আমি বলিলাম, কি রকমে?
তিনি বলিলেন, যে খুন করেছিল, সেই মাতালের ভাণ করে এই গাধার চোখে ধূলা দিয়েছে।
আমি। সে কেন আবার সেই বাড়ীর কাছে আসবে?
গোবিন্দ। ইয়ারিং-ইয়ারিং। এটা আর বুঝতে পারছেন না, ইয়ারিংয়ের তল্লাসে এসেছিল। ডাক্তার, আমি এই খুনীকে ধরেছি, কেবল হাতে হাতকড়ী দিতে বাকী।
আমি। আপনি কি বলতে চান, যে লোক খুন করেছে, সে কে, আপনি জানতে পেরেছেন?
গোবিন্দ। নিশ্চয়। এখন এই পর্যন্ত, পরে সব বলব।
কাজেই আমি আর তাহাকে বেশি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না, নিজেও ক্লান্ত হইয়াছিলাম। বাসায় আসিয়াই শুইয়া পড়িলাম।
পর দিবস প্রাতে গোবিন্দ বাবু আমাকে একখানি সংবাদপত্র, দেখিতে দিলেন। বলিলেন, এই বিজ্ঞাপনটা একবার দেখুন।
আমি দেখিলাম;–
কুড়ান পাওয়া গিয়াছে,–গত রাত্রে সেটী-মহল্লার রাস্তায় একটি ইয়ারিং কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছে। যাঁহার হারাইয়াছে, তিনি সিং দরজার ৪নং বাড়ীতে ডাক্তার বসুর নিকট আবেদন করিলে পাইবেন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিনানুমতিতে আপনার নাম ব্যবহার করিয়াছি, ক্ষমা করিবেন।
আমি বলিলাম,তাতে কিছুই ক্ষতি হয় নাই; তবে যদি কেহ আসে, তবে আমার কাছে ত ইয়ারিং নাই।
গোবিন্দ। ভয় নাই, আমি বাজার থেকে একটা ইয়ারিং কিনে এনেছি। এইটাতেই আমাদের কাজ চলবে।
আমি। আপনি কি মনে করেন, কেউ আসবে? গোব। নিশ্চয়ই। খুব সম্ভব সেই লোকই আবে। সে কোন রকমে ইয়ারিংটা ফেলে এসেছিল, পথে এসে ইয়ারিং সঙ্গে নেই দেখে ইয়ারিং খুঁজতে ফিরে এসেছিল; কিন্তু কনেষ্টবল দেখে মাতালের ভাণ করে চলে যায়। কাজেই সে মনে করতে পারে যে, ইয়ারিংটা হয় ত রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকবে।
আমি। সে কি এখানে আসা নিতান্ত বিপজ্জনক মনে করবে না?
গোবিন্দ। কেন? সে ভাববে যে ইয়ারিংটা নিশ্চয়ই রাস্তায় কোন গতিকে পড়ে গিয়েছিল, সুতরাং খুনের সঙ্গে যে ইয়ারিংটা পার কোন সম্ভাবনা আছে, তা তার মনে হবে না। পাছে সে কোন সন্দেহ করে, সেইজন্যই ত আপনার নামে বিজ্ঞাপন দিয়াছি। একজন ডাক্তার ব্যক্তি যে তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছে, তা তার মনেই হবে না। কাজেই সে নিশ্চয়ই আসবে।
আমি। যদি আসে তবে কি করবেন?
গোবিন্দ। দেখা যাবে তখন; তবে আপনার রিভলবারটি ঠিক করে রাখুন। লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সে এলে তার সঙ্গে বেশ গম্ভীর ভাবে কথা কবেন। যেন প্রথমেই সে কোন রকমে কোন সন্দেহ করতে না পারে।
এই সময়ে সদর দরজায় কে কড়া নাড়িল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সাবধান,আমরা যে মহাত্মাকে চাই,তিনি উপস্থিত। নিতান্ত পক্ষে যদি স্বয়ং না হন, তাঁরই লোক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
আমরা উভয়ে উৎকণ্ঠিত ভাবে আগন্তুকের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবুর খুনী-যুবকই সত্য সত্যই আসিতেছে, কিন্তু যে আসিল, সে যুবক নহে—একেবারে পুরুষ মানুষই নয়। একটি অতি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক—অতি কষ্টে ধীরে ধীরে গৃহে প্রবিষ্ট হইল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। দেখিলাম তিনি বৃদ্ধাকে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেছেন।
বৃদ্ধা গৃহ মধ্যে আসিয়া কহিল, ডাক্তার সাহেব কি এখানে থাকেন?
আমি সত্বর বলিলাম, আমিই ডাক্তার।
বৃদ্ধা বহুক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া পরিধেয় জীর্ণ বস্তু মধ্য হইতে একখানি সংবাদপত্র বাহির করিল; তাহার পর বলিল, এ খবরটা কি আপনি লিখেছেন?
আমি। হাঁ।
বৃদ্ধা। আমার মেয়ে মুনিয়া কাল রাত্রে তার একটা ইয়ারিং হারিয়ে ফেলেছে। সে কাল তার মামার বাড়ী গিয়েছিল, সেই তার মামা রাম সদনিয়া, সোণার—সেই চকের সোণার, তার বড় ব্যেম, তাই দেখতে যায়, আমার মুনিয়া। আমরা বড় গরিব। সে সন্ধ্যার পর সেটী-মহল্লা দিয়ে আছিল; সেইখানেই তার সোণার ইয়ারিং কোথায় পড়ে যায়। আমরা বড় গরীব, পঁচিশ টাকা দিয়ে তাকে কিনে দিই।
আমি ইয়ারিংটি বাহির করিয়া বলিলাম, এই কি সেই ইয়ারিং?
বৃদ্ধা। হাঁ, হাঁ, এই সেই, এই সেই। আহ, আমার মুনিয়া কত খুসী হবে! সে সেই পৰ্য্যন্ত কঁদছে, বাছা আমার বড় ছেলে মানুষ, তার আর কেউ নেই।
আমি। তুমি কোথায় থাক?
বৃদ্ধা। এই—এই—এই ও মহল্লায়। এই চকের পূবদিকে হামির পল্লীতে।
গোবিন্দ বাবু সঙ্কেত করায় আমি বৃদ্ধার হস্তে ইয়ারিং টা দিলাম; দিয়া বলিলাম, এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, এই ইয়ারিংটা আপনার মেয়ে মুনিয়ারই বটে।
বৃদ্ধা ইয়ারিংটা পাইয়া আমাকে বারংবার ধন্যবাদ দিয়া ধীরে ধীরে গৃহের বাহির হইয়া গেল। গোবিন্দ বাবু সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইলেন; বোধ হইল যেন তিনিও বৃদ্ধার অনুসরণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া জানালার নিকট গিয়া মুখ বাড়াইয়া দাঁড়াইলেন। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহার পাশে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধা অতি কষ্টে অতি ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়া যাইতেছে। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতেছেন। বৃদ্ধা বহির্ভূত হইলে গোবিন্দ বাবু শিশ দিতে দিতে আবার আসিয়া চেয়ারে বসিলেন। তিনি কোন কথা কহেন না দেখিয়া আমি অবশেষে বলিলাম, কি বুঝলেন?
গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, এ হয় সেই লোক, না হয় তার সঙ্গী।
আমি। যদি সেই লোক, তবে ধরিলেন না কেন?