প্রতিভা। আমি খুব খুশী হয়েছি, বরেন্দ্র বাবুকে বলবেন।
আমি। নিশ্চয়ই বলব।
প্রতিভা। সন্ধ্যার পর নিশ্চয় আসবেন।
আমি। নিশ্চয়ই আসব।
বাসায় আসিয়া দেখিলাম, গোবিন্দ বাবু ও বরেন্দ্র বাবু উভয়ে বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।
বলা বাহুল্য, আমি বরেন্দ্র বাবুর মুক্তিতে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিলাম। প্রতিভা যাহা বলিয়াছিল, তাহাও আমি বরেন্দ্র বাবুকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব। যেমন করে হয়, চোরাই জহরত আমাকে বার করতেই হবে। এতে আমার সর্বস্ব যায়, তাও পণ; বাবা যথেষ্ট রেখে গেছেন।
গোবিন্দ বাবু আমার সম্মুখে দুইখানা টেলিগ্রাম ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, দেখছেন, আমি তখন মথুরা আর এলাহাবাদ পুলিশকে কেন খবর দিয়েছিলেম। মঙ্গলুর নৌকা মথুরা বা এলাহাবাদ পার হতে পাবে না। পুলিশ খুব নজর রাখবে।
আমি। তার পর এখন কি কবেন?
গোবিন্দ। নৌকা মধুরার দিকে গেলে উজান ঠেলে যেতে হবে খুব দেরী হবে। তারা সম্ভবমত কাল রাত্রি এগারটার সময় নৌকায় উঠেছে। সকালের মধ্যে কখনই মথুরায় যেতে পারে না। যদি এলাহাবাদের দিকে গিয়ে থাকে, তা হলে ভাটার টান পাবে, খুব শীঘ্র যাবে। তা হলেও এলাহাবাদ পৌঁছিতে পারবে না। দুখানা নৌকা দুদিকে পাঠিয়েছি, তারা মধুর আর এলাহাবাদ গিয়ে টেলিগ্রাফ করবে। তা হলেই সব জানা যাবে।
আমি। আপনাকে দারোগা সন্ধ্যার সময় বাসায় থাকতে বলেছেন। তিনি দেখা করতে আসবেন।
গোবিন্দ। দেখলেন, ডাক্তার বাবু।
আমি। তাদের সাহেব তাকে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিয়েছেন।
গোবিন্দ। দিতেই হবে। এই সব পুলিশ-কর্তারা ব্যস্ত হয়ে আগে হতে একটা ধারণা করে সকল কাজ একবারে মাটা করে ফেলে। এখন একটু সেতার বাজান যাক্।
তাঁহার সুমিষ্ট সেতারে মন তন্ময় হয়। আমরা উভয়েই নীরবে বসিয়া শুনিতে লাগিল। সন্ধ্যার একটু পূৰ্বে গোবিন্দ বাবু সেতার বন্ধ করিলেন। বন্ধ করিয়া তামাক টানিতে আরম্ভ করিলেন। বরের বাবুও দুই-একটান তামাক টানিয়া উঠিয়া গেলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরেই দারোগা সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ সমাদরে বসাইলেন। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, এখন দেখছি, আপনার কথাই ঠিক।
গোবিন্দ। কাল ত হেসেই একেবারে উড়িয়ে দিলেন।
মহম্মদ। সেইজন্যই সময়ে সময়ে আমরা বোকা বনে যাই। সাহেব আপনার কথা শুনে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিলেন। তিনিও দেখা করতে আসবেন।
গোবিন্দ। কিছুই করতে হবে না। আসামী আমিই ধরে দেব।
মহম্মদ। বলেন কি? আপনি কি জানেন, সে কোথায় আছে?
গোবিন্দ। ঠিক জানি না, তবে শীঘ্রই জাতে পাব। আমি কাল, আপনাকে বলেছিলাম যে, আমি তার নাম পৰ্যন্ত জানি।
মহম্মদ। আপনি আশ্চৰ্য্য লোক। আমরা সকলেই আপনার কাছে মাথা নীচু করতে বাধ্য। তার নামটা কি?
গোবিন্দ। এক-পেয়ে আবদুল।
মহম্মদ। বলেন কি? আপনি অদ্ভুত লোক।
গোবিন্দ। আমি আপনাদের আসামী ধরে দিব; কিন্তু আপনাদের দু-একটা কাজ করা চাই।
মহম্মদ। বলুন, এখনই করব।
গোবিন্দ। বেশী কিছু নয়, আমি একখানা খুব ভাল নৌকা চাই, সঁড়ী-মাঝী আপনাদের বিশ্বাসী কনেষ্টবল হওয়া চাই। আর সেই নৌকা কোন রকমে কেউ যেন পুলিশের নৌকা বলে জানতে না পারে।
মহম্মদ। সে আর শক্ত কথা কি-কবে চাই?
গোবিন্দ। বোধ হয়, কালই চাই।
মহম্মদ। এখনই গিয়ে তার বন্দোবস্ত কছি।
গোবিন্দ। দুজন সুদক্ষ ইনস্পেক্টরকেও সঙ্গে চাই, সঙ্গে যেন রিভলভার থাকে। লোকটা সহজ নয়।
মহম্মদ। আমি নিজেই যাব, আর করিমবক্সকে সঙ্গে নেব।
গোবিন্দ। চারটে হাতকড়ী সঙ্গে নেবেন।
মহম্মদ। চার জন আসামী নাকি?
গোবিন্দ। এই রকম এখন বোধ করছি।
মহম্মদ। আপনি অদ্ভুত লোক,—নিশ্চয়ই অদ্ভুত লোক।
গোবিন্দ। এখন এই পর্যন্ত। আর কিছু দরকার হয় খবর দিব।
মহম্মদ। যখনই যা হুকুম করবেন, তাই তামিল হবে। আসামী ধরাই চাই।
গোবিন্দ। এখন কাকেও কিছু বলবেন না। আসামী ধরা পড়লে প্রশংসা আপনারই।
মহম্মদ। তা ত নিশ্চয়।
গোবিন্দ। প্রোমসনও হতে পারে।
মহম্মদ। সে আপনার মেহেরবানী।
মহম্মদ সাহেব অন্যান্য কথাবার্তার পর আমাদের সেলাম দানে একেবারে দাতাকর্ণ হইয়া বিদায় হইলেন। আমরাও প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম।
যদিও প্রতিভাকে ছাড়িয়া তখনই যাইতে আমার প্রাণ চাহিল না, কিন্তু গোবিন্দ বাবু আমাকে বিলম্ব করিতেও দিলেন না। বরেন্দ্র বাবু আমাদিগকে তাহার বাসা-বাড়ীতে রাত্রে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন; আমরা তাঁহার বাসা-বাড়ীর দিকে চলিলাম।
বলা বাহুল্য,বরেন্দ্র বাবু আহারের বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার বাড়ী হইতে ফিরিতে আমাদের অনেক রাত্রি হইল। বাসায় আসিয়া গোবিন্দ বাবু ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?
সে উত্তর করিল, না।
গোবিন্দ বাবু কোন কথা কহিলেন না। আমি শয়ন করিতে গেলাম।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
পরদিবস প্রাতে আমি ও গোবিন্দ বাবু মঙ্গলুর সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু জানিলাম, সে এখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, প্রতিভার সহিত দেখা করিয়া আসি, কিন্তু গোবিন্দ বাবু দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। মুখ ফুটিয়া কোন কথা বলিতে পারিলাম না।