- বইয়ের নামঃ হত্যাকারী কে
- লেখকের নামঃ পাঁচকড়ি দে
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
হত্যাকারী কে? – ০১
প্রথমার্ধ
উপক্রমণিকা
আমার কথা
দুইজনেই নীরবে বসিয়া আছি , কাহারও মুখে কথা নাই। তখন রাত অনেক , সুতরাং ধরণীদেবীও আমাদের মত একান্ত নীরব। সেই একান্ত নীরবতার মধ্যে কেবল আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিক্ষণে স্পষ্টীকৃত হইতেছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আমি পকেট হইতে ঘড়ীটা বাহির করিয়া দেখিলাম , “ইঃ ! রাত একটা !”
আমার মুখে রাত একটা শুনিয়া যোগেশবাবু আমার মুখের দিকে একবার তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন। অনন্তর উঠিয়া একান্ত চিন্তিতের ন্যায় অবনতমস্তকে গৃহমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন। এইরূপ আরও কিছুক্ষণ কাটিল , হঠাৎ পার্শ্ববর্তী শয্যার উপরে বসিয়া , আমার হাত ধরিয়া যোগেশচন্দ্র ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন , –
“আপনার সদয় ব্যবহারে আমি চির ঋণী রহিলাম। আপনার ন্যায় উদার হৃদয় আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। আপনি ইতিপূর্ব্বে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন ; কিন্তু আমি তাহার যথাযথ উত্তর দিতে পারি নাই ; আমার এখনকার অবস্থার কথা একবার ভাবিয়া দেখিলে আপনি অবশ্যই বুঝিতে পারিবেন , সেজন্য আমি দোষী নহি। আপনি আমার সম্বন্ধে যে সকল বিষয় জানিবার জন্য একান্ত উৎসূক হইয়াছেন , আমি তাহা আজ অকপটে আপনার নিকট প্রকাশ করিব ; নতুবা আমার হৃদয়ের এই দুর্ব্বহ ভার কিছুতেই কমিবে না। ঘটনাটা যেরূপ জটিল রহস্যপূর্ণ , শেষ পর্য্যন্ত শুনিতে আপনার অত্যন্ত আগ্রহ হইবেই। আপনি যদি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে পারেন , তাহা হইলে আমি এখনই আরম্ভ করিতে পারি। ঘটনাটার মধ্যে আর কোন নীতি বা হিতোপদেশ না থাক , অক্ষয়বাবু যে একজন নিপুণ ডিটেক্টিভ সে পরিচয় যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কেহ যদি কখনও কোন বিপদে পড়েন , তিনি যেন অক্ষয়বাবুরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। আমার বিশ্বাস , ন্যায়পথে থাকিয়া নিরপেক্ষভাবে যথাসময়ে ঠিক কার্য্যোদ্ধার করিবার ক্ষমতা তাঁহার বেশ আছে।”
আমি মুখে যোগেশবাবুকে কিছুই বলিলাম না। মুখ চোখের ভাবে মস্তকান্দোলনে বুজ্খাইয়া দিলাম , তাঁহার কাহিনী আমি তখনই শুনিতে প্রস্তুত , এবং সেজন্য আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আরও একটু ভাল হইয়া বসিলাম।
যোগেশচন্দ্র তখন বলিতে আরম্ভ করিলেন।
প্রথম পরিচ্ছেদ
যোগেশচন্দ্রের কথা
