গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, আপনাকে তাহা হইলে টাকা হারিতে হয়। এ প্রবন্ধ আমিই লিখেছি।
আমি একটু অপ্রস্তুত হইলাম। আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, আপনি লিখেছেন?
গোবিন্দরাম। গোবিন্দ। হাঁ, আমিই লিখেছি। ছেলে বেলা থেকে দেখে শুনে চেষ্টা-চরিত্র করে কিছু শিখেছি। এ বিষয়ে আমার একটু ঝোঁক আছে। আপনি যা বছেন, একেবারেই হয় না,অসম্ভব,-আমি বলি, অসম্ভব নয়, খুব সম্ভব। চেষ্টা করিলে সকলেই পারে। শুধু বলা নয়, প্রকৃত পক্ষে এই বিদ্যার উপর আমার গ্রাসাচ্ছাদন নির্ভর করছে।
আমি। কি রকম?
গোবিন্দ। আমার নিজের একটা ব্যবসা আছে। আপনি ডাক্তার, কন্সালটিং ডাক্তার কাকে বলে, তাতে নিশ্চয়ই জানেন।
আমি। হাঁ, বড় ডাক্তার। কঠিন পীড়া হলে ছোট ডাক্তারেরা যার পরামর্শ নিয়ে থাকে।
গোবিন্দ। সেই রকম আমি একজন কন্সালটিং ডিটেকটিভ। যখন সরকারী বেসরকারী ডিটেটিভেরা কোন বিষয় স্থির করতে পারেন না, বা কোন খুন জাল জুয়াচুরির কিনারা করতে পারেন না, তখন তারা আমার পরামর্শ আবশ্যক মনে করেন। আমি তাদের ঠিক পথ বলে দি, তাঁরা সেই পথ ধরে ঠিক রহস্যভেদ করতে পারেন। আমিও আমার ফি পাই।
আমি। আপনি কি বলতে চান যে আপনি ঘরে বসে কিছু না দেখে, কেবল শুনে ঠিক পথ বলে দিতে পারেন? ভাল ভাল ডিটেটিভেরা যা পারে না, আপনি ঘরে বসে তাহাই পারেন?
গোবিন্দ। হাঁ, এ বিদ্যা আমি অনেক পরিশ্রমে শিক্ষা করেছি। ইহাই আমরা ব্যবসা। তবে সব সময়েই যে ঘরে বসে পরামর্শ দিই, তা নয়। যদিও আমি পুলিশে কাজ করি না, তবুও লোকে আমাকে গোবিন্দ দারোগা বলে। ভারতবর্ষের সকল স্থানের বড় বড় ডিটেকটিভ আমার পরামর্শ নিতে আসেন। নানাস্থান আমাকে দেখতে হয়। এই দেখুন না, এখন লাহোরে; আবার এক সময় হয়ত দেখবেন বিহারে বিরাজমান।
আমি সে কথার কোন উত্তর করিলাম না, দেখিয়া তিনি বলিলেন, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হয় না। আপনার সঙ্গে আমার যে দিন প্রথম দেখা হয়, সেদিন আমি আপনাকে দেখবামাত্র বলেছিলাম,
কাবুল হতে কবে এলেন, স্মরণ আছে?
আমি। আছে।
গোবিন্দ। কেমন করে বলে?
আমি। নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে আগে বলেছিল।
গোবিন্দ। না, তা নয়। শুনলেম আপনি ডাক্তার। দেখলাম, আপনার পরা খাকি,পায়ে আমোনিসন বুট,শরীরের জীর্ণাবস্থা, কাজেই তখনি বুঝ লেম যে, আপনি নিশ্চয়ই কাবুলের যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ছুটী নিয়ে ফিরেছেন।
আমি। বুঝিয়ে দিলে খুব সহজ, সন্দেহ নাই। আপনার কথায় বিখ্যাত ফরাসী গোয়েন্দা লিকোর কথা, আমার মনে পড়ল।
গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, লিকো খুব উদ্যমশীল গোয়েন্দা বটে, তবে বৈজ্ঞানিক নয়, লিকো যা ছ মাসে কতো আমি তা একদিনে করি।
আমি গোবিন্দ বাবুর কথায় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলাম। ভাবিলাম, লোকটা ভারি অহঙ্কারী। আর কিছু না বলিয়া আমি জানালা দিয়া। মুখ বাহির করিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, একটা লোক যেন কোন বাড়ী খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। বলিলাম, রাস্তায় একটা লোক কার বাড়ী খুঁজে বেড়াচ্ছে।
গোবিন্দবাবু সেইদিকে চাহিয়া বলিলেন, কে, ঐ লোকটা? পল্টনের পেন্সনী সুবেদার দেখছি, এখন পুলিসের জমাদারী কছে।
আমি মনে মনে বলিলাম, আমাকে বাহাদুরী দেখান হচ্ছে। নিশ্চয়ই একে চেনেন। আর না চিলেও জানেন যে, উনি যা বলবেন, আমি তাই বিশ্বাস করব।
এই সময়ে সেই লোক আমাদের বাসায় প্রবেশ করিল। আমরা উভয়ে অগ্রবর্তী হইলাম। সে বলিল, আমি গোবিন্দ দারোগা সাহেবকে খুঁজছি। এই কি তার বাসা?
