এই বলিয়া তিনি সত্বর চলিলেন। মাঝি চীৎকার করিয়া আমাদের পশ্চাৎ হইতে বলিল, কত দেবেন বলুন না।
গোবিন্দ বাবু সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সত্বর পদে সহরের দিকে চলিলেন। কিয়দ্দর আসিয়া বলিলেন, রেলে গেলে পাছে কেউ সন্দেহ করে বলে এক-পেয়ে মহাশয় বুদ্ধি খাটিয়ে নৌকায় গেছেন?
আমি। বোধ হয়, দূরে গিয়ে কোন ষ্টেশনে রেলে উঠবে, না?
গোবিন্দ। শীঘ্র না। দিন কত কোথায়ও লুকিয়ে থাকবে। জানে খুন আর চুরির জন্য একটা মস্ত হৈ-চৈ পড়ে গেছে। পুলিশ চারিদিকে টেলিগ্রাফ করেছে।
আমি। এখন আপনি কি করবেন?
গোবিন্দ। চলুন বাসায় যাই। একটু ঘুমাতে হবে। সমস্ত রাত্রিটা নিদ্ৰা নাই।
গোবিন্দ বাবু বাসায় আসিবার পথে তার আফিসে গিয়া দুইটা টেলিগ্রাফ করিলেন। একথানা এলাহাবাদে, আর একখানা মথুরায়। আমি এতই ক্লান্ত হইয়াছিলাম যে, বাসায় আসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িলাম।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।
নিদ্রার পর আমি অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইলাম। উঠিয়া দেখি, গোবিন্দ বাবু চুরুট টানিতে টানিতে এক মনে কাগজ-পত্র দেখিতেছেন। তখন অনেক বেলা হইয়াছিল, আমরা উভয়ে স্নানাহার করিলাম। গোবিন্দ বাবু এত অন্যমনস্ক ছিলেন যে, তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমার সাহস হইল না।
সহসা তিনি বলিলেন, আমাদের একটা বড় অন্যায় কাজ হয়েছে।
আমি বলিলাম, কি?
গোবিন্দ। কি? প্রতিভা ভাবিত রয়েছে। তাকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল। আপনি এখনই যান।
আমি। আমি!
গোবিন্দ। হাঁ গো মশায়, আমার অন্য কাজ আছে।
আমি। তাকে কি বল?
গোবিন্দ। আশ্চর্য! যা-যা ঘটেছে, সব তাকে খুলে বলবেন?
আমি। এখনই যাব? গোবিন্দ।
আমি তৎক্ষণাৎ প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। সে নিতা উদগ্রীব হইয়াছিল। আমাকে দূর হইতে দেখিয়া প্রতি সত্বর বাহিরে আসিল। আমাকে সাদরে একটা ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল। সলজ্জভাবে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কোন কথা বলিল না।
আমি বলিলাম, কাল যা-যা ঘটেছে, তাই আপনাকে বলবার জন্য গোবিন্দ বাবু আমাকে পাঠিয়েছেন?
তৎপরে আমি সমস্ত তাহাকে বলিলাম। প্রতিভা বরেন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইল। বলিল, আপনারা তাকে খালাস কার জন্য বিশেষ চেষ্টা করবেন। তিনি ত সে সময়ে বাড়ী ছিলেন না।
অবশ্যই গোবিন্দ বাবু এ বিষয়ে বিশেষ চেষ্টা করবেন?
এ লোকটা কবে ধরা পড়বে?
তা ঠিক কেমন করে বল্ব? তবে গোবিন্দ বাবু যেরূপ ক্ষমতাপন্ন লোক, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই ধরা পড়বে।
সে ধরা পড়ক-না-পড়,ক, যা হয় হক, কিন্তু বরেন্দ্র বাবুকে আজই খালাস কবেন। নিশ্চয়ই তার ভারি কষ্ট হচ্ছে।
গোবিন্দ বাবু সে বিষয়ে খুব চেষ্টিত আছেন।
আপনি এখন যান, তাঁকে বিশেষ করে বলুন।
আমি আপনার নাম করে তাকে বলব।
আমি উঠিলাম। প্রতিভা বলিল,আপনি আবার কখন আসবেন?
