গোবিন্দ। একটু সন্দেহের জন্য। যদি এ সেই লোক হয়, তবে যে রকম বুড়ী সেজেছে, তাতে খুব বাহাদুরী আছে। একটু সন্দেহ হওয়ায় ধরুলেম না, কারণ যথার্থই এ যদি বুড়ী হয়, তবে আমাকে বড়ই অপ্রস্তুত হতে হত। আরও একটি কথা, এ যদি সেই লোক হত, তবে অন্য ইয়ারিং নিজের বলে নিত না। তাও যদি নিয়ে থাকে লোকটা চতুর চূড়ামণি।
আমি। তা যাই হোক, সে নিজে না হলে—তার সঙ্গী ত নিশ্চয়। এর অনুসরণ করা আমাদের উচিত ছিল।
গোবিন্দ। বৃথা। এর অনুসরণ করলে,এখন এ বুড়ীটা–খুবই সম্ভব বুড়ী নয়—কিছুতেই সে সঙ্গীর নিকট যেত না। সচরাচর ডিটেক্টিভেরা তাই করে থাকে বটে, কিন্তু আমার প্রথা সেরূপ নয়। অনুসরণ করে অনেক সময়ই ঠিক ফল পাওয়া যায় না।
এই সময়ে সহসা ঘরের মধ্যে আট দশটা ধূলা মাখা নেংটী পরা ছোঁড়া প্রবেশ করিল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া, চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
গোবিন্দ বাবু আমার ভাব দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, এরা আমারই তাল-বেতালের দল।
তাহার পর তাঁহার তাল-বেতাল দলস্থ একজনের দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ননীয়া, কোন খবর আছে? তাকে খুঁজে পেয়েছ?
ননীয়া। না হুজুর, এখনও পাই নি।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আচ্ছা, খবর পেলে ননীয়া, তুমি একলা এসে আমায় খবর দিও, আর সকলে যেন রাস্তায় থাকে। এই লও, তোমাদের জল-খাবারের পয়সা। বলিয়া পকেট হইতে কতক গুলা পয়সা বাহির করিয়া ননীয়ার হাতে দিলেন। দাতা ও গৃহীত কেহই পয়সাগুলি গণনা করিলেন না। ননীয়া পয়সাগুলি তাহার নেটীংর এটা খুটে বাঁধিলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সন্ধান পাইলেই আমাকে খবর দিবে।
ননীয়া বলিল, হাঁ হুজুর।
গোবিন্দ। এখন যাও।
তাহারা উৰ্দ্ধশ্বাসে পলাইল; আমি অত্যন্ত বিস্মিতভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। তিনি বলিলেন, ভাল ভাল ডিটেকটিভ যা পারে না, এদের দ্বারা আমার সে কাজ হয়।
আমি। আপনি এদের সেটী-মহল্লার ব্যাপারে লাগিয়েছেন না কি?
গোবিন্দ। হাঁ।
আমি। কেন?
গোবিন্দ। পরে দেখতে পাবেন। আমি যাকে চাই, এরাই তার সন্ধান দিতে পাবে।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না ভাবিয়া আমি কিছু বলিলাম না। জানালা দিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, দি সুরমল সাহেব ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে উৎফুল্লমুখে আমাদের বাসার দিকেই আসিতেছেন। আমি সে কথা গোবিন্দ বাবুকে বলিলাম; গোবিন্দ বাবু উঠিয়া আসিয়া তাহাকে দেখিয়া বলিলেন, হাঁ। এবার কতকটা মজার কথা শুনতে পাওয়া যাবে।
আমি। কি রকম?
গোবিন্দ। দেখতেই পাবেন এখনই।
ক্ষণপরে সূরমল সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, আমাকে প্রশংসা করুন, এক মুখে নয় শতমুখে।
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, শত মুখ আমার ত নাই ব্যাপার কি?।
সূরযমল সাহেব মশুকান্দোলন করিয়া খুব উৎসাহের সহিত বলিলেন,ব্যাপার! সেটী-মহল্লার মামলার আমিই একটা কিনারা করে ফেলেছি।
গোবিন্দ। ইতিমধ্যেই, বাঃ বেশ, আপনি তবে ঠিক সূত্র ধরতে পেরেছেন?
