আমি শিহরিত হইলাম—কিয়ৎক্ষণ কোন কথাই কহিতে পারিলাম না। তৎপরে বলিলাম, ঘটনা খুব রহস্যময় সন্দেহ নাই। এই দুই জন কেন এত রাত্রে এ বাড়ীতে এল, কেনই বা একজন আর একজনকে খুন করলে? কেনই বা সে দেয়ালে সাজ লিখে গেল। বলতে কি, আমি এখনও এর কিছুই স্থির করে উঠতে পারছি না।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ক্রমে সবই পাবেন। সে সাজ লেখে নাই, সাজা–অর্থাৎ প্রতিহিংসা বা দণ্ড লিখতে যাচ্ছিল,তাড়াতাড়িতে সবটা লিখতে পারে নি। সাজার শেষ ‘আ’রের টান মাত্র ধরেছিল। কাজেই বোঝা যায়, লোকটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য, খুন করেছে। বিশেষতঃ বুকে একটা বড় রকমের আঘাত না পেলে কেউ কারও প্রাণ নিয়ে টানাটানি করে না। ইয়ারিং দেখে অনুমান হয়, এর স্ত্রী বা প্রণয়পাত্রী সম্বন্ধে কোন হানি করায় এই সাজা। আর অস্ত্র ঘাতের কোন চিহ্ন না থাকায় সহজেই বোঝা যায়, লোকটা বিষে খুন হয়েছে। পরে সব জাতে পারবেন। এখন আসুন,এই পুলিশ-বারিক।
গাড়ী হইতে নামিয়া আমরা উভয়ে কনেষ্টবলের সঙ্গে পুলিশ বারিকে প্রবিষ্ট হইলাম। গত রাত্রে যে কনেষ্টবল যে বাড়ীতে খুন হইয়াছে সেইখানকার বিটে পাহারায় ছিল, সে শীঘ্রই আসিয়া গোবিন্দ বাবুকে সেলাম দিল। গোবিন্দ বাবু আমাকে ইঙ্গিত করিয়া এক খান খাটিয়ায় নিজ দেহভার অর্পণ করিলেন। আমিও বসিলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমিই কি কাল সেই বিটে রাত্রে পাহারায় ছিল।
সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর, রাত দুটা থেকে চারটা পর্যন্ত আমার পাহারা ছিল।
গোবিন্দ। আচ্ছা, তুমি সেখানে কি কি দেখেছিলে, আগাগোড়া আমাদের বল দেখি।
কনেষ্টবল। হাঁ হুজুর, আগাগোড়া যা যা হয়েছিল, সব বলে যাচ্ছি।
গোবিন্দ। হাঁ, কিছু বাদ দিও না।
কনেষ্ট। দুটোর সময় আমার বিটে গিয়ে আমার জুড়ীদারের সঙ্গে মোড়ে দাড়িয়ে কথাবার্তা করে শেষ সেটী-মহল্লার দিকে গেলাম, জুড়ীদার অন্যদিকে গেল। বড় ভারি অন্ধকার, রাস্তার আলো মিট মিট করছে, কিছুই ভাল দেখা যায় না। কোন দিকে কেউ নেই। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় কাদাও খুব হয়েছে। আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি, এমন সময় আমার নজর হঠাৎ একটা বাড়ীর আলোর দিকে পড়ল। আমি জানতেম, সে বাড়ীটা খালি ছিল। ওলাউঠায় বাড়ীটায় তিন-চার জন মরে যাওয়ায় সেই পৰ্যন্ত বছরখানেক খালি পড়ে আছে, কেউ ভাড়া নেয় না। কেউ কেউ বলে বাড়ীটায় ভূত আছে।
গোবিন্দ। আচ্ছা ভূতের কথা পরে শুনব—এখন থাক্, তার পর কি হল তাই বল।
কনেষ্ট। খালি বাড়ীতে আলো দেখে ব্যাপার কি জানার জন্য আমি দরজা পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু
গোবিন্দ। কিন্তু ভিতরে যেতে ভয় পেয়ে ফিরে এলে?
কনেষ্টবল আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিল। গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।
কনেষ্টবল কহিল, হুজুর, সে কথা ঠিক। যদিও আমি মানুষকে ভয় করিনে—কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়া শক্ত। তাই মনে করুলেম, জুড়ী দারকে সঙ্গে লওয়া ভাল। সেইজন্য সেখান থেকে ফিরে, রাস্তার জুড়ীদারের সন্ধানে এলেম।
গোবিন্দ। এ অবস্থায় কাকেও দেখতে পেলে?
কনেষ্ট। না, কোথাও কাকেও দেখতে পাই নি।
গোবিন্দ। তার পর তুমি আবার দরজার দিকে এলে?
কনেষ্ট। হাঁ হুজুর-সরকারী চাকরী, এতে ভয় কর চলে না। জবাবদিহি করতে হবে ভেবে আমি দরজার কাছে এসে দরজাটাতে হাত দিতেই যেন সেটা আপনা হতেই খুলে গেল। দেখি, জানালার কাছে একটা বাতি জ্বলছে। তার পর আমি সেই ঘরে ঢুকে দেখি
গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) যা দেখলে তা আমরা জানি। তুমি চার-পাঁচ বার ঘরের চারদিকে ঘুরে, লাসের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। ভাল করে সেটাকে দেখতে লাগলে?
কনেষ্টবল এবার বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বিস্ফারিত নয়নে গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিল, হুজুর সে সময়ে সেখানে আপনি কোথায় ছিলেন?
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন,আমি সেখানে ছিলাম না। তার পর কি হল?
কনেষ্ট। তার পর জুড়ীদারকে চেঁচিয়ে ডালেম। সেও ছুটে সেখানে এল।
গোবিন্দ। সে সময়ে কোন লোককে রাস্তায় দেখতে পেলে?
কনেষ্ট। হাঁ, কিন্তু সে লোকের মত লোকই নয়।
গোবিন্দ। সে কি?
কনেষ্ট। দেখলেম, রাস্তায় একটা লোক মাতাল হয়ে টছে। সে দেয়ালে ঠেস্ দিয়ে গান ধরেছে। দাঁড়াতে পারছে না, গান গলা দিয়ে বেরুচ্ছে না। হুজুর, অনেক অনেক মাতাল দেখেছি, কিন্তু এমন মাতাল কখন দেখিনি।
গোবিন্দ। তাকে ধলে না কেন?
কনেষ্ট। আমাদের তখন খুনই প্রধান কাজ, মাতাল ধরার সময় নয়।
গোবিন্দ বাবু ভ্রূকুটি করিলেন। বিরক্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, লোকটার চেহারা কেমন?
কনেষ্ট। তাও তখন ভাল করে দেখিনি। আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি লাস দেখতে ছুটলেম।
গোবিন্দ। তবে তার কিছুই ভাল করে দেখ নাই?
কনেষ্ট। না।
গোবিন্দ। তার পর সে লোকটার কি হল?
কনেষ্ট। তার পর সে কোন গতিকে নিশ্চয়ই নিজের বাড়ীর দিকে চলে গিয়েছিল।
গোবিন্দ। তার হাতে কি একটা চাবুক ছিল ?
কনেষ্ট। মনে নাই, বোধ হয়—ছিল না।
গোবিন্দ। কোন গাড়ী বা একা কাছে দেখেছিলে বা গাড়ীর শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?
কনেষ্ট। না।
আচ্ছা, আর কিছু জাবার নাই। বলিয়া গোবিন্দ বাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলাম। বাহিরে আসিয়া তিনি বলিলেন, এই গাধা অনায়াসে কাল রাত্রে নিজের প্রমোসন পেতে পাত, যে খুনীর সন্ধানে সূরযমল আর রাম সিং আজ আকাশ পাতাল ভেবে মছে, কাল রাত্রে এ তাকে অনায়াসে ধতে পারত।