আমরা দেখিলাম, আন্দামানী আহত হইয়াছে। সে দুই হতে নৌকার ছই ধরিবার চেষ্টা পাইল,—কিন্তু পারিল না; ঘুরিয়া যমুনার জলে পড়িয়া গেল।
পর মুহূর্তেই আমরা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম; কিন্তু আন্দা মানীর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। তাহার দেহ গভীর জলে নিমগ্ন হইয়াছে।
এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, জোরে–জোরে—আরও জোরে। বেটা জহরতের সিন্দুক জলে ফেলে দিচ্ছে।
আমরা দেখিলাম, একটা লোক যথার্থই একটা সিন্দুক নৌকার ধারে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিতেছে। আমরা অগ্রসর হইবার পূৰ্বেই মহা শব্দে সেই সিন্দুক যমুনা গর্ভে পড়িল।..
গোবিন্দ বাবু বলিলেন একটু দাড় ছাড়। জায়গাটা ঠিক করে রাখি। পর মুহূর্তেই তিনি বলিলেন,না-না-হয়েছে। খুব জোরে বেয়ে যাও।
নৌকা আবার সবেগে ছুটিল। কিন্তু অপর নৌকার দাড়ী-মাঝি৷ ভয় পাইয়া নৌকা তীরের দিকে চালাইল। আমাদের নৌকাও তীর বেগে পশ্চাতে ছুটিল। তীরের নিকট আসিয়া দাড়ী-মাঝিরা লম্ফ দিয়া জলে পড়িল। আমরা নৌকা ধরিয়া ফেলিলাম।
সেই লোকটাও লাফাইয়া জলে পড়িল। তখন আমরা দেখিলাম, সত্য সত্যই তাহার এক পা কাঠের।
লম্ফ দিয়া তীরে পড়ায় তাহার সেই কাঠের পা কাদায় একেবারে বসিয়া গেল। সে প্রাণপণে কাদা হইতে পা টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। তাহাতে তাহার পা আরও কাদায় বসিয়া গেল।
মহম্মদ সাহেব ও তাহার দুই ইনস্পেক্টর সত্বর গিয়া তাহার হাতে হাতকড়ী লাগাইয়া দিলেন। অন্যান্য কনেষ্টবল নৌকা বাঁধিয়া শীঘ্রই মঙ্গলু ও তাহার সহযাত্রীদের ধরিয়া হাতকড়ী লাগাইল।
আমরা সকলে পড়িয়া টানিতে টানিতে কাদা হইতে মুক্ত করিয়া এক-পেয়ে আবদুলকে তীরে তুলিলাম। সে বিকট হাস্য করিতে লাগিল। তাহার হাসিতে অন্যের কথা বলিতে পারি না, আমার হৃদয় কঁপিয়া উঠিল।
আমরা সকলেই বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে কতকগুলা চুরুট বাহির করিয়া সকলকে এক-একটি দিলেন; তৎপরে আবদুলকেও একটা দিয়া বলিলেন,আবদুল, খাও। এত কষ্ট না দিলেই ভাল ছিল। সিন্দুকটা জলে ফেলে না দিলে তোমার পক্ষেও ভাল ছিল।
গোবিন্দ বাবুর মুখে তাহার নাম শুনিয়া আবদুল অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল, বলিল, আপনি আমার নাম জানলেন কেমন করে?।
গোবিন্দ। তা না জানলে কি তোমার মত লোককে ধরা যায়। তোমার কথা সব জানি,কেবল জহরত কোথা হতে এসেছিল, তাই আনি না। সব কথা যদি সত্য বল,তবে তোমাকে ফাঁসী কাঠ থেকে বাঁচাব।
