বাসার পারে পদার্পণ করিয়াই তিনি ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?
সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর।
গোবিন্দ বাবু সত্বর ভিতরে প্রবিষ্ট হইয়া টেলিগ্রাম তুলিয়া লইলেন। একটি নয়, দুইটি টেলিগ্রাম। কিন্তু টেলিগ্রাম দুইটি খুলিয়া দেখিয়া তিনি চিন্তিত হইলেন; কোন কথা কহিলেন না। চিন্তিত মনে পথ চারণ করিতে লাগিলেন।
তিনি একেবারেই কোন কথা কহেন না দেখিয়া, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছু হয়েছে নাকি?
তিনি টেলিগ্রাম দুইটি আমার দিকে ফেলিয়া দিলেন। আমি তুলিয়া লইয়া পড়িলাম।
তিনি যে দুইখানি নৌকা দুইদিকে পাঠাইয়াছিলেন, সেই দুই নৌকার লোকে টেলিগ্রাফ করিতেছে যে, তারা যমুনার কোন স্থানে মজলুর নৌকার সন্ধান পায় নাই—কোন স্থানেই সে নৌকা নাই।
সহসা গোবিন্দ বাবুর মুখ ফুটিল,ওঃ,আমি কি গাধা! মঙ্গলু ভায়ার নৌকা কোন গতিকেই মথুরা বা এলাহাবাদ পার হয়ে যেতে পারে নাই, অথচ এলাহাবাদ থেকে মথুরার মধ্যে যমুনার কোনখানে মঙ্গলুর নৌকা নাই. আমার লোকের ভুল হতে পারে না, কারণ নৌকার মাঝিরা মঙ্গলুকে চেনে। তবে কি নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে এরা স্থলপথে পালিয়েছে। তা হতে পারে না, কারণ মঙ্গলু গরীর লোক, স্ত্রী পরিবার নিয়ে ঘর করে, সে এক-পেয়ের ভিতরের কথা কিছুই জানে না। সে তার জীবনের অবলম্বন নৌকা সহজে ডুবিয়ে দিতে রাজী হবে না। এক-পেয়েও মঙ্গলু মাঝির মত পণ্ডিতকে কখনই ভিতরের কথা বলবে না। তা হলে পুলিশের হাত এড়াবার জন্য দিন-কতক নৌকসুদ্ধ গা-ঢাকা দেবার পক্ষে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মশায় কি উপায় করতে পারেন? সহজ উপায় আছে। মঙ্গলু হলে আর দাড়ী দাড়ে, ভিতরে গোপনে বন্ধু নৌকাটা বাচাল করে দেবেন। হু হু করে নৌকায় জল উঠতে থাকবে। মঙ্গলু তাড়াতাড়ি নৌকা কিনারায় লাগাবে। মেরামত না কলে নৌকা আর চলে না। নৌকা ভীরে ভোলা হবে, মেরামত আরম্ভ হবে। অবশ্য এক-পেয়ে বন্ধু মঙ্গলুকে যথেষ্ট টাকা দেবেন। এই রকমে এক-পেয়ে কোন গ্রামে নৌকা সুদ্ধ দিন কত বাস করবেন। পুলিশ নদী রেল খুঁজে মরুক, কোথায়ও তাদের সন্ধান পাবে না। গোলমালটা কিছু থামলে, তখন এক-পেয়ে ভায়া নৌকা করে এলাহাবাদ বা আর কোনখানে মেলে উঠে অন্তর্হিত হবেন। কেমন, এই কি ঠিক নয়, ডাক্তার?।
এতক্ষণ গোবিন্দ বাবু যে কথা বলিতেছিলেন, তাহাতে, কে হইতেছিল যে, যেন তিনি নিজের মনেই চিন্তা করিতেছিলেন ; এক্ষণে সহসা তিনি আমাকে প্রশ্ন করায় আমি কি উত্তর দিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। একটু পরে বলিলাম, আপনি যে ভাবে বাদানুবাদ করে মীমাংসায় আছেন, তার উপর আমার কোন কথা নাই।
গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা হলে এটা সাব্যস্ত যে এক-পেয়ে ভায়া নৌকাসুদ্ধ তীরে কোন গ্রামে আছেন। নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত মনে আছেন; কারণ তিনি ভাবেন যে, সেখানে যে তিনি আছেন, তা কেহই সন্দেহ করবে না। তার সন্ধানে আমাকে স্বয়ংই যেতে হল, দেখছি। ডাক্তার, আপনাকে এখানে একা থাকতে হল; কারণ একজনের বাসায় থাকা দরকার। আমার নামে যদি কোন চিঠী কি টেলিগ্রাম আসে বা কেউ কোন কথা বলতে আসে, তবে যা ভাল বিবেচনা হয়করবেন। আমি এখনই রওনা হলেম।
আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া তিনি তখনই প্রস্থানের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। সামান্য কয়েকটি দ্রব্যাদি লইয়া তিনি পনের মিনিট যাইতে-না-যাইতে অন্তর্হিত হইলেন।
পরদিন তিনি ফিরিলেন না। তার পর আর একটা দিনও কাটিয়া গেল। আমাকে কোন পত্রাদিও লিখিলেন না। আমি তার কোন সন্ধানই পাইলাম না। . এই দুইদিন আমি প্রতিভার বাড়ী সকালে বৈকালে গিয়াছিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, তাহার নিকট সৰ্ব্বদা থাকিতেই আমার প্রাণ চায়।
তৃতীয় দিবসের দুই প্রহরের সময় আমি বাসায় বসিয়া নানা বিষয় নিজ মনে ভাবিতেছিলাম, এই সময়ে একজন কাবুলীওয়ালা কতক গুলা শীতবস্ত্র মাথায় করিয়া ঘরের ভিতর আসিয়া বলিল, বাবু সাহেব, কিছু কাপড়-চোপড় নিন।
আমি। না।
কাবুলী। খুব সস্তায় দিব। নগদ টাকা দিবেন না। মাসে মাসে কিছু দেবেন।
আমি। না বাপু, আমার দরকার নাই।
কাবুলী। একখানা নিন,–না হয় একবার দেখুন।
এই বলিয়া সে মাথার কাপড়গুলা ধপ, করিয়া সেখানে ফেলিল।
আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম, আমি লইব না,–তুমি কি আমাকে জোর করে দেবে। এখনই বেরিয়ে যাও, না হলে পুলিশ ডাকব।
সে হো হো করিয়া খুব হাসিয়া উঠিল। তাহার সেই বেয়াদবীতে আমার রাগ আরও বাড়িয়া উঠিল; দুই-এক ঘা দিবার উদ্যোগ করিতেছি,এমন সময়ে সে বলিল,ডাক্তার বাবু! আপনি যখন আমাকে চিতে পারেন নাই, তখন আর অপরের সাধ্য কি যে চেনে?
আমি বিস্ময়বিহ্বল হইলাম। একি, এ যে গোবিন্দ বাবু।
আমি বলিলাম, আপনি অদ্বিতীয় লোক। কার সাধ্য আপনার ছদ্মবেশ চেনে?
তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, আজ কাল গ্রামে গ্রামে বেড়াবার পক্ষে কাবুলী হওয়াই সুবিধা,–নয় কি?
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।
গোবিন্দ বাবু নিজ ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া স্থির হইয়া বসিলেন। এবং একটা সুদীর্ঘ চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিয়া বলিলেন,যা বলেছিলাম তাই। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধুটি মঙ্গলুর নৌকা বানচাল করেছেন, কাজেই নৌকা মেরামত করবার দরকার হয়। এলাহাবাদের দিকে এখান থেকে আট ক্রোশ দূরে, মীরপুর বলে একটা গ্রাম আছে। সেই খানেই নৌকা উঠিয়ে মেরামত আরম্ভ হয়েছে। নিশ্চয়ই মঙ্গলুকে অনেক টাকা দিয়ে রাজী করে রেখেছে। এ দিকে একটু গোলমাল থেমে গেলে আবার নৌকা জলে ভাসিয়ে ভায়া কোন ষ্টেশনে রেলে উঠে সরে পড়তে চান। তা বোধ হয় আর হচ্ছে না। এখন আপনি যতশীঘ্ৰ পারেন, প্রস্তুত হন।