যতদূর হতে হয় – ওঃ ! বেটী কি বুদ্ধিমতী , সাবাস্ মেয়ে যা হক !”
আমি তাহার সেই তন্ময়তার মধ্যে একটু অবসর পাইয়া বলিলাম , ” ওঃ হরি ! আপনি তাহা হইলে এখন সেই মোক্ষদাকে দোষী ঠিক -”
বাধা দিয়া আমার মুখের দিকে ক্ষণমাত্রস্থায়ী একটা বিরক্তিব্যঞ্জক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন , ” মোক্ষদা? তাও কি সম্ভব ! একি কাজের কথা? আপনি অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছেন দেখিতেছি – আপনি আমার নিযোক্তা – আপনার কাছে কথাটা আর অধিকক্ষণ গোপন রাখা ঠিক হয় না। অন্য আর প্রমাণ দেখাইবার কোন আবশ্যকতা নাই – আমি একেবারে হত্যাকারীকে আপনার প্রত্যক্ষ করিয়া দিতেছি।”
বলিতে বলিতে অক্ষয়কুমারবাবু উঠিলেন। ক্ষিপ্রহস্তে পথের দিক্কার একটি জানালা সশব্দে খুলিয়া ফেলিলেন। এবং জানালার সম্মুখভাগে ঝুঁকিয়া কাহাকে লক্ষ্য করিয়া বংশীধ্বনি করিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আমার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল , এবং দৃষ্টি সম্মুখে সর্ষপ-কুসুম নামক বিবিধ-বর্ণ-বিচিত্র ক্ষুদ্র গোলকগুলি নৃত্য করিয়া উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল।
ক্ষণপরে দুইটি লোক সেই ঘরে প্রবেশ করিল। একজনকে দেখিবামাত্র পুলিস-কর্ম্মচারী বলিয়া চিনিতে পারিলাম। আর তাহার পাশের লোকটি সে-ই – গত রাত্রে যে বালিগঞ্জের পথ হইতে আমার বাড়ী পর্য্যন্ত আমার অনুসরণে আসিয়াছিল।
সেই লোকটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া অক্ষয়কুমারবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন , ” আপনি কি এই লোকটিকে চিনিতে পারেন?”
আমি বলিলাম , ” হ্যাঁ , যখন আমি আপনার বাগান হইতে ফিরিতেছিলাম , তখন এই লোকটি আমার বাড়ী পর্য্যন্ত অনুসরণ করিয়া আসিয়াছিল ; কিন্তু তাহার পূর্ব্বে ইহাকে আর কখনও দেখি নাই।”
অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন , ” না দেখিবারই কথা। আমারই আদেশে এই লোক আপনার অনুসরণ করিয়াছিল।” এই বলিয়া তিনি বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া নবাগতদ্বয়কে বলিলেন , ” তোমাদের ওয়ারেন্ট বাহির কর , ইঁহারই নাম যোগেশবাবু – ইনিই লীলার হত্যাকারী।”
কথাটা শুনিয়া বজ্রাহতের ন্যায় আমি সবেগে লাফাইয়া উঠিয়া দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গেলাম। এবং তেমন মধ্যাহ্ণ-রৌদ্রোজ্জ্বল দিবালোকেও উন্মীলিত চক্ষে চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। এই বিশ্বজগতের সমুদয় শব্দ-কোলাহল আমার কর্ণমূলে যুগপৎ স্তম্ভিত হইয়া গেল গাঢ়তর গাঢ়তর গাঢ়তর অন্ধকারে চারিদিক ব্যাপিয়া ফেলিল। কতক্ষণ পরে জানি না – প্রকৃতিস্থ হইয়া দেখিলাম , অয়ষ্কঙ্কণে আমার হস্তদ্বয় শোভিত এবং সন্নিবদ্ধ হইয়াছে। অক্ষয়বাবু বলিতেছেন , যোগেশবাবু , আপনার জন্য আমি দুঃখিত হইলাম। কি করিব? কর্ত্তব্য আমাদিগের সর্ব্বাগ্রে। আপনি জানিয়া-শুনিয়াও এইমাত্র মোক্ষদার স্কন্ধে নিজের অপরাধটা