সূরয। কেবল সুত্র ধরা নয়। সূত্র ধরতে–
গোবিন্দ বাবু বাধা দিয়া সপরিহাসে বলিলেন, তবে কি একেবারে রজ্জু ধরা নাকি–
সূরয। রজ্জুই বটে—আসামী একেবারে হাজতে।
গোবিন্দ। বলেন কি! তার নাম কি?
সূরয। তার নাম লালা গোকুল প্রসাদ, লোকটা রেলে কাজ করে।
গোবিন্দ। বটে, সব আমাদের খুলে বলুন। আমরা দুজনেই শুনে বিস্মিত হবার জন্য উৎসুক হয়ে রয়েছি।
সূরয। বলছি, শুনুন, শোনবার কথাই বটে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
সূরযমল সাহেব বলিতে লাগিলেন। আমরা উভয়ে নীরবে তাহার কথা শুনিতে লাগিলাম।
সূরযমল বলিলেন, আসল মজা হচ্ছে যে গাধা রাম সিং ভায়া উল্টা ধাঁধায় ঘুরছেন। তিনি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংয়ের সন্ধানে গেছেন। হা! হা! হা! আমি সন্ধান করে সেই ডাক পিয়নটার সঙ্গে আগেই দেখা করলেম। সে এই দুজন লোক যে বাসায় থাকত, তা দেখিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, আমি তখনই সেই বাড়ীতে গিয়ে সেখানে কে থাকে সন্ধান নিলেম। সে বাড়ীতে লালা গোকুলপ্রসাদ বলে একটা লোক বাস করে। তার সংসারে এক বুড়ী মা ও এক যুবতী বিধরা ভগ্নী ভিন্ন আর কেহ নাই। এই গোকুল প্রসাদ রেলে কেবল পনের টাকা মাহিনা পায়, তাতে তাদের চলে না দেখে বাড়ীর বার দিকটা ভাড়া দেয়। এই বার বাড়ীতে মাসখানেক দুজন মারাঠী এসে বাসা নিয়েছিল। আমি বাড়ীতে গোকুলপ্রসাদের সন্ধান নিয়ে জানলেম যে, সে রেলে কাজে গেছে। বুড়ী মা বাড়ীতে আছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করলেম। তার মেয়েও তার পাশে বসে রয়েছে। দেখলেম, দুজনেই বড় বিষন্না; বিশেষত মেয়েটা যে খুব কেঁদেছে, তা তার চোখ দেখলেই বোঝ। যায়। আমি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা কলাম, তোমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন খুন হয়েছে তা শুনেছ? বুড়ী ঘাড় নাড়িল, কিন্তু কোন কথা কহিল না, মেয়েটি কেঁদে উঠল। তখনই আমি বুঝলেম যে এরা এ খুনের ভিতরকার অনেক কথা জানে। তখন জিজ্ঞাসা করলেম, কাল কখন এরা দুজন তোমার বাড়ী থেকে বার হয়ে যান? সত্য কথা বল, আমি পুলিশের লোক। বুড়ীর মুখ আরও পাংশুবর্ণ হয়ে গেল,তার মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। সেই সময় মেয়েটি বলে উঠল, মা, মিথ্যা কথা বলা মিছে। যা যা হয়েছে সব একে বল। দাদা তাতে সন্তুষ্ট ভিন্ন অসন্তুষ্ট হবেন না। মেয়ের কথা শুনে বুড়ী ভয়ানক রেগে উঠল। পাগলী হতভাগী, তুই ত তোর দাদাকে মালি। বলে বুড়ী কঁদতে আরম্ভ করে দিল। আমি বললেম,আমাকে সত্য কথা বল,সব ঠিক ঠিক বলে বরং তোমাদের উপকার হবে। তখন বুড়ী চোখের জল মুছে বলতে লাগল,-মনে করবেন না, যে আমার ছেলে এই খুন করেছে, সে এর কিছুই জানে না। তবে পাছে আপনারা তাকে খুনী বলে সন্দেহ করেন, এইজন্যই আমার ভয়। বলেই বুড়ী থেমে গেল। আমি তখন বললেম,সব খুলে বলে উপকার আছে। বুড়ী বলে,দুজন মারাঠী ভদ্র লোক আমাদের বাড়ীতে এক মাস বাসা করে আছেন। আমরা বড় গরীব, খরচ চলে না বলে বার দিটা ভাড়া দিই। এমন হবে জালে কে এমন কাজ করে। সে যা হক, কাল একজন মারাঠী খুন হয়েছে শুনে, আমি