কোথায় যাবেন?
ভায়াকে গ্রেপ্তার করতে।
আমিও যাব
নিশ্চয়। রিভলবারটা সঙ্গে নিন। বেটারা সহজ লোক নয়।
নৌকা করে যাবেন?
হাঁ, নৌকাতেই তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে জহরতের পিক পাওয়া দায় হবে। এখন কোথায় পুতে রেখেছে নিশ্চয়।
গোবিন্দ বাবু আর কাল বিলম্ব করিলেন না। আমরা প্রস্তুত হইয়া-শীঘ্রই কোতোয়ালীতে আসিলাম। মহম্মদ সাহেব আরও দুইজন ইনস্পেক্টরকে সঙ্গে লইলেন। কেহই রিভার লইতে ভুলিলেন না। চার জোড়া হাতকড়ীও লওয়া হইল। ছয়জন কনেষ্টবল দাড়ী ও একজন জমাদার মাঝি সাজিয়া চলিল।
মহম্মদ সাহেব নৌকা আগে হইতে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমরা সকলে সত্বর নৌকায় উঠিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিলাম। তীরবেগে নৌকা ছুটিল।
মিরপুরের নিকট আসিয়া গোবিন্দ বাবু নৌকা হইতে নামিলেন। আমাদের সকলকে তথায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি সেখান হইতে একাকী গেলেন।
কিন্তু তিনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, যা ভেবেছিলাম। তাই। বেটারা কেমন করে খবর পেয়ে বা সন্দেহ করে আধঘণ্টা আগেই নৌকা ছেড়ে এলাহাবাদের দিকে চলে গেছে। নৌকা এখনই খুলে দাও, খুব জোরে দাঁড় টান।
নৌকা তখনই খুলিয়া দেওয়া হইল। নৌকা আবার তীরবেগে দুটিল। ছয় দাড় আমাদের নৌকায় ছিল, সুতরাং তাহাদের নৌকা আমরা যে শীঘ্রই ধরিতে পারিব, সে বিষয়ে আমাদের সকলেরই বিশেষ ভরসা হইল।
তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল। আমরা রাত্রি আটটা পর্যন্ত চলিলাম, তবুও তাহাদের নৌকার কোন চিহ্ন দেখিলাম না। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কথা কহিবার কিছু ছিল না। সকলেই বোধ হয়, আমার মত উৎসুকচিত্তে মঙ্গলুর নৌকার প্রতীক্ষা করিতে ছিলেন। গোবিন্দ বাবু নদীর চারিদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে লাগিলেন।
মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার ত ভুল হয় নাই, গোবিন্দ বাবু?
গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে কেবল মাত্র বলিলেন, না। মহম্মদ। আমরা ত তাদের নৌকা ছেড়ে আসি নাই?
গোবিন্দ। না, সেদিকে চোখ রেখেছি।
মহম্মদ। তাদের দুই দাঁড়ের নৌকা, আর আমাদের ছয় দাড়ের নৌকা। আধ ঘন্টা আগে যদি তারা নৌকা ছেড়ে থাকে, তবে তাদের নৌকা এতক্ষণে আমাদের ধরা উচিত।
গোবিন্দ। তারা কি আর দুই চারটা দাড় বাড়াতে পারে না? সম্ভবমত তাই করেছে। বেশী পয়সা দিয়ে মিরপুর থেকে দুই তিনটা দাড়ী সংগ্রহ করেছে।
এই সময়ে আমরা সম্মুখে একখানা নৌকা দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ বাবু মহোল্লাসে বলিয়া উঠিলেন, খুব জোরে টান, ওই সেই নৌকা।
আমাদের নৌকা মহা বেগে ছুটিল।
******
আরও অর্ধঘণ্টা কাটিল। যদিও এখন সেই নৌকা আমাদের নৌকা হইতে বেশী দূরে ছিল না, তবু আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই নৌকাও খুব জোরে চলিতেছে।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন দারোগা সাহেব, নৌকায় চার দাড়।
মহম্মদ। সে নৌকা না হতেও পারে।
গোবিন্দ। এখনই দেখা যাবে। সাধারণ চড়নদারের নৌকায়
ক্রমে আমাদের নৌকা অগ্রবর্তী নৌকার আরও নিকটস্থ হইতে লাগিল। তখন আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই অগ্রবর্তী নৌকার মাঝি ভিতরের একজনকে কি বলিল। তখন সেই ব্যক্তি ছইয়ের বাহিরে আসিয়া আমাদের নৌকা দেখিতে লাগিল। আমরা তাহার আকৃতি বা চেহারা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম না।
গোবিন্দ বাবুর তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহাকে দেখিল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, এই যে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু।
বোধ হইল যেন, তাহার কথা সেই ব্যক্তির কানে গেল। আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম সে দাড়ীদের কি বলিল। আমরা দেখিলাম, তখন তাহারা প্রাণপণে দাড় টানিতে লাগিল।
তখন দুই নৌকায় প্রকৃতই বা আরম্ভ হইল। আমরা সকলে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রমাগত বলিতে লাগিলাম,জোরেজোরেজোরে। ছয় জন পাহারাওয়ালা, তাহাদের শরীরে যত বল ছিল, সমস্ত প্রয়োগ করিয়া প্রাণপণে দাঁড় টানিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, আর একটু বেশী জোর দিলে, দাড় ভাঙিয়া তাহারা উল্টাইয়া জলে গিয়া পড়িবে।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
আমাদের নৌকা ক্রমে সেই নৌকার আরও নিকটবর্তী হইল। বোধ হয়, আর এক শত হাত দূরেও নাই।
এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, রিভলবার, রিভলবার,-গুলি-গুলি কর।
আমরা কিছু না বুঝিয়াও সত্বর নিজ নিজ পকেট হইতে বিভ বার বাহির করিলাম। এই সময়ে ঝপ করিয়া কি একটা আমাদের নৌকার সম্মুখে জলে পড়িল।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন না, সেই আন্দামানী, মাঝির পিছনে দাড়িয়ে আমাদের দিকে তীর ছুড়ছে-ও সব বিষাক্ত তীর। ওতেই নরেন্দ্র বাবুর মৃত্যু হয়েছে। কাছে যাবার আগে আন্দামানীর হাত বন্ধ করতে না পারুলে, প্রাণ যাবে।
সৌভাগ্যের বিষয় নৌকা তখনও তত নিকটস্থ হয় নাই, নতুবা নিক্ষিপ্ত তীর নিশ্চয়ই আমাদের গায়ে লাগিত। এখনও দুই নৌকা পরস্পর হইতে যত দূর ছিল,তাহাতে আমাদের পিস্তলের গুলিও তাহার গায় লাগিবার সম্ভাবনা ছিল না।
আন্দামানীও তাহা বুঝিয়াছিল। সে তাহার তীর ধনুকে লাগাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই, আমাদের হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতেছিল।
ক্রমে নৌকা আরও নিকটস্থ হইল। সাঁ করিয়া একটা তীর আমাদের পাশ দিয়া চলিয়া গেল; আমরা একেবারে রিভলবার ছুড়িলাম। আমাদের রিভারের আওয়াজের সঙ্গে এক পৈশাচিক বিকট চীৎকারে যমুনার বক্ষ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।