সূরযমল ও বলিলেন, হাঁ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
গোবিন্দ বাবু হাঁটু পাতিয়া বসিয়া মৃতদেহ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন যে কোনখানে কোন অস্ত্রের দাগ নাই। ঘরময় তো রক্ত।
উভয়েই বলিলেন, আমরা বিশেষ করে দেখেছি। লাসের কোন খানে অস্ত্রাঘাতের কোন চিহ্ন নাই।
গোবিন্দ। তা হলে এই রক্ত নিশ্চয়ই আর এক জনের। সম্ভবত সেই লোকই এই খুন করেছে।
রাম। সেটা কিরূপে সম্ভব?
গোবিন্দ। সম্ভব সব। আপনি কি বোম্বের পেষ্টনজী তোরাবজীর খুনের কথা পড়েন নাই?
রাম। না।
গোবিন্দ। পড়া উচিত। সংসারে প্রায়ই নূতন কিছু হয় না। যা হয়েছে তাই হয়।
বলিয়া গোবিন্দ বাবু মৃতদেহের সর্বাঙ্গ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, তবে কোন অস্ত্রে এর মৃত্যু হয় নাই— রক্ত অন্যের। পকেটে টাকা ছিল, সুতরাং টাকার জন্যেও কেহ একে খুন করে নাই। যাক্, যা দেখবার দেখা হয়েছে। এখন লাশ চালান দিতে পারেন।
লাস চালান দিবার বন্দোবস্ত পূৰ্বেই স্থির ছিল। শববাহিগণ লাস তুলিবার উদ্যেগ করিলে লাসের বস্ত্র মধ্য হইতে একটি সুন্দর ইয়ারিং ইক করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। রাম সিং গিয়া এস্তে সেটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, দেখছি, এটি কোন স্ত্রীলোকের ইয়ারিং, তবে এখানে একজন স্ত্রীলোকও উপস্থিত ছিল।
আমরা সকলে সেই ইয়ারিংটি বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলাম।
সূরবমল বলিলেন, এতে আরও রহস্য ক্রমে বেড়ে উঠছে।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কেন? এতে কি আপনি মনে করেন যে, এ খুনের কিনারা করা সহজ হবে? পুলিশ কৰ্ম্মচারিদ্বয়ের কেহই কোন উত্তর করিলেন না।
তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ডাকঘরে খবর নেওয়া হয়েছে কি?
সূরয। হা, পত্ৰ এরা ডাকঘর থেকেই নিয়ে যেতেন; তবে, একজন পিয়ন একবার এদের বাসা দেখেছিল, সে চিঠী বিলি কছিল, এই সময় এদের একজন একটা বাড়ী হতে বার হচ্ছিলেন। সে সেলাম করলে একজন বলেন, এই বাড়ীতে আমরা থাকি। সকালে সে পিয়ন ডাকঘরে ছিল না। তার সন্ধানে আবার লোক পাঠিয়েছি।
গোবিন্দ। ভাল, এর পকেটে যে চিঠী আছে তা নাসিক থেকে এসেছে দেখছি। নাসিকে টেলিগ্রাফ করেছেন?
সূরয। হাঁ, এখনও উত্তর পাই নাই।
গোবিন্দ। কি টেলিগ্রাফ, করেছেন, শুতে পাই?
সূরয। ঘটনা সব জানিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা কিছু খবর দিতে পারেন কি না।
গোবিন্দ। কেবল এই? সূরয। আর বিশেষ কি টেলিগ্রাফ করব?
এই সময়ে রাম সিং পশ্চিম দিক্কার গৃহ-প্রাচীর দেখাইয়া দ্বিয়া বলিলেন,দেখুন, দেখুন। আমরা সকলে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, তথায় বড় বড় অক্ষরে কি লেখা আছে। নিকটে গিয়া দেখিলাম, সুস্পষ্ট রক্তে লেখা–
সাজা
রাম সিং সোৎসাহে বলিলেন, দেখুন এটা রক্তে স্পষ্ট লেখা। লিখিবার সময় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়েছিল, তাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা হোক্, এতে লোকটা যে আত্মহত্যা করে নাই, তা জানা যাচ্ছে। যে একে খুন করেছে, সেই কাল রাত্রে এটা লিখে গেছে।
সূরয। তা তো বুঝতে পারা গেল, কিন্তু তুমি এ দেখে কি ভাবছ বল দেখি?
রাম। আমার স্পষ্টই বোধ হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন-না-কোন স্ত্রীলোক জড়িত আছে; পরে জানা যাবে। বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকের, নাম সাজাদী। লোকটা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে চলে গেছে।
গোবিন্দ বাবু এতক্ষণ নীরবে দাড়াইয়া ছিলেন ; এক্ষণে বলিলেন, ঘরটা এতক্ষণ আমি বিশেষ পরীক্ষা করি নাই। আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে ত এখন দেখতে পারি।
উভয় পুলিশ-কর্ম্মচারীই বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয়ই দেখিতে পারেন।
তখন গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে একটা মাপের টেপ, বাহির করিয়া ঘর ও প্রাচীরের নানা স্থান মাপিতে লাগিলেন। ঘরের মেজে বিশেষ রূপে পৰ্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। এক স্থান হইতে কতক গুলি সাদা ধূলা বা ছাই যন্ত্রে সংগ্রহ করিয়া একটা কগজে মুড়িয়া পকেটে রাখিলেন। তৎপরে চারিদিক বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া পকেট হইতে ধীরে ধীরে একখানি ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস বাহির করিলেন। ঐ গ্লাস দ্বারা নানা স্থান দেখিলেন। রক্তে লেখা কথাটি উহার দ্বারা খুব ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। আমরা সকলে নীরবে; দাঁড়াইয়া তাহার কাৰ্য-কলাপ দেখিতে লাগিলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে ধীরে ধীরে গ্লাসখানি পকেটে রাখিয়া গোবিন্দ বাবু বলিলেন, হয়েছে। এখন যেতে পারা যায়।
সূরযমল বলিলেন, আপনি কি মনে করেন?
গোবিন্দ। আপনারা যেরূপ এ বিষয়ে চেষ্টা করছেন, তাতে আমার এখন কিছু বলা ধৃষ্টতা মাত্র। তবে আপনারা কতদূর কি করেন, যদি তা আমায় জানান, তবে পরে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যতদূর সম্ভব হয়, তা আমি বলতে পারি। কাল রাত্রে এ বিটে যে কনেষ্টবল ছিল, তার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।
রাম। সে এখন থানায় আছে। সেখানে গেলেই দেখা হতে পারে।
গোবিন্দ। আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা কব মনে করেছি।
আমরা সকলে বাড়ীর বাহিরে আসিলাম। বিদায় হইবার সময় গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কোন স্ত্রীলোকের সন্ধানে বৃথা সময় নষ্ট করবেন না। কোন স্ত্রীলোক এখানে কাল রাত্রে ছিল না—দুজন মাত্র লোক ছিল। লোকটা খুন হয়েছে, আত্মহত্যা করে নি। যে খুন করেছে-সে পুরুষ, স্ত্রীলোক নয়। সে ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, বয়সে যুবক, পা দেহের পরিমাণে ছোট। অতি মোটা, নাগরা জুতা পায়ে ছিল। বর্ম্মা চুরুট খাচ্ছিল। সে এই লোকটাকে একখানা এক্কায় এখানে এনেছিল। এক্কার ঘোড়ার তিনটা লাল পুরাণ ও একটা নূতন ছিল। লোকটার সম্ভবমত যক্ষ্মা বা রক্ত পিত্তের ব্যারাম আছে। এখন এই পর্যন্ত বলতে পারি।