তাকে দেখতে যাই; গিয়ে দেখি যার নাম বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, তিনিই খুন হয়েছন। ইনি খুব বড় লোক বলে বোধ হয়, দু হাতে টাকা খরচ করতেন। আর একজন যার নাম শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, সে বোধ হয় এর মোসাহেব ছিল। কিন্তু বড় লোক হলে কি হয়,-লোক বড় ভাল নয়। ভয়ানক মাতাল, রোজই বোতল বোতল মদ খেত, আর বলতে বলতে বুড়ী মধ্যপথে আবার থেমে গেল। আমি বললেম, কিছু গোপন কর না, সব সত্য বল। বুড়ী বলে,আয় এরা দুজনেই একদিন রাত্রে আমার মেয়ের উপর অত্যাচার করতে চান, আহা। বাছা আমার কত কেঁদেছে। সেই কথা শুনে গোকুলপ্রসাদ আমার, এদের উঠিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। এমন সময়ে–এই পরশু এরা একটা তারের খবর পেয়ে নিজেই জিনিষ-পত্র গুছিয়ে দেশে যাবার জন্য আন্দাজ রাত আটটার সময় ষ্টেশনে রওনা হয়। তারা চলে যেতে আমি খুব খুসী হলেম। কিন্তু রাত্রি এগারটা কি বারটার সময় আবার দেখি হঠাৎ বালকিষণ আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হল। বাছা গোকুলপ্রসাদের রাত্রে রেলে কাজ ছিল, সে তখনও ফিরে নাই বলে দরজা খোলা ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলেম, হাঁ, বালকিষণ এসে কি করলে? বুড়ী বলে, দেখি ভয়ানক মাতাল হয়ে এসেছে। আমার মেয়েকে ছুটে ছুটে টলে টলে ধরতে যায়, আমার সমুখে তাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। আমি একলা কি করব, এই মাতালের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা পাব, চেঁচিয়ে লোক ডাক্ব মনে কছি, ঠিক সেই সময়ে আমার ছেলে গোকুলপ্রসাদ এসে পড়ল। সে এসে সেই মাতালটার গলা ধরে তাকে রাস্তায় দিয়ে এল। তাতেও সে যায় না। দরজার সমুখে ভারি মাতলামী করতে লাগল, তখন আবার গোকুলপ্রসাদ একটা লাঠী নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিতে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর তোমার ছেলে কখন ফিরে এল?বুড়ী বলে,প্রায় ঘণ্টা দুই পরে।আমি জিজ্ঞাসা করলেম, এতক্ষণ কোথায় ছিল, কিছু বললে? বুড়ী বলে, হ, আমরা তার জন্য বসেছিলাম। এসে বলে যে তাকে রেল থেকে ডাক্ত এসেছিল, তাই রেল-আফিসে গিয়েছিল। আমি দেখলেম, সন্দেহের আর কিছুই নাই, ঠিক পথেই এসে পড়েছি; তথাপি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করলেম, আর সেই লোকটার কোন কথা তুমি তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর নাই? বুড়ী বলে, জিজ্ঞাসা করেছিলাম বই কি। তা সে বললে যে, তার হাতে লাঠী দেখে সে ভয়ে পালিয়ে গেছে। গোকুলপ্রসাদ পেছনে তাড়া করায়, সেইখান দিয়ে একখানা একা যাচ্ছিল, তাতে চড়ে সে পালিয়ে গেল। তখন আমি, হ, এতেই হবে, বলে বিদায় হলেম। সেখান থেকে বেরিয়ে একেবারে রেল-আফিসে গিয়ে গোকুল প্রসাদকে গ্রেপ্তার করলেম। আর প্রমাণ কি চাই? নিশ্চয়ই এ মারাঠীকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পেটে সজোরে লাঠীর গুতো মারায় হঠাৎ লোকটা মারা পড়ে। তখন গোকুল প্রসাদ লাসটা সেই থালি বাড়ীতে টেনে নিয়ে ফেলে রেখে বাড়ী ফিরে আসে।