আমি বড় ব্যস্ত হয়ে থাকব।
কত দুর কি হয়, রাত্রে এসে খবর দিব।
আমার জন্য আপনাদের ভারি কষ্ট হচ্ছে।
কিছুই নয়। আপনার জন্য আমাদের কোন কষ্ট হবার সম্ভাবনা কোথায়?
প্রতিভা কোন উত্তর করিল না দেখিয়া, আমি গমনোদ্যত ভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। আমাকে গমনোদ্যত দেখিয়া প্রতিভা বলিল, কখন আসবেন?
আমি বলিলাম, যত শীঘ্র পারি আসব।
আমি বাহিরে আসিল্প ভাবিলাম, একবার কোতোয়ালীতে খবরটা নিয়ে যাওয়া ভাল। এইরূপ মনে করিয়া আমি থানায় আসিয়া
ইনস্পেক্টর মহম্মদ তোগীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সাদরে বসাইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই গোবিন্দ বাবু আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?
আমি। না, এদিকে এসেছিলাম, তাই একবার খবর নিয়ে যাব মনে করলেম।
মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুই হয় ত ঠিক।
আমি। কি রকম।
মহম্মদ। আমরা বরেন্দ্র বাবুকে ছেড়ে দিয়েছি।
শুনিয়া আমার প্রাণে বড় যথার্থই আনন্দ হইল। আমি সাগ্রহে বলিলাম, কেন?
মহম্মদ। তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই। খুনের রাত্রে তিনি সে বাড়ীতে ছিলেন না। এমন কি,অনেক দিন হতেই তিনি সেই বাড়ীতে আন নাই। সে রাত্রে তিনি প্রথম আপনাদের সঙ্গে ঐ বাড়ী যান, গিয়ে ভাইকে মৃতাবস্থায় দেখতে পান। এ সব বেশ ভাল রকম সপ্রমাণ হয়েছে,-সুতরাং সুপারিন্টেডেন্ট সাহেব এই সব সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি। তিনি যে খুন করেন নাই, তা নিশ্চয়।
মহম্মদ। আমরা নিশ্চিন্ত নই। যিনি খুন হয়েছেন, তার বাড়ীর গত চাকর-বাকরকে ধরে এনেছি। দেখা যাক, তারা কি বলে। তার পর সমস্ত রেল-ষ্টেশনে, আর থানায় থানায়, জেলায় জেলায়, টেলিগ্রাফ করেছি; সুতরাং যিনিই খুন করুন, তাঁকে শীঘ্রই ধরা পড়তে হবে।
আমি। আপনারা যখন আছেন, তখন সে নিশ্চয়ই ধরা পড়বে। মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুকে বলবেন; আজই সন্ধ্যার সময় তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করব; যেন তিনি বাসায় থাকেন। সাহেব তার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম করেছেন।
আমি উঠিলাম। পথে আসিয়া ভাবিলাম, প্রতিভাকে বরে বাবুর কথা বলে যাওয়া উচিত। আমি আবার প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম। প্রতিভা আমাকে এত শীঘ্র ফিরিতে দেখিয়া ব্যক্তভাবে বাহিরে আসিল। আমি বলিলাম ব্যস্ত হয়ো না। বরেন্দ্র বাবুকে নির্দোষী জেনে পুলিশে তাকে ছেড়ে দিয়েছে, তাই জেনে আবার এখানে বন্দুতে এলেম।
প্রতিভা বলিল, আমরা ত জানতেম যে, তিনি নির্দোষী।
আমি। এখন চললেম, সন্ধ্যার পর এসে কি হয় বলে যাব।