কি মনে করিয়া যে আমি তখন অক্ষয়বাবুকে আমার কাজে নিয়োজিত করিয়াছিলাম , সেকথা এখন ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। কতক বা ভয়ে , কতক বা রাগে এবং কতক বা অনুতাপে , তখন আমি কতকটা পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম। যদি আপনি কখনও কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন – প্রকৃত ভালবাসা যাহাকে বলে , যদি আপনি সেইরূপ ভালবাসায় কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন , তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন , কি মর্ম্মান্তিক ক্লেশ আমি ভোগ করিতেছি। কি আশ্চর্য্য , আমি এখনও সেই নিদারূণ যন্ত্রণা সহ্য করিয়া বাঁচিয়া আছি।
আমি বাল্যকাল হইতেই লীলাকে ভালবাসিয়া আসিতেছি। লীলা আমাকে সর্ব্বন্তঃকরণে ভালবাসিত ; সে ভালবাসার তুলনা হয় না। মরিয়াও কি লীলাকে ভুলিতে পারিব? শৈশবকাল হইতেই শুনিতাম লীলার সহিত আমার বিবাহ হইবে। তখন হৃদয়ের কোন প্রবৃত্তি সজাগ হয় নাই , তথাপি সেকথায় কেমন একটি অজানিত আনন্দ-প্রবাহে সমগ্র হৃদয় উল্লসিত হইয়া উঠিত। তাহার পর বড় হইয়াও সেই ধারা অটুট ছিল। আমাদিগের আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না বলিয়া আমার সহিত লীলর বিবাহে লীলার পিতার কিছু অনিচ্ছা থাকিলেও লীলার মাতার আর তাহার ভ্রাতা নরেন্দ্রনাথের একান্ত আগ্রহ ছিল। নরেন্দ্রনাথ আমার সহাধ্যায়ী বন্ধু। এমনকি , তাঁহাদিগের আগ্রহে লীলার পিতাকেও সম্মত হইতে হইয়াছিল। সুতরাং লীলা যে একদিন আমারই হইবে , এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার সমভাবে অক্ষুণ্ণ ছিল।
এমন সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে আমার পীড়িতা মাতাকে লইয়া আমাকে বৈদ্যনাথে যাইতে হয়। পীড়ার উপশম হওয়া দূরে থাক্ , বরং উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। মা বাঁচিলেন না। মা ভিন্ন সংসারে আমার আর কেহ ছিল না। মাতার সহিত সংসারের সমুদয় বন্ধন আমার শিথিল হইয়া গেল – সমগ্র জগৎ শূন্যময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। একমাত্র লীলা – সে শূন্যতার মধ্যে – দীনতার মধ্যে – আমার সমগ্র হৃদয়ে অভিনব আশার সঞ্চার করিতে লাগিল।
বৎসরেক পরে দেশে ফিরিয়া শুনিলাম লীলা নাই – লীলা আমার নাই – তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে – সে তখন অপরের। তাহার চিন্তাও তখন আমার পক্ষে পাপ। এই মর্ম্মভেদী কথা শুনিবার পূর্ব্বে আমার মৃত্যু শ্রেয়ঃ ছিল।
লীলার পিতা এ বিবাহ জোর করিয়া দিয়াছেন , পত্নী পুত্রের মতামত তাঁহার কাছে আদৌ গ্রাহ্য হয় নাই।
যাহার সহিত লীলার বিবাহ হইয়াছে , তাহার নাম শশিভূষণ। সে আমার অপরিচিত নহে। তাহার সহিত আমার আগে খুব বন্ধুত্ব ছিল।
মাথার উপরে শাসন না থাকায় , নির্দ্দয়প্রকৃতি পিতৃহীন শশিভূষণের চরিত্র যৌবন-সমাগমে যখন একান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল , আমি তখন হইতে আর তাহার সহিত মিশিতাম না ; হঠাৎ কখনও যদি কোনদিন পথে তাহার সহিত দেখা-সাক্ষাৎ ঘটিত , পরস্পর কুশল প্রশ্নাদি ছাড়া বন্ধুত্বসূচক কোন বাক্যালাপ ছিল না।
শশিভূষণের বাৎসরিক হাজার-বারশত টাকার একটা আয় ছিল ; তাহাতেই এবং প্রতিমাসে কিছু কিছু দেনা করিয়া তাহার সংসার , বাবুয়ানা , বেশ্যা এবং মদ বেশ চলিত। সেই ঘোরতর মদ্যপ বেশ্যানুরক্ত শশিভূষণ এখন লীলার স্বামী।