আবদুল। আমি সে বাবুকে খুন করি নাই। ঐ আন্দামানী টাঙ্গা তার তাঁর দিয়ে তাকে আগে মেরেছিল,–সেই আগে ঘরে গিয়ে দড়ী ধরে উপরে উঠে গিয়ে দেখি, বাবু মরে গেছে।
মহম্মদ। সেটাকে জেন্ত ধরতে পারলেই ঠিক হত।
গোবিন্দ। এখন নৌকা খুলে দাও ফিরে যেতে যেতে আবদুল তোমার ইতিহাস শুতে চাই। সত্য বলে, তোমার উপকার হবে, জানবে।
আবদুল। আর মিথ্যা বলে লাভ কি? সব খুলে বল্ব। আগে একটু চুরুট খাই।
গোবিন্দ। আহা, খাও-খাও, ঠাণ্ডা হও। অনেক কষ্ট দিয়েছ। আরও কিছু কষ্ট পেতে হবে জহরতের সিন্দুকটার জন্য।
আবদুল আবার হ হহ শব্দে হাসিয়া উঠিল। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। আমি মনে মনে ভাবিলাম, এমন দুরাত্মা কি জগতে আর দ্বিতীয় আছে।
কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল বলিল, এ বেচারারা কিছু জানে না। পয়সা পেয়ে নৌকা ভাড়া দিয়েছিল। বাবু দেখবেন, এরা যেন আমার জন্য মারা না যায়।
আমি ভাবিলাম, এরূপ দুরাত্মার মনেও নীতি-জ্ঞান আছে।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমরা জানি। ওদের কিছু হবে না।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।
মঙ্গলুর নৌকা আমাদের নৌকার সঙ্গে বাঁধিয়া আমরা আগ্রার দিকে ফিরিলাম। চারিজন কনেষ্টবল দাঁড় টানিতে লাগিল। দুই জন মঙ্গলুদের পাহারায় রহিল। আবদুলকে আমরা চারিদিকে বেরিয়া বসিলাম। আবদুল বলিতে লাগিল;–
আমাদের চার জনের ফতেপুর শিখরিতে বাড়ী। ছেলে বেলা থেকেই আমরা দোস্ত। যাইহোক নসীবের দোষেই হক, আর গুনেই হক, আমরা ঠগীর দলে মিশে পড়ি। সে অনেক কথা,–সেসব বলার দরকার নাই, জহরতের কথাই বলি।
গোবিন্দ। হাঁ,–সে সব বোঝা গেছে। এখন এই জহরতের গল্পই বল।
আবদুল। কোন গতিকে আমরা শুনতে পাই যে, রামগড়ের নবাব তার উজীরকে অনেক টাকার জহরত দিয়ে মথুরার শেঠের কাছে পাঠিয়েছেন। এই সব জহরত বাধা রেখে তাঁর টাকা চাই।
মহম্মদ। শুনেছিলাম বটে, কিন্তু রামগড়ের নবাব জহরতের কথা অস্বীকার করেন।
আবদুল। তিনি খুব লুকিয়ে টাকা ধার করতে ইচ্ছা করেছিলেন। তাই তার বিশ্বাসী উজীর সামান্য সওদাগর সেজে কেবল একজন লোক নিয়ে আগ্রায় পৌঁছান। কেউ এ কথা জানতে পারে না। কোন গতিকে আমরা এ খবর পাই। জহরত খোয়া গেলে, তিনি কোম্পানীর ভয়ে সব কথা অস্বীকার করেন।
গোবিন্দ। তার পর।
আবদুল। তার পর এই খবর পেয়ে আমরা তাঁর সঙ্গ নিই; কিন্তু পথে কোনখানে কাজ হাসিল করতে পারি নাই। শেষে যখন তিনি আগ্রায় মসাফের-খানায় বাসা নিলেন, তখন সেখান থেকে যেতে দিলে কাজ হাসিল হবার আর সম্ভাবনা নাই ভেবে, আমরা চারজনে সাহসে ভর করে মাফের-খানায় গিয়ে সেই রাত্রেই তার গলা টিপে কাজ শেষ করে দিই। সঙ্গের লোকটাকে দেখতে পাই নাই। তাকে শেষ করতে পালে আমাদের আর কোন ভয় ছিল না।