চাপাইতেছিলেন? তাহাতে আপনাকে বড় ভাল লোক বলিয়া বোধ হয় না। সে যাহা হউক , যেদিন আপনি আমার সহিত প্রথম দেখা করেন , সেইদিন আপনার মুখে হত্যাবৃত্তান্ত শুনিবার সময়েই আমি কোন সূত্রে আসল ঘটনাটা ঠিক বুঝিতে পারিয়াছিলাম। সেইজন্যই আপনার দেয় পুরষ্কারের হাজার টাকা একটি দস্তুরমত লেখাপড়া করিয়া কোন ভদ্রলোকের মধ্যস্থতায় জমা রাখিতে বলি। আপনিও তাহা রাখিয়াছেন। আর আপনিও জানেন , শুধু হাত কখন কাহারও মুখে ওঠে না। সে যাহাই হউক , ইহাতেই আপনার হৃদয়ের একটা মহৎ উদারতার পরিচয় পাওয়া যায় , শশিভূষণ আপনার ঘোরতর শত্রু হইলেও সে যে নিরপরাধ , তাহা আপনি অন্তরে জানিতেন। আপনার অপরাধে যে তাহাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে , এই ভাবিয়া আপনার যথেষ্ট অনুতাপ হইতেই এই হাজার টাকা পুরস্কারের সৃষ্টি। এখন দুই-চারিটি প্রমাণ দেখাইয়া দিলে , আপনি যে একটা অর্ব্বাচীনের হাতে কেস্টা দেন নাই , সে সম্বন্ধে আপনার আর কোন সন্দেহ থাকিবে না। যেদিন লীলা খুন হয় , সেইদিন রাত দশটার সময়ে বাগানে আপনার সঙ্গে শশিভূষণের খুব একটা রাগারাগি হয়। এবং তাহাকে খুন করিবেন বলিয়া আপনি উচ্চকণ্ঠে শাসাইয়াছিলেন। অবশ্যই আপনার সেই উচ্চকণ্ঠের শাসনগুলি সেই সময়ে শশিভূষণ ছাড়া আরও দুই-একজনের শ্রুতিগোচর হইয়াছিল। ইহার কিছুক্ষণ পরে শশিভূষণ তাহার ছুরি চুরির কথা জানিতে পারে। শশিভূষণকে না বলিয়া সেই ছুরিখানি আপনি লইয়াছিলেন। আপনার এই ‘না-বলিয়া-ছুরি-গ্রহণ’ সম্বন্ধে আমি দুই-একটা প্রমাণও সংগ্রহ করিয়াছি। সেদিন শশিভূষণের তীক্ষ্ণতর কটূক্তিতে আপনার রক্ত নিরতিশয় উষ্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। আপনি বাড়ীতে ফিরিয়াও নিজেকে কিছুতেই সামলাইতে পারেন নাই ; আপনি শশিভূষণকে হত্যা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়া পুনরায় তাহার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। এবং আপনার মাথায় হঠাৎ কি একটা প্ল্যান্ উদ্ভব হওয়ায় , আসিয়াই বৈঠকখানা ঘর হইতে ছুরিখানা ‘না-বলিয়া-হস্তগত-করা নামক পাপে’ লিপ্ত হইয়া আসেন। তখন একজন পরিচারিকা আপনাকে দেখিয়াছিল। আপনি ভদ্রলোক , সে ছোটলোক সুতরাং তখন সে আপনার উপর এরূপ একটা গর্হিত সন্দেহ করিতে পারে নাই। এদিকে যখন এইরূপ দুই-একটি ক্ষুদ্র ঘটনা আরম্ভ ও সমাপ্ত হইয়া গেল , তখনও শশিভূষণ সেই বৈঠকখানার ছাদে মদ খাইতেছিল। উদ্যানে আপনাদের সেই বাগ্বিতণ্ডার পরে আপনি যখন চলিয়া গেলেন – কোন দুর্জ্ঞেয় কারণে শশিভূষণের মনে একটা বড় অস্বাচ্ছন্দ্য উপস্থিত হয়। এবং সেই অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করিবার জন্য সে আবার বৈঠকখানার ছাদে উঠিয়া মদ্যপান আরম্ভ করিয়া দেয়। মদেই লোকটা মাথা খাইয়া দিয়াছিল। যতটা পারি , বসিয়া বসিয়া খাইল। তাহার পর বাকীটা বোতলের মুখে ছিপি আঁটিয়া যখন ঘরের আলমারীতে রাখিতে যায় – তখন দেখে আলমারী খোলা রহিয়াছে এবং ছুরিখানি সেখানে নাই। দেখিয়া প্রথমে একটু চিন্তিত হইল। তাহার পর দুই-একবার এদিক-ওদিক খুঁজিয়া না পাইয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল। এবং লীলাকে ছুরির সহসা অদৃশ্য হবার কথা বলিল। সেই সময়ে তাহার শয়ন-গৃহের পার্শ্বস্থ গলিপথে মোক্ষদা কোন লোককে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিল। মোক্ষদাকে আমি সেই লোকটার নাম জিজ্ঞাসা করায় সে বলে তাঁহাকে সে চেনে না , পূর্ব্বে কখনও দেখে নাই। তখন আমি একটা কৌশল করিয়া আপনাকে তাহার সম্মুখে নিয়ে যাই ; আপনি তাহার মুখে তখন যে সকল কথা শুনিয়াছিলেন , তাহা ভাষণমাত্র , আমিই তাহাকে এইরূপ একটা অভিনয় দেখাইতে শিখাইয়া দিয়াছিলাম। যাহা হউক , মোক্ষদা আপনাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারে। তখন রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হইয়া আসিল। তাহা হইলেও কেবল মোক্ষদার কথায় আমি বিশ্বাস করি নাই – সেটা ডিটেক্টিভদিগের স্বধর্ম্মও নহে। আর যাহা হউক , সেই প্রাচীরের পার্শ্ববর্ত্তী পদচিহ্ণগুলি মিলাইয়া দেখিবার একটা সুযোগ সেই সঙ্গে ঠিক করিয়া লই। সেইজন্য আপনাকে আমার বাগানবাড়ীতে গিয়া হল্ঘরে যাইতে সবেমাত্র-বিলাতীমাটি-দেওয়া সোপানে নগ্নপদে অতি সন্তর্পণে উঠিতে হয়। তাহাতে সেই সদ্যোমার্জ্জিত বিলাতীমাটিতে আপনার পায়ের যে সব দাগ পড়ে , আমি সেইগুলির সহিত ময়দার ছাপে তোলা সেই গলি পথের দাগগুলি মিলাইয়া বুঝিতে পারি – সকলই এক পায়ের চিহ্ণ এবং সেই পা মহাশয়েরই।” এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন , এবং নিজের হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে অতি উৎসাহের সহিত বলিতে লাগিলেন , ” মোক্ষদা বেটী ভারি চালাক – ভারী বুদ্ধিমতী – সাবাস্ মেয়ে যা হোক – যতদূর ফিচেল হতে হয়। কি জানেন , যোগেশবাবু , তাহা হইলেও , আমি , মোক্ষদার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পারি নাই। আপনাদের সহিত সাক্ষাৎকালে সে যদি আমার কথা আপনাকে বলিয়া দিয়া থাকে , যে আমি আপনাকে ফাঁদে ফেলিবার চেষ্টা করিতেছি ; অথবা আপনি কৌশলে তাহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির করিয়া লইয়া আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া থাকেন , এই আশঙ্কা করিয়া আমি এই লোককে তখন আপনার বাড়ী পর্য্যন্ত আপনার অনুসরণ করিয়া দেখিতে বলিয়াছিলাম। আপনি বাড়ীতে যান , কি আর কোথায় যান – কি করেন , আপনার মুখের ভাব কি রকম , এইসব লক্ষ্য করিতে বলিয়া দিয়াছিলাম। যখন আপনি বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন , এই লোক তখন আপনার বাড়ীর সম্মুখে দুইঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া যখন আপনাকে বাহিরে আসিতে দেখিল না – তখন নিশ্চিত মনে ফিরিয়া আসিয়া আমাকে সংবাদ দিল। তাহার পর আপনার নামে আজ ওয়ারেণ্ট বাহির করিয়া আমার কর্ত্তব্য নিষ্পন্ন করিলাম। বলিতে কি , অনেক খুনের কেস্ আমার হতে আসিয়াছে , তার মধ্যে একটা ছাড়া এমন অদ্ভুত কোনটাই নয়। যাহা হউক , এখন বুঝিলেন , শশিভূষণ নিরপরাধ এবং হত্যাকারী কে?”