গোবিন্দ। আমিই গোবিন্দ দারোগা। কি চাও বাপু?
সে সেলাম দিয়া বলিল, ডিটেকটিভ-ইনেস্পেক্টর সূরযমল সাহেব এই পত্র দিয়েছেন।
গোবিন্দ বাবু পত্ৰ লইয়া খুলিলেন। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি কাজ কর?
সে বলিল, আগে পল্টনে সুবাদারী করতেন, এখন পেন্সন নিয়ে পুলিসে জমাদারী কচ্ছি।
পত্রের কোন উত্তর নাই, শুনিয়া সে সেলাম দিয়া চলিয়া গেল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
গোবিন্দ বাবু পত্র পাঠ করিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি মনে করেন এই লোকটাকে আমি আগে চিনতেম, তা নয়। আমি কোন জন্মে ওকে আগে দেখি নাই।
আমি বলিলাম, তবে কি করে জানলেন যে, ও আগে পল্টনে ছিল, এখন পুলিসে আছে?
গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, অতি সহজে জানা যায়। আপনি যদি এ বিদ্যা শিক্ষার চেষ্টা করতেন, তা হলে আপনিও সহজে বলতে পাতেন। আমি দেখলেম, লোকটার বুকে একখানা মেডেল ঝুলছে, চলন সাধারণ সিপাইয়ের মত নয়, আফিসারের ধাঁজা; সুতরাং বুঝলেম, লোকটা পল্টনে সুবাদার ছিল। তার পর দেখলেম, বয়স হয়েছে; যদিও পুলিশের পোষাক পরা নেই, তবে মাথায় জমাদারের পাগণ্ডী রয়েছে, কাজেই তখনই বুঝলেম যে, লোকটা পেন নিয়ে এখন পুলিশের জমাদারী করছে। দেখলেন, সব বিষয়ে দৃষ্টি থাকলে কত শীঘ্র কত বিষয় জানা যায়।
আমি বলিলাম, যথার্থই আশ্চর্যজনক,সন্দেহ নাই। তিনি সেই পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।
আমি পড়িলাম; প্রিয় গোবিন্দ বাবু!
কাল রাত্রে সেটী-মহল্লায় একটা ভয়ানক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। গোলযোগ বলিয়া বোধ হইতেছে। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় বিটের কনেষ্টবল একটা খালি বাড়ীর ভিতর একটা আলো অলিতেছে,দেখিতে পায়। সে গিয়া দেখে সদর দরজা খোলা; ভিতরে গিয়ে দেখে যে, সম্মুখের ঘরের মেয়ে একটি ভদ্রলোকের মৃতদেহ পড়িয়া আছে। খবর পাইয়াই আমরা গিয়ে উপস্থিত হই। পোষাক-পরিচ্ছদে দেখি লাম, লোকটা মারাঠী, ঘর রক্তময়, অথচ মৃতদেহের কোনখানে আঘাতের চিহ্নমাত্র নাই। পকেটে পঁয়তাল্লিশটা টাকা আর দুখানা চিঠী ছিল। ঠিকানায় লেখা শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর, আর একখানিতে বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর। চিঠী একখানা খোলা, একখানা বন্ধ। আমরা যেখানকার যা সেই রকমই রেখেছি; আপনি যদি একবার অনুগ্রহ করিয়া আসেন, তবে বড়ই উপকৃত হই। আপনার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। ইতি।
বশংবদ
শ্ৰীসূরযমল।