গোবিন্দ। না কলে সে তার সর্বনেশে তীর দিয়ে আমাদের প্রতিও বড় অন্যায় কত।
আবদুল। তা নিশ্চয়, সে তীর গায়ে লাগলে এক মিনিটও দেরী হয় না। এমন ভয়ানক বিষ মাখান তীর। টাঙ্গাই সে বিষের তীর তৈয়ারী করতে জাত।
মহম্মদ। হাঁ, তার পর? আবদুল।
আবদুল। আমি ভেবেছিলাম, অত রাত্রে সে ঘরে কেউ নাই। কিন্তু টাঙ্গা ছাদের উপরের ছোট ফাঁক দিয়ে ঘরে লোক দেখে অমনই তীর ছুঁড়ে। সে লাফিয়ে ঘরে পড়বার আগেই কমিসরিয়েট বাবুর ছেলে সরে যায়। আমি গিয়ে দেখি, একদম আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি টাঙ্গাকে অনেক গালাগালি দিয়েছিলাম। ছেলের উপর আমার রাগ ছিল না,সে বেচারা কি জানে। বাপকে পেলে বোঝা যেত।
মহম্মদ। তার পর?
আবদুল। তার পর আমি দড়ী দিয়ে সিন্দুকটা নামিয়ে দিই, পরে দুজনে নীচে নেমে এসে বরাবর যমুনার ধারে আসি। মঙ্গলুর নৌক ভাড়া করে সরে পড়ি।
গোবিন্দ। হাঁ, তার পর পাছে পুলিশ নৌকার সন্ধানে যায় বলে মজলুর অসাক্ষাতে নৌকা বাচাল করে দিয়ে মেরামতের জন্য ডেঙায় তুললে?
আবদুল। আপনি এ সব কেমন করে জানলেন?
গোবিন্দ বাবু হাসিলেন।
আবদুল বলিল, এখন সব কথাই–আপনাদের বলেম। আর আন্দামানে যাবার ইচ্ছা নাই,—ফাঁসী হলে বড় বেখুশী হব। আর একটা চুরুট দিন। এটা শেষ হয়ে এসেছে।
গোবিন্দ বাবু তাহাকে আর একটা চুরুট দিলেন।
এদিকেও রাত্রিশেষ। এইরূপ সময়ে আমাদের নৌকা আসিয়া, আগ্রায় ঘাটে লাগিল। দারোগা সাহেব তাঁহার আসামী লইয়া কোতোয়ালীতে গেলেন। যাইবার সময় বলিলেন, জহরতের সিন্দুকটা, কাল থেকে তুলতেই হবে।–জায়গাটা ত মনে আছে, গোবিন্দ বাবু?
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কতক কতক।
পুলিশ কর্মচারিগণ আসামী লইয়া প্রস্থান করিলে গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, প্রতিভা ব্যস্ত হয়ে আছে,–আপনি গিয়ে তাকে, সব কথা বলে তবে বাসায় আসবেন। আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব।
আমি প্রতিভাদের বাড়ীর দিকে চলিলাম। সে আমাদের প্রতীক্ষায় সর্বদাই উদগ্রীব থাকিত,–আমাকে দেখিয়া, ছুটিয়া বাহিরের ঘরে আসিল। আমি তাহাকে সকল কথা বললাম। সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সব শুনিল। পরে আমি বিদায় হইবার জন্য উঠিয়া বলিলাম, তোমার সঙ্গে বোধ হয়, এই শেষ দেখা,-আর দেখা হবে কি না কে বলতে পারে?
প্রতিভা চকিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল কেন?
আমি। দেশে যাব মনে করেছি। আমি চলে গেলে আমার কথা কি তোমার মনে থাকবে,– তুমি কি একটু দুঃখিত হবে?
প্রতিভা মস্তক অবনত করিয়া বলিল, হব?
আমি কি বলিলাম জানি না,–বোধ হয়, বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, তবে সঙ্গে চল না কেন? প্রতিভা কি বলিল, স্মরণ নাই, বোধ হয়, কিছুই বলে নাই। কিন্তু দেখিয়াছিলাম,-সহসা তাহার কপোলযুগ রক্তাভ হইয়া উঠিয়া এক অদৃষ্টপূৰ্ব কোন সৌন্দর্য্যে তাহার মুখখানি ভরিয়া উঠিয়াছিল। আর তখন আমি কম্পিত হস্তে তাহার মৃণালভূল্য হাত দুখানি ধরিয়া তাহার সেই আরজ মুখখানি চুম্বন করিয়াছিলাম। সে লজ্জায় আমার হাত ছাড়াইয়া এক নিমেষে ছুটিয়া, পালাইয়াছিল। সহসা আমার স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল—সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত দেখা করিলাম।
উপসংহার।
পরদিবস সন্ধ্যার সময় গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, কথাটা ফল্ল ত?
আমি বুঝিয়া ও-না বুঝিয়া বলিলাম, কি ফলবে?
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভবিতব্যি,-ভবিতব্যি।
আমি বলিলাম, আমি কিছুই বুঝতে পাছি না।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা পাবেন কেন? তবে মনে মনে যে না পারছেন–তা নয়। বৃথা চেষ্টা ডাক্তার-আমার কাছে কিছু গোপন করতে পারবেন না। আপনি গোপন করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনারই মুখ চোখের ভাব আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তিনি একটু নীরবে থাকিয়া বলিলেন, যা হক–আমি আচাৰ্য মশায়ের কাছে সব শুনেছি। প্রতিভা যখন রত্ন, আমি আপনাকে কনগ্রাচুলেট করি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা দুজনে চিরসুখে সুখী হন। আর আমি আমার সেতার আর তামাক চুরুট নিয়ে মহা আনন্দে বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দিই।
আমি। আপনি সব শুনেছেন। আমি আপনাকে বলব মনে করছিলাম।
গোবিন্দ। এতে আর লজ্জা কি? আপনি ত আর ছোট নন।