আমার পত্র পাঠ শেষ হইলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সূরযমল লাহোর-পুলিশের একজন প্রধান ডিটেকটিভ। আর যে ইনস্পেক্টরটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, গোয়েন্দাগিরীতে তারও খুব সুখ্যাতি আছে। তার নাম রাম সিং; কিন্তু দুজনে আদা-কাচকলার বন্ধুত্ব। দুজনেই খুব চালাক বটে, কিন্তু পূর্ব ভাবটা ঠিক বজায় রেখেছে। এই জন্যই এরা প্রায়ই খুন জাল জুয়াচুরীর কোন কিনারা করতে পারে না। তাড়াতাড়ি করে মরে। এই দুজনকে যদি এই ব্যাপারের একটু কিছু সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যায়, তবে বড়ই মজা হয়।
তিনি যে রূপে স্থির ভাবে এই কথা বলিলেন, তাহাতে আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। বলিলাম, বোধ হয়, আপনার আর দেরি করা উচিত নয়। আপনার জন্য কি একখানা গাড়ী ডেকে এনে দিব।
তিনি হাসিয়া বলিলেন, আমি যাব কি না ঠিক নাই?
আমি। কেন? আপনি ত এই চান।
গোবিন্দ। সত্য বটে, কিন্তু আমার লাভ কি? প্রশংসা হলে সে প্রশংসা সূরযমল রাম সিং এণ্ড কোম্পানীরই হবে।
আমি। এমন সময় একদিন আসবে, যখন আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।
তিনি হাসিয়া বলিলেন, আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। তৎপরে একটু ভাবিয়া বলিলেন, আচ্ছা গিয়েই একবার দেখা যাক্। আসুন।
আমি বলিলাম, আমিও যাব কি?
গোবিন্দ। ক্ষতি কি? যদি কোন কাজ না থাকে, আসুন না; একটা নূতন বিষয় দেখা হবে।
আমরা উভয়ে রওনা হইলাম। বাহিরে আসিয়া একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া কোচম্যান্কে সেটী-মহল্লায় লইয়া যাইতে বলিলাম। গোবিন্দ বাবু ঝিঁঝিট-খাম্বাজের গৎ ভাঁজিতে ভাঁজিতে চলিলেন।
আমি তাহার ভাব দেখিয়া বলিলাম, আপনি দেখছি, যে কাজে। যাচ্ছেন, সে বিষয়ে একটুও ভাবছেন না।
তিনি বলিলেন, সব না দেখে-শুনে মনে মনে কিছু আন্দাজ করে আগে থাকতেই ধারণাটা খারাপ করা বড়ই ভুল। এতে আর পরে বাধীন চিন্তার ক্ষমতাটা থাকে না।
কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়োয়ান গাড়ী থামাইয়া বলিল, এই সেটী-মহল্লা।
গোবিন্দ বাবু গাড়ী হইতে নামিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামিলাম। তিনি কোচম্যানকে গাড়ী লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিতে বলিয়া হাঁটিয়া চলিলেন। নিকটস্থ একজন কনেষ্টবলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কাল রাত্রে কোন্ বাড়ীতে খুন হয়েছে?
সে দেখাইয়া দিল। আমরা বাড়ীর সম্মুখে আগিয়া দেখিলাম, বাটার চারিদিকে প্রাচীর আছে, সম্মুখে একটি গেট, ঐ গেট হইতে একটি পথ বাড়ীর সদর দরজার সিঁড়ী পর্যন্ত গিয়াছে। বাড়ীর সম্মুখে এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে হিন্দীতে লেখা আছে। কাল রাত্রে বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং রাস্তায় গভীর চাকার দগ অনেক মানুষের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।
আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু প্রথমেই বাড়িতে প্রবেশ করিয়া লাস দেখিবেন; কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া সদর রাস্তা ও বাড়ীর রাস্তা বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। চারিদিক দেখিয়া ধীরে ধীরে পথের ধারে ঘাসের উপর দিয়া চলিতে আরম্ভ করিলেন। আমাকেও সেইরূপ করিতে বলিলেন।
* *****
বাড়ীর দরজায় একজন কনেষ্টবল দাঁড়াইয়া জনতা দূর করিবার চেষ্টা পাইতেছে; চেষ্টা বৃথা, কেহ সেখান হইতে নড়িতেছে না। বাড়ীর ভিতর কি হইয়াছে ও হইতেছে দেখিবার জন্য উৎসুক হওঁ। সেই দিকে মাথা তুলিয়া চাহিতেছে। আমরা উপস্থিত হইলে সেই দ্বার রক্ষক কনেষ্টবল একটা সেলাম করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
এই সময়ে সূরযমল নিকটে আসিয়া বলিলেন, আপনার আসায় বড়ই বাধিত হলেম। যা যেখানে ছিল, আপনার জন্য তা সব ঠিক সেই রকমই রেখেছি।
গোবিন্দরাম। গোবিন্দ বাবু পথের দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কেবল ঐটী। এক দল মহিষের আমদানী হলেও ত বোধ হয়, রাস্তা এমন বখৎ হত না। নিশ্চয়ই, সূরযমল সাহেব, রাস্তাটা এ রকম হতে দেবার আগে আপনি এটা বিশেষ লক্ষ্য করেছিলেন।
সূরযমল একটু অপ্রস্তুত হইলেন। বলিলেন, আমি ভিতরের ব্যাপার নিয়েই বড় ব্যস্ত ছিলাম। রাম সিং সাহেব এখানে ছির ন, তিনি নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করেছেন।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আপনাদের মত দুজন সুদক্ষ লোক যখন রয়েছেন, তখন সকলবিষই লক্ষ্য করেছেন সন্দেহ নাই।
সূরযমল উৎসাহের সহিত বলিলেন,না—না, কিছু ফাঁক পড়ে নাই। গেল। আপনি এখানে গাড়ী করে এসেছেন কি?
সুরয। না।
গোবিন্দ। রাম সিং সাহেব?
সূরয। না।
গোবিন্দ। তবে চলুন ভিতরটা একবার দেখা যাক।
আমরা সকলে একটি প্রকোষ্ঠে প্রবিষ্ট হইলাম। বহুদিন লোকের বসবাস না হওয়ায় গৃহতলে প্রায় চার আঙ্গুল ধূলা জমিয়াছে। মধ্যস্থলে একটি মৃতদেহ পড়িয়া আছে। লোকটি ছাদের দিকে বিকটভাবে চাহিয়া রহিয়াছে। আমি যুদ্ধে অনেক অনেক ভয়াবহ মৃতদেহ দেখিয়াছি, কিন্তু এই লাসের মুখের মত বিভীষিকাময় বিকৃত মুখ আর কখনও দেখি নাই। দেখিলে বোধ হয়,যেন লোকটা গুরুতর পাপী, মৃত্যু সময়ে কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল। এই মৃতদেহ দেখিয়া আমার শিরায় শিরায় প্রবল বেগে রক্ত ছুটিল। আমি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, তিনি অতি স্থির চিত্তে এই মৃতদেহ বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতেছেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
আমরা দেখিলাম, রাম সিং আশে-পাশের ঘর সকল দেখিতেছেন। তিনি আমাদের দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিলেন, খুব গোলমেলে মালা, সন্দেহ নাই। আমি অনেক খুন দেখেছি, কিন্তু এই খুনের মর্ম কিছুই বুঝতে পারছি না।