গোবিন্দ বাবুর কথা শুনিয়া আমরা তিন জনই বিশেষ আশ্চৰ্য্যাম্বিত হইলাম। কেহই কোন কথা কহিলাম না। অবশেষে সূরযমল বলিলেন, যদি খুনই হয়ে থাকে, তবে কি করে খুন হল?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিষে। তৎপরে রাম সিংহের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, লোকটা সাজা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। সাজা উর্দ্দু, কথা, মানে প্রতিহিংসা; সুতরাং আপনি সাজাদী নামের মেয়ে মানুষ খুঁজতে অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না। এই বলিয়া তিনি আমার হাত ধরিয়া দ্রুতপদে বাহিরে আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন।
গাড়ী থানার দিকে ছুটিল।
সরমল আমাদের সঙ্গে একজন কনেষ্টবল দিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
তথা হইতে বহির্গত হইয়া গোবিন্দ বাবু গাড়োয়ানকে তার অফিসে যাইতে আজ্ঞা করিলেন। তথায় একটি টেলিগ্রাফ করিয়া তিনি আবার আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন; তৎপরে বলিলেন, যদিও এ সম্বন্ধে আমি একটা স্থির ধারণ করিয়াছি, তবুও আরও কিছু জানা ভাল।
আমি বলিলাম, আমি আপনার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। সত্য সত্যই কি আপনি উহাদের দুইজনকে যাহা বলিলেন, তাহা বিশ্বাস করেন?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ইহাতে ভুল হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। আমি প্রথমেই পথে লক্ষ্য করিলাম যে একখানা এক্কার চাকার দাগ কাদায় স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। কাল রাত্রি বারটা-একটার সময় বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং এই এক্কা নিশ্চয়ই এখানে একটার পরে আসিয়াছে। বোধ হয়, আপনাকে বলিতে হবে না যে, একার চাকার দাগ আর অন্যান্য গাড়ীর চাকার দাগ সকলই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র। তার পর একটা ঘোড়ার পায়ের দাগ পড়িয়াছে; পায়ের তিন পায়ের অপেক্ষা এক পায়ের দাগ বেশী বসিয়াছে, সুতরাং বুঝিতে বেশী কষ্ট হয় না যে ঐ নালটা অপর তিনটা হতে নূতন ছিল।
আমি। যথার্থই আপনার কথায় আমি অবাক হচ্ছি।
গোবিন্দ। না না,অবাক হবার কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে সকলেই এরূপ পারেন। তার পর এই গাড়ীখানা ভিন্ন যে আর কোন গাড়ী এখানে আসে নি, তা আর কোন গাড়ীর চাকার দাগ না দেখতে পেয়েই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। আর দুজনের বেশী লোক যে এক্কায় আসে নাই তাও আমি বুঝলেম, ঘোড়র পায়ের দাগ দেখে। ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিল না। পায়ের দাগ দেখে বোঝা যায়,এদিক ওদিক করছিল। যদি কেউ এর রাস ধরে বা মুখ ধরে থাকত, তবে ঘোড়া কখনও এমন করতে পারে না। লোকটা অপর লোককে নিয়ে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, গাড়ী এমনই রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল। গাড়ীর কাছে কোন লোক ছিল না। আর সাক্ষী সঙ্গে করে কেউ খুন করতে আসে না। আর কেবল দুজন লোক যে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, তা তাদের পায়ের দাগেই বেশ জানা যায়। আমি কেবল দুজন লোকের পায়ের দাগই লক্ষ্য করেছিলাম, আর অধিক লোকের পায়ের দাগ দেখা যায় না। আরও লক্ষ্য করেছি, একজনের পায়ে নাগরা জুতা,একজনের পায়ে বিলাতী জুতা; যাঁর বিলাতী জুতা, তিনি এই মরে পড়ে আছেন; কাজেই নাগরা জুতাধারী মহাশয় এই হত্যা ক্রিয়া সম্পন্ন করে স্বস্থানে প্রস্থান করেছেন।
আমি। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক, কিন্তু লোকটা যে ছয় ফুট লম্বা, তা কিরূপে জালেন?
গোবিন্দ। লেকের পা ফেলার দাগ দেখে শতকরা নিরনই জনের দৈর্ঘ্য বলা যায়। যে যেমন লম্বা বা বেঁটে সে তেমনই দূরে বা কাছে পা ফেলে। এ সব অনেক কথা; আর একদিন বলব।
আমি। তার পর বয়স?
গোবিন্দ। এও পা ফেলার দাগ দেখে, বলা যায়। একজন বালক যত দূরে দূরে পা ফেলে বা যেমন করে পা ফেলে, একজন যুবক বা বৃদ্ধ তেমন পারে কি? এসব বিশেষ লক্ষ্য করতে হয়, রীতিমত মনোযোগ দিয়ে শিখতে হয়। শিখতে পারূলে পা ফেলার দাগ দেখে লোকের বয়স বলা খুব সহজ।
আমি। এও যেন মানিলাম; তারপর রক্ত-পিত্তের ব্যারাম।
গোবিন্দ। এটা কতকটা আন্দাজ, তবে খুব সম্ভব। লাসের কোন থানে আঘাতের দাগ নেই, তবে ঘরে এত রক্ত এল কোথা থেকে? তা হলে এ রক্ত যে খুন করেছে তারই। কিন্তু যদি সে এই লোক টার দ্বারা আঘাতিত হয়ে থাকে, তবে, সে চুপ করে দাড়িয়ে হয় নাই। তা হলে একটা ছোটাছুটি ঠেলাঠেলি ধস্তাধস্তি হতো। তা হলে ঘরেও তার চিহ্ন থাকত। সুতরাং সে আহত হয় নি। নিজে নিজে আহত হবারও কোন কারণ নাই। যদি আত্মহত্যা করতে যেত, তা হলে সে এইখানেই পড়ে থাকৃত; এক্কায় উঠে চলে যেতে পারে না। তাই ভাবছি লোকটার রক্ত-পিত্তের বোগ ছিল। এ রোগে খুব বেশি রাগ হলে বা কোন রকমে উত্তেজিত হলে, অনর্গল রক্ত মুখ দিয়ে বার হতে থাকে। এ রক্তারক্তি ব্যাপার দেখে আমার ত তাই মনে হয়।
আমি। আর বর্মা চুরুট।
গেবিন্দ বাবু এবার একটু হাসিয়া বলিলেন, চুরুটের ছাই আমি যতটা চিনতে পারি, বোধ হয় আর কেউ ততটা পারে না। আপনি দেখলেন না, মেজে থেকে কতকটা ছাই তুলে আমি কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছি। এ ছাই বৰ্ম্মা চুরুটের।
আমি। যে খুন করেছে, সেই যে খাচ্ছিল তার মানে কি?
গোবিন্দ। বিলাতী জুতার এলোমেলো পা ফেলা দেখেই বুঝেছি লোকটাখুব মাতাল হয়েছিল; তারপর এর মুখ শুকেও দেখলেম, মুখে কেবল মদের গন্ধ। আর এ লোকটা যে মনে অজ্ঞান ছিল, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। নতুবা এ ইচ্ছে করে খুন হতে এই বাড়ীতে আসে নাই। লাসের মুখের বিকট ভাব দেখে বুঝলেন না যে, মবার সময় লোকটা তার হত্যাকারীকে চিন্তে পেরেছিল। বিস্ময় ভয়, রাগ, সব মিশিয়ে মুখের কি একটা ভয়ানক ভাব